অর্ণবী চক্রবর্তী পর্ব ১: কলকাতার স্যাঁতসেঁতে হাওয়া আর একলা বারান্দা কলকাতার এই বর্ষা আমি কত বছর দেখিনি? নাকি দেখেছি, শুধু মনে রাখিনি? হাত বাড়ালেই জল পড়ে—ছাদের কার্নিশ থেকে, ল্যাম্পপোস্টের মাথা থেকে, পুরনো কালের জানলা থেকে। আর বারান্দা? ওই একলা বারান্দা, যেটার পাশে একটা চেয়ার থাকে, ধূলো জমা, যে চেয়ারে বাবা বসতেন, কাঁধে গামছা, হাতে চায়ের কাপ, আর চোখে শূন্যতা। সেই শূন্যতা আমার চোখেও এসে পড়ে আজকাল, জানো? এখন আমি একা থাকি। বেলেঘাটার এই পুরনো বাড়িতে। নাম শুনেই বোঝা যায়, রাজবাড়ি নয়, তাও যেন একটা অলিখিত ইতিহাস টিকে আছে দেওয়ালে। মা মারা যাওয়ার পর এই বাড়িটা আমি বেচে দিলাম না কেন,…
-
-
মেঘালি দাস ঋত্বিক মৈত্র ডান হাতে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ আর বাঁ হাতে পুরনো স্কচটেপের খোপ ধরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল স্টোর রুমের দরজার সামনে। জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের হালকা রোদ যেন স্টোর রুমটার চারপাশে ধুলোর আস্তরণে সোনালি পরত ছড়িয়ে দিয়েছে। দোতলার দক্ষিণ ঘরের এক কোণে আটকে থাকা এই ছোট্ট ঘরটা বহুদিন পর খোলা হচ্ছে আজ। কলকাতার মধ্যবিত্ত এক বাড়ির ক্লান্ত দেয়ালের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্টোর রুমটা যেন নিজের ভেতরে আর্কাইভ করে রেখেছে মৈত্র পরিবারের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো। হোস্টেলে যাওয়ার আগে নিজের প্রিয় ক্যারম বোর্ডটা নিয়ে যেতে চায় ঋত্বিক—এটাই তো ছিল তার আর বাবার একমাত্র ‘বন্ধুত্বের খেলা’, সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে দুটো…
-
রুক্মিণী ভট্টাচার্য পর্ব ১: মেঘ জমেছে হাজরা মোড়ের সেই পুরোনো বাস স্টপটায় দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। তার পরনে একটা সাদা-লাল ছাপার কুর্তি, হাতে একটা বই, মুখটা মেঘলা আকাশের মতো ভাবনায় ঢাকা। বৃষ্টি নামবে বুঝে ছাতাটা খুলে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু জানত না, এই ছাতাটাই একদিন একটা গল্প হয়ে উঠবে। পাঁচ মিনিট আগেই ট্রামলাইন বরাবর হাঁটছিল একটা ছেলেও। নাম তন্ময়। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ, আর কানে হেডফোন। ট্রামটা চলে গেছে, কিন্তু ছেলেটা থেমে দাঁড়ায়—বৃষ্টি তার চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে, অথচ সে নড়ছে না। বৃষ্টি বাড়তেই দুজনেই একটু করে সরে আসে স্টপের ছাউনির নীচে। হঠাৎ একটা ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় মেয়েটির কাঁধটা। ছেলেটি একটু এগিয়ে এসে…
-
সুকুমার ঘোষ এক কলকাতার সল্টলেকের অষ্টম তলার কর্পোরেট অফিস কাচের দেওয়ালের ভিতর বন্দি এক ফ্ল্যাটস্ক্রিন-চালিত জীবন। কেবিনের মাথার উপরে দুলছে স্পটলাইট, ডেস্কের কোণায় রাখা অ্যালো ভেরা পাত্রে মাটি শুকিয়ে গেছে, অথচ অভিরূপ বসুর চোখে ক্লান্তির ছায়া নেই—সে অভ্যস্ত। প্রত্যেকদিন সকাল ন’টায় ঠিক নীল শার্ট, ধূসর ব্লেজার আর চকচকে লেদারের জুতো পরে অফিসে প্রবেশ করে; তার মুখে এক প্রকার যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাস—যেটা হয়তো মাল্টিন্যাশনাল পরিবেশের জরুরি পোশাক। অভিরূপ একজন সফল ব্র্যান্ড ম্যানেজার, মেট্রিক্স আর কনভার্সনের পরিসংখ্যানের সঙ্গে যার ঘুম–জাগরণের সম্পর্ক। সে জানে কোন ক্লায়েন্ট কবে “impression” চায়, কাকে “engagement” দিয়ে মাতাতে হয়, আর কোন প্রেজেন্টেশনের সময় একটা থ্রি-পয়েন্টার স্লাইড শেষ মুহূর্তে গুঁড়িয়ে…
-
সুদীপ্ত চৌধুরী পর্ব ১ আমার জন্ম হয়েছিল এক গরম দুপুরে, হাওড়ার একটি ছোট গ্যারেজের ভেতর। চারপাশে ধুলো, কাঠের গন্ধ, আর যন্ত্রপাতির আওয়াজ। তখন আমি কিছুই বুঝতাম না—শুধু টের পাচ্ছিলাম, কিছু একটা নতুন হচ্ছে। লোহা, রাবার আর রঙের গন্ধে ভরা সেই অদ্ভুত পরিবেশে কেউ আমাকে তৈরি করছিল, নিঃশব্দে, নিখুঁতভাবে। আমার কঙ্কাল জুড়ে নিচ্ছিল একে একে চাকা, হ্যান্ডেল, প্যাডেল। আমার গায়ে পড়ছিল চকচকে লাল রঙ, ঠিক যেন একটা নতুন জামা। সেই রঙে আমার আত্মা খুঁজে পেল নিজেকে। আমার গায়ে প্রথম স্পর্শ দিয়েছিল একটি খুদে হাত—সে ছিল শিবু, বছর আটেকের এক ছেলেমানুষ। ওর বাবা সেই গ্যারেজে কাজ করত, আর আমাকে তৈরি করেছিল তাঁরই…
-
ঐশী মল্লিক শুরুর চা, শুরুর স্বপ্ন শহরের ঘুম তখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। কলকাতার গলি গলি জেগে উঠছে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে। হাওড়ার চায়ের দোকানগুলোর মধ্যে অন্যতম লালদার ছোট্ট দোকান। ছোট টিনের চালা, কাঁচের বয়ামে বিস্কুট, আর সিগারেটের গন্ধে ভাসা একটা সকাল। এখান থেকেই শুরু আমাদের পথচলা—স্বাদের পথে, মানুষের পথে, গল্পের খোঁজে। আমরা পাঁচজন। আমি ঐশী, আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রিমা, ওর বর রজতদা, আমার ভাই নীল আর ড্রাইভারের আসনে থাকা বিজয়। আমাদের গন্তব্য—ডুয়ার্স, শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং। তবে লক্ষ্যটা শুধু জায়গা দেখা নয়। লক্ষ্য হলো—প্রত্যেক জায়গার খাবার চেনা, অনুভব করা। তাই তো আমরা একে বলছি ‘খাবার-ভ্রমণ’, বা সহজ কথায়—স্বাদের পথচলা। …