সুতপা মল্লিক কলকাতার উত্তরের এক পুরনো বনেদি বাড়ির ভেতর দুপুরটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। ছাদের ওপর চড়া রোদ, নিচের দোতলা বাড়ির অন্দরে নিঃশব্দের এক গহ্বর। ব্রতী সেন জানলার ধারে বসে ছিল, পাশের ঘরে টিকটিকির ডাকে একটানা সময় যেন আটকে পড়েছিল। দুপুরের খাবার, থালা বাসনের শব্দ, শাশুড়ির নিয়মিত বকুনি—সবই সেদিনের মতো সেরে ফেলা হয়েছে। অরিন্দম অফিসে, শাশুড়ি ঘুমোচ্ছেন, আর এই সময়টুকু তার—সে জানে, এই এক-দেড় ঘণ্টা সে তার মতো করে বাঁচতে পারে। কিন্তু কীভাবে বাঁচে, তা সে নিজেই জানে না। তার পছন্দের খাতা, একটা পুরনো পেন আর সেই শাদা পৃষ্ঠা—যেখানে সে শব্দে শব্দে নিজের নিঃশব্দ চিৎকারগুলো গেঁথে রাখে। কেউ জানে না, কেউ…
-
-
চৈতালি মুখার্জি সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে বিছানার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। তৃষা সেন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন দেয়ালের দিকে। একটা থমথমে নিঃশব্দতা, যেন প্রতিটি দিন একই ভাবে নিজের ভারে এগিয়ে আসে তার জীবনে। পাশের ঘর থেকে কাবেরী সেন—তার মা—চায়ের কাপ রাখার আওয়াজে ব্যস্ততার সূচনা জানিয়ে দেয়। “চা ঠান্ডা হয়ে যাবে,”—এটাই তৃষার প্রতিদিনের প্রথম শোনা সংলাপ। সে কিছু না বলে উঠে পড়ে, মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। কাবেরী চায়ের কাপে চিনি কম দেখেই মুখ বাঁকান, “আজকাল এসব মিষ্টিহীন জীবনটাই কি খুব ফ্যাশনেবল?” তৃষা হেসে বলে, “না রে মা, আজকে গলায় একটু সমস্যা, তাই মিষ্টি কম। ক্লাসে তো সারাদিন কথা…
-
অনামিকা পোদ্দার এক বাড়ির উঠোনটা এখন আর আগের মতো নেই। আগের সেই লালমাটির ছোঁয়া, গোলপাতার ছায়ায় মেখে থাকা দুপুরগুলো যেন বহু আগেই হারিয়ে গেছে, আর আজকের এই কংক্রিট বাঁধানো বারান্দার ঠাণ্ডা ছায়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীমণি দেবী যেন সেই সব দিনের অলিখিত স্মৃতিগুলো স্পর্শ করতে চায়। তাঁর হাতে ধরা একটা ছোট কাঁচের বাক্স, যার ভিতরে মোটা তুলোয় মোড়া সেই পুরনো সোনার নোলক। ছেলেবেলার দিনগুলোয় লক্ষ্মীমণি যেদিন প্রথম শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিলেন, সেদিন শাশুড়িমা এই নোলকটি তাঁর নাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন বলেছিলেন, “এইটা শুধুই অলংকার নয়, এইটা হইলো আমাদের ঘরের গৌরব, নারীর কৌলীন্য, সম্মান আর আত্মপরিচয়ের ছাপ।” আর সেই দিন থেকে শুরু করে অজস্র রাত্রি…
-
শুভশ্রী হাজরা অধ্যায় ১: সুতোয় বাঁধা স্বপ্ন ঝিরঝিরে হাওয়ায় গঙ্গার ধারে ঢেউ খেলছে পাটের সুতো। আঁচল সরকার ধৈর্যের সঙ্গে তা শুকোতে দিচ্ছে রোদে, শাড়ির রঙ যেন ঠিকঠাক বসে। এ দৃশ্য যেন শুধু শিল্প নয়, একটা স্বপ্নের সূচনা। আঁচলের বয়স মাত্র ২৪। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মা সুমিত্রা সরকার আর দিদিমা বাসন্তী সরকারই ছিল তার আশ্রয়। আঁচল বড় হয়েছে এই গ্রামেই — নদিয়ার চরবাঁশবেড়িয়া। ছোট্ট, সরল একটা গ্রাম। কিন্তু তার চোখে ছিল আকাশ ছোঁয়ার বাসনা। “মা, আজকে পাটের রঙটা যেন ঠিকঠাক না বসে,” রোদে শুকোনো সুতোটা হাতে তুলে এনে আঁচল বলল। সুমিত্রা উত্তর দিল, “তুই যেমন মন দিয়ে বানাস, তাতে যা-ই…