স্নেহা চৌধুরী সকালবেলা গ্রামের শান্তিপূর্ণ আবহে অনিকেত সাইকেলের চাকা ঘুরাতে থাকে, যেন প্রতিটি ঘূর্ণনই গ্রামের মানুষের জীবনের ছোট্ট গল্পকে স্পর্শ করছে। সূর্য কুয়াশার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠছে, এবং পাতার কোণে কণা কণায় জলরাশি ঝলমল করছে। গ্রামের সরু মাটির পথ ধরে সে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি ছোট্ট গলি তার কাছে পরিচিত—যেমন সে সেই গ্রামের প্রত্যেকটি মুখের সঙ্গে পরিচিত। ডাকপিয়ন হিসেবে তার দৈনন্দিন কাজ হলো চিঠি পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু অনিকেতের কাছে প্রতিটি চিঠি কেবল কাগজ নয়; তা মানুষের আবেগ, স্মৃতি এবং হাহাকার-এর সংমিশ্রণ। বাড়ি বাড়ি যায়, দরজার ঘুষি বাজায়, কখনও কেউ হাসি দিয়ে স্বাগত জানায়, কখনও কেউ নীরবতা বজায় রাখে।…
-
-
তনুশ্রী রায় এক রোজকার মতো সকালটা শুরু হয় একঘেয়ে নিয়মে—চা, শাড়ির আঁচল গুঁজে নেওয়া, আর বাড়ির সদর দরজাটা হালকা শব্দে টেনে বন্ধ করা। শহরের কিনারে পুরোনো একটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষপ্রাচীন ডাকঘরটি যেন সময়কে আটকে রেখেছে নিজের দেওয়ালে। দুলালী ঘোষ, যাকে শহরের সকলে ‘দিদি’ বলে জানে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় এসে সেই সাদা-লাল রঙের গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। দেওয়ালে ঝোলানো পিতলের ঘড়িটা তার আগমনের সাক্ষী হয়ে থাকে, তার চলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চুপচাপ টিক টিক করে। খোলা জানালার ফাঁকে মৃদু আলো ঢোকে, আর তাতে ধুলোর কণাগুলি বাতাসে ভাসে যেন স্মৃতির মতো। দুলালী টেবিলে রাখা তার কাঠের বক্স খোলে, যেখানে…
-
অধ্যায় ১: চিঠির মতো নিঃশব্দ পাহাড়ে ওঠার পথে হঠাৎ করে কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ট্রেকিং পাথ বেয়ে যে ঘোড়ামারা ডাকে ওঠা গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল অভিজিৎ সরকার, তার চারপাশে যেন হঠাৎই সময় থমকে গেল। বালির কাঁধে বয়ে আনা ছোট স্যুটকেস, একটা জলচৌকো ব্যাগ আর হাতে ধরা সরকারি ফাইলের খাম—সবই ভার হয়ে উঠল যেন হঠাৎ। এই ডাকঘরটা, পুরুলিয়ার এক পাহাড়ি অঞ্চলের প্রান্তে অবস্থিত, বহু বছর আগেই তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে রেকর্ডে লেখা ছিল। কিন্তু হেড অফিস থেকে অদ্ভুত এক চিঠির সূত্র ধরে, তাকে বদলি করা হল এই ‘বন্ধ’ ডাকঘরে। সে ভেবেছিল হয়তো কোনো ফাইলের গরমিল, অথবা ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু বদলিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন…
-
ঋতুপর্ণা ঘোষাল ১ পাঞ্জাবের গরম তখন তীব্র, কিন্তু আকাশজুড়ে ছড়ানো এক অপূর্ব বিকেলের আলো। চারপাশে সরষে ফুলের হলুদ ঢেউ, আর তার মাঝে একটি মাটির পথ—যেটা সোজা চলে গেছে একটি ছোট্ট গ্রামে। গ্রামটির নাম ছিল হুসেনওয়ালা, সীমান্তের অনেকটা কাছেই, কিন্তু তখনো সীমান্ত বলে কিছু নেই। এপাশ-ওপাশের মানুষ তখনো ‘একটাই দেশ’ ভাবত। সেই গ্রামে একটি পুরনো, আধাবসতি জমিদার বাড়িতে থাকতেন এক নিঃসন্তান শিক্ষক দম্পতি। তাঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন তাঁদের একমাত্র ভাইঝি—অরুন্ধতী। অরুন্ধতী তখন ষোলো কি সতেরো হবে। বড় বড় চোখ, শাড়ি পরে চুলে বেণী বাঁধে, কিন্তু চোখেমুখে শহরের পড়ুয়া মেয়ে বলেই স্পষ্ট বোঝা যেত। সে লাহোরের কুইন্স কলেজের ছাত্রী, গ্রীষ্মের ছুটিতে…