সৌম্য কর ১ গ্রামের নাম আড়বেলিয়া, নদীর ধারে ছোট্ট অথচ প্রাণবন্ত এক বসতি। এখানকার মানুষদের জীবন সহজ, হাসি-ঠাট্টা আর খুনসুটিতে ভরা। এই গ্রামেই জন্মেছে আর বড় হয়েছে শশী—পুরো নাম শশীভূষণ। শশীকে যারা চেনে, তারা জানে সে মনের দিক থেকে একেবারে স্বচ্ছ কাচের মতো, কিন্তু মাথার দিক থেকে মাঝে মাঝেই গুবলেট করে ফেলে। শশীর বোকাসোকা স্বভাব গ্রামে বহুল আলোচিত; কখনো গরুকে খড়ের বদলে নিজের নতুন ধুতি খাইয়ে দিয়েছে, কখনো আবার জমির মাপ নিতে গিয়ে লাঠির বদলে খুপরি দিয়ে দাগ কেটেছে। গ্রামের বৃদ্ধেরা বলেন—“শশী ভালো ছেলে, কোনো খারাপ কাজ করে না, কিন্তু বুদ্ধিটা যেন একটু এদিক-ওদিক।” তবে একথা সবাই মানে—শশীর অন্তর সোনার…
- 
				
 - 
				
পিউ রায় এক অভীক যখন শহরের ব্যস্ত রাস্তা, ক্লান্ত করা যানজট এবং কংক্রিটের পাহাড় ছেড়ে গ্রামে প্রবেশ করে, তখন তার মন যেন এক নতুন পৃথিবীর দিকে উন্মুক্ত হয়ে যায়। গাড়ির জানালা দিয়ে যে সব সবুজ মাঠ, বিস্তীর্ণ খামার, এবং ধীরে ধীরে পাহাড়ের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা পুরনো খামারবাড়ি দেখা যাচ্ছিল, তা যেন শহরের ব্যস্ততা এবং ধোঁয়াশাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দেয়। গাড়ি যখন ধীরে ধীরে কাঁচা পথের দিকে প্রবেশ করে, অভীক দেখতে পায় কাদা জমির উপর বৃষ্টির জল ঢেউ খেলাচ্ছে, আর পাখির ডাক পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলছে। শহরের কাচ-লোহা আর কংক্রিটের গন্ধ যেন একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু গ্রামে প্রবেশের…
 - 
				
অমিত ধর ১ সকালবেলার ট্রেন থেকে নেমে দলটি যখন বিষ্ণুপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল, তখনো শহরের আকাশে ছিল কুয়াশার হালকা চাদর। শীতের সকালের সেই আর্দ্র ও শীতল বাতাসের মধ্যে দূরে কোথাও বাজছিল মন্দিরের ঘণ্টা, যা মিলেমিশে এক ধরনের মিষ্টি শান্তি এনে দিচ্ছিল মনকে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিল ধূসর কুয়াশার আচ্ছাদন, আর তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল লাল ইটের প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরের মাথা, যেন ইতিহাসের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। অরিজিৎ কাঁধের ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল—কুয়াশার মধ্যে উঁকি মারা শিখর, প্রাচীন অলঙ্করণে ভরা মন্দিরের দেওয়াল, আর সকালের হাটে আসা মানুষের ভিড়। প্রিয়া নোটবুক খুলে…
 - 
				
অনিন্দিতা ঘোষ পাল ১ প্রান্তি ছিল গ্রামের একেবারে সাধারণ মেয়ে। কাঁচা মাটির ঘর, উঠোনে মাটির চুলা, আর সারাদিন খাটুনি খাটা বাবা-মা—এই ছিল তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ। তবে তার মধ্যে এক অন্য রকম প্রাণ ছিল। চারপাশের মেয়েরা যখন মাঠের ধারেই লাজুক হয়ে বসে থাকত বা পুতুল নিয়ে খেলত, তখন প্রান্তি ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করতে বেশি ভালোবাসত। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা ফেলে দিয়ে ছুটে যেত পাড়ার মাঠে। সেখানে ফুটবল খেলছিল বড় ছেলেরা, তার চোখে পড়ল বলটা কীভাবে এপাশ-ওপাশ দৌড়চ্ছে, ছেলেরা কেমন মন দিয়ে তাড়া করছে। প্রথমবারের মতো তার মনে হল, “এই খেলাটার মধ্যে যেন এক যাদু আছে।” মনে হল, ফুটবলের ওই গোল…
 - 
				
