নয়ন বিশ্বাস ১ কলকাতার ঘুমন্ত ভোরে, যখন গলির কুকুরগুলোও নিস্তব্ধ হয়ে যায়, ঠিক তখনই অরুণাভর স্বপ্ন শুরু হয়। এক নির্জন নীলচে আলোর ঘেরাটোপে সে দাঁড়িয়ে থাকে, সামনে দূরের এক বটগাছ, যার পাতা ঝরে না—শুধু ধীরে ধীরে হাওয়ায় ভাসে। প্রতিবার স্বপ্নটা শুরু হয় সেই গাছের নিচে, আর সেই মেয়েটি ধীরে ধীরে আবছা হয়ে এগিয়ে আসে কুয়াশার ভেতর থেকে। তার পরনে নীল রঙা ধুতি-সদৃশ এক শাড়ি, মুখে কোনো সাজ নেই, অথচ চোখে একধরনের জ্যোতি, যেন চাঁদের আলো সেখানে ঘনীভূত হয়েছে। “তুমি আবার এসেছো,” মেয়েটি বলে ধীর কণ্ঠে। “আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। কিন্তু মনে রেখো, আমি বাস্তব না… আমি তোমার হৃদয়ে আছি।”…
-
-
ঋদ্ধি চক্রবর্তী পর্ব ১: কালির চোখ কলকাতা শহরের মধ্যভাগে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরোনো পাঠাগার—“রায় রে’ডিং রুম”—তেমন কোনও বিখ্যাত জায়গা নয়। অথচ সেখানে প্রতিদিন দুপুর তিনটার সময় ঠিক এক জন মহিলা এসে বসেন, বাম দিকের দ্বিতীয় সারির তৃতীয় টেবিলে। তাঁর নাম অনামিকা বাগচী। বয়স আটাশ। পেশায় গবেষক, জাদুবিদ্যা ও তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তাঁর আসল কাজ শুরু হয় যখন বইয়ের পাতাগুলো শেষ হয়, আর প্রশ্নগুলো মুখে না থেকে ঢুকে পড়ে মগজে। সেদিন দুপুরেও অনামিকা এসে বসেছিল টেবিলটায়। লাল কাপড়ে মোড়া একটা পুরনো খাতা তার সামনে। নাম নেই, লেখকের উল্লেখ নেই। পাতাগুলোতে শুধুই আঁকা—ত্রিকোণ, মন্ডল,…
-
সুব্রত গাঙ্গুলি প্রতীক দত্ত, কলকাতার এক নামকরা দৈনিকের অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিক, চিরকাল যুক্তির পথ ধরেই হাঁটতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু কিছু ঘটনা এমন থাকে, যেগুলো যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়—এমনই এক ঘটনার পেছনে ছুটে সে এসে পৌঁছেছিল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক গ্রামে, নাম উজানডাঙা। শহর থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে, রুক্ষ কাঁচা রাস্তা ও নিস্তব্ধ পলিমাটির ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি—মহিমা চৌধুরী প্রাসাদ। এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কাহিনি তাকে টেনেছিল এখানে: প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির রাতে, বাড়ির মধ্যবর্তী ত্রিকোণ চত্বরে রাখা এক প্রাচীন ব্রোঞ্জের প্রদীপ নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে—কেউ জ্বালায় না, কেউ দেখেনি জ্বালাতে, তবুও জ্বলে। খবরটি প্রথম সে পায় এক…
-
ঊর্মি পাল অধ্যায় ১: “অশ্রু ও বিষ” অমৃতা এক কঠিন সন্ধ্যায় ঘরের জানালার কপাট বন্ধ করে বসেছিল। তার চারপাশে সন্ধ্যার অন্ধকার পসরানো শুরু করেছে, কিন্তু তার মনে এখনও মায়ার মতো সাদা আলোয় একটা বিষণ্ণ রূপের প্রতিফলন। এক সময় সে স্বপ্ন দেখেছিল, কী সুন্দর হবে তার জীবন! কিন্তু এখন তার সামনে শুধু একটা দীর্ঘ অন্ধকার পথ, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তার জীবনের সবকিছুই যেন একটা অদৃশ্য বেষ্টনীতে আটকে গেছে, পরিবারের চাহিদা, তার স্বামী রোহিতের প্রত্যাশা, তার সন্তান মাহির স্নেহের আগ্রহ—এসব কিছু মিলে এক ভারী বোঝা হয়ে গেছে। রোহিত একজন সফল ব্যবসায়ী, কিন্তু তার সাফল্যের পেছনে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।…
-
মৈত্রেয়ী দত্ত শহরের ব্যস্ততম অংশটি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। দিনের উন্মুক্ত আলো অদৃশ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল, আর সেই অন্ধকারে কেবল কিছু একটিই দৃশ্যমান ছিল—বাসস্ট্যান্ড। একে একে বাসগুলো চলে যাচ্ছে, কিন্তু তাতে কোনো কোলাহল নেই, যেন শহরের জীবন থেমে গিয়েছে। এই সন্ধ্যার মধ্যে এক তরুণী, সুহানা, দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন তার মন ভীষণ বিষন্ন ছিল। তার জীবনের প্রতিদিনের দৌড়, কর্মব্যস্ততা, আর সামাজিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে তাকে কোথাও কিছু হারিয়ে যেতে দেখাচ্ছিল। তার কাছে প্রতিটি দিন যেন একরকমের আলগা হয়ে উঠছিল—যেমন কিছু না কিছু তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছিল, কিন্তু সে কিছু করতে পারছিল না। এই অদৃশ্য শূন্যতা তাকে আজ…
-
জয়ন্ত কুমার চক্রবর্তী অধ্যায় ১: আগমনী ছায়া অক্টোবরের শেষভাগ। পাহাড়ি হাওয়ার কাঁপন তখন নতুন করে জানান দিচ্ছিল আসন্ন শীতে পাহাড়ের নিঃসঙ্গতা কেমন হতে চলেছে। অনির্বাণ রায়, এক শহুরে গ্রাফিক ডিজাইনার, ছুটির ফাঁকে একা একাই বেরিয়েছিল উত্তরবঙ্গের দূরবর্তী একটি পাহাড়ি গ্রামে। লোকাল ট্রেনের স্টেশন থেকে তিন ঘণ্টা জিপে চড়েই যেতে হয় সেই গ্রামে, নাম দারগাঁও। এই জায়গাটি এখনও গুগল ম্যাপেও পুরোপুরি চিহ্নিত নয়, অথচ স্থানীয় ট্রেকার আর পুরনো লোককথা শুনতে ভালোবাসা মানুষের মধ্যে এটি একটি গোপন রত্নের মতো। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতি দেখা, পাহাড়ি ধ্বংসাবশেষ ঘোরা আর একটু নির্জনতা খোঁজা। কিন্তু লজে পৌঁছনোর পর প্রথম সন্ধ্যাতেই এক বৃদ্ধা, ললিতা মল্লিক…