পাৰ্থ প্ৰতিম মুখার্জী পূর্ণিমার রাত ছিল শান্তিনিকেতনের। আশ্রমের চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, শুধু দূরে মাঠের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এমন রাতে আকাশে এক বিরল দৃশ্য ফুটে উঠল—দিগন্ত জুড়ে টানা লালচে আগুনের রেখা, যেন কেউ জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে দিয়েছিল আকাশের বুকের ভেতর দিয়ে। গ্রামের ছেলেরা উল্লাস করে চিৎকার করল—“উল্কাপাত!” মহিলারা মন্দিরের ঘন্টার শব্দ তুলল, ভাবল দেবতার আশীর্বাদ নেমে এসেছে। কিন্তু বৃদ্ধ লোকেরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তাদের চোখে ভয়, কপালে ঘাম, ঠোঁটে নিঃশব্দ ফিসফিসানি। তারা জানত, এটা কেবল কোনো নক্ষত্রপতন নয়—এটা “তান্ত্রিক পথ,” যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অন্ধকার ইতিহাস। বহু বছর আগে শোনা গিয়েছিল, এক তান্ত্রিক পূর্ণিমার রাতে এই…
-
-
অধ্যায় ১ – কালীঘাটের এক শীতল ভোরে, যেখানে কলকাতার ভিড় এবং অব্যক্ত কোলাহল দূরের মনে হয়, সেখানে এক প্রাচীন আশ্রমের ভিতরে রহস্যের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছিল। ভৃগুনাথ তান্ত্রিকের পুরনো মালা, যা বহু বছর ধরে মাটির ধুলো জমিয়ে রেখেছিল, হঠাৎ করেই ভিজে ওঠে টাটকা লাল রক্তে। আশ্রমের কাঠের মেঝে অন্ধকার এবং আর্দ্রতার সংমিশ্রণে যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে, আর মালার রঙের সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ। স্থানীয় বাসিন্দারা একে অমাবস্যার মতো কালো অঘটনের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখলেন; কেউ কেউ বললেন, “এটি মানুষের রক্ত নয়, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির ছাপ।” আশ্রমের পুরনো দেয়ালে ঝুলন্ত ছবি এবং তান্ত্রিকের প্রত্নচিহ্নগুলো যেন হঠাৎই জীবন্ত…
-
রূপসী সেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে গবেষণা করছে। তার প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু কাহিনি খুঁজে বের করা যা আধুনিক সমাজে হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থানীয় গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় সে শুনেছে এক রহস্যময় মঠের কথা, যেখানে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সংঘটিত হয় বলে মানুষের মধ্যে ভীতি ও কৌতূহল দুটোই বিরাজ করে। গ্রামের প্রবীণরা বারবার তাকে সতর্ক করেছে, “মঠে যেও না, রূপসী। সেখানে যে ঘটনা ঘটে, তা কল্পনার অতীতেও নেই।” রূপসী শুরুর দিকে ভয় পেয়েও গবেষণার প্রতি তার আকর্ষণ তাকে পিছনে সরাতে পারেনি। প্রতিটি লোককথা তাকে আরও গভীরে টানছে, যেন মঠের প্রতি একটি অদৃশ্য…
-
অগ্নিভ চক্রবর্তী ১ কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের পুরনো ভবনটার করিডোর সবসময়ই যেন একটু অন্ধকার আর আর্দ্র গন্ধে ভরা থাকে, বিশেষ করে বর্ষার রাতে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছে ঠান্ডা বাতাস, আর কোথাও দূরে হাসপাতালের করিডোরে ভিজে স্লিপারের শব্দ ভেসে আসছে। অয়ন মুখার্জী, তৃতীয় বর্ষের মেডিকেল ছাত্র, নিজের ঘরে বসে নোটস লিখছিল, কিন্তু মনটা অস্থির। সেদিন বিকেল থেকে বন্ধুর ফোনে কোনো উত্তর নেই—ঋত্বিক সেন, যে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, সবসময় সময়মতো খবর দেয়, তার এই নীরবতা অয়নকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ হঠাৎ পাশের ঘর থেকে আসা একটা ধাক্কার শব্দ অয়নকে চমকে দিল। শব্দটা…
-
সৌম্যজিত লাহিড়ী ১ অক্টোবরের সূর্য তখন রক্তিম হয়ে অস্ত যাচ্ছে, বিষ্ণুপুর শহরের উপর ধীরে ধীরে নেমে আসছে পুজোর সন্ধ্যা। বাঁকুড়ার ধুলোমাখা পথ পেরিয়ে ঋষভ সেনগুপ্ত তার DSLR-টা কাঁধে ঝুলিয়ে নামল লোকাল বাস থেকে। বেশ কিছুদিন ধরেই সে পরিকল্পনা করছিল দুর্গাপুজোর এক বিশেষ সিরিজ করবে — শহর থেকে দূরে, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এমন পুজো, যেগুলো এখন কেবল ইতিহাসের পাতায় টিকে আছে। বিষ্ণুপুরের এক স্থানীয় গাইড তাকে বলেছিল, শহরের প্রান্তে একটা পোড়া রাজবাড়ি আছে যেখানে কোনো এক সময় দুর্গাপুজো হত, আজ আর কেউ যায় না, কিন্তু একটা প্রতিমা নাকি এখনও প্রতি বছর বানানো হয় এবং অল্প কিছু মানুষ সেখানে পুজো করে। কৌতূহলবশত…
-
