ঈশিতা ঘোষ পর্ব ১ একটা অদেখা শহরের নাম কলেজ স্ট্রিটের শেষ মাথায় একটা ছোট কফির দোকান ছিল, যার নাম মনে নেই অর্ণবের। এমনকি তার বাইরের নামফলকটাও আজ মনে করার চেষ্টা করলে, চোখের সামনে শুধু ফ্যাকাশে হলদে রঙটা ভেসে ওঠে। তবু, সেই কফির গন্ধ, টেবিলের কাঠের দাগ, আর এককোণে বসে থাকা মেঘলার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকার মুহূর্তগুলো অর্ণবের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। মেঘলা তখন সদ্য রেডিওতে কাজ পাওয়া এক স্বপ্নবিলাসিনী, আর অর্ণব তখন কবিতা লেখার ভান করে। তারা কেউই তখন জানত না, চিঠির যুগটা শেষ হতে চলেছে। সে সময় ফোন ছিল, ঠিকই, কিন্তু মেঘলা বলত — “কল করে বললে কথাটা…
-
-
অনুত্তমা গাঙ্গুলী পর্ব ১ রুদ্রপ্রভা সেন সকাল ন’টায় ঠিক সময়েই ‘একান্ত প্রকাশ’-এর কাঠের দরজাটা খুলে দেন। কাঠে জং ধরেছে, একটু ঠেললে কঁকিয়ে ওঠে, যেন অফিসটাও জানে—তাঁর ভিতরটা এখন একরকম বিষণ্নতা আর অভ্যাসের বোঝায় ভারী হয়ে আছে। বাইরে একটানা বৃষ্টি পড়ছে, পার্কস্ট্রিটের সেই পুরনো ইমারতের তিনতলায় তাঁর ছোট্ট অফিস, যার জানালার কাঁচে কুয়াশা জমে থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়। রুদ্রপ্রভা বত্রিশে পা দেওয়া একা মহিলা। না, একা শব্দটা নেহাতই সামাজিকভাবে। ভেতরে তাঁর ভিতর আরেকটা রুদ্রপ্রভা থাকে, যে রাতবিরেতে কাঠের টেবিলের এক কোণে বসে অজস্র পাণ্ডুলিপি পড়ে, যেগুলো হয়তো কেউই পড়বে না। কিন্তু তবুও সে পড়ে। আজ সকালটা একটু অন্যরকম। রিসেপশন টেবিলের ওপর…
-
প্রীতম ১ শিয়ালদহ স্টেশনের বিকেলের চেনা ব্যস্ততা। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়ালে যে শব্দটা ওঠে—লোকের হাঁটার, announcements-এর কণ্ঠস্বর, ভ্যাপসা গরমে বাতাসের কম্পন—সেইসব কৌশিকের কাছে নতুন কিছু নয়। গত ছয় মাস ধরে, রোজ এই সময়েই, সে দাঁড়ায় একই জায়গায়—একটা পুরনো চায়ের দোকানের পাশের হলুদ রঙের খুঁটির সামনে। তার রুটিন প্রায় যন্ত্রের মতো: অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রাম ধরে স্টেশন, তারপর সেই নির্দিষ্ট কোচে উঠে বাড়ি ফেরা। কিন্তু আজ কৌশিকের মন একটু অস্থির। সে ঠিক জানে না কেন। হয়তো কারণ, গত তিন দিন ধরে সে যার মুখ খুঁজছিল, সেই মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটির নাম জানে না কৌশিক। তারা কোনোদিন কথাও…
-
ঋতুপর্ণা বসু শীতের দুপুরে শীত তখন শহরের কাঁধে নেমে বসেছে। কলেজের লাইব্রেরির বাইরের কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল অনিরুদ্ধ। তার পরনে ছিল ধূসর সোয়েটার, গলায় মাফলার, আর হাতে ছিল একটিমাত্র বই—জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সে বইটা যেমন ছিল, তেমনই তার মনটাও—অদ্ভুত নিঃশব্দ, সময়ের গন্ধ মাখানো। বইয়ের পাতায় চোখ ছিল, কিন্তু মন ছিল বইয়ের বাইরের জগতে। প্রতিদিন বিকেলে লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে যে মেয়েটা নামে, আজও সে ঠিক সময়মতো নামছে। তার নাম প্রভা। ছিমছাম পরিপাটি সাজ, নীল-সাদা শাড়ি, কানে ছোট্ট ঝুমকা। চোখে এক অদ্ভুত আভা, যেন কোনো কথা না বলেই সে অনেক কিছু বলে যেতে পারে। অনিরুদ্ধ বহু দিন ধরেই তাকে লক্ষ করে, কিন্তু…
-
ঈশিতা সেনগুপ্ত জানলার ওপারে কলকাতার উত্তরের এক পুরনো পাড়ায়, লাল ইটের তিনতলা বাড়িটা বহু দিনের সাক্ষী। উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরনো ফুলদানি, জং ধরা বাইসাইকেল, আর সবথেকে দৃষ্টিনন্দন—একটা ঘন পাতা কদমগাছ। সেই গাছের নিচে প্রতিদিন সকালে বসে এক ছেলেটা, তার কোলে একটা স্কেচবুক, হাতে পেন্সিল—নিস্তব্ধ ঘোরে ডুবে যায় নিজের আঁকায়। ছেলেটির নাম অয়ন। অয়নের জীবনের ছন্দ বড়ো একঘেয়ে ছিল। আঁকাআঁকি আর কদমগাছের নিচে বসে থাকা ছাড়া সে খুব একটা কারো সঙ্গে মেশে না। পড়াশোনার দিন পেরিয়ে, সে এখন ঘরে বসেই গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে। পাড়ায় বহুদিনের বাসিন্দা, তাই কারও চোখে নতুন নয়। তবে হঠাৎ করেই সব বদলে গেল, যেদিন জানালায় সে…