সুশান্ত দাস ১ গ্রামের পুকুরটি সবসময়ই একটি রহস্যময় উপস্থিতি বয়ে আনে। দিনের আলোয় যখন গ্রামের মানুষ সাধারণ কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে, তখনও পুকুরটি যেন নীরবভাবে তাদের নজর কাড়ে। পুকুরটির পানি গভীর এবং অন্ধকারের মিশ্রণে যেন অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে দেয়। পুকুরের চারপাশে হালকা ঘাস আর কিছু ছোট গাছ থাকলেও, রাতে সেই ঘাস আর গাছের ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষ নানা গল্প শোনায়—কিছু গল্প কেবল ভয়ের, আবার কিছু গল্পে বলা হয় বহু বছর আগে এখানে একটি মেয়ের রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছিল। সেই মেয়েটিকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। লোকেদের কথা অনুযায়ী, মেয়েটির আত্মা এখনও পুকুরের পানির মধ্যে ভেসে বেড়ায়।…
-
-
অধ্যায় ১ : পুরনো ডাকঘর অরিন্দম চক্রবর্তী শহুরে মানুষ। কলকাতার ভিড় আর ব্যস্ততার ভেতর বহু বছর চাকরি করে হঠাৎই একদিন ট্রান্সফারের চিঠি এসে যায় তার হাতে—পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে তাকে বদলি করা হয়েছে নতুন পোস্টমাস্টার হিসেবে। প্রথমে একটু মন খারাপ হয়েছিল, কেননা শহরের আরাম, বন্ধুদের আড্ডা, সিনেমা হল বা বইয়ের দোকান সব কিছুই ছেড়ে আসতে হবে। তবু ভেতরে ভেতরে কৌতূহলও ছিল, গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নেওয়া যাবে, আর নতুন জায়গার নতুন অভিজ্ঞতাও তো একরকম রোমাঞ্চ। ট্রেন থেকে নামতেই গ্রামের ছবিটা তার চোখে ধরা দেয়—চওড়া কাঁচা রাস্তা, দুই পাশে ধানক্ষেত, হাওয়ায় ভেসে আসা খড়ের গন্ধ, আর দূরে সাদা মন্দিরের শিখর। এমন সরল…
-
সায়ন দত্ত অয়ন ছোটবেলা থেকেই ভূতের গল্পের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করত। অন্ধকার ঘর, কাঁপতে থাকা মোমবাতি আর দাদুর মুখে শোনা অলীক কাহিনিই যেন তার ভিতরে কৌতূহলের বীজ বুনে দিয়েছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কৌতূহল রূপ নিল এক নতুন রূপে—একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরের উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। তার ইউটিউব চ্যানেল “ভুতের সত্যি কাহিনি” খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, কিন্তু অয়ন জানে শুধু সাধারণ গল্প দিয়ে আর কাজ হবে না। দর্শকরা চাইছে কিছু ব্যতিক্রম, কিছু ভয়ঙ্কর অথচ বাস্তব মনে হয় এমন অভিজ্ঞতা। দিনরাত সে ল্যাপটপের পর্দায় বসে খুঁজতে থাকে কোথায় কী রহস্যময় জায়গা আছে, কারা সত্যিই ভুত দেখেছে, অথবা কোন অন্ধকার ইতিহাস…
-
অজয় মাহাতো ১ পুরুলিয়ার জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতেই পর্যটক দলের মধ্যে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা তৈরি হয়। পাকা রাস্তার সীমারেখা শেষ হতেই পথটি ঢেউ খেলানো মাটির ও শিকড়ে ভরা হয়ে ওঠে, চারপাশে গাছেদের সোনালি রোদ আর গাঢ় ছায়ার খেলা যেন এক আলাদা জগৎ খুলে দিচ্ছিল। দলের সকলের চোখে এক সঙ্গে আগ্রহ এবং অজানা ভয়ের মিশ্রণ—কারণ তারা জানত, এই জঙ্গলের মাঝখানে ব্রিটিশ আমলের এক ডাকবাংলো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ করেই দেখতে পাওয়া যায় এক ধুলোমাখা, দু’তলার ভবন, যার খণ্ডিত জানালা আর দারুণভাবে কেটে ফেলা দরজা অতীতের কাহিনী কল্পনার আঙিনায় উদ্ভাসিত করছিল। ছায়াময় বাতাসে দূর থেকে ঘোড়ার টগবগ আওয়াজ…
-
মৈনাক ভৌমিক ১ পুরুলিয়ার চন্দনবন — নামটি আজও অনেকের কাছে অজানা, যদিও লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা বহু গল্পের কেন্দ্রবিন্দু এই অরণ্য। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলটি আদিবাসী জনপদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলে ভরপুর, যেখানে আজও সূর্যাস্তের পর কেউ একা পথ মাড়ায় না। অথচ সেখানেই, এক শতাব্দী পুরনো ব্রিটিশ জরিপ মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া এক দাগচিহ্ন—“K.T. Akhra (Abandoned)”—ডঃ ঋত্বিক বসুর চোখে পড়ে। বহুদিন ধরে প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রচর্চা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসা এই প্রত্নতত্ত্ববিদ তার টিম নিয়ে রওনা দেন চন্দনবনের উদ্দেশ্যে। তাঁর দলের সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের গবেষক ইরা সেনগুপ্ত, ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর অভীক মণ্ডল, তথ্যলিপিকার তৃষা দে এবং স্থানীয় গাইড হিসেবে নিযুক্ত হন নিতাই মাহাতো,…
-
সুদীপ্তা কর ১ সরকার পরিবার বহু পুরোনো। শহরতলির শেষপ্রান্তে, ক্যানেলের ধারে মোটা পাঁচিলে ঘেরা প্রাসাদসদৃশ এক বাড়ি—যার কাঠের দরজার ওপর এখনও খোদাই করে লেখা আছে ‘সরকার ভিলা, ১৯২৩’। প্রবোধ সরকার এখানে জন্মেছিলেন, তাঁর বাবা-মারও জন্ম এই বাড়িতেই। সময় বদলেছে, কিন্তু বাড়ির চালচিত্র, লোহার রেলিং, কাঠের মেঝে—সবই থেকে গেছে ঠিক তেমনি। বিয়ের দিনটা ছিল মাঘের মাঝামাঝি—হালকা শীত, শিউলির শেষ গন্ধ, আর বাড়ি ভরা আলো। বিয়ের কোলাহলের মধ্যে শ্রেয়া এসে পা রাখল এই পুরনো সংসারে, লাল বেনারসীতে ঢাকা মুখে একরাশ লাজ লুকিয়ে। মীনাক্ষী দেবী, নতুন বৌমাকে দেখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি অনুভব করলেন—মেয়েটা যেন একদম শান্ত, পরিণত, গম্ভীর। সে কম কথা বলে, হাসে…
-
তন্ময় লাহিড়ী নবান্নের আগে বর্ষা থেমে গিয়েছিল, কিন্তু গ্রামের কাঁচা রাস্তা এখনও স্যাঁতসেঁতে। হালকা কুয়াশায় মোড়া মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে সাব্যসাচী রায় তাকিয়ে ছিল ভগ্ন জমিদারবাড়িটার দিকে। ক’টা জানালার কাঁচ নেই, ছাদে আগাছার রাজত্ব, আর দেয়ালগুলোয় গাঢ় সবুজ শ্যাওলা লেপে আছে—তবু, সেই কুঠির যেন সময়ের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে এক অমোচনীয় অভিযোগ নিয়ে। শহর কলকাতার জীবন থেকে দূরে, বহু বছর পর সে আবার ফিরে এসেছে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেয়—কিন্তু এভাবে? কুড়িয়ে পাওয়া এক পুরনো চিঠির টানে, যেখানে লেখা ছিল—“কুঠির জেগে উঠেছে, সাব্যসাচী, ফিরে আয়।” পাঠিয়েছিলেন ভবানী দাসী, যিনি তার ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে কাজ করতেন, এখন একা থাকেন গ্রামের উপান্তে। সাব্যসাচীর মধ্যে একটা অদ্ভুত টান…
-
অধ্যায় ১: চিঠির মতো নিঃশব্দ পাহাড়ে ওঠার পথে হঠাৎ করে কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ট্রেকিং পাথ বেয়ে যে ঘোড়ামারা ডাকে ওঠা গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল অভিজিৎ সরকার, তার চারপাশে যেন হঠাৎই সময় থমকে গেল। বালির কাঁধে বয়ে আনা ছোট স্যুটকেস, একটা জলচৌকো ব্যাগ আর হাতে ধরা সরকারি ফাইলের খাম—সবই ভার হয়ে উঠল যেন হঠাৎ। এই ডাকঘরটা, পুরুলিয়ার এক পাহাড়ি অঞ্চলের প্রান্তে অবস্থিত, বহু বছর আগেই তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে রেকর্ডে লেখা ছিল। কিন্তু হেড অফিস থেকে অদ্ভুত এক চিঠির সূত্র ধরে, তাকে বদলি করা হল এই ‘বন্ধ’ ডাকঘরে। সে ভেবেছিল হয়তো কোনো ফাইলের গরমিল, অথবা ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু বদলিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন…
-
দেবযানী ভট্টাচার্য এক বীরভূমের প্রত্যন্ত এক গ্রামে অবস্থিত অরুণপুকুর—চারপাশে শাল, মহুয়া, আর শিমুল গাছে ঘেরা এক নিঝুম জলাশয়, যেটিকে ঘিরে রয়েছে শত গল্প, শত কানাঘুষো। দিনের বেলায় সেটি যেন নিরীহ; গ্রামের মহিলারা সেখানে জল তোলে, শিশুরা খেলে। কিন্তু সূর্য ঢলে যাওয়ার পর সেই পুকুরের ঘাট কেমন যেন থমকে যায়। পাখিরা উড়ে যায় অন্য দিকে, কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও কিছুক্ষণ পরেই চুপ করে যায়। গ্রামের মানুষ বলে—“ওই সময় কেউ যেও না ঘাটের দিকে, মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে জলে।” এই গল্পে সৌরভ মুখোপাধ্যায়, গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র, আদৌ বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞান, লজিক, নিউরোলজি, আর ইউটিউব ডকুমেন্টারির উপর দাঁড়ানো তার যুক্তিনির্ভর…
-
ঐশী মুখার্জী পর্ব ১: আগমন রাত্রি নামে ধীরে ধীরে, যেমন করে কোনও চেনা মুখে অচেনা ছায়া নেমে আসে। নবগ্রাম যেন শহরের এক ভুলে যাওয়া বাঁক—আলপথে মোড়া, কুয়াশার ভিতর ঢাকা, আর কোনো এক অসমাপ্ত অভিশাপের ভিতর আটকে থাকা একটি গ্রাম। এখানেই থামল ছ’জন তরুণ নাট্যদলের সদস্য—সাগ্নিক, শ্রেয়সী, ঋদ্ধি, অয়ন, তুরীণ আর জয়িতা। তারা এসেছে একটা নাটকের রিহার্সাল করতে, যার জন্য দরকার ছিল এক নির্জন জায়গা, দূরে শহরের কোলাহল থেকে। এই ‘রাতবাড়ি’র কথা জানিয়ে দিয়েছিল তুরীণের মামা, যিনি স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাড়ির নাম শুনেই একটা কাঁটার মতো কিছু গাঁথা ছিল সাগ্নিকের মনে—“রাতবাড়ি”—মানে কি? রাত হলে বাড়ি জেগে ওঠে, না কি…