নীলাদ্রী সেনগুপ্ত ১ রুদ্র বসুর চোখে নদিয়ার এই ছোট্ট গ্রামটা ছিল শুধু আরেকটা বিনিয়োগের জায়গা, অথচ আজ যখন সে ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে পুরনো তাঁতকলের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার বুকের ভেতর যেন কিছু একটা গুমরে ওঠে। শহরের কোলাহল, ব্যস্ত কর্পোরেট দুনিয়া আর অবিরাম ডেডলাইনের জীবন থেকে বেরিয়ে রুদ্র এবার নিজের মতো করে কিছু শুরু করতে চায়—নিজের তৈরি কিছু, নিজের সিদ্ধান্তে। তাই তো সে কিনে নিয়েছে এই বহু বছর ধরে বন্ধ পড়ে থাকা, ধুলো-জমা এক তাঁতকল, যেটার ইটের গায়ে এখনও পুরোনো মসৃণতা আর গুমোট ঘামের গন্ধ লেগে আছে। কলের কেয়ারটেকার, বৃদ্ধ মদন, তাকে চাবি তুলে দেয় এক কথাও না বলে—শুধু একবার…
-
সৌমিক ভট্টাচার্য ১ পাহাড়ি রাস্তাগুলো যেন কোনও অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল অভিজিৎ সেনগুপ্তকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক, লোকবিশ্বাস এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল তার। একটি গবেষণা প্রকল্পের সূত্রে সে এবার রওনা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক অদ্ভুত দূরবর্তী গ্রামে—সিংরিপাহাড়। ট্রেন থেকে নামার পর পায়ে হেঁটে, জিপে চড়ে, শেষমেশ খচ্চর পিঠে চেপে পৌঁছাতে হয়েছিল তাকে সেই দুর্গম স্থানে। পাহাড়গুলো যেন দাঁড়িয়ে ছিল এক অভেদ্য প্রাচীর হয়ে—মানুষের সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ নিজেদের মতো করে সাজানো এক অলৌকিক গ্রাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছায়াঘেরা গাছপালা, পাথরের বাড়ি, আর সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে আসা কুড়িটি দরজা-জানালা। অভিজিৎ…
-
অভ্র মিত্র অধ্যায় ১: অমাবস্যার আগে শ্যামনগর—পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক নিঃস্তব্ধ গ্রাম, যেখানে রাত নামে আগেভাগেই আর কুকুর ডাকে না। চারদিকে যেন অদৃশ্য কিছু চেপে বসে, হাওয়া নিঃশব্দ হয়, আর মাটির ঘরের জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হয় না কোনও আলো। অমাবস্যা ঘনিয়ে এলে গ্রামের জীবন থমকে যায়, শিশুদের মুখে হাঁসি থাকে না, আর মায়েরা বাচ্চাদের চোখে কাজল পরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, যেন অজানা কিছু চোখে না পড়ে। শতবর্ষ আগের কথা, এক চণ্ডীপাঠের মঞ্চে নাকি অদ্ভুত এক যজ্ঞ হয়েছিল, যেখান থেকে এক আগুন উঠে পুরো মন্দির গ্রাস করে নেয়। তখন থেকেই চণ্ডীমণ্ডপ ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর ওই দিনটিকেই অনেকে গ্রাম ইতিহাসের বিভীষিকা বলে চিহ্নিত করে।…
-
তথাগত সান্যাল অধ্যায় ১: ডামরুর প্রথম ধ্বনি শিবরাত্রির রাত। হিমছোঁয়া বাতাসে ভেসে আসছে ধূপধুনোর গন্ধ, শালবনের ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটি ছুঁয়ে। উত্তর ত্রিপুরার অরণ্যঘেরা গুহামন্দিরে দাঁড়িয়ে ঋভু রায়চৌধুরী অনুভব করলেন—এ কেবল একটি সাধারন রাত্রি নয়। দিনদুয়েক আগেই কলকাতা থেকে আসার সময় লোকাল ড্রাইভার বলে দিয়েছিল, “এই মন্দিরে আজও কিছু ঘটে… বিশেষ করে শিবরাত্রির রাতে।” ঋভু প্রথমে হেসেছিলেন। তবে সেই হাসি চাপা পড়ে গেল, যখন তিনি ওই গুহার সামনে পৌঁছে এক ছায়াময় বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলেন—দাঁতহীন মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, গায়ে জটাধারী চেহারা, আর হাতে ছিল একটি পুরনো কাঠের বাক্স। বৃদ্ধ কোনও কথা না বলে কেবল ইশারায় বাক্সটি ঋভুর…
-
সুব্রত গাঙ্গুলি প্রতীক দত্ত, কলকাতার এক নামকরা দৈনিকের অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিক, চিরকাল যুক্তির পথ ধরেই হাঁটতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু কিছু ঘটনা এমন থাকে, যেগুলো যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়—এমনই এক ঘটনার পেছনে ছুটে সে এসে পৌঁছেছিল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক গ্রামে, নাম উজানডাঙা। শহর থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে, রুক্ষ কাঁচা রাস্তা ও নিস্তব্ধ পলিমাটির ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি—মহিমা চৌধুরী প্রাসাদ। এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কাহিনি তাকে টেনেছিল এখানে: প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির রাতে, বাড়ির মধ্যবর্তী ত্রিকোণ চত্বরে রাখা এক প্রাচীন ব্রোঞ্জের প্রদীপ নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে—কেউ জ্বালায় না, কেউ দেখেনি জ্বালাতে, তবুও জ্বলে। খবরটি প্রথম সে পায় এক…