শৌনক দে গ্রামের সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ সেন অনুভব করলেন যে, এখানে কোনো সাধারণ শীতলতা নেই; বরং এক অদ্ভুত শীতলতা আছে, যা হাড় কাঁপানোর মতো ঠান্ডা না হলেও, মনকে স্থির করে, চুপচাপ করে রাখে। গ্রামটি চুপচাপ, রাস্তার ধুলো উঠছে নিঃশব্দে, এবং বাতাসে যেন অদৃশ্য কোনো দমনের গন্ধ ভাসছে। গ্রামের মানুষের চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক, যা তাদের মুখের হাসিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তারা খুব সাবধানভাবে চলাফেরা করে, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ একটি ছোট কুঁড়েঘরের কাছে রিকশা থামালেন, যেখানে গ্রামের মানুষ সাধারণ জীবনযাপন করছে বলে মনে হলেও, তাদের আচরণে যেন প্রতিটি মুহূর্তে এক অনিশ্চয়তার চাপ…
-
-
কল্যাণ মুখার্জী শ্মশান ঘাটে সেই রাতে যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। চারিদিকে ঘন কুয়াশার চাদর, দূরে শ্মশানের পুরনো বটগাছের ডালে ডালে বাদুড়ের কর্কশ ডাক, আর মাঝেমধ্যেই কুকুরের হাহাকার যেন ভয়কে আরও ঘনীভূত করে তুলছিল। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার নয়, তবু পূর্ণিমার আলোয় চারদিক সাদা হয়ে উঠলেও সেই আলোতে ছিল এক অস্বাভাবিক রক্তাভ আভা। যেন চাঁদ নিজেও এই রাতের সাক্ষী হতে গিয়ে অচেনা কোনো রূপ ধারণ করেছে। গ্রামের মানুষজন শ্মশানের সীমানা থেকে দূরে, পুকুরপাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে তাকিয়ে ছিল। কারও চোখে ভীতি, কারও চোখে কৌতূহল, কিন্তু সবার মনে একই প্রশ্ন—আজ রাতেই কি ভৈরবনাথ তাঁর বহুদিনের সাধনার সফলতা অর্জন করতে চলেছে? সেই…
-
অংশুমান রায় ঋদ্ধির আগমন কলকাতার শীত তখন পড়তে শুরু করেছে, তবে হাওয়ার ধার এখনো নরম। সন্ধের আলোয় গড়িয়াহাটের মোড় থেকে দক্ষিণে যে রাস্তা নেমে গেছে, সেই ফুটপাথগুলো ভরে উঠছে শালপাতার ধোঁয়া, ভাজা মুড়ির গন্ধ, আর দোকানিদের চেঁচামেচিতে। ড. অনির্বাণ দত্তের চেম্বার এই মোড় থেকে দশ মিনিট হাঁটাপথ। তিনতলা পুরনো বাড়ির দ্বিতীয় তলায়, কাঠের পালিশ করা দরজা, পাশে ছোট পিতলের নেমপ্লেট — Dr. Anirban Dutta, Consultant Psychologist. চেম্বারের ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। দিনের শেষ রোগী চলে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। অনির্বাণ ডেস্কে হেলান দিয়ে কাগজপত্র গুছাচ্ছিলেন, তখনই নিচের দারোয়ান কাঁচা গলায় ডাকল, — “ডাক্তারবাবু, একজন এসেছেন… বলছেন খুব জরুরি।” তিনি চোখ তুলে…
-
রজত মিত্র দূরপাল্লার লোকাল ট্রেনটা ধীরে ধীরে গ্রামের ছোট্ট স্টেশনে এসে থামল। বিকেলের নরম আলোয় প্ল্যাটফর্মটা যেন হালকা সোনালি ধুলোয় মোড়া। ট্রেন থেকে নেমে চারপাশের নিস্তব্ধতা অনুভব করতেই মোহনাদের কলকাতার কোলাহলের সঙ্গে একেবারে বিপরীত এক জগৎ মনে হল। হাতে ছোট্ট ট্রলিব্যাগ, আর কাঁধে স্লিংব্যাগ নিয়ে সে স্টেশনের গেট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। গ্রামের রাস্তা নির্জন, দু’পাশে শিউলি আর শালবনের সারি। দূরে দেখা যায়, ধূসর এক প্রাসাদসদৃশ বাড়ি, আকাশের নিচে একাকী দাঁড়িয়ে আছে—সেটাই রায়চৌধুরী বাড়ি। বাবার মুখে অনেক শুনেছে এ বাড়ির গল্প, কিন্তু বাস্তবে দেখে যেন বুকের ভিতরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। অটোরিকশা চালক যখন ভাড়া নেওয়ার পর তার দিকে একবার…
-
তপন কুমার মুখার্জী ১ শীতের শেষ দিকের একটি সকাল। কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমানগামী লোকাল ট্রেনটি ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে এগোচ্ছে। জানালার ধারে বসে আছেন ড. অরিন্দম মুখার্জি—চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, কোলের উপর মোটা নোটবুক আর কলম। বাইরে শস্যক্ষেত, তালগাছ, আর মাঝেমাঝে কুয়াশা ভেদ করে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ কুঁড়েঘর। অরিন্দম ইতিহাসের ছাত্র নন, বরং ইতিহাস তাঁর জীবনের অনিবার্য এক নেশা। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক, পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে এখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। তাঁর থিসিসের বিষয়—বঙ্গের জমিদারি যুগের শেষভাগে তান্ত্রিক আচার ও স্থাপত্য। মাসখানেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে পুরনো নথি ঘাঁটতে গিয়ে তিনি প্রথম ‘চন্দ্রমণ্ডপ’-এর উল্লেখ পান—একটি পাথরের বেদি,…
-
১ প্রাচীন কাল থেকে গ্রামটির নাম শিউলিবাড়ি, তবে এই নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে বহু গোপন কাহিনি। গ্রামের উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ প্রাচীন তন্ত্রপীঠ মন্দির, যার কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কানে কানে পৌঁছেছে। লাল ইটের গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে, ফাটল ধরা প্রাচীর থেকে গাছের শিকড় নেমে এসেছে যেন সময়ের আঁচড়। জনশ্রুতি আছে, এই মন্দির একসময় এক তান্ত্রিক রাজা নির্মাণ করেছিলেন, যিনি দেবীর কৃপা পাওয়ার জন্য নরবলি পর্যন্ত দিতেন। গ্রামের বয়স্করা বলেন, মন্দিরের অন্তঃকক্ষে এক গোপন দরজা আছে, যার ওপারে বন্দি রয়েছে এক অদ্ভুত অলৌকিক শক্তি—শক্তি, যা একবার মুক্তি পেলে সমগ্র অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। দিনের বেলাতেও মন্দিরের ভেতরে…
-
অরুণাভ বসু অমাবস্যার সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই আকাশে অদ্ভুত একটা চাপা গুমোট তৈরি হয়েছিল, যেন দিনের আলোও বাতাসে লুকিয়ে থাকা অজানা আশঙ্কাকে অস্বীকার করতে পারছিল না। নীরজ সেই সকাল থেকেই গুরুর নির্দেশমতো ঘর ছাড়িয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিস জোগাড় করতে বেরিয়েছিল—একটি প্রাচীন লাল কাপড়ের টুকরো, কালো মোমবাতি, শিবের জীর্ণ মূর্তি, আর সেই দুর্লভ পুঁতির মালাটি, যা এক সময় গুরুর গুরু তার হাতে তুলেছিলেন। প্রতিটি জিনিস যেন নিজের ভেতর গোপন কোনো স্পন্দন বহন করছিল, নীরজ মনে মনে বুঝতে পারছিল, এ রাত শুধু আরেকটা সাধনার রাত নয়; এ রাতে এমন কিছু ঘটতে চলেছে, যার ওজন বহন করা সহজ নয়। শহরের ভাঙা প্রাচীন অলিগলি,…
-
অগ্নিভ বসু ১ মেঘে ঢাকা আকাশ, ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার চাদরে মোড়া বাঁকুড়ার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি জিপ। স্টিয়ারিংয়ের পাশে বসে ডঃ নীলাভ মুখার্জী ডায়েরির পাতায় অস্থির হাতে কিছু নোট নিচ্ছিলেন—যার বেশির ভাগই ছিল স্থানীয় পুরাতাত্ত্বিক মানচিত্রের হালনাগাদ তথ্য। তাঁর মুখে সিগারেট, চোখে ক্লান্তির ছাপ। পেছনে বসে ছিলেন গবেষক মালবিকা রায়, যিনি জানালার কাঁচ সরিয়ে বাইরের পাহাড়ঘেরা দিগন্তে তাকিয়ে ছিলেন, যেন কোন কিছু চেনার চেষ্টা করছেন—যা হয়তো কোনো ছবি বা কাহিনি পড়ে মনে গেঁথে গিয়েছিল। গাড়িচালক রঘু হাঁসদা হঠাৎ বলে উঠল, “আর একটু সামনে গেলেই গোবিন্দপাহাড়পুর, বাবু। আপনারা যেই দেউলের খোঁজ করছেন, সেটার ধ্বংসস্তূপ ওই গ্রামের ওপারেই। তবে লোকজন…
-
মৈনাক ভৌমিক ১ পুরুলিয়ার চন্দনবন — নামটি আজও অনেকের কাছে অজানা, যদিও লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা বহু গল্পের কেন্দ্রবিন্দু এই অরণ্য। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলটি আদিবাসী জনপদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলে ভরপুর, যেখানে আজও সূর্যাস্তের পর কেউ একা পথ মাড়ায় না। অথচ সেখানেই, এক শতাব্দী পুরনো ব্রিটিশ জরিপ মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া এক দাগচিহ্ন—“K.T. Akhra (Abandoned)”—ডঃ ঋত্বিক বসুর চোখে পড়ে। বহুদিন ধরে প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রচর্চা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসা এই প্রত্নতত্ত্ববিদ তার টিম নিয়ে রওনা দেন চন্দনবনের উদ্দেশ্যে। তাঁর দলের সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের গবেষক ইরা সেনগুপ্ত, ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর অভীক মণ্ডল, তথ্যলিপিকার তৃষা দে এবং স্থানীয় গাইড হিসেবে নিযুক্ত হন নিতাই মাহাতো,…
-
অধ্যায় ১: চিঠির মতো নিঃশব্দ পাহাড়ে ওঠার পথে হঠাৎ করে কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ট্রেকিং পাথ বেয়ে যে ঘোড়ামারা ডাকে ওঠা গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল অভিজিৎ সরকার, তার চারপাশে যেন হঠাৎই সময় থমকে গেল। বালির কাঁধে বয়ে আনা ছোট স্যুটকেস, একটা জলচৌকো ব্যাগ আর হাতে ধরা সরকারি ফাইলের খাম—সবই ভার হয়ে উঠল যেন হঠাৎ। এই ডাকঘরটা, পুরুলিয়ার এক পাহাড়ি অঞ্চলের প্রান্তে অবস্থিত, বহু বছর আগেই তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে রেকর্ডে লেখা ছিল। কিন্তু হেড অফিস থেকে অদ্ভুত এক চিঠির সূত্র ধরে, তাকে বদলি করা হল এই ‘বন্ধ’ ডাকঘরে। সে ভেবেছিল হয়তো কোনো ফাইলের গরমিল, অথবা ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু বদলিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন…