দীপক সাহা শহরের নিস্তব্ধ সকালের আলোয় যখন পত্রিকার পাতায় পাতায় ছাপা হচ্ছিল গত রাতের নানা খবর, তখনই মানুষের চোখে ধরা দিল এক অস্বাভাবিক শিরোনাম—“বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর অরিন্দম রায় হঠাৎ নিখোঁজ।” খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই সারা শহরে আলোড়ন। যে মানুষটি তার তুলি আর রঙের যাদু দিয়ে বিশ্বকে বারবার অবাক করেছে, যার চিত্রকর্ম একেকটা প্রদর্শনীতে কোটি টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়, তিনি নাকি হঠাৎ করেই উধাও! অরিন্দম ছিলেন শুধু শিল্পী নন, তিনি ছিলেন এক ধরনের দর্শন—রঙের ভেতরে মানুষের অজানা ভয়, দুঃখ, ভালোবাসা আর মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, যেন প্রতিটি ছবিই জীবন্ত হয়ে ওঠে। এমন এক মানুষ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে তা সাধারণ…
-
-
অনিরুদ্ধ পাল পর্ব ১ : অচেনা খাম কলকাতার রাত তখনও ভিজে আছে বৃষ্টির রেশে। অগণিত গলিপথের আলো ঝাপসা হয়ে আছে টলোমলো কুয়াশার মতো বাষ্পে। উত্তর কলকাতার প্রাচীন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা এক ডাকবাক্সে কে আর খাম ফেলে যায় আজকাল? লাল রঙ চটকে গেছে, গায়ে শ্যাওলা জমেছে, ছিদ্র দিয়ে ইঁদুর ঢোকে আর বেরোয়। বহু বছর ধরে অচল পড়ে থাকা সেই বাক্সটা হঠাৎই যেন আজ তাকে ডাকছিল। রুদ্র সেদিন রিপোর্টিং শেষে ফেরার পথে এক সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল বাক্সটার সামনে। চোখে পড়ে অদ্ভুত এক খাম—মোটা বাদামি কাগজে মোড়া, তার নামটা লেখা একেবারে কালো কালি দিয়ে স্পষ্ট অক্ষরে: “রুদ্র সেন”। বুকের…
-
ঋত্বিক দাশগুপ্ত পর্ব ১ : হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি কোলকাতার পুরোনো উত্তর শহরের ভাঙাচোরা গলির ভেতর এক নিস্তব্ধ বিকেলে অরিন্দম দত্ত নিজের বাবার কাঠের আলমারিটা খুলে বসেছিল। ধুলো জমে থাকা পুরোনো কাগজ, শুকনো কালির দাগ, আর অচেনা হিজিবিজি আঁকায় ভর্তি খাতাগুলো সবসময়ই তাকে টানত। বাবা ছিলেন একসময়ের ভ্রমণপিপাসু, যিনি চাকরি আর সংসারের চাপে সেই টানকে গুছিয়ে রেখেছিলেন আলমারির অন্ধকারে। বাবার মৃত্যুর দু’বছর পরেও অরিন্দম প্রায়ই এই আলমারিটা খুঁজে খুঁজে দেখত, যেন কোথাও লুকিয়ে আছে বাবার জীবনের অজানা কোনো গল্প। সেই বিকেলেই তার চোখে পড়ল চামড়ার মলাট বাঁধানো এক ডায়েরি। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো ছুঁয়ে অরিন্দমের শরীরে কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ জাগল।…
-
১ কলকাতার উত্তর শহরের ভেতর একসময়ের জমজমাট থিয়েটার আজ ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকের দেওয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে দাগ, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে, অডিটোরিয়ামের আসনগুলোতে ধুলো জমে পাহাড়ের মতো স্তূপ তৈরি হয়েছে, অথচ সব্যসাচী সেনের চোখে যেন অন্য এক স্বপ্ন ভেসে উঠেছিল। সে অনেকদিন ধরে ভেবেছিল তার নতুন নাটক কোথায় মঞ্চস্থ করবে—এমন জায়গা চাই যেখানে কেবল আলো-শব্দের খেলা নয়, জায়গাটাই যেন নাটককে জীবন্ত করে তুলতে পারে। যখন প্রথম এই ভাঙাচোরা থিয়েটারের ভেতর পা রাখল, তখনই অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতল স্রোত তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে, অথচ সেই শীতলতার ভেতরেই যেন জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের কৌতূহল। কুহু মুখার্জী, নাটকের নায়িকা, প্রথম দিনেই…
-
রজত মিত্র অধ্যায় ১ – অর্ণব সেনের স্টুডিওটা যেন এক অন্যরকম জগৎ। শহরের ব্যস্ততার ভিড় থেকে কিছুটা দূরে, উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির ছাদের ঘরটিকে সে নিজের সৃজনশীল আশ্রয় বানিয়েছে। ঘরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে নানা রঙের টিউব, তুলি, পুরনো ক্যানভাস আর অর্ধেক আঁকা ছবির স্তূপ। জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে, ধুলো জমা কাঠের মেঝেতে আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ছে, আর বাতাসে মিশে আছে টারপেনটাইন আর জলরঙের ঘ্রাণ। অর্ণবের জীবন মূলত এই চার দেয়ালের ভেতরেই আবদ্ধ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় নেই, কেবল মাঝে মাঝে চিত্রপ্রদর্শনীতে হাজির হয়ে কিছু চেনাজানা মুখকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তাকে…
-
অর্ণব দাশগুপ্ত পর্ব ১: লাল সূচকের সকাল শেয়ার বাজারের দালালদের জীবনকে বাইরের লোকেরা চকচকে ভেবে নেয়। যেন প্রতিদিনই টাকার বৃষ্টি হয়, প্রতিটি ডাকে লেনদেনের ঝলমলে খেলা। কিন্তু ভেতরে যারা থাকে, তারা জানে আসলে কেমন চাপ, কেমন দমবন্ধ করা দৌড়, আর কেমন গোপন ভয়ের সঙ্গে প্রতিদিনের হিসাব মেলাতে হয়। সৌমিক চৌধুরী সেই ভেতরের মানুষ। সবার কাছে সে “সৌমিক দা”—কলকাতার ডালহৌসির এক পুরোনো শেয়ার ব্রোকারেজ অফিসের নির্ভরযোগ্য দালাল। তার হাতে ক্লায়েন্টরা তাদের সঞ্চয় তুলে দেয়, তাদের স্বপ্ন, তাদের ভরসা। আজকের সকালটা শুরু হয়েছিল আশ্চর্যভাবে ভারী এক নীরবতায়। টিভির স্ক্রিনে তখনও বাজার খোলেনি, কিন্তু সূচকের আগে-পরে ছুটে চলা লাল আর সবুজ রেখাগুলো যেন…
-
এক ড. অমিতাভ সেনগুপ্ত ছিলেন দেশের অন্যতম খ্যাতিমান পদার্থবিদ, যিনি সময় ও শক্তি-সম্পর্কিত গবেষণায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি, উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ি, যেন বিজ্ঞান আর প্রাচীনতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন—একদিকে আধুনিক ল্যাবরেটরি, অন্যদিকে কাঠের আসবাব, পুরনো বইয়ের তাক, আর দেয়ালে টাঙানো বিরল ঘড়ি। সেই বাড়ির স্টাডি রুমে, এক শীতল নভেম্বরের রাত, পুলিশ এসে দেখতে পেলেন—ড. সেনগুপ্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর ডান হাত ছড়ানো, মুখে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। চোখ আধখোলা, যেন মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি কিছু দেখেছিলেন যা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঘরের বাতাসে ভাসছে পুরনো কাঠের গন্ধ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা হাওয়া, আর দেয়ালে…
-
প্রিয়ম চক্রবর্তী শরতের শেষ ভাগ, আকাশে তুলোর মতো ভাসমান মেঘ আর বাতাসে ধানের গন্ধ মিশে আছে। কলকাতার ইতিহাসবিদ অনিন্দ্য মুখার্জী ও তাঁর স্ত্রী সায়ন্তী ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে, যেখানে স্থানীয় কলেজে আয়োজিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও লোককথা নিয়ে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হবে অনিন্দ্যকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন্তী ক্যামেরা হাতে ধানক্ষেত, নদীর ধারে চরাচর, আর মাটির ঘরের ছবি তুলছিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের সরলতা সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ রাখে, আর অনিন্দ্যর কাছে লোককথা মানে ইতিহাসের ভেতরে লুকোনো এক অদেখা দরজা। সেমিনার ভেন্যুটি ছিল গ্রামপঞ্চায়েত ভবনের বড় হলঘর, যেখানে বাঁশের মাচা দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, কাগজের…
-
প্ৰদীপ্ত গুহ ১ অভিজিৎ ও মীরা যখন নিউটাউনের নতুন ফ্ল্যাটে প্রথম দিন পা রাখল, তখন তাদের চোখে ছিল একেবারে অন্যরকম আলো। দীর্ঘদিন ধরে যেই মুহূর্তের অপেক্ষায় তারা ছিল—নিজেদের একান্ত ঘর, নিজেদের সাজানো সংসার, অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তব হলো। ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মীরা প্রথম হাসল, তার চোখে ছিল আনন্দ আর আবেগের মিশেল। লিভিং রুমে ঢুকেই বড় বড় জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া সকালের রোদ তাদের গায়ে পড়ল, যেন সেই আলোও তাদের নতুন সূচনার সাক্ষী হতে চাইছে। অভিজিৎ সবকিছু লক্ষ্য করে মনে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পেল, এতদিনের পরিশ্রমের পর অবশেষে সে…
-
প্ৰদ্যুত হালদার অধ্যায় ১ : কনটেইনারের গোপন রহস্য হাওড়ার শালিমার রেলইয়ার্ড রাতের আঁধারে যেন এক অন্য জগৎ। দিনের কোলাহল, গাড়ির গতি, রেলস্টেশনের ভিড় সব মিলিয়ে এ জায়গাটির অস্তিত্ব কেউ টেরই পায় না। কিন্তু গভীর রাত নামলে, ফাঁকা ফাঁকা রেললাইনগুলোর পাশে লম্বা সারিতে দাঁড়ানো পুরোনো মালগাড়িগুলো অদ্ভুত এক ভৌতিক আবহ তৈরি করে। সেদিনও এমনই এক রাতে, যখন কুয়াশার আস্তর ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে, তখন শ্রমিকদের নজরে আসে এক পুরোনো কনটেইনারের দিক থেকে আসা তীব্র পচা দুর্গন্ধ। প্রথমে তারা ভেবেছিল ইঁদুর বা কুকুর মারা গেছে ভেতরে, কিন্তু গন্ধ যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হতে থাকে এর পেছনে কিছু ভয়ঙ্কর লুকিয়ে আছে। চারজন…