• Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    জলরঙের জীবন

    নয়না ঘোষ অধ্যায় ১: নিঃসঙ্গতার ছায়া মায়া বড় শহরের এক আধুনিক স্টুডিওর মধ্যে বসে থাকে, যেখানে জানালার কাচে বিকেলের আলো আলোর খেলা খেলে। স্টুডিওর দেয়ালগুলো সাদা, কিন্তু সেই সাদার মধ্যে যেন অদৃশ্যভাবে তার নিজের ভাঙা জীবনের ছায়া ঢেকে আছে। প্রায়শই সে নিজেকে ভেতরে ভেতরে শূন্য বোধ করে, যেন চারপাশের কোলাহল, মানুষের উদাসীন হাসি এবং শহরের ব্যস্ততা কিছুতেই তার আত্মার মধ্যে ঢুকতে পারছে না। ফাঁকা ক্যানভাসগুলো কোণে একাকী দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তারা যেন শুধু শূন্যতার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং মায়ার নিঃসঙ্গতার গভীর অনুভূতি প্রকাশ করছে। তার দৃষ্টিতে প্রতিটি ফাঁকা ক্যানভাস যেন একটি মৃদু ডাক, যা তার ভিতরে লুকানো আবেগকে ছুঁয়ে দিচ্ছে—আবেগ যা…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    ছিন্ন মুকুট

    এক রিবা, এক স্বপ্নের মতো জীবনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তার নবগৃহে পা রাখল। অভিজাত পরিবারের নববধূ হিসেবে তার আগমন ছিল যেন এক চলচ্চিত্রের দৃশ্য—দীর্ঘ কার্পেট, সোনালি আলোয় ঝলমলানো হালকা পর্দা, দারুণ সজ্জিত হল এবং চারপাশে ঝলমলে ক্রিস্টাল লাস্টার। তার স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেছে বিশাল বাগান, ফোয়ারার ছোঁয়া, আর রঙিন ফুলের ছটা যা বাড়ির প্রতিটি কর্নারে ছড়িয়ে রয়েছে। সামাজিক দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তার নতুন পোশাক, হীরার গহনা এবং নিখুঁত চেহারা যেন প্রতিদিনের নাট্যশালা। রিবা নিজেকে দেখছিল এক নিখুঁত ছবির অংশ হিসেবে—যেখানে তার জীবন হবে প্রশান্ত, অভিজাত, এবং প্রতিটি মুহূর্ত হবে সুশৃঙ্খল। তবে এই বাহ্যিক গ্ল্যামারের পেছনে লুকানো বাস্তবতা ধীরে ধীরে…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    অন্তরঙ্গ পরিচয়

    অন্তরা মান্না অধ্যায় ১ – মায়ার জীবন, বাইরের চোখে, এক নিখুঁত শান্তির গল্পের মতো মনে হয়। সকালে উঠে রিয়াদের সঙ্গে চায়ের কাপ ভাগ করে নেওয়া, রাস্তার ধারের ছোট্ট ফুলের দোকান থেকে রঙিন ফুল আনা, এবং বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে হালকা আড্ডা—সবকিছু যেন একটি সুন্দর ছন্দে বাঁধা। মায়া মনে করত, এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তার জীবনের আসল সম্পদ। রিয়াদের হাসি, তার কোমল স্পর্শ, এমনকি তার ক্ষুদ্র অভ্যাসগুলোও—যেমন বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে পড়া, কফি খাওয়ার ধরণ—সবই মায়ার মনে একধরনের উষ্ণতা সৃষ্টি করত। তারা দুজনেই একে অপরের মেলবন্ধনে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল, এমনকি দিনের শেষে নিঃশব্দে একে অপরের হাত ধরার অভ্যাসও মায়াকে অদ্ভুত সান্ত্বনা দিত।…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    নির্জন শহর

    তমালিকা দাস মহামারীর প্রথম ঢেউ এসে যেন শহরের প্রাণ এক নিমেষে কেড়ে নিল। কলকাতার মতো এক কর্মব্যস্ত মহানগর, যেখানে প্রতিদিনের সকাল মানেই ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন, গাড়ির হর্নে মুখরিত রাস্তা, আর মানুষের ভিড়ের কোলাহল—সেই শহর হঠাৎই হয়ে গেল এক বিরান চৌহদ্দি। অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে মানুষ ঘরে বন্দি, যেন কেউ আর সাহস করছে না রাস্তায় পা বাড়াতে। দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ, ফুটপাতের চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চা নেই, স্কুল-কলেজের ফটকগুলো তালাবন্ধ, সিনেমাহলের আলো নিভে গেছে। শহরের বাতাসে মিশে আছে শুধু আতঙ্ক আর শূন্যতা। এই নিস্তব্ধতায় একমাত্র ভেসে আসে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—একটা ভৌতিক আর্তনাদের মতো, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, মৃত্যু যেন প্রতিদিনই আরও…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    বনলতা

    ১ শহরের সকাল সবসময়ই ব্যস্ততার সঙ্গে শুরু হয়—বসন্তপুর নামের এই আধুনিক নগরীটা যেন ঘুমায় না। উঁচু উঁচু বহুতল ভবনের জানালা থেকে সূর্যের আলো গড়িয়ে এসে পড়ছে নিচের ব্যস্ত রাস্তায়, যেখানে গাড়ির হর্ন আর মানুষের ভিড় মিলেমিশে এক অদ্ভুত কোলাহল তৈরি করেছে। এই ভিড়ের মাঝেই প্রতিদিনের মতো পথ হাঁটছে বনলতা—পঁচিশ বছরের এক তরুণী, যার চেহারায় ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট হলেও চোখে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে নোটবুক, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিমায় যেন কেবল দায়িত্ব পালন করার যান্ত্রিকতা। শহরের এই কোলাহল তাকে কখনোই আপন মনে হয়নি; বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভিড় তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সে এই ব্যস্ত মানুষের…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    অদম্য

    নিবেদিতা বসু অনন্যার শৈশবটা অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল। যেখানে বেশিরভাগ মেয়েরা পুতুল সাজাতে, রান্নাবান্না খেলতে কিংবা চকচকে চুলের ফিতেতে মেতে থাকে, সেখানে অনন্যার চোখ জ্বলে উঠত ব্যাট-বলের নাম শুনলেই। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই তার খেলার সঙ্গী ছিল পাশের গলির ছেলেরা। তারা যখন ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামত, অনন্যা কাঁধের ব্যাট ঝুলিয়ে দৌড়ে যেত। প্রথমে ছেলেরা তাকে নিতেই চাইত না, “মেয়েরা খেলতে পারে নাকি?”—এমন ঠাট্টা-বিদ্রুপ হতো নিয়মিত। কিন্তু অনন্যার চোখে এক অদ্ভুত জেদ ছিল, যেন প্রতিটি অবহেলার উত্তর সে ব্যাটের শব্দে দিতে চায়। খেলার সুযোগ না পেলেও সে গলি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সবার খেলা দেখত। কারও ব্যাটিং ভেঙে পড়লে,…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - সামাজিক গল্প

    অপরিচিতা মোহিনী

    সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    টিফিনবক্স

    চৈতালি মুখার্জী ১ ভোর সাড়ে চারটে। দমদমের একটি পুরোনো একতলা বাড়ির উঁচু-নীচু ইটের মেঝেতে পা রাখতেই ঠান্ডা সরে আসে পায়ের পাতায়। মীরা কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। উনুনে কেরোসিন ঢালার শব্দ, দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে আগুন জ্বালায় সে—শব্দ হয় ফিসফিসে, অথচ বুকের ভিতর এই মুহূর্তেই যেন এক ধরণের আগুন জ্বলে ওঠে। চাল ধোয়া জল হাতে করে হাঁড়িতে ফেলে সে, পেঁয়াজ কুচো করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে—তাড়াহুড়োতে আঙুল কেটে গেলে পাত্তা দেয় না। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে সে মাঝে মাঝে—আজ তিনটি নতুন অর্ডার এসেছে, তার মানে ১৩টা টিফিন বানাতে হবে, একটাও যেন কম তেল না হয়, বেশ ঝাল না হয়, আরেকটায় যেন কড়ি…

  • Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

    ঘুঙুর

    মহুয়া নাগ এক রাধিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের ঘুঙুরজোড়ায় আলতো করে আঙুল বোলায়। সে জানে এই ঘুঙুরগুলো কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এগুলো তার অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি। ঘরে বাতাস চলাচল করে না, মশারির ফাঁকে ভোরের আলো ঢুকে চিবুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; তবু তার মন যেন কোথাও চলে গেছে—এক বিস্তৃত মঞ্চে, যেখানে কেবল সে আছে, তার নাচ আছে, আর আছে নিঃশব্দ দর্শক। বাইরে থেকে শোনা যায় তবলার ঠেক-ঠুক শব্দ—তার বাবা সুবীর সেনের রেওয়াজ চলছে, ভোর পাঁচটার ধারা বজায় রেখে। রাধিকা সেই তাল চেনে, সেই লয় তার ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিদিন, কিন্তু আজকাল সে তবলার তাল নয়, শরীরের সঞ্চালনের ভাষা বুঝতে চায়। তার মা মীনাক্ষী…

  • Bangla - তন্ত্র

    রক্ততিলক

    সৌভিক নন্দী ১ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের সেই রাতটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা ছিল, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। শহরের ব্যস্ততা একটু শান্ত হলেও, গলিগুলোয় যেন ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠছিল। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এক রিকশাওয়ালা প্রথম মৃতদেহটি দেখতে পান—লাল রঙের কাঁথায় মোড়া একটি দেহ, যার কপালে স্পষ্ট লাল তিলক, যেন রক্তে আঁকা। তার চিৎকারে স্থানীয় থানা ছুটে আসে। অচিন্ত্য বসু, ডেপুটি কমিশনার (ক্রাইম ব্রাঞ্চ), সকালে ফোন পান—”স্যর, কালীঘাটে অদ্ভুত খুন… একটা সিম্বলিক মার্ডার বলেই মনে হচ্ছে।” সাদা শার্ট গায়ে চাপিয়ে, ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে, তিনি বললেন, “জীবনে কিছুই সিম্বলিক হয় না। সব কিছুরই মানে আছে। পাঠাও লোক।” কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিজেই…