সহেলী দেব অগ্নিশিখা দত্ত ছিলেন এক মফস্বল শহরের সাধারণ স্কুলশিক্ষিকা, কিন্তু তার ভেতরে ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি, যা বাইরের সাধারণ চোখে ধরা পড়ত না। শাড়ির আঁচল গুঁজে স্কুলে গিয়ে তিনি যেমন মাটির গন্ধে ভিজে থাকা খড়ের ছাউনিওয়ালা শ্রেণিকক্ষে মেয়েদের পড়াতেন, তেমনি দিনের শেষে ঘরে ফিরে নিজের বুকের ভেতর জমতে থাকা অস্থির স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই বই ছিল তার নিঃশ্বাসের মতো—বইয়ের পাতায় সে খুঁজে পেয়েছিল পৃথিবীর অচেনা দরজা, ইতিহাসের আলো, আর ভবিষ্যতের কল্পনা। অথচ তার গ্রামে মেয়েদের হাতে বই পৌঁছাত না, তারা বইকে দেখে শুধু পড়াশোনার বোঝা ভেবেই ভয় পেত। অনেক মেয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো, কেউ কেউ সংসারের…
-
-
মৌসুমী ধর অধ্যায় ১: আয়নার ওপারে মেহেরা দত্ত সকালবেলার সূর্যের মৃদু আলোয় ঘুম থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকালেন। আয়নাটা ছোট্ট, বাথরুমের দরজার ভেতর লাগানো, আর সেই আয়নাতেই প্রতিদিনই তার ছায়াটা দেখতে হয়। ছায়াটা যেন কিছুক্ষণ আগের থেকে একটু ভিন্ন হয়ে গেছে—একটু ক্লান্ত, একটু বিষণ্ণ, আর কখনো কখনো যেন আড়ালে চুপ করে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। গৃহবধূ মেহেরা, যিনি স্বামী কৌশিক ও দুই সন্তানের জন্য জীবন গড়েছেন, আজও রাঁধুনির কাজ থেকে একটু বিরতি নিয়ে চুপচাপ সেই আয়নার দিকে তাকালেন। দেড় দশক আগে কলেজে ইংরেজিতে অনার্স করার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করেছিল সে; শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল, বইয়ের সঙ্গেই জীবন কাটানোর তাগিদ ছিল। কিন্তু…
-
চৈতালি লাহিড়ী এক প্রতিভার জীবনের প্রথম স্মৃতি যেন সেই গন্ধ—হলুদের, ধূপের, আর নতুন শাড়ির আলতো কলকার। বাল্যবিয়ে তার জন্য ছিল এক নীরব আনুষ্ঠানিকতা, চোখের কোনায় জল জমলেও মন বোঝেনি এর অর্থ। ছোট্ট গ্রামের মাটির বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির লাল ইটের প্রাচীরের মধ্যে পা রাখার মুহূর্তে সে অনুভব করেছিল পৃথিবীটা কত বড়, আর সেই বড় পৃথিবীতে সে কতটুকু ক্ষুদ্র। প্রতিভার বয়স তখন মাত্র তেরো, বইয়ের পাতায় এখনও তার হাতের গন্ধ লেগে ছিল, অথচ জীবনের নতুন পাঠশালায় তাকে পা রাখতে হলো অনিচ্ছায়। স্বামী অরুণমাধব, দশ বছরের বড়, শুরুর দিকে মুখে কথাই বলতেন না; শ্বশুরবাড়ির রীতিনীতি, শাশুড়ির কড়া চোখ, আর গৃহস্থালির দায়িত্ব একসঙ্গে যেন…
-
শ্রাবণী দাস ১ ভোর তখন পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কিন্তু নদীয়ার ছোট্ট তাঁতশিল্পের গ্রাম বর্ণনাদহ যেন দিনের প্রথম নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। গ্রামের মাটির গন্ধ, ধোঁয়া ওঠা চুল্লির কাশফুলের মতো পাতলা ধোঁয়া, আর তাঁতের খটখট আওয়াজ—সব মিলে এক অবাক মায়ার ভোর। সেই মায়ার মধ্যেই উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল মেঘলা পাল, এক হাতে ধরা সুতোর গোছা আর অন্য হাতে তার বাবার পুরোনো নকশার খাতা। চুলে গাঁথা ছিল লাল জবা, চোখে ছিল দূরের স্বপ্নের আলো। মেয়েটির বয়স বেশি না—এই বাইশ, তবুও তার চিন্তা যেন এক শিল্পী আর বিপ্লবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সে জানে, এই গাঁয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই তাকে জড়িয়ে ধরেছে সমাজের রক্ষণশীলতা, কিন্তু একইসাথে তার চোখে…
-
পূরবী মজুমদার এক কলকাতার বুকে গড়ে ওঠা এক চিরাচরিত বহুতল আবাসন। বাইরে ব্যস্ত রাজপথ, চিরচেনা হর্নের শব্দ, বাতাসে ভেসে আসা বেগুনি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর ভেজা মাটির গন্ধ। এই কোলাহল আর নিস্তব্ধতার মিশেলে একটি ঘরে বসবাস কুমুদিনীর—এক গৃহবধূ, এক মা, এক পুত্রবধূ। তার নিজের নামটা যেন আজ আর কারও মুখে উচ্চারিত হয় না। সবাই তাকে ডাকে “মা”, “বৌমা”, “মেসোমশাইয়ের বৌ”, কিংবা “ছোট বৌ” বলে। এই নামগুলির আড়ালে কোথাও হারিয়ে গেছে কুমুদিনী নামের সেই মেয়েটি, যে একদিন স্বপ্ন দেখত রঙ আর তুলির খেলায় নিজের জীবনের গল্প লেখার। সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢোকে। বারান্দার গাছগুলোয় কয়েকটা শালিকের ডাক। কুমুদিনীর দিন…