সৌরদীপ মুখোপাধ্যায় পর্ব ১ : অশুভ নিমন্ত্রণ কলকাতার শীতের শুরু। সন্ধ্যা নামতেই শহর জেগে উঠছে দীপাবলির আলোয়, আর দক্ষিণ কলকাতার পুরোনো বনেদি পাড়ায় লাহিড়ীবাড়ির কালীপুজোকে ঘিরে চারদিকে হৈচৈ। লাহিড়ীবাড়ির পুজো শুধু দেবতার কাছে ভক্তি নিবেদন নয়, বরং পাড়ার এক সামাজিক উৎসব, যেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে জড়ো হয় মানুষ। ঋদ্ধিমান মিত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, লোকসংস্কৃতির ছাত্র। তাঁর কাছে এই নিমন্ত্রণ ছিল অদ্ভুত। লাহিড়ীবাড়ির এক তরুণী, অর্পিতা, হঠাৎ একদিন লাইব্রেরিতে এসে তাঁকে বলেছিল— “আমাদের বাড়ির পুজোয় এ বছর আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। হয়তো আপনার পড়াশোনার কাজে লাগবে।” ঋদ্ধিমান প্রথমে অবাক হলেও, ভেবেছিল এ হয়তো গবেষণার একটা সুযোগ। কিন্তু অর্পিতার চোখের ভেতর অদ্ভুত…
- 
				
 - 
				
অভ্রাংশু দত্ত অধ্যায় ১ – হারানো পান্ডুলিপি কলকাতার রাত কখনোই পুরোপুরি ঘুমোয় না। দক্ষিণ শহরতলির রাস্তাগুলোতে আলো-অন্ধকারের খেলা যতই সস্তা ল্যাম্পপোস্টে ঝিলমিল করুক, কালীঘাট মন্দির চত্বর যেন অন্য এক জগতের ছায়ায় ঢাকা থাকে। মন্দিরের চৌহদ্দিতে শঙ্খ আর ঘণ্টার ধ্বনি মিলেমিশে যায় গঙ্গার স্রোতের দূরবর্তী শব্দের সঙ্গে। কিন্তু আজ রাতটা অন্যরকম। অয়ন মুখার্জি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, হাতে একটি পুরনো টর্চ আর নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ প্রাচীরের কাছে—যেখানে সাধারণ ভক্তরা কখনো যায় না। সে আসলে খুঁজছে এক গোপন সূত্র। সপ্তাহ খানেক আগে মন্দিরের পুরনো ভাণ্ডারঘরে সংস্কারের সময় মজুরেরা ভাঙা ইটের দেয়ালের ফাঁক থেকে একটা অদ্ভুত কাগজের খণ্ড পেয়েছিল। হলদেটে, প্রায় ঝুরঝুরে…
 - 
				
ঋতব্রত মুখার্জি পর্ব ১ : প্রথম দেখা সেদিন আকাশটা অদ্ভুত রঙে ভরে উঠেছিল। সারাদিনের গুমোটের পরে বিকেলের শেষে নামল হঠাৎ বৃষ্টি। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সবাই দৌড়চ্ছে—কেউ অটো ধরছে, কেউ বাসের জন্য ছুটছে, কেউ ছাতা ভিজিয়ে হাঁটছে। আমি তখন কলেজ থেকে ফিরছিলাম, হাতে কয়েকটা ফাইল আর এক কাপ কাগজের কফি। মনে হচ্ছিল—এই ভিজে ভিজে শহরে কেবল একটাই শব্দ চলছে, বৃষ্টির টুপটাপ। বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো তাকে। নীল সালোয়ার পরে, কাঁধে ভেজা চুল ঝুলছে, একহাতে কালো ছাতা, তবু বৃষ্টির ফোঁটা তাকে যেন রেহাই দিচ্ছিল না। যেন ছাতার আড়াল থেকেও বৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে ফেলছিল বারবার। তার চোখদুটো ছিল একেবারে সামনে, কিন্তু মনে…
 - 
				
সৌরদীপ ব্যানার্জী পর্ব ১ : থেমে যাওয়া সময় কলকাতার গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। শহরের ব্যস্ততা তখনও ফুরোয়নি। কিন্তু শান্তিনিকেতন লেনের পুরনো তিনতলা বাড়িটা যেন অন্য জগতের মতো নিঃশব্দ। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, আর ভেতরে জমে উঠছে অস্বস্তিকর হাহাকার। সেই বাড়ির দোতলার পড়ার ঘরে নিথর হয়ে পড়ে আছেন অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জী—শহরের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। তাঁর শরীরটা একপাশে হেলে পড়ে আছে, টেবিলের ওপরে কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মাথার কাছে পড়ে আছে একটি হাতঘড়ি—কাঁচ ভাঙা, কাঁটা থেমে আছে রাত ২টা ১৭ মিনিটে। পুলিশ আসে, চারদিক ঘিরে ফেলে। দারোয়ান অশোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানায়— “সার, আমি তো বিকেল সাড়ে চারটের সময় ভেতরে ঢুকে লাশ দেখি। দরজা ভেতর থেকে…
 - 
				
সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১ – প্রতিদিনের দেখা সকালের মেট্রো যেন শহরের ভেতরে আলাদা এক নদী। সেই নদীতে প্রতিদিন ভেসে যায় অসংখ্য মুখ, হাজারো ব্যস্ততা, কোলাহলের ