অভ্রাংশু দত্ত অধ্যায় ১ – হারানো পান্ডুলিপি কলকাতার রাত কখনোই পুরোপুরি ঘুমোয় না। দক্ষিণ শহরতলির রাস্তাগুলোতে আলো-অন্ধকারের খেলা যতই সস্তা ল্যাম্পপোস্টে ঝিলমিল করুক, কালীঘাট মন্দির চত্বর যেন অন্য এক জগতের ছায়ায় ঢাকা থাকে। মন্দিরের চৌহদ্দিতে শঙ্খ আর ঘণ্টার ধ্বনি মিলেমিশে যায় গঙ্গার স্রোতের দূরবর্তী শব্দের সঙ্গে। কিন্তু আজ রাতটা অন্যরকম। অয়ন মুখার্জি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, হাতে একটি পুরনো টর্চ আর নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ প্রাচীরের কাছে—যেখানে সাধারণ ভক্তরা কখনো যায় না। সে আসলে খুঁজছে এক গোপন সূত্র। সপ্তাহ খানেক আগে মন্দিরের পুরনো ভাণ্ডারঘরে সংস্কারের সময় মজুরেরা ভাঙা ইটের দেয়ালের ফাঁক থেকে একটা অদ্ভুত কাগজের খণ্ড পেয়েছিল। হলদেটে, প্রায় ঝুরঝুরে…
- 
				
 - 
				
অপূর্ব ঘোষ অধ্যায় ১ – আগমন ভুবনেশ্বরের কোলাহল পেরিয়ে যখন গাড়ির চাকা ধুলো উড়িয়ে হিরাপুর গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় ঢুকল, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, যাদের চোখে স্পষ্ট কৌতূহল ও উত্তেজনা, গাড়ি থেকে নেমে এল ধীরে ধীরে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর অনিরুদ্ধ মুখার্জি, প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য ও তান্ত্রিক মন্দির নিয়ে খ্যাত এক গবেষক। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী প্রফেসর সঞ্জনা সেন, যিনি সম্প্রতি পুরাণ ও লোকবিশ্বাস নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও ছিলেন দুই তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ—অভিজিৎ ও রোহন—যাদের উচ্ছ্বাস প্রায় বালকসুলভ। তারা এসেছেন বিখ্যাত চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের রহস্য অনুধাবন করতে, যেটি শুধু শিল্পকলার নয়, আধ্যাত্মিক ও গুপ্ততান্ত্রিক…
 - 
				
অদ্বৈত বসু পর্ব ১: নীল পুকুরের কিংবদন্তি গ্রামের নাম কদমডাঙা। বর্ধমান জেলার ভেতরে, ঘন বন আর ধানক্ষেতের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা এই গ্রামটিকে খুব বেশি কেউ চিনত না। লোকেরা সাধারণত এখানে আসে না, আসলেও সন্ধে নামলেই তাড়াতাড়ি ফিরতে চায়। কারণ, গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে এক ভয়াল কাহিনি—গ্রামের মাঝখানে যে পুকুরটা, তাকে সবাই বলে “নীল পুকুর।” পুকুরের জল দিনে সাধারণ, কাদামাটির মতো ঘোলা আর অচেনা গন্ধে ভরা। কিন্তু রাত নামলেই, বিশেষ করে পূর্ণিমার আলোয়, পুকুরের জল হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক নীল। লোককথায় আছে, সেই নীল আলো আসলে কোনো চাঁদের প্রতিফলন নয়, বরং পুকুরের তলায় ঘুমিয়ে থাকা এক নিষিদ্ধ তন্ত্রশক্তির জ্যোতি। অদিত্য বহু বছর পর…
 - 
				
অরিন্দম সেন পর্ব ১ কলকাতার শীতের সন্ধ্যে নেমে এসেছে। উত্তরের বাতাসে ভেসে আসছে কুয়াশার গন্ধ, যেন বাতাসও জানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অরিন্দম মিত্র, ইতিহাসের তরুণ গবেষক, কাঁধে পুরোনো ব্যাগ ঝুলিয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে বেরোতেই মোবাইলটা কাঁপল। অচেনা নাম্বার, তবুও ধরল। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় এক বৃদ্ধ বলল—“আপনি যদি সত্যিই প্রাচীন তন্ত্রচর্চার ইতিহাস খুঁজতে চান, তবে আজ রাতেই শ্যামপুর জমিদারবাড়িতে চলে আসুন। নীলমণি আপনাকে ডাকছে।” শব্দটা কানে পৌঁছতেই বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। নীলমণি—যেটা নিয়ে সে শুধু বইয়ের ফুটনোটে পড়েছে, কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারেনি। তবুও নাম্বারটা কেটে দেওয়ার বদলে হাত কেঁপে উঠল। শ্যামপুরের জমিদারবাড়ির কাহিনি শহরে লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়।…
 - 
				
ময়ূখ দেব রাতের অন্ধকার যখন গ্রামের কোল ঘিরে নেমে আসে, তখন সবকিছু যেন শান্তির জাল ছড়িয়ে দেয়। ঘুমন্ত গ্রামবাসীর মধ্যেই হঠাৎ একটি অদ্ভুত হাসির শব্দ ভেসে আসে বাতাসে, যা এতটাই রহস্যময়ী যে কেউ সঠিকভাবে বোঝে না এটি কার। কেউ বলছে, এটি দেবীর হাসি, যা গ্রামের লোকদের নিরাপত্তা এবং আশীর্বাদ দেয়; আবার কেউ বলে এটি একটি দুষ্টু পিশাচিনীর হাসি, যা রাতের অন্ধকারে মানুষের মন দানবীয়ভাবে কাঁপিয়ে তোলে। হাসিটি কোনোটিই নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির আবহ, যা গ্রামের প্রতিটি ঘরে অচেনা ভাবনা এবং অশান্তি সৃষ্টি করে। গ্রামের কিছু বুড়ো বলেন, “এই হাসি আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি নিয়ে আসে। কেউ যদি হঠাৎ শুনে, সে…
 - 
				
অয়ন চক্রবর্তী পর্ব ১: উত্তরাধিকার কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে অনেক দূরে, পুরোনো গ্রাম বাড়িটায় পা রাখতেই অর্কের মনে হল যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল বাতাসে খেজুরপাতার শোঁ-শোঁ শব্দ। অর্ক বহু বছর পর ফিরেছে এখানে—তার ঠাকুরদার মৃত্যুর খবর পেয়েই। ছোটবেলা কেটেছিল এই বাড়িতেই, তারপর বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরে উঠে যাওয়া। ঠাকুরদা ছিলেন একেবারে গ্রামীণ মানুষ, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি ছিল, যেন তিনি অনেক অজানা কিছু জানতেন। বাড়ির ভেতর পা রাখতেই ধুলোমাখা গন্ধ নাকে এল। মাটির দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, সিঁড়িতে শেওলা জমেছে। কিন্তু ঠাকুরদার ঘরটা ছিল যেমন ছিল, তেমনই আছে। বাঁশের খাট, একপাশে বইয়ের তাক, আর পুরোনো কাঠের…
 - 
				
ঋত্বিক বসু পর্ব ১ শ্মশানের ধোঁয়া যেমন ধীরে ধীরে রাতের বাতাসে মিলিয়ে যায়, তেমনই গোপালচন্দ্রর জীবনও এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মিশে গেছে। সে এই শ্মশানকর্তার কাজ করছে প্রায় পনেরো বছর। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত—কখনও কফিনে ঢাকা শরীর, কখনও শবযাত্রার সানাই, আবার কখনও হাহাকার করা আত্মীয়দের চোখের জলে ভিজে যাওয়া কাঠের চৌকি। তার কাছে সব যেন একই রকম। শ্মশান মানেই মৃত্যু, মৃত্যু মানেই চুপচাপ এক ছায়ার দিকে মিলিয়ে যাওয়া। কিন্তু সে রাতে কিছু যেন অন্যরকম ছিল। আগুন নিভে এসেছে, শেষ কাঠটুকু ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। গোপালচন্দ্র বাঁশের ঝুড়ি হাতে গঙ্গার জলে ভিজিয়ে ছাই ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চারদিক নির্জন, কেবল রাতের পেঁচার ডাক আর…
 - 
				