দেবব্রত জানা অধ্যায় ১: শস্যখেতের ছায়ায় পুব দিক থেকে সূর্যের আলো যখন ধানক্ষেতের কাঁচা সবুজ পাতার উপর পড়ত, রঘুবর হালদারের মনেও আলো ঝরে পড়ত। প্রতিদিনের মতো আজও সে ভোর ছ’টার মধ্যে মাঠে পৌঁছে গিয়েছিল। কুয়াশা তখনো জমির উপর পাতলা চাদরের মতো বিছানো, আর নলকূপের জলে হাত-মুখ ধুয়ে রঘুবর দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের জমির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ—যেন মাটি কথা বলছে তার সঙ্গে। এই জমি তার দাদার দাদা কিনেছিলেন, এরপর প্রজন্ম ধরে চাষ চলছে, আর এখন তিনিই সেই উত্তরাধিকার। ধান, পাট, সর্ষে, আর মাঝেমাঝে একটু আখ—এই নিয়েই তাদের সংসার চলে। জমির প্রতিটি চওড়া ডোল, প্রতিটি মাটির ফাটল, এমনকি কোথায় কাক বাসা বাঁধে—সব…
 - 
				
সৌমিতা বিশ্বাস অধ্যায় ১: বছর দশেক পর গ্রামে ফিরলো জয়ন্ত। কলকাতার কোলাহল আর ক্লান্ত শ্বাসের শহর থেকে শরতের এক হিমেল সকালে সে যখন লোকাল বাসে চেপে নামল, তখন মাথার ওপর আকাশ যেন ঢেলে দিয়েছে শিশিরভেজা কাশফুলের রাজ্য। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরনো বটগাছটা দেখে বুকের মধ্যে কিছু একটা ধক করে উঠল — অনেকদিন আগে যেখানে দাঁড়িয়ে কুসুম তার স্কুলব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলেছিল, “একদিন তুমি যদি চলে যাও জয়ন্ত, আমি কিন্তু ঠিক এই গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষা করব।” সময় তার কাজ করেছে — গাছটা আজও আছে, তবে তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেবেলার কুসুম নেই। গ্রামের মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে…
 - 
				
সৌমেন পাল কুন্দিলপুর — ছোট্ট একটি গ্রাম, দক্ষিণ ২৪ পরগনার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে থাকা, যেন চুপিচুপি বেঁচে থাকা এক টুকরো সময়। এখানে ভোর হয় ধানক্ষেতে পাখিদের ডাকে, আর বিকেল নামে কুঁচো মাছ ধরা ছেলেদের হৈচৈয়ে। ঝিলের ধারে প্রাচীন বটগাছটা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, যেমনটা ছিল পঁচিশ বছর আগে — যখন অভয়চরণ মণ্ডল প্রথম এই গ্রামে এসেছিলেন সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে। মাথায় তখন পাকা চুল তেমন ছিল না, চোখের কোণেও ক্লান্তির রেখা ছিল না। তিনি তখন সদ্য কলেজ-ফেরত এক আদর্শবাদী তরুণ, বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই পারে সমাজকে বদলাতে। গ্রামের মাটির রাস্তা, খড়ের ঘর, ঘোলা জলের পুকুর, অবিশ্বাস আর কুসংস্কারে ভরা মন…
 - 
				
অরিত্রা মৈত্র ভোরের প্রথম কুয়াশা যখন মাঠের উপর ধোঁয়ার মতো বসে থাকে, তখন কাঁসার ঘরে একটা ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। যেন ভোর নিজেই ধাতুর গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। সেই শব্দের উৎস—হরিপদ কর্মকার, দক্ষিণ ভাদুরিয়া গ্রামের প্রাচীনতম কাঁসারু। তার হাতের চেটো আর আঙুলে শক্তি কমে এলেও, যন্ত্রণা বা ক্লান্তি তাকে থামাতে পারেনি। তার ঘরে আলো জ্বলে মাটির প্রদীপে, আর চোখে জ্বলে এক অবিনশ্বর দীপ্তি—সংগ্রামের, টিকে থাকার, আর আত্মসম্মানের। তার ছেলে অনিমেষ তখনো বিছানায়, কিন্তু সেই ঝমঝম শব্দ তার ঘুমের অংশ হয়ে গেছে। এ শব্দ তার শৈশবের লোরি, আর ভবিষ্যতের দিশা। প্রতিদিন এই শব্দেই সে জাগে। কখনো কখনো স্বপ্নেও সে…