অর্কদীপ চক্রবর্তী পর্ব ১ — প্রদর্শনীর রাত বালিগঞ্জের ‘মিত্র ভিলা’ যেন আজ আলোর এক জটিল গোলকধাঁধা। প্রাচীন করিন্থীয় স্তম্ভগুলোতে সাদা কাপড়ের পর্দা নেমে এসেছে, বাতাসে শীতাতপের সঙ্গে ফুলের গন্ধ—চামেলি, টিউব রোজ, আর একটু যেন আপাত অচেনা ধূপের ধোঁয়া। চৌহদ্দিতে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকে থেকে মৃদু ট্রামের ঘণ্টা ভেসে আসে, কিন্তু বাড়ির ভিতর তা পৌঁছয় না; ভিতরের উল্লাস আর ফিসফাস শব্দ সবকিছুকে আড়াল করে দেয়। আজ প্রদর্শনীর রাত—শুভ্রাংশু মিত্র তাঁর নতুন অধিগ্রহণ, সেই বিরল নীল হীরের ‘প্রাইভেট ভিউয়িং’-এর আয়োজন করেছেন। ‘নীল শাপলা’—এই নামটায় স্থির হয়েছে বাড়ির শিল্পপরামর্শদাতা মৃণালিনী বসু। কাঁচের বক্সের মধ্যে হীরেটা রাখা—জার্মানির বুলেটপ্রুফ গ্লাস, চারদিক জুড়ে ক্ষীণ লাল লেজার-গ্রিড, নিচে…
-
-
অর্ণব দাশগুপ্ত পর্ব ১: লাল সূচকের সকাল শেয়ার বাজারের দালালদের জীবনকে বাইরের লোকেরা চকচকে ভেবে নেয়। যেন প্রতিদিনই টাকার বৃষ্টি হয়, প্রতিটি ডাকে লেনদেনের ঝলমলে খেলা। কিন্তু ভেতরে যারা থাকে, তারা জানে আসলে কেমন চাপ, কেমন দমবন্ধ করা দৌড়, আর কেমন গোপন ভয়ের সঙ্গে প্রতিদিনের হিসাব মেলাতে হয়। সৌমিক চৌধুরী সেই ভেতরের মানুষ। সবার কাছে সে “সৌমিক দা”—কলকাতার ডালহৌসির এক পুরোনো শেয়ার ব্রোকারেজ অফিসের নির্ভরযোগ্য দালাল। তার হাতে ক্লায়েন্টরা তাদের সঞ্চয় তুলে দেয়, তাদের স্বপ্ন, তাদের ভরসা। আজকের সকালটা শুরু হয়েছিল আশ্চর্যভাবে ভারী এক নীরবতায়। টিভির স্ক্রিনে তখনও বাজার খোলেনি, কিন্তু সূচকের আগে-পরে ছুটে চলা লাল আর সবুজ রেখাগুলো যেন…
-
অনিন্দিতা রায় পর্ব ১ — ট্রেনের জানালা শিয়ালদহ স্টেশন গমগম করছে মানুষের চিৎকারে, বোঝাই ট্রেনের হুইসেলে আর উদ্বাস্তুদের কান্নায়। আগস্টের আর্দ্র গরমে ছাপোষা মানুষের ভিড় যেন এক বিশাল ঢেউ হয়ে উঠেছে, যাদের কোনো ঠিকানা নেই, আছে শুধু ছিন্ন দেহের মতো ভেঙে যাওয়া স্মৃতি। অঞ্জলি দাঁড়িয়ে আছে ভাই হরিদাসকে পাশে নিয়ে, হাতের মুঠোয় একটা ভাঁজ করা চিঠি। সেই চিঠি খুলনা থেকে সঙ্গে এনেছে, অন্য কিছু আনতে পারেনি। ট্রাঙ্কে আছে সামান্য কাপড় আর কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল, কিন্তু বুকের ভেতর যেটা নিয়ে এসেছে সেটা অদৃশ্য—শিকড় ছেঁড়া এক গ্রামের ঘ্রাণ, উঠোনে ঝরা শিমুলফুল, আর রহিমার মুখ। চারপাশে রেললাইনের শব্দে ভরে উঠলেও অঞ্জলি শুনতে পাচ্ছে কেবল…
-
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: আগমন কলকাতার শহরে কত রকমের গলি আছে—কোথাও শুধু হালচালহীন ইটের দেওয়াল, কোথাও পুরোনো বারান্দার ফাঁক দিয়ে নীচে ঝুলে থাকা ধুলো-কণার ঝালর, কোথাও অন্ধকার ড্রেনের কানা ধরে বাচ্চাদের খেলা। অথচ শহরের একই শরীরের ভেতরে কতগুলো ভিন্ন আত্মা বাস করে। অর্ণবের জন্য এই শহর ছিল চেনা—ক্লাসে যাতায়াত, কফিহাউসের টেবিলে আড্ডা, কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান। কিন্তু যেদিন সে উত্তর কলকাতার সেই গলিতে প্রথমবার ঢুকল, মনে হল অজানা এক শহর খুলে গেছে তার সামনে। মোড়ে একটা ছোট্ট চা-দোকান। দোকানি মিঠুন দা চেনা মানুষ, তবে এখানে দাঁড়িয়ে অর্ণবকে দেখে খানিকটা অবাক। বলল, —“কোথায় যাচ্ছিস? এই রাস্তাটা তোর পথ নয়।” অর্ণব ব্যাগ কাঁধে…
-
ইরা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১ – প্রথম আলাপ কলকাতার শরৎকাল। পুজোর ভিড়, আলোয় মোড়া রাস্তা, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে উলুধ্বনি আর ঢাকের তালে কেঁপে উঠছে শহর। অভ্রর মাথাটা অদ্ভুতভাবে ভারী লাগছিল। সে এক নামী বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। সারা বছর ধরে ক্লায়েন্টের চাপ, ডেডলাইনের ঝড়, কনসেপ্ট নিয়ে মিটিং আর টেনশনে ভরা রাতজাগা তার জীবনের রুটিন হয়ে উঠেছে। তবুও দুর্গাপুজো এলে কেমন এক ধরণের হাওয়ার পরিবর্তন হয়—শহর যেন অদৃশ্য আনন্দে ভেসে ওঠে। সেদিন ছিল ষষ্ঠীর সন্ধ্যা। অভ্র অফিস থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর টানে গেল ঢাকুরিয়ার কাছে এক বনেদি পরিবারের বারোয়ারি পুজো দেখতে। আলো, আলপনা, মণ্ডপে ঢোকার গেট—সবকিছুই যেন চমকপ্রদ। অথচ অভ্রর মন খারাপ।…
-
অর্জুন ধর দ্য কল ব্যাক দিল্লির পুরোনো চাঁদনি চকের গলির ভেতরে এক ছোট্ট বইয়ের দোকান। নাম স্মৃতির আড্ডা। কাঠের তাকজোড়া ভরে আছে পুরোনো গোয়েন্দা উপন্যাস, ইংরেজি ক্লাসিক, বাংলার কবিতার বই। দোকানের মালিক অর্ণব সেন—চল্লিশ ছুঁইছুঁই, চশমা পরা, গম্ভীর মুখের মানুষ। তার বুকশপে দুপুরগুলো শান্ত, শুধু পাখির ডাক আর বাইরের যানজটের আওয়াজ ভেসে আসে। কেউ তাকে চিনে না, কেউ জানে না, এই নিরীহ বই বিক্রেতা একসময় ভারতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ গুপ্তচর ছিল। অর্ণবের দিনগুলো কাটছিল সহজেই—সকালে দোকান খোলা, দুপুরে ক’জন ছাত্রছাত্রী আসে নোটস খুঁজতে, সন্ধ্যায় তিনি একা বসে থাকেন। কিন্তু এই শান্তজীবন হঠাৎই ভেঙে দিল এক পুরনো ফোনকল। রাত তখন সাড়ে দশটা।…
-
অনন্যা ঘোষ ১ কলকাতার শরতের বিকেলটা ছিল অদ্ভুত নীরব। কলেজ থেকে ফিরে ঈশা নিজের ছোট্ট ঘরের জানলার ধারে বসে ছিল, হাতে ল্যাপটপ। শাদা কাপে চা ধোঁয়া তুলছিল, আর পাশে খোলা ছিল ফেসবুক। সাহিত্যের প্রতি ঈশার টান বরাবরই প্রবল, তাই সে কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি লিটারেচার গ্রুপে যোগ দিয়েছিল। ওই গ্রুপে মাঝেমাঝেই নতুন নতুন কবিতা, গল্প, আলোচনার পোস্ট আসত, আর ঈশা সেগুলো পড়ে আনন্দ পেত। সেদিনও সে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটি কবিতার ওপর চোখ আটকে গেল। কবিতার নাম ছিল—“অচেনার ছায়া।” কবিতার ভাষা ছিল সহজ অথচ গভীর, যেন শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট থেকে দূরে কোনো নিঃশব্দ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের একাকিত্বকে কাগজে…
-
সিদ্ধার্থ দে ১ শান্তিনিকেতনের ভোরবেলার আলোয় সবকিছু যেন অন্যরকম লাগে। কলকাতার ধূসর আকাশ, ধোঁয়া আর হর্নের ভিড় থেকে অনেক দূরে এই ছোট্ট শহরের গন্ধ আলাদা—সেগুনপাতার, শিউলির, আর লালমাটির ধুলো মিশে থাকা সেই গন্ধ। ঋজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব এই গন্ধের ভেতরেই কেটেছে। বাবা-মা কলকাতায় চাকরি করলেও পড়াশোনার সুবিধা আর নিরাপত্তার জন্য ঋজুকে রেখে গিয়েছিলেন দিদিমা অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অঞ্জনার ছিল এক ধরনের নিঃশব্দ শক্তি—তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা, যিনি দিনের বড় অংশটাই কাটাতেন পড়ার টেবিলে বা হাতের কাজ নিয়ে। শীতের বিকেলে উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসে হাতে সুই-সুতো নিয়ে কাজ করতেন তিনি, আর ঋজু এক পাশে বসে হয়তো বই পড়ত, নয়তো দিদিমার সেলাই করা…
-
তনিমা বসাক পর্ব ১: অজ্ঞাত সংলাপ কলকাতার গ্রীষ্মের বিকেল যখন কাচে ধাক্কা মারে, মনের ভেতরের অতীত-বর্তমানও তখন এক অদ্ভুত তাপমাত্রায় কাঁপে। ড. অরণ্য সেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাইরের ঝিম ধরা রোদ আর ঘামচাপা শহরের ভাঁজে ভাঁজে যতসব অদেখা গল্প জমা হচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে। তাঁর চেম্বারটি শহরের দক্ষিণে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছাকাছি, চতুর্থ তলায়, চুনে ধরা দেওয়ালের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া বিবর্ণ সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এক প্রাইভেট চেম্বার। এইখানেই তিনি মানুষের মন পড়েন—যেমন দারোয়ান পড়ে কাগজে মোড়া চা, কিংবা বইয়ের দোকানের ছেলে পড়ে পৃষ্ঠার ভাঁজ। আজ তাঁর টেবিলের সামনে বসে রয়েছে এক অদ্ভুত মেয়ে—নিপা বসু। চোখে সুরের মতো নরম অস্থিরতা,…
-
কাজল সরকার কলকাতার পুরনো শহর, যেখানে কালের সঙ্গেই এক এক করে হারিয়ে গেছে অনেক ইতিহাস, সেখানে এক রহস্যময় চুরি অথবা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। স্থানটি ছিল শহরের এক পুরনো অঞ্চলে, যেখানে অন্ধকার গলিপথ, পুরনো ভাড়াবাড়ি, আর দীর্ঘ ইতিহাস ঘেরা চায়ের দোকানগুলো ইতিহাসের এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করে। ঋত্বিক মজুমদার, একজন ইতিহাস গবেষক এবং ব্যবসায়ী, যে কিনা কলকাতার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করত, তার বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয় এক অদ্ভুত ঘটনা। পুলিশ প্রথমে ভাবল এটি একটি সাধারণ চুরি, কিন্তু পরে যখন ঋত্বিকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়, এবং তার কাছে থাকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও নিখোঁজ হয়ে যায়, তখন সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কেবলমাত্র চুরিই নয়,…