ঋতব্রত চক্রবর্তী পর্ব ১ : স্বপ্নের শুরু রাতের নিষ্প্রভতা যেন লালচে ছাই হয়ে উঠে বসে আছে স্বপ্নের ভেতরে—একটা শ্মশান, পাঁচটি নিবিড় প্রদীপ, নিরাবেগ নদীর ধারে কাঁসার থালায় রাখা কালচে ধূলি, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা অসম্পূর্ণ শব্দ: “হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… ন—” তারপরই ফাঁকা, এমন এক ফাঁকা যা নিঃশব্দ নয়; অদৃশ্য কণ্ঠের ভাঙন-ধ্বনি সেখানে ঘণ্টার মতো পাক খেতে থাকে, মাটির নিচে চোরা জলের শব্দের মতো সরে যায়, আবার ফিরে আসে। সেই স্বপ্ন থেকে পাঁচজন পাঁচ জায়গায়, পাঁচটি শরীর ভিন্ন ভিন্ন ঘামে, একই আতঙ্কে জেগে উঠল—যেন কোনো অদেখা আঙুল তাদের বুকের ওপর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে লিখে রেখে গেল একটি মাত্র বৃত্ত, যার ভিতরে…
 - 
				
ঋদ্ধি সেনগুপ্ত পর্ব ১: ভোরট্রেন কলকাতার ভ্যাপসা গরম আর অনন্ত জটের ভিড়ের মধ্যে অর্ণার বুক ভরে উঠছিল এক অদৃশ্য ক্লান্তিতে। প্রতিদিন সকালেই সে অফিসের বাস ধরত, ফাইল আর কম্পিউটার স্ক্রিনে ডুবে থেকে সন্ধ্যার পরে ঘরে ফিরত। চারপাশের সবাই যেন শুধু ছুটছে, অথচ কোথাও পৌঁছোচ্ছে না। গত কয়েক মাসে সে বুঝতে পেরেছিল—তার নিজের ভেতরেও এক রকম শূন্যতা জমেছে, যা ভরাট করার মতো কিছু নেই। এই শহর তাকে আর টানে না। একরাতে ডেস্কে বসেই সে হঠাৎ বুকিং করেছিল দার্জিলিংয়ের ট্রেন টিকিট—আর ভাবেনি। সকাল সাড়ে তিনটেয় অ্যালার্ম বাজার আগেই তার ঘুম ভেঙে যায়। চারদিক তখনও অন্ধকার, কেবল ভেজা বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ।…
 - 
				
অরিত্র মুখার্জী পর্ব ১: আগুনের চোখ অমাবস্যার রাতে গ্রামের নিস্তব্ধতা যেন অদৃশ্য কোনো হাত এসে একেবারে চেপে ধরত। গঙ্গার তীরের ছোট্ট জনপদ খয়েরপুরে তখন বাতাসও গায়ে লাগতে চাইত না। মাটির ঘরগুলো মৃদু শ্বাসের মতো নিস্তেজ হয়ে থাকত, পুকুরের জলে চাঁদের প্রতিফলন তো নেই-ই, তারকারাও যেন আকাশের কালো পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। শুধু মন্দিরের গায়ে, কুঁচকে যাওয়া লালচে ইট আর কালো ধোঁয়া-মাখা দেয়ালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেই প্রাচীন কালীমূর্তি—যার চোখে অদ্ভুত এক জ্যোতি নাকি দেখা যায়। বৃদ্ধরা বলত, “আগুনের চোখ”। তাদের দাবি, প্রতি অমাবস্যার রাতে মূর্তির দু’চোখ হঠাৎই জ্বলে ওঠে যেন কারো গায়ের ভিতর থেকে দাউ দাউ করে আগুন…