অপূর্ব ঘোষ অধ্যায় ১ – আগমন ভুবনেশ্বরের কোলাহল পেরিয়ে যখন গাড়ির চাকা ধুলো উড়িয়ে হিরাপুর গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় ঢুকল, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, যাদের চোখে স্পষ্ট কৌতূহল ও উত্তেজনা, গাড়ি থেকে নেমে এল ধীরে ধীরে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর অনিরুদ্ধ মুখার্জি, প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য ও তান্ত্রিক মন্দির নিয়ে খ্যাত এক গবেষক। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী প্রফেসর সঞ্জনা সেন, যিনি সম্প্রতি পুরাণ ও লোকবিশ্বাস নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও ছিলেন দুই তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ—অভিজিৎ ও রোহন—যাদের উচ্ছ্বাস প্রায় বালকসুলভ। তারা এসেছেন বিখ্যাত চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের রহস্য অনুধাবন করতে, যেটি শুধু শিল্পকলার নয়, আধ্যাত্মিক ও গুপ্ততান্ত্রিক…
- 
				
 - 
				
অরিত্র সেনগুপ্ত প্রথম পর্ব: ভাঙা মন্দিরের ছায়া কলকাতার গরম দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো গ্রন্থাগারে বসে ঋদ্ধি মুখোপাধ্যায় ধুলোমাখা এক দলিল উল্টেপাল্টে দেখছিল। দলিলটা এসেছে এক ব্রিটিশ কালেক্টরের আর্কাইভ থেকে—মলিন, ফ্যাকাশে কাগজে অদ্ভুত সব আঁকিবুঁকি। প্রথমে ওগুলো অর্থহীন দাগ মনে হলেও, চোখ অভ্যস্ত হতে না হতেই ঋদ্ধি দেখল ম্লান লাল কালি দিয়ে আঁকা একটা মানচিত্র। নদী, গাছপালা, আর মাঝখানে লেখা কয়েকটি সংস্কৃত শব্দ—“যত সূর্যের ছায়া, তত রাজাধন।” ঋদ্ধির বুকের ভেতর ঝড় উঠল। এ শুধু কোনো দলিল নয়—এ যেন ইতিহাসের অমূল্য দরজা খুলে দেওয়ার চাবি। কর্ণসুবর্ণ—গৌড়ের সেই প্রাচীন রাজধানী যেখানে শশাঙ্কদেব একসময় রাজত্ব করেছিলেন, সেখানকার ধনের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে মানচিত্রে। ঠিক তখনই গ্রন্থাগারের…
 - 
				
সন্দীপ সেনগুপ্ত হুগলির বিস্তীর্ণ গ্রামীণ প্রান্তরে, নদীর ধারে শ্যাওলায় ঢাকা ইটের প্রাচীর আর ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো গড়। সময়ের ক্ষয়ে ক্ষয়ে এর অনেকটা ভেঙে পড়েছে, অনেকটা মাটির নিচে চাপা পড়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো অদ্ভুত নিদর্শন, অথচ স্থানীয়রা একে ভয়ে এড়িয়ে চলে। দীর্ঘদিন ধরে শোনা যায়, গড়ের ভেতরে রাত নামলে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—কখনো তলোয়ারের ঝনঝনানি, কখনো পদশব্দ, আবার কখনো গভীর নিশ্বাসের আওয়াজ। ফলে গ্রামবাসীর চোখে এ জায়গা “অভিশপ্ত” বলেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই ভয়ের মধ্যেও সরকার ঠিক করে, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জায়গাটি খনন করা দরকার। হয়তো গড়ের ভেতর থেকে মিলবে বাংলার ইতিহাসের…
 - 
				
প্রাচীন মন্দির খননের সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ ভোরের কুয়াশার মধ্য দিয়ে মাটির ওপরে পড়ে। অধ্যাপক সৌম্য সেনগুপ্ত, যিনি দেশের এক নামকরা প্রত্নতত্ত্ববিদ, একাগ্রভাবে খননক্ষেত্রের দিকে এগোচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অরণ্য দত্ত, যিনি সৌম্যের পাশে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার কাজ করতেন। মাটির স্তর একের পর এক সরানো হচ্ছিল, আর ধুলোমাখা খণ্ডকোণ থেকে প্রাচীন কালকার নানা নিদর্শন উঠে আসছিল। হঠাৎ অরণ্য একটি অস্বাভাবিক আকৃতির বস্তু অনুভব করলেন। তার হাতের মুঠোয় ধরা পড়ল এক অলঙ্কৃত শঙ্খ, যার গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো যেন কেবল সময়ের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। শঙ্খের উপর ক্ষীণ লালচে দাগ, যা প্রথমে কেবল মাটির দাগ মনে হলেও, যখন সূর্যের আলোতে…
 - 
				
পুলক বিশ্বাস নীলয় সেনের জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের স্তর থেকে, কিন্তু এবার তার গবেষণার পথ তাকে নিয়ে এল বাস্তবের ভেতরে জমে থাকা সময়ের ধুলোয় ঢাকা রহস্যে। কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে দীর্ঘ ভ্রমণের পর যখন মুর্শিদাবাদের মাটিতে পা রাখল, তার চোখের সামনে খুলে গেল এক অচেনা অথচ পরিচিত ইতিহাসের দরজা। রেলস্টেশনের পুরনো কাঠের বেঞ্চ, দেওয়ালে ঝুলে থাকা ম্লান বিজ্ঞাপন, আর মানুষের চেনা-অচেনা মুখগুলোর ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে যেন অনুভব করছিল—এই শহর কেবল ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি এক অদৃশ্য সময়ের ভাণ্ডার, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি পথ, প্রতিটি গাছ লুকিয়ে রেখেছে গল্প। মুর্শিদাবাদকে বলা হয় বাংলার মুঘল রাজধানীর উত্তরসূরি,…
 - 
				
মৈনাক সেন ডঃ নীরব মুখার্জীর জীবনে আজকের দিনটি অন্যরকম একটি দিনের মতো মনে হচ্ছিল। প্রত্নতত্ত্বের প্রতি তার আগ্রহ এবং অতীতের অজানা ইতিহাসকে উদঘাটনের তৃষ্ণা তাকে প্রাচীন রাজবাড়ির দিকে নিয়ে এসেছিল। বর্ধমান জেলার কোলাহলপূর্ণ শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এই রাজবাড়ি প্রায় শত বছরের ইতিহাস লুকিয়ে রেখেছিল। স্থানীয়রা তাকে সতর্ক করেছিল, গুজবের ছায়ায় ভরা এই প্রাসাদে প্রবেশ করলে অজানা বিপদের মুখোমুখি হতে হতে পারে, কিন্তু নীরবের কৌতূহল তাকে থামাতে পারেনি। প্রবেশদ্বার পেরোতেই, তার চোখে ধরা পড়ল বিশাল পাথরের দেয়াল, যেগুলোতে সময়ের ছাপ স্পষ্ট। পাথরের গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত প্রতীক এবং ধূসর রঙের পাপড়ির মতো ছোপ তাকে এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে নিক্ষেপ…
 - 
				
গৌরব মিত্র কলকাতার আর্চিওলজি ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমে বসেছিলেন দীপাংশু মুখার্জী। দেওয়ালের একপাশে প্রাচীন শিবমূর্তির ছবি, অন্যপাশে মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যের স্লাইড প্রজেক্টর থেকে আলো ফেলে ঝলমল করছে। টেবিলের ওপর ছড়ানো নোটবুক, কাগজপত্র, আর তার হাতের পরিচিত সিগারেটের ধোঁয়া মিলেমিশে যেন কক্ষটিকে এক অদ্ভুত আবহে ভরিয়ে তুলেছিল। সেমিনার চলাকালীনই দপ্তরের এক চতুর্থশ্রেণির কর্মী এসে একটি খাম দিয়ে গেল—সাধারণ বাদামি রঙের, কোন প্রেরকের নাম নেই, কেবল কালো কালিতে লেখা তাঁর নাম আর ডিপার্টমেন্টের ঠিকানা। খানিকটা অবাক হয়ে খাম খুলতেই চোখ আটকে গেল মাত্র এক লাইন লেখায়—“চৌষট্টি যোগিনীর পূজা অসমাপ্ত, তুমি কি দেখতে চাও?”। মুহূর্তেই শরীরের ভেতর শিরশিরে একটা শীতলতা ছড়িয়ে গেল। ‘চৌষট্টি যোগিনী’…
 - 
				
অরুণোদয় দত্ত ১ ঢাকার ব্যস্ত রেলস্টেশনে তখন সকাল গড়িয়ে আসছে। কোলাহলের ভেতরেও চারজন মানুষ যেন নিজেদের ছোট্ট এক পৃথিবীতে ডুবে আছে। অরিন্দম—ইতিহাসের অধ্যাপক—চোখে চশমা, হাতে একটি পুরনো নোটবুক, যেখানে সে বছরের পর বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর সম্পর্কে নোট লিখে রেখেছে। তার মধ্যে এক ধরনের দৃঢ়তা, যা ছাত্রদের সামনে লেকচার দেওয়ার সময়ের মতোই নির্ভীক। পাশে বসে আছে অনন্যা, পিঠে ঝোলানো কালো ব্যাগে রাখা ক্যামেরার লেন্স উঁকি দিচ্ছে। সে বারবার আশেপাশের দৃশ্যগুলো দেখছে, যেন প্রতিটি মুহূর্তকে ফ্রেমে ধরে রাখতে চায়। সায়ন একটু গম্ভীর চেহারায় টিকিট পরীক্ষা করে, আরেকবার ব্যাগের ভেতরের গবেষণার নথি গুছিয়ে রাখে। তার কাছে এই ভ্রমণ নিছক আনন্দ নয়, বরং…
 - 
				
ছত্তিসগড়ের গভীর জঙ্গলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারদিকটা যেন অদৃশ্য কোনো চাপা রহস্যে ঘেরা—গা ছমছমে নিরবতা, ঘন কুয়াশা আর মাঝে মাঝে শোনা যায় অজানা পাখির ডানার শব্দ। ডঃ নীলয় সেনগুপ্ত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান, জিপ থেকে নেমেই চারপাশটা একবার ঠান্ডা চোখে স্ক্যান করলেন। পিছনে তাঁর দলের বাকি সদস্যরা: তরুণ তথ্যচিত্র নির্মাতা অরিন্দম পাল, প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্র বিশারদ ডঃ শ্রুতি দত্ত, ইতিহাসের গবেষক তনুশ্রী মুখার্জী এবং স্থানীয় গাইড兼ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট রাহুল কোসলে। তাঁরা আজ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, তার হদিশ পেয়েছিলেন কিছু দুর্লভ আদিবাসী নকশা বিশ্লেষণ করে। কথিত আছে, এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যেই আছে এক প্রাচীন মন্দির, যার অবস্থান এতদিন…
 - 
				
অগ্নিভ বসু ১ মেঘে ঢাকা আকাশ, ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার চাদরে মোড়া বাঁকুড়ার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি জিপ। স্টিয়ারিংয়ের পাশে বসে ডঃ নীলাভ মুখার্জী ডায়েরির পাতায় অস্থির হাতে কিছু নোট নিচ্ছিলেন—যার বেশির ভাগই ছিল স্থানীয় পুরাতাত্ত্বিক মানচিত্রের হালনাগাদ তথ্য। তাঁর মুখে সিগারেট, চোখে ক্লান্তির ছাপ। পেছনে বসে ছিলেন গবেষক মালবিকা রায়, যিনি জানালার কাঁচ সরিয়ে বাইরের পাহাড়ঘেরা দিগন্তে তাকিয়ে ছিলেন, যেন কোন কিছু চেনার চেষ্টা করছেন—যা হয়তো কোনো ছবি বা কাহিনি পড়ে মনে গেঁথে গিয়েছিল। গাড়িচালক রঘু হাঁসদা হঠাৎ বলে উঠল, “আর একটু সামনে গেলেই গোবিন্দপাহাড়পুর, বাবু। আপনারা যেই দেউলের খোঁজ করছেন, সেটার ধ্বংসস্তূপ ওই গ্রামের ওপারেই। তবে লোকজন…