পৌলমী দে ১ গ্রামের মাঠ যেন হঠাৎ করেই এক টুকরো উৎসবের স্বর্গে রূপ নিল। চারদিকে উড়ছে রঙিন পতাকা, বাতাসে মিশে আছে ভাজা মিষ্টির গন্ধ আর মাটির প্রদীপের কাঁচা মাটির সুবাস। বার্ষিক পূজার মেলা—যেটার জন্য ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার মনেই অপেক্ষার ছাপ। সন্ধ্যা নামতেই মাঠ ভরে উঠেছে ভিড়ে, শিশুদের হাসির কলরব, ঢোলের তালে তালে নাচ, আর দোকানিদের ডাকাডাকিতে চারপাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আলো-আঁধারের খেলা চলতে চলতে মেলার প্রতিটি কোণে মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল, ঠিক যেন গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে সবাই আজ একসাথে বেরিয়ে পড়েছে। এই আনন্দের আবহের মাঝেই মাটির প্রদীপ নিয়ে বসেছে রাহুল—গ্রামের এক সাদাসিধে ছেলে, যার জন্য এই মেলাটা শুধু…
-
-
পিউ রায় এক অভীক যখন শহরের ব্যস্ত রাস্তা, ক্লান্ত করা যানজট এবং কংক্রিটের পাহাড় ছেড়ে গ্রামে প্রবেশ করে, তখন তার মন যেন এক নতুন পৃথিবীর দিকে উন্মুক্ত হয়ে যায়। গাড়ির জানালা দিয়ে যে সব সবুজ মাঠ, বিস্তীর্ণ খামার, এবং ধীরে ধীরে পাহাড়ের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা পুরনো খামারবাড়ি দেখা যাচ্ছিল, তা যেন শহরের ব্যস্ততা এবং ধোঁয়াশাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দেয়। গাড়ি যখন ধীরে ধীরে কাঁচা পথের দিকে প্রবেশ করে, অভীক দেখতে পায় কাদা জমির উপর বৃষ্টির জল ঢেউ খেলাচ্ছে, আর পাখির ডাক পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলছে। শহরের কাচ-লোহা আর কংক্রিটের গন্ধ যেন একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু গ্রামে প্রবেশের…
-
পৌলমী বসাক অধ্যায় ১ : ট্রেনের জানালা দিয়ে ধেয়ে যাওয়া দৃশ্য যেন অর্ণব আর ঈশিতার চোখে এক নতুন পৃথিবীর চিত্র আঁকছিল। কলকাতার কোলাহল পেরিয়ে ট্রেন যত ভেতরের দিকে এগোচ্ছিল, ততই বাড়ছিল সবুজের প্রলেপ, ঝকঝকে মাঠ আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি। সাদা মেঘে ছাওয়া আকাশের নিচে এই ভ্রমণ যেন তাদের জন্য এক মুক্তির নিশ্বাস। কলেজে গত কয়েক মাস ধরে পরীক্ষা, প্রোজেক্ট আর শহরের চাপে তারা দু’জনেই যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই গ্রামে ছুটি কাটাতে যাওয়ার এই পরিকল্পনা, যেটা প্রথমে হালকা মজার প্রস্তাব ছিল, এখন এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছে। ট্রেনের সীট ভাগাভাগি করে বসে অর্ণব আর ঈশিতা একে অপরের দিকে…
-
কল্যাণ মুখার্জী শ্মশান ঘাটে সেই রাতে যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। চারিদিকে ঘন কুয়াশার চাদর, দূরে শ্মশানের পুরনো বটগাছের ডালে ডালে বাদুড়ের কর্কশ ডাক, আর মাঝেমধ্যেই কুকুরের হাহাকার যেন ভয়কে আরও ঘনীভূত করে তুলছিল। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার নয়, তবু পূর্ণিমার আলোয় চারদিক সাদা হয়ে উঠলেও সেই আলোতে ছিল এক অস্বাভাবিক রক্তাভ আভা। যেন চাঁদ নিজেও এই রাতের সাক্ষী হতে গিয়ে অচেনা কোনো রূপ ধারণ করেছে। গ্রামের মানুষজন শ্মশানের সীমানা থেকে দূরে, পুকুরপাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে তাকিয়ে ছিল। কারও চোখে ভীতি, কারও চোখে কৌতূহল, কিন্তু সবার মনে একই প্রশ্ন—আজ রাতেই কি ভৈরবনাথ তাঁর বহুদিনের সাধনার সফলতা অর্জন করতে চলেছে? সেই…
-
তানিয়া দে সকালবেলার রোদ যখন সবে ধানক্ষেতের মাথায় নরম সোনালি আলো ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে, তখনই গ্রামের মাঠে হাওয়া বইছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা লাল কাপড়ে মোড়া কাকতাড়ুয়াটা যেন চারদিকের দৃশ্যকে গম্ভীর দৃষ্টিতে দেখছিল—তার জীর্ণ মুখখানা, খড়ভর্তি বুক আর বাঁশের দেহে ঝোলানো লাল জামাটি বাতাসে দুলে উঠছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হত কোনো মানুষ হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু গ্রাম্য বাচ্চাদের কাছে সে ছিল বন্ধু আর খেলনার মতো। সেদিনও কৃষ্ণ প্রথমবার সেখানে এসেছিল—খালি পায়ে ধুলো মাখা মাঠে দৌড়ে এসে কাকতাড়ুয়ার পায়ের কাছে বসে পড়েছিল। তার হাতে একটা ছোট্ট কাঠের গাড়ি, যেটা তার বাবা তৈরি করে…
-
সঞ্জয় দে এক ঝর্ণাটির সামনে দাঁড়িয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে যুবকটি, যেন এই নির্জন জলপ্রপাত এক গভীর নিঃশব্দ ডাক ছুঁড়ে দিচ্ছে তার বুকের ভেতর। গ্রামের একপ্রান্তে ঘন জঙ্গলের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই বিশাল ঝর্ণা, দিনের আলোয় যেন স্বচ্ছ অথচ রহস্যে মোড়া। জনশ্রুতি বলে, এই ঝর্ণায় কেউ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না—আর এমন নিখোঁজের ঘটনা কেবল একজন নয়, বহুজনের। মানুষজন বলত, তারা নিজের চোখে দেখেছে—কে যেন একদিন হেঁটে হেঁটে ঝর্ণার ধার ঘেঁষে জলের ভেতরে ঢুকে গেল, কিন্তু জল কোনো গতি ছাড়াই স্থির থেকে গেল, আর সেই মানুষ আর ফিরে এল না। পঁচিশ বছর আগে এমনই একদিন যুবকের বাবা, একজন…