প্ৰদ্যুম্ন মুখার্জী ১ পিন্টু, কলকাতার এক অফিসের পুরোনো চা-ওয়ালা, প্রতিদিন সকাল ন’টার আগে হাজির হয় অফিসের গেটে। হাতে তার স্টিলের ট্রে, তাতে ফ্লাস্কভরা গরম দুধ-চা, কাঁচের গ্লাস, আর সাথে একপাশে রাখা ছোট্ট কৌটোতে বিস্কুট। অফিসের ভেতর ঢুকেই সে সবার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে—“মনীশদা, চা খাবেন তো?”, “তৃণাদি, এক গ্লাস দুধ-চা দেবো?”—যেন প্রত্যেকটা কর্মচারীর স্বাদ আর মুড সে মুখস্থ করে রেখেছে। পিন্টুর হাসিমাখা মুখ আর সহজ কথা বলার ভঙ্গিতে অফিসের সবার সঙ্গে তার এক আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কেউ নতুন জয়েন করলে প্রথমেই তাদের হাতে গরম গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে দিত—“চা না খেলে অফিসের কাজ একটুও চলবে না।” এইভাবে বছর…
- 
				
 - 
				
১ কলকাতার উত্তর শহরের ভেতর একসময়ের জমজমাট থিয়েটার আজ ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকের দেওয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে দাগ, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে, অডিটোরিয়ামের আসনগুলোতে ধুলো জমে পাহাড়ের মতো স্তূপ তৈরি হয়েছে, অথচ সব্যসাচী সেনের চোখে যেন অন্য এক স্বপ্ন ভেসে উঠেছিল। সে অনেকদিন ধরে ভেবেছিল তার নতুন নাটক কোথায় মঞ্চস্থ করবে—এমন জায়গা চাই যেখানে কেবল আলো-শব্দের খেলা নয়, জায়গাটাই যেন নাটককে জীবন্ত করে তুলতে পারে। যখন প্রথম এই ভাঙাচোরা থিয়েটারের ভেতর পা রাখল, তখনই অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতল স্রোত তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে, অথচ সেই শীতলতার ভেতরেই যেন জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের কৌতূহল। কুহু মুখার্জী, নাটকের নায়িকা, প্রথম দিনেই…
 - 
				
ঋদ্ধিমান গুহ ১ বেঙ্গালুরুর ব্যস্ততার ভিড়ে অদ্বৈতের দিন শুরু হয় একঘেয়ে অফিসের কাজ দিয়ে, শেষ হয় আবার সেই অফিসেই জমে থাকা ফাইলের পাহাড়ে ডুবে থেকে। কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে রাত কেটে যায়, কফির কাপে ভর করে শরীর চালায়, কিন্তু ভেতরের শূন্যতাকে কিছুতেই পূর্ণ করতে পারে না। উত্তর কলকাতার ছেলেটি ছোটবেলা থেকে কখনো ভাবেনি—শহরের এত দূরে একা পড়ে থাকবে। কাজের চাপ, নতুন জায়গার অনিশ্চয়তা, আর নিঃসঙ্গতা মিলে তাকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে তোলে। তবু প্রতিদিন রাত নামলেই একটুখানি আলো জ্বলে ওঠে—সোহিনীর কল। ফোনের পর্দায় ভেসে ওঠা তার মুখই যেন অদ্বৈতের দিনের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। কিন্তু এই দেখা শুধুই কাঁচের দেয়ালে…
 - 
				
স্বপ্ননীল রায় (১) প্রথম দিনের সকালের সেই মুহূর্তটা অদ্রিজার কাছে অনেকটা অচেনা রাস্তা ধরে হাঁটার মতো ছিল। নতুন কাজ, নতুন প্রোজেক্ট, নতুন অফিস—সবকিছুই যেন একসাথে এসে তার কাঁধে বসে পড়েছিল। কো-ওয়ার্কিং স্পেসের কাচ-ঘেরা ফ্লোরে পা রাখা মাত্রই সে এক অদ্ভুত গন্ধ টের পেল—কফির তাজা গন্ধ, প্রিন্টারের কালি, আর ল্যাপটপের তাপে তৈরি হওয়া ধাতব উষ্ণতার মিশ্রণ। চারপাশটা আধুনিক সাজে সাজানো—ছোট ছোট ডেস্ক, হালকা রঙের দেয়াল, গাছপালা দিয়ে সাজানো কোণ, আর টেবিলের ওপরে খোলা ডায়েরি ও টেক-গ্যাজেটের মেলা। অদ্রিজার হাতে তখন একটা ফাইল আর একটা ল্যাপটপ ব্যাগ, মুখে স্বাভাবিক ভদ্র হাসি। সে একে একে ডেস্কগুলো দেখছিল, যেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাদের কাজে…
 - 
				
জয়দীপ বিশ্বাস এক হ্যারিসন রোডের পশ্চিম প্রান্তে, রাস্তাঘেঁষে ছায়ায় ঢাকা এক পুরনো, প্রায় ভাঙা-ভাঙা বাড়ি—যার কাঁচ ভাঙা জানালার ওপারে আজও পড়ে আছে কিছু পুরনো পর্দা, ছেঁড়া পোস্টার, আর থিয়েটারের ধুলো ধরা আসবাব। শহরের ব্যস্ততা আর উজ্জ্বল আলো থেকে দূরে এই অব্যবহৃত অপেরা হলটা গত কুড়ি বছর ধরে সময়ের স্তব্ধতায় নিজেকে মুড়ে রেখেছে। নাম—“অ্যালিগ্রো থিয়েটার”। একসময় কলকাতার থিয়েটারপাড়ার গর্ব ছিল এই অপেরা হল, যেখানে যুগের পর যুগ বাঙালি অপেরার জন্ম হয়েছে—পিয়ানো, কর্ড, ভায়োলিন আর দোতারা মিলেমিশে সুরের এক আদি-আধুনিক কাব্য রচনা করেছিল এখানে। কিন্তু সেই অপেরা একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়—কারণ, যা কারও কাছে স্পষ্ট নয়। কেউ বলে আগুন লেগেছিল…
 - 
				
সমীরণ সেনগুপ্ত এক রাত বারোটার কিছু পর। কলকাতার বুক জুড়ে যেন নিঃশব্দ এক বিষণ্নতা নেমে এসেছে। গলির পর গলি পেরিয়ে ডঃ অভিজিৎ ধর এসে দাঁড়ালেন জাফরান রোডের মোড়টায়—বামদিকে একটি পুরনো, ভাঙাচোরা বাড়ির পাশে লাগোয়া সংকীর্ণ দেওয়াল, যার গায়ে ছায়ার মতো কিছু একটার টলোমলো প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হচ্ছে। চারদিক ফাঁকা, তবে বাতাস ভারী। এক অদ্ভুত চুলকানির মতো অনুভব হচ্ছে তার মস্তিষ্কের ভেতর—এমন যেন কোনও অজানা কম্পন, অতি নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে মগজকে ঘিরে ধরেছে। এই জায়গাটায় বহু বছর আগে এসেছিলেন তিনি, শেষবার স্ত্রী রীণার হাত ধরে, তখনও জানতেন না—এই নির্জন গলি একদিন তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। গলির শেষপ্রান্তে একটা হলদে আলো টিমটিম করছিল,…
 - 
				
অধ্যায় ১: উত্তরাধিকার দক্ষিণ কলকাতার শেষ প্রান্তে, গড়িয়ার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বাড়িগুলোর মধ্যে একটি ছিল “নীলকুঠি”—একটা অর্ধভাঙা, গাঢ় সবুজ পাতাবরণে ঢাকা অদ্ভুত প্রাসাদসদৃশ বাড়ি। বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত, নিঃসঙ্গ সেই বাড়িটির একটিমাত্র প্রহরী ছিল সময়—যার সঙ্গে লড়তে লড়তে ভেঙে পড়েছিল ছাদের কার্নিশ, ভেঙে গিয়েছিল মেঝের সিমেন্ট, আর কড়া নড়তে নড়তে শূন্যতার ভিতরেও এক অচেনা শব্দ তৈরি হত। অনেকেই বলত, ও বাড়ি ভৌতিক। কেউ কেউ বলত, শয়তানের বাড়ি। কিন্তু অদ্বৈত মৈত্র এসব কল্পকাহিনি শুনেই বড় হয়নি। তার শৈশবের কতশত দুপুর আর সন্ধ্যে এই বাড়ির এক কোনায় তার ঠাকুরদার কোলে বসে কেটেছে—পুঁথি আর প্রাচীন কাগজের গন্ধমাখা গল্পের ভিতর। তবে বড়…
 - 
				
ত্রিসা ভট্টাচার্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট—চিরচেনা, চিরসজীব, আলো-আঁধারির এক নিটোল সহবাস। দিনের শেষে যখন রাজপথের হট্টগোল স্তিমিত হয়ে আসে, আর দোকানপাটগুলো একে একে ঝাঁপ ফেলে দেয়, ঠিক তখনই এই রাস্তার পেট থেকে জেগে ওঠে অন্য এক কলকাতা—যার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় ছায়া, স্মৃতি, আর কিছু হারিয়ে যাওয়া নাম। এই শহরের এক কোণে, এক ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানটা যেন শহরের ব্যস্ততা থেকে আলাদা, নিজের ছন্দে বাঁচে। নাম—”রিডিং রুম”। দোকানটা যত না বিক্রির জন্য, তার চেয়েও বেশি যেন অপেক্ষার জন্য বানানো। এখানে ধুলোমাখা বুকশেলফে ঠাসা পুরনো বই, কাঠের মেঝেতে বেজে ওঠা অদ্ভুত কড়মড় শব্দ, আর দোকানঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁসার ঘড়ির মতোই অপরিবর্তিত…