অর্পণ মিত্র অধ্যায় ১ – প্রথম ফোঁটা কলকাতার আকাশ কেমন যেন অচেনা রঙের ছিল সেই দিন, যেন বর্ষার প্রথম ফোঁটা এসে শহরের পুরনো রাস্তাগুলোকে নতুন জীবন দিতে চেয়েছে। ভেজা ইটের ফুটপাথ, নোনা কংক্রিটের দেওয়াল, আর রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট জলরঙের পুলের মধ্যে কেবল বৃষ্টির নরম শব্দই ভেসে আসছিল। মায়া, তরুণী যে বয়সেই শহরের কোলাহল থেকে একেবারে দূরে থাকতে ভালোবাসত, ভেজা ছাতার ভাঁজ মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে “নীলবাতি” নামের চায়ের দোকানের দিকে এগোয়। দোকানের ছোট্ট নীল বাতিটি দূর থেকে তাঁকে আহ্বান করছিল—এক ধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ, যেন শহরের সব ভিড় ও আওয়াজ এই এক জায়গায় মিলিত হয়। ভেতরে ঢুকে মায়া যেন…
-
-
অমিতাভ মাইতি কলকাতার পুরনো রেলস্টেশনের সেই নির্জন প্ল্যাটফর্মে প্রথম পা রাখতেই অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা জেগে ওঠে। সকালবেলার হালকা কুয়াশার মধ্যে প্ল্যাটফর্মের ধুলো জমে থাকা সিমেন্টের রঙ ধূসর এবং শীতল, যেন সময় নিজেই এখানে থমকে গেছে। চারপাশে ভিড়ের কোনো চিহ্ন নেই, শুধু কখনো কানে ভেসে আসে দূরের ট্রেনের হালকা সড়কঘর্ষণ বা মাটিতে ধ্বনিত ধাতব চাকার শব্দ। অনির্বাণের চোখে ধরা পড়ে প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে ছায়ামূর্তি—একটি অচেনা ছায়া, যা ঠিক মানুষের মতো হলেও বিস্তৃত আলোয় মিলিয়ে গেলে স্পষ্ট রূপ বোঝা যায় না। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে অদ্ভুতভাবে শান্ত। বাতাসে একটি নিঃশব্দ, ভীষণ ঘন নীরবতা ভেসে বেড়াচ্ছে, যা যেন…
-
সৌমিক হালদার এক কলকাতার শহরটা যেন প্রতিদিনই নিজের মতো এক নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ততা, রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, ফুটপাতের দোকানদারদের হাঁকডাক, হাওড়া-ব্রিজ থেকে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত প্রতিটি রাস্তায় শহরের নিজস্ব ছন্দ ছড়িয়ে থাকে। এমনই এক ব্যস্ত মোড়, যেখানে চারপাশের গাড়ির ভিড়, ঠেলাগাড়ির ধাক্কাধাক্কি, ট্রাফিক পুলিশের বাঁশির শব্দ আর মানুষের ভিড় একসাথে মিশে গিয়ে তৈরি করে এক অসহ্য কোলাহল। ট্যাক্সিচালক রাহুল প্রতিদিনই এই মোড় পেরোয়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর—তার জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে এই মোড়। কিন্তু প্রতিদিনই সে লক্ষ্য করতে শুরু করে এক অদ্ভুত কিশোরী মেয়েকে। মেয়েটি কখনো ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে,…
-
সৃজন বসু এক পার্ক স্ট্রিটের রাত মানেই আলো, কোলাহল, গাড়ির হর্ন আর মানুষের হাসি-আড্ডায় ভরা এক জীবন্ত ছবি। সেদিনও ব্যতিক্রম ছিল না। শীতের শুরুতে রাস্তায় রঙিন লাইটের মালা, বিদেশি আর দেশি সুরের মিশ্রণ, আর খাবারের গন্ধে ভরে উঠেছিল বাতাস। রাত সাড়ে নয়টার দিকে ‘দ্য ব্লু অর্কিড’ নামের এক বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় ডিনারের ভিড় ঠাসা। মোটা মোটা গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, শহরের ধনী-প্রভাবশালী মহল ব্যস্ত নিজেদের গল্পে, কেউ চুমুক দিচ্ছে রেড ওয়াইনে, কেউবা কাঁটাচামচে কেটে নিচ্ছে স্যামন স্টেকের টুকরো। হঠাৎ করেই দূরের আকাশে একটি মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়—প্রথমে মনে হয় কোনো মোটরসাইকেল পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু শব্দের দিকনির্দেশ যেন উপরের…
-
হিমাদ্রি মুখার্জী ১ দক্ষিণ কলকাতার ‘উজ্জ্বল আলয়’ হাউজিং কমপ্লেক্সের সকালটা ছিল একেবারে সাধারণ। দুধওয়ালা এসে গেটের বাইরে হাঁক দিলো, মুন্না ওয়াচম্যান ঝিমোতে ঝিমোতে ঘাড় তুলে চাবি দিলো, আর বাচ্চারা স্কুলবাস ধরতে দৌড়োতে লাগল। নবদম্পতি তুহিন আর বুবলি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে নিজেদের ইউটিউব ভিডিওর থাম্বনেইল নিয়ে আলোচনা করছিল, ঠিক তখনই বুবলি ফিসফিস করে বলল, “তুমি লক্ষ করেছো, ৪০৩ ফ্ল্যাটের জানালাটা কাল রাত থেকে বন্ধই আছে। আজ সকালেও কেউ বেরোলো না!” তুহিন কপাল কুঁচকে বলল, “অ্যাই, ঠিক বলেছো তো! বিমলবাবু তো রোজ সকাল সাতটায় হাঁটতে বেরোন, আর অঙ্কুর গলা ফাটিয়ে গেম খেলে—আজ একটাও শব্দ নেই!” সন্দেহজনকভাবে তারা দুজনে দোতলায় উঠে…
-
জিনিয়া পর্ব ১ শুক্রবার বিকেল। অফিসের ক্লান্তি গায়ে মেখে তিশা এসেছিল গড়িয়াহাটের এক ছোট্ট কফিশপে। বাইরের ট্র্যাফিকের আওয়াজ, হর্ণ, পাঁপড়ির দোকানের চিৎকার—সব মিলিয়ে শহরটা তখনও জেগে, ব্যস্ত, যেন কেউ ঘুমোতে দিচ্ছে না। তিশা এক কোণে বসে ল্যাপটপ খুলে ছবি এডিট করছিল, কানে হেডফোন। তার টেবিলে ছিল একটা ছোট্ট ডায়েরি, যেটায় মাঝে মাঝে সে হঠাৎ করে কিছু লিখে রাখে। কখনও কোনও মুখের রেখা, কখনও কোনও গন্ধ, কখনও কোনও রঙ। ওর মনে হয়, এসব জিনিস হারিয়ে গেলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে। “সরি, এই চেয়ারটা ফাঁকা?” তিশা কাঁধ তুলে তাকিয়ে দেখে, একটা মেয়ের গলা। সাদা কুর্তি, গলায় ঝুলছে একটা ল্যাপটপ ব্যাগ। চোখে ক্লান্তি, মুখে…