তমালিকা দাস মহামারীর প্রথম ঢেউ এসে যেন শহরের প্রাণ এক নিমেষে কেড়ে নিল। কলকাতার মতো এক কর্মব্যস্ত মহানগর, যেখানে প্রতিদিনের সকাল মানেই ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন, গাড়ির হর্নে মুখরিত রাস্তা, আর মানুষের ভিড়ের কোলাহল—সেই শহর হঠাৎই হয়ে গেল এক বিরান চৌহদ্দি। অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে মানুষ ঘরে বন্দি, যেন কেউ আর সাহস করছে না রাস্তায় পা বাড়াতে। দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ, ফুটপাতের চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চা নেই, স্কুল-কলেজের ফটকগুলো তালাবন্ধ, সিনেমাহলের আলো নিভে গেছে। শহরের বাতাসে মিশে আছে শুধু আতঙ্ক আর শূন্যতা। এই নিস্তব্ধতায় একমাত্র ভেসে আসে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—একটা ভৌতিক আর্তনাদের মতো, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, মৃত্যু যেন প্রতিদিনই আরও…
-
-
১ শহরের সকাল সবসময়ই ব্যস্ততার সঙ্গে শুরু হয়—বসন্তপুর নামের এই আধুনিক নগরীটা যেন ঘুমায় না। উঁচু উঁচু বহুতল ভবনের জানালা থেকে সূর্যের আলো গড়িয়ে এসে পড়ছে নিচের ব্যস্ত রাস্তায়, যেখানে গাড়ির হর্ন আর মানুষের ভিড় মিলেমিশে এক অদ্ভুত কোলাহল তৈরি করেছে। এই ভিড়ের মাঝেই প্রতিদিনের মতো পথ হাঁটছে বনলতা—পঁচিশ বছরের এক তরুণী, যার চেহারায় ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট হলেও চোখে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে নোটবুক, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিমায় যেন কেবল দায়িত্ব পালন করার যান্ত্রিকতা। শহরের এই কোলাহল তাকে কখনোই আপন মনে হয়নি; বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভিড় তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সে এই ব্যস্ত মানুষের…
-
নিবেদিতা বসু অনন্যার শৈশবটা অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল। যেখানে বেশিরভাগ মেয়েরা পুতুল সাজাতে, রান্নাবান্না খেলতে কিংবা চকচকে চুলের ফিতেতে মেতে থাকে, সেখানে অনন্যার চোখ জ্বলে উঠত ব্যাট-বলের নাম শুনলেই। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই তার খেলার সঙ্গী ছিল পাশের গলির ছেলেরা। তারা যখন ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামত, অনন্যা কাঁধের ব্যাট ঝুলিয়ে দৌড়ে যেত। প্রথমে ছেলেরা তাকে নিতেই চাইত না, “মেয়েরা খেলতে পারে নাকি?”—এমন ঠাট্টা-বিদ্রুপ হতো নিয়মিত। কিন্তু অনন্যার চোখে এক অদ্ভুত জেদ ছিল, যেন প্রতিটি অবহেলার উত্তর সে ব্যাটের শব্দে দিতে চায়। খেলার সুযোগ না পেলেও সে গলি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সবার খেলা দেখত। কারও ব্যাটিং ভেঙে পড়লে,…
-
সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…
-
চৈতালি মুখার্জী ১ ভোর সাড়ে চারটে। দমদমের একটি পুরোনো একতলা বাড়ির উঁচু-নীচু ইটের মেঝেতে পা রাখতেই ঠান্ডা সরে আসে পায়ের পাতায়। মীরা কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। উনুনে কেরোসিন ঢালার শব্দ, দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে আগুন জ্বালায় সে—শব্দ হয় ফিসফিসে, অথচ বুকের ভিতর এই মুহূর্তেই যেন এক ধরণের আগুন জ্বলে ওঠে। চাল ধোয়া জল হাতে করে হাঁড়িতে ফেলে সে, পেঁয়াজ কুচো করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে—তাড়াহুড়োতে আঙুল কেটে গেলে পাত্তা দেয় না। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে সে মাঝে মাঝে—আজ তিনটি নতুন অর্ডার এসেছে, তার মানে ১৩টা টিফিন বানাতে হবে, একটাও যেন কম তেল না হয়, বেশ ঝাল না হয়, আরেকটায় যেন কড়ি…
-
মহুয়া নাগ এক রাধিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের ঘুঙুরজোড়ায় আলতো করে আঙুল বোলায়। সে জানে এই ঘুঙুরগুলো কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এগুলো তার অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি। ঘরে বাতাস চলাচল করে না, মশারির ফাঁকে ভোরের আলো ঢুকে চিবুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; তবু তার মন যেন কোথাও চলে গেছে—এক বিস্তৃত মঞ্চে, যেখানে কেবল সে আছে, তার নাচ আছে, আর আছে নিঃশব্দ দর্শক। বাইরে থেকে শোনা যায় তবলার ঠেক-ঠুক শব্দ—তার বাবা সুবীর সেনের রেওয়াজ চলছে, ভোর পাঁচটার ধারা বজায় রেখে। রাধিকা সেই তাল চেনে, সেই লয় তার ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিদিন, কিন্তু আজকাল সে তবলার তাল নয়, শরীরের সঞ্চালনের ভাষা বুঝতে চায়। তার মা মীনাক্ষী…
-
সৌভিক নন্দী ১ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের সেই রাতটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা ছিল, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। শহরের ব্যস্ততা একটু শান্ত হলেও, গলিগুলোয় যেন ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠছিল। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এক রিকশাওয়ালা প্রথম মৃতদেহটি দেখতে পান—লাল রঙের কাঁথায় মোড়া একটি দেহ, যার কপালে স্পষ্ট লাল তিলক, যেন রক্তে আঁকা। তার চিৎকারে স্থানীয় থানা ছুটে আসে। অচিন্ত্য বসু, ডেপুটি কমিশনার (ক্রাইম ব্রাঞ্চ), সকালে ফোন পান—”স্যর, কালীঘাটে অদ্ভুত খুন… একটা সিম্বলিক মার্ডার বলেই মনে হচ্ছে।” সাদা শার্ট গায়ে চাপিয়ে, ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে, তিনি বললেন, “জীবনে কিছুই সিম্বলিক হয় না। সব কিছুরই মানে আছে। পাঠাও লোক।” কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিজেই…
-
কুহেলী ধর ১ বাড়ির বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে। মেঘলা গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে রইল জানলার ধারে। নীচে প্যান্ডেলের বাঁশ বেঁধে গাঁদার মালা ঝোলানো হচ্ছে, ঢাকিরা এসেছে, ঢাকের প্রতিটা আওয়াজে যেন বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। ঘরের ভেতরে চায়ের কাপ রাখা, তাতে ধোঁয়া উঠছে না — কারণ মেঘলা আর চা খায় না, কবে যে নিজের পছন্দের তালিকা থেকে চা নিজেই বাদ দিয়েছে, তার ঠিক নেই। বরং, স্বামী রণদীপ আর মেয়ের জন্য রোজ সময়মতো ব্রেকফাস্ট বানানোই এখন তার কাছে ‘প্রিয় কাজ’। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটায় দাঁড়িয়ে, স্বামী অফিসের কথা বলে আজ একটু দেরিতে উঠেছে। মেয়েটা পাশের ঘরে অনলাইন ক্লাসে ব্যস্ত, অথচ…
-
দেবজয় ঘোষ (এক) কলকাতার উত্তর শহরের শোভাবাজার অঞ্চলে শীতকাল প্রবেশ করার আগেই বাতাসে একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভব জাগে — যেন গলির অন্ধকার কোণাগুলো আরও গভীর হয়, পুরনো বারান্দাগুলো থেকে ছায়ারা লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সেই শহরেরই এক কোণে, চৌবাগান স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে পড়ে থাকা একটি পুরনো, বন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্গা মণ্ডপ — “মিত্র চৌধুরী পরিবার মণ্ডপ” নামে পরিচিত — আজও বেঁচে আছে স্মৃতির মধ্যে, কিন্তু সকালের আলোয়ও কেমন ছায়াচ্ছন্ন লাগে। ঋদ্ধিমা রায়, কলকাতার এক সাহসী তদন্তকারী সাংবাদিক, বহুদিন ধরে এই স্থানটির গুজব নিয়ে শুনে এসেছে— আশ্বিন মাসের প্রতি দশমীর রাতে এখানে ঘটে কিছু অলৌকিক, তান্ত্রিক আচার, যেগুলোর স্বাক্ষী শুধু বাতাস আর…
-
প্রজ্ঞা সেনগুপ্ত এক সূর্য তখন পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতিতে, আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে কমলা রঙের ছায়া। গ্রামের শেষপ্রান্তের কাঁচা রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে। গরু-বাছুর ফিরেছে খুঁটির কাছে, ধোঁয়া উঠেছে রান্নার চুলায়। এমন সময় একটা ছায়ামূর্তি—কোনওমতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, কাপড় ছেঁড়া, হাঁটা কাঁপা কাঁপা। তার মুখটা ঢাকা, কিন্তু চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ স্পষ্ট। কেউ জানে না কোথা থেকে এল, বা কী ঘটেছে। অনেকে জানতেও চায় না। গ্রামের মধ্যে কানাঘুষো শুরু হল, “ওই তো সরকারবাড়ির পেছনের পথ দিয়ে আসছে! ওই তো রাধার কনিকা… বাঁচাও বাবা, আবার নাম জড়াবে গ্রামের।” কেউ জল এগিয়ে দিল না, কেউ তাকে…