অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ভাট্টা সবসময় একইরকম থাকে। পুরোনো বইয়ের গন্ধ, চায়ের ভাঁড় হাতে ছাত্রদের ঝাঁক, ফুটপাতের দোকানগুলোয় বইয়ের পাহাড়—সব মিলিয়ে শহরের একটুকরো জাদুর মতো লাগে। অর্ণব সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ধীরপায়ে হাঁটছিল। বই কেনা তার আসল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মনে মনে একটা অজানা টান তাকে এখানে টেনে এনেছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে অন্য কোনোদিন সে সোজা বাড়ি ফিরলেও আজকে কেন যেন এই রাস্তার টানে চলে এসেছে। দোকানদাররা গলা উঁচিয়ে ডাকছিল—“সেকেন্ড হ্যান্ড, সস্তার দামে, বিরল সংস্করণ!” অর্ণব এক-দুটি দোকানে থামল, বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল। তার চোখে হঠাৎ পড়ল এক পুরোনো ধূলো ধরা বই—চামড়ার মলাট ছেঁড়া, কাগজগুলো হলুদ হয়ে গেছে, তবু…
-
-
রূপক চক্রবর্তী শহরের ব্যস্ততা, গাড়ির হর্ণ আর মানুষের ঢল—সবকিছু যেন অরিন্দম ও মেঘলার জীবনের ভাঙনের প্রতিধ্বনি বহন করে। তারা প্রতিদিন একই পথে হাঁটে, একই অফিসে প্রবেশ করে, একই কফি শপে চুপচাপ বসে থাকে, কিন্তু তাদের চোখ আর মন ভিন্ন জগতে বিভক্ত। শহরের আলোকময় রাস্তায় অগণিত মানুষ চলাফেরা করে, হেসে খেলে, আর জীবনের ছোটখাটো সাফল্যে আনন্দিত হয়, অথচ অরিন্দম ও মেঘলা তাদের নিজেদের ভেতরের শূন্যতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়। সম্পর্কের ভাঙনের সেই শীতলতা, যা শুরুতে শুধুই কণ্ঠস্বরের তিক্ততা বা অশ্রুত অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা যেত, এখন ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদৃশ্য বরফের স্তর তৈরি করেছে। এই বরফের স্তর…
-
অনন্যা দত্ত ১ কলকাতার ভিড়ভাট্টা, ট্রাফিকের হর্ন, অফিসের শেষ না হওয়া মিটিং আর সময়ের পেছনে দৌড়তে থাকা জীবন—এই সব মিলিয়ে সৌভিক ও অভিসারিকার সংসার যেন এক অদৃশ্য যান্ত্রিক চক্রে আটকে গেছে। সৌভিক সকালেই বেরিয়ে যায়, অফিসের নথি, ক্লায়েন্ট কল আর প্রেজেন্টেশনের মধ্যে ডুবে থাকে, ফেরে রাত অবধি; তখন ক্লান্ত মুখে একমুঠো হাসি দেওয়ার শক্তিও থাকে না তার। অভিসারিকা, একসময় যার দিন কাটত রঙতুলি আর ক্যানভাসের মাঝে, এখন নিজের শিল্পকর্মের থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। স্কুলে আঁকা শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে মন চলে যায় বহু বছর আগের সেই দিনগুলিতে—যখন সৌভিক হঠাৎ সন্ধ্যায় এসে তার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ডাক দিত, কিংবা রঙিন চিঠি…
-
সায়নী বসু শীতল জানলার কাচে ভোরের শিশির জমেছে, আলো এসে পড়েছে থেরাপি রুমের কাঠের মেঝেতে। ড. মেঘলা দত্ত প্রতিদিনের মতো আজও ক্লিনিকের টেবিলে বসে, পেশেন্ট ফাইল ঘাঁটছেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে ন’টা। নতুন রোগী আসার কথা সাড়ে দশটায়—রেফার করা হয়েছে একটি সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে। “স্মৃতিভ্রষ্ট, আচরণ স্বাভাবিক, অস্থায়ী আবাসন হোমে রাখা হয়েছে,”—এইমাত্র এমন একটি রোগী এসেছেন যার জীবন যেন এক ছেঁড়া পাজল। মেঘলা চোখ বুলিয়ে নেয় রিপোর্টে, কিন্তু বিশেষ কিছু ধরা পড়ে না। তার মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা কাজ করে, কারণ এই ধরনের রোগীদের মাঝে প্রায়ই এমন কিছু থেকে যায়, যা রিপোর্টে ধরা পড়ে না—হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, অসম্পূর্ণ গল্প, বা…
-
অর্কদীপ ঘোষ ১ আষাঢ়ের এক শেষ বিকেল। ধূলিধূসর রাস্তা পেরিয়ে রাধিকার গাড়ি এসে দাঁড়াল শান্তিনিকেতনের এক পুরনো বাড়ির সামনে—দোতলা, লালমাটির ধুলোয় লেপা উঠোন, চারপাশে পেঁচিয়ে ওঠা মাধবীলতা আর ঘন পাতা গন্ধরাজ গাছের ছায়া। জানালার গরাদে কাঁটা লতাভরা স্মৃতি আটকে আছে, যেন কেউ সময়কে ছেঁচে রেখে দিয়েছে ওই দেয়ালের ফাটলে। এক সময় এই বাড়ির প্রতিটি কোণা তার চেনা ছিল—দাদুর বইয়ের আলমারি, মামিমার হাতের লুচির গন্ধ, আর উঠোনের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিশাল গন্ধরাজ গাছ, যার তলায় একদিন ঋষভ দাঁড়িয়ে বলেছিল, “তুই চলে যাবি তো ঠিকই, কিন্তু এই গন্ধটা থেকে যাবে। জানবি আমি কাছে আছি।” আজ বছর তেরো পর রাধিকা সেই…
-
আকাশ চৌধুরী অধ্যায় ১: আগমন শিলংয়ের আকাশটা যেন পুরনো কাচের জানালার মতো — ভেজা, ঝাপসা, আর চুপচাপ। এয়ারপোর্ট থেকে নামতেই ঋতব্রত দত্ত বুঝেছিল, এই জায়গাটার হাওয়ার মধ্যে কিছুর এক নিঃশব্দ আকর্ষণ আছে। উবার বুক করতে করতে চোখ পড়ল চারপাশের ঘন সবুজে ঢাকা টিলাগুলোর দিকে, দূরে একটা ঝরনার শব্দ যেন হালকা করে ছুঁয়ে গেল স্মৃতিকে। অফিসের বার্ষিক কনফারেন্সে আসা, সে কথা ঠিক। কিন্তু মুম্বইয়ের একঘেয়ে কাচঘেরা অফিসকক্ষ থেকে এই ছ’হাজার ফুট উপরের শহরে এসেই তার ভিতরটা অন্যরকম বেজে উঠল। গাড়ি চলছিল টানা পাহাড়ি রাস্তায়, উঁচু-নিচু ধাপ পেরিয়ে। জানালার কাঁচ নামিয়ে ঋতব্রত এক ফোঁটা ঠান্ডা বৃষ্টির জলে নিজের আঙুল ভিজিয়ে ফেলল। হঠাৎ…