রূপক চক্রবর্তী শহরের ব্যস্ততা, গাড়ির হর্ণ আর মানুষের ঢল—সবকিছু যেন অরিন্দম ও মেঘলার জীবনের ভাঙনের প্রতিধ্বনি বহন করে। তারা প্রতিদিন একই পথে হাঁটে, একই অফিসে প্রবেশ করে, একই কফি শপে চুপচাপ বসে থাকে, কিন্তু তাদের চোখ আর মন ভিন্ন জগতে বিভক্ত। শহরের আলোকময় রাস্তায় অগণিত মানুষ চলাফেরা করে, হেসে খেলে, আর জীবনের ছোটখাটো সাফল্যে আনন্দিত হয়, অথচ অরিন্দম ও মেঘলা তাদের নিজেদের ভেতরের শূন্যতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়। সম্পর্কের ভাঙনের সেই শীতলতা, যা শুরুতে শুধুই কণ্ঠস্বরের তিক্ততা বা অশ্রুত অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা যেত, এখন ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদৃশ্য বরফের স্তর তৈরি করেছে। এই বরফের স্তর…
-
-
সুচেতা মিত্র অধ্যায় ১ – আগমন শহরের কোলাহল, ধোঁয়া আর ব্যস্ত রাস্তাগুলো পেরিয়ে যখন বাসটা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে উঠতে শুরু করল, তিতলির বুক ভরে উঠল এক অদ্ভুত অনুভূতিতে। জানালার কাচে ঠেস দিয়ে বসা সে এতদিন যেভাবে উঁচু দালান আর গাড়ির ভিড়ের মধ্যে ডুবে থেকেছে, সেভাবে যেন এই প্রকৃতির রঙে নিজেকে কখনও মেলাতে পারেনি। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসা কুয়াশা, মাঝেমধ্যেই চোখে পড়া ছোট ছোট টিনের চালওয়ালা ঘর, আর দূরে ভেসে আসা ঝর্ণার শব্দ তাকে এক অচেনা নেশায় ভরিয়ে তুলছিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি বাঁক ঘুরতেই নতুন কোনো পৃথিবী অপেক্ষা করছে, যেখানে নেই শহরের চাপা অস্থিরতা, নেই অফিসে বসে কাটানো…
-
নীলয় বসাক এক অরণ্যের আঁকাবাঁকা রাস্তায় ভোরের প্রথম আলো ভেসে আসছিল। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ধরে বহুটা পথ পেরিয়ে রিচার্ড অবশেষে পৌঁছাল সেই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে, যাকে স্থানীয়রা ‘রংভ্যালি’ বলে ডাকে। গ্রামের নাম মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না, পর্যটন গাইডবুকেও তার উল্লেখ নেই। তবু পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় মোড়া জায়গাটির প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ টেনেছিল তাকে। মেঘলা আকাশের নিচে সিঁড়ির মতো সাজানো ধানক্ষেত, কুয়াশায় আধঢাকা ছোট ছোট কুঁড়েঘর আর মাটির রাস্তার ধারে পাথর বসানো ঢাল—সবকিছু যেন রিচার্ডের চোখে এক অলৌকিক দৃশ্যের মতো ভেসে উঠল। লম্বা দেহ, খয়েরি দাড়ি আর গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে গ্রামের সীমানায় পা রাখতেই লোকেরা থমকে তাকাল। এত দূরে, এত…
-
ঊর্মি রায়চৌধুরী ১ সকালটা ছিল শান্ত, যেন প্রকৃতির বুক জুড়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা ছড়িয়ে আছে। অর্ণব চৌধুরী ও মৃণালিনী সেন সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে পৌঁছেই সে শূন্যতাকে অনুভব করেছিল, যেন এ জঙ্গল কেবল সবুজ আর বন্য প্রাণে নয়—গভীর কোনো গোপন স্মৃতিতে পূর্ণ। ওডিশার মায়াবী ঘন বনপথ পেরিয়ে যখন তাদের জিপ গাড়িটা বন বিভাগের অনুমতিপত্রসহ রেঞ্জ অফিসে পৌঁছায়, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা একদিকে শান্তিদায়ক, আর অন্যদিকে অজানা কিছুর পূর্বাভাসের মতো ঠেকছিল। রেঞ্জার রুদ্র বেহেরা, মাঝবয়সী এক চৌকস বন আধিকারিক, সংক্ষিপ্ত হাসি আর কাঠখোট্টা চোখে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। পরিচয়পর্বের পর তিনি তাদের জানালেন, “তোমরা যে জায়গায় যেতে চাইছো সেটা একটু গভীর অঞ্চল, কম লোক…
-
প্ৰতুল দে ১ চায়ের গন্ধে ভেজা বিকেল হাসপাতালের নিঃশব্দ করিডোর, মেয়ের বিদেশ থেকে আসা না আসা নিয়ে হিসেব, রোজকার ডায়েরির পাতায় অনুপস্থিত মানুষটার অদৃশ্য ছায়া—এসবের মাঝখানে অনন্যা সেন নিজের জীবনের হিসেবনিকেশ করতে করতে কখন যে পঞ্চাশের ঘর পেরিয়ে এসেছেন, সেটা বুঝতেও পারেননি। স্বামীর মৃত্যুর পরে সংসারটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গিয়েছিল, একটা দীর্ঘ নিঃশব্দতায় আবৃত একাকীত্ব। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির ছোট্ট ফ্ল্যাটটা যেন ধীরে ধীরে তার ঘর নয়, নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা হয়ে উঠেছিল। একমাত্র মেয়ে দীপা বিয়ের পর লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার পরে সেই নিঃশব্দতা আরও ঘনীভূত হয়, যেন পুরোনো আসবাব, দেয়ালের রং, ড্রয়ারের ভাঁজে ভাঁজে শুধু স্মৃতি জমে থাকে, জীবনের চলন নয়।…