অধ্যায় ১ – সাধকের যাত্রা অশ্বিনের জীবন শুরু হয় এক শান্ত গ্রামের পেছনের গাঁয়ের ছোট্ট আশ্রম থেকে, যেখানে প্রতিটি সকাল কীর্তনের স্বরে ভরে ওঠে এবং প্রতিটি সন্ধ্যা নির্জন প্রার্থনার আবেশে মিশে যায়। কিন্তু অশ্বিনের অন্তরে কেবল শান্তি নয়; ছিল এক গভীর অন্বেষণ, এক অদৃশ্য আগ্রহ যা তাকে গ্রামের সীমারেখার বাইরে পাঠিয়েছিল। তার চোখে অনন্তের খোঁজ, মনে অচেনা জ্ঞান অর্জনের তীব্র বাসনা। প্রতিদিন সে গ্রাম্য বেদে বসে বৃদ্ধ সাধকদের শিষ্যত্বের পাঠ শোনে, তবুও তার হৃদয় চাইল আরও বড় কিছু, এমন কিছু যা তার আত্মাকে শুদ্ধ করবে এবং তাকে মৃত্যুর পরে মুক্তির আলো দেখাবে। এই আত্মার তৃষ্ণা তাকে ধীরে ধীরে আশ্রমের সীমানার…
-
-
তমাল রায় ১ অর্ণব যখন প্রথমবার নির্জন শ্মশানঘাটের ধুলোমাখা পথ পেরিয়ে প্রবেশ করল, তখন রাতের আকাশে চাঁদটি অর্ধেক আকারে ঝুলছিল। আশ্রমের চারপাশে বন এবং মৃত গাছের ছায়া মিলেমিশে এক অদ্ভুত নিরবতা তৈরি করেছিল। পায়ে পাথরের শব্দ পড়লেই যেন সারা আশ্রম প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। অর্ণবের বুক ভরা অস্থিরতা ও উত্তেজনা এক সময়ে তার মনকে জ্বলতে বসিয়েছে। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সে ধীরে ধীরে তার তন্ত্রসাধনার স্থানটি নির্ধারণ করল—একটি পুরনো শ্মশানঘাটের ধারে, যেখানে আগের কেউ খুব কম প্রবেশ করেছে। আশ্রমের প্রবেশ পথের গাছগুলো যেন তাকে সতর্ক করে বলছিল—“এই জায়গায় প্রতিটি ছায়া চোখ রাখে।” অর্ণব জানত, এখান থেকে তার সাধনা আর কোনো সাধারণ পথে যাবে…
-
আত্রেয়ী বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যায় ১: হারানো মুখ হাসপাতালের করিডোরটা ঠান্ডা আর ধূসর, যেন কাঁচের খাঁচায় আবদ্ধ কোনো অদৃশ্য বিষাদ। অর্ঘ্য সান্যাল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল—তার হাতের মুঠোয় একটুকরো পুরনো ছবি, যেখানে ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে হাসছে; পরনে হলুদ ফ্রক, গলায় একটি লাল হৃদয় আকৃতির লকেট। পাশেই এক কিশোর ছেলেকে দেখা যাচ্ছে—চোখেমুখে দায়িত্ব, একরাশ ভালোবাসা। ছবিটার নিচে কালি দিয়ে লেখা—“দাদা আর রাত্রি, পুরুলিয়া ভ্রমণ, ২০০৩।” অর্ঘ্য ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে, গভীর শ্বাস নেয়। তারপর চোখ মেলে চুপিচুপি ফিসফিসিয়ে বলে, “আমি এবারও তোর কাছে পৌঁছাব, রাত্রি।” বিগত বিশ বছর ধরে তার এই কথাটুকু বদলায়নি, শুধু মানুষটা বদলে গেছে—বিজ্ঞানমনস্ক থেকে সে…
-
১ ঋভু সেনগুপ্ত ভোরবেলা কলকাতা থেকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেই বুঝে গিয়েছিল—এই যাত্রা তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত আর অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে। সাংবাদিক জীবনে সে বহু ঘটনা দেখেছে, বহু মানুষ, কিন্তু এমন এক গুহার অস্তিত্ব—যেখানে আজও ‘দক্ষিণাগ্নি’ নামে তান্ত্রিক যজ্ঞ হয়, তা শুনে প্রথমে অবিশ্বাসই করেছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেই তার হাতে এসে পড়েছিল এক পুরনো চিঠি, যা লিখেছিলেন একজন মৃত প্রত্নতত্ত্ববিদ—ড. বিভাস মুখোপাধ্যায়। চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত এক অরণ্যঘেরা গুহার, যেখানে “দেহান্তরণ” নামক এক প্রাচীন তন্ত্রচর্চা আজও গোপনে চলে। চিঠিতে লেখা ছিল একটি মাত্র লাইন: “যদি সত্য জানতে চাও, তবে আগুনকে ভয় পেও না। দক্ষিণাগ্নি সব জানে।” সেই লাইন…
-
সুমন দাস ১ শিলচরের একান্ত কোণে, যেখানে সরু গলি ছুঁয়ে উঠে যায় পাহাড়ের ঢালে এবং সেখানেই ছড়িয়ে আছে কামাক্ষ্যা মন্দিরের প্রাচীন কমপ্লেক্স—সেখানকারই এক জনমানবহীন অংশে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ পুরোনো গ্রন্থাগার, ‘তান্ত্রচক্র পাঠাগার’। লাল ইটের দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, কাঠের জানালার পাল্লা আধা খোলা, যেন কেউ সদ্যই ভিতরে ঢুকেছে—বা বেরিয়ে এসেছে। এখানে কর্মরত গ্রন্থাগারিক সায়ন্তন রক্ষিত, নিজেকে খুব সাধারণ মানুষ বলেই ভাবেন। ইতিহাসের ছাত্র হলেও জীবনের কোনো দিকেই তিনি সাহসী পদক্ষেপ নেননি। দিনগুলো কাটে ধুলো ঝাড়া, বই গোছানো, আর কামাক্ষ্যার মন্দিরে যাত্রার আগে কিছু সাধুদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কিন্তু সেইদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিক। বাতাসে এক রকম কাঁপুনি ছিল, এবং গ্রন্থাগারে ঢোকার মুখে…