বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় হিমালয়ের বুক চিরে উঠে যাওয়া সেই সরু আঁকাবাঁকা পথটায় যখন চারজন অভিযাত্রী প্রথম পা রাখল, তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। আকাশের রঙ ধূসর, তবে মেঘের আড়ালে সূর্য মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যেন সতর্ক করে দিচ্ছে—এই পথে চলা সহজ হবে না। অভিজিৎ সেনগুপ্ত, অভিযানের দলনেতা, একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে বহু দুর্গম পাহাড়, পরিত্যক্ত গুহা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদ চষে বেড়িয়েছেন, কিন্তু আজকের গন্তব্য নিয়ে তাঁর মনে সন্দেহ কাজ করছিল। এই ‘তপোবন’ সম্পর্কে যা কিছু জানা গেছে, তার সবটাই টুকরো টুকরো, বিপজ্জনকভাবে অস্পষ্ট। ঋদ্ধিমা ধর, তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং নৃবিজ্ঞানী, এক প্রাচীন পোড়াদেওয়ালের গায়ে পাওয়া খোদাই দেখে এই তপোবনের সম্ভাব্য অবস্থান চিহ্নিত করেছিলেন।…
-
-
তপতী ঘোষাল ১ ঝাড়গ্রামের পাতাঝরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছে একটা পুরনো জিপ, যার ইঞ্জিনের গর্জন আর পেছনের চাকার কাদামাখা ঝাঁকুনিতে ভেসে যাচ্ছে অরণ্যের শান্তি। বসন্তের শেষ সপ্তাহ, গাছগুলো যেন নিজেদের সবুজ পোশাক খুলে রেখেছে – পাতাগুলো শুকিয়ে পড়ে আছে মাটিতে, যার উপর গাড়ির টায়ার টেনে দিচ্ছে সরু দাগ। জিপের ভিতর বসে থাকা স্পেনীয় গবেষক ড. লুইস রডরিগেজ জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলেন—একটা কালো কুড়ুলের মতো আকৃতির কিছু খুব দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে গেল। পাশে বসা স্থানীয় গাইড গঙ্গা হাঁসদা বলল, “এইসব কিছু না স্যার… সাপেরা এই সময় খুব সক্রিয় থাকে।” লুইসের ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল। সে বহুদিন ধরেই…
-
মণিষা মুখোপাধ্যায় অধ্যায় ১: “চিত্রের টানে” কলকাতার ছিমছাম ফ্ল্যাটে বসে ঐশী সেন তার স্কেচবুক আর ল্যাপটপের মাঝে ডুবে ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনায়। পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প নিয়ে তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্প, বিশেষ করে চালচিত্র। চালচিত্র—বাংলার মন্দিরের চাল বা চূড়ার নিচে আঁকা একরকম ন্যারেটিভ চিত্রপট, যা দেব-দেবীর কাহিনি বা পুরাণকথা বলে দেয়। কিন্তু বাঁকুড়ার ‘ধনেশ্বরপুর’ নামের একটি ছোট্ট গ্রামে একটি পরিত্যক্ত মন্দির আছে, যার চালচিত্রে নাকি পুরাণ নয়—তান্ত্রিক চিত্র রয়েছে। তার অধ্যাপক, ডঃ রূপক দত্ত, এই মন্দিরের একটি কালো-সাদা ছবির কপি ঐশীকে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “এটা কিছুটা ব্যতিক্রমী। তুই চাইলে এইটার উপর কাজ করতে পারিস, কিন্তু সাবধানে।” ঐশীর মন…
-
অদ্রীশ চক্রবর্তী ১ শৌভিক দত্তের চোখের সামনে পুরনো ছাপাখানার প্রেস মেশিন ক্রমাগত ক্লিক করতে থাকল। ঢাকা গলির ভেতরে, এক কোণে ছাপাখানাটি ঘরছাড়া ও বড্ড পুরোনো হয়ে পড়েছে। দিন-রাত কর্মচারীরা যন্ত্র চালায়, কিন্তু আজ সকালে কিছু অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। পেছনের ডেস্কে বসে ছিল শৌভিক, হাতে ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত কিছু অর্ডার, তবে একটার মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। “এই অর্ডারটা কোথা থেকে এল?” শৌভিক মনে মনে প্রশ্ন করছিল। এই অর্ডারের ঠিকানা ছিল রহস্যময় এবং পুরোপুরি অচেনা—”অনন্তপুর, গোধূলি প্রান্তে”। তাছাড়া, যে-ই অর্ডারটি দিয়েছিল, তার নাম লেখা ছিল “প্রেরক অজ্ঞাত”। এই ধরনের অর্ডার তো কখনো আসে না! তবে অদ্ভুত এক জিনিস ছিল—অর্ডারটি…
-
অরুণাভ ভট্টাচার্য ১ সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু কালীঘাটের শ্মশানে সেই আলো-আঁধারির খেলা যেন কালেরও ঊর্ধ্বে। পুরনো বটগাছের গায়ে লেপ্টে থাকা শ্যাওলার মতো এক ধরণের অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল চারপাশে। অগস্ত্য ধীর পায়ে ঢুকল ভেতরে। মাথায় পুরনো ছাইরঙা চাদর, চোখে লালসালুকে ছেয়ে যাওয়া অভ্যস্ত দৃষ্টির অভিব্যক্তি — এক সমাজচ্যুত তান্ত্রিক, যার নাম এখন আর কেউ স্মরণ করে না। কেউ বলে সে পাগল, কেউ বলে অভিশপ্ত, কিন্তু সে জানে — সে ফিরে এসেছে শ্মশানে একটা মাত্র মুখ খুঁজতে, যেটা তার নিজের। এখানে, এই আগুন আর ছাইয়ের ভেতরে লুকিয়ে আছে সেই মুখ — পাঁচ মুখো তান্ত্রিকের একটি অংশ — যে নাকি শুধুমাত্র…
-
রিতা সুর চৌধুরী এক শ্মশানের নরম সাদা ছাই আর কালো পাথরের ফাঁক দিয়ে বেরোনো ধোঁয়ার মতোই নিঃশ্বাস নিত রুদ্রনাথ—যেন প্রাচীন কালের অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিয়েছে আর ছাড়তে চায় না। এক সময় তান্ত্রিকদের মধ্যে যার নাম ছিল সম্মানের, সেই রুদ্রনাথ আজ শুধু অন্ধকার আর ব্যর্থতার এক জীবন্ত প্রতিমা। চোখের তলায় গভীর গর্ত, কপালে কালি আর রক্তের তিলক, ছেঁড়া গেরুয়া বসনে জড়ানো দেহ আর হাতের শিরাগুলোতে শুকিয়ে যাওয়া তেলের গন্ধ—সব মিলিয়ে এক পচন ধরা সাধকের চেহারা। শ্মশানটি সেই সময় প্রায় পরিত্যক্ত; মাঝে মধ্যে শুধু মৃতদেহের মিছিল এসে পুড়ে যায়, ধোঁয়ার সাথে মিলিয়ে যায় কান্নার শব্দগুলো। রুদ্রনাথের তন্ত্রের আসন সেই চিতা ভস্মের…
-
তপন রুদ্র চাঁপারডাঙা গ্রামে অভিরূপ যখন প্রথম পা রাখল, তখন সন্ধ্যার আলো একে একে গিলে নিচ্ছিল ঝোপঝাড়, কুঁড়েঘর আর ধুলোভরা কাঁচা পথ। কাঁকনজঙ্গল পেরিয়ে যে লোকালয়, সেখানকার মানুষজন ঠোঁট চেপে কথা বলে। অথচ তারা কথা বলে না, এমন নয়। শুধু অভিরূপ লক্ষ্য করেছিল—কোনো কিছু যেন তাদের চোখের পেছনে আটকে থাকে। কী যেন এক অজানা আশঙ্কা, ঠিক ধরা যায় না, ছুঁয়ে ফেলা যায় না, কিন্তু টের পাওয়া যায় বাতাসে, গন্ধে, চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে। অভিরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে একটি এনজিও-র টিচিং প্রজেক্টে চাকরি নিয়েছে। গ্রামবাংলায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার নোবেল মিশন। তৃতীয় পোস্টিং এই চাঁপারডাঙা। এর আগেও দু’টি গ্রামে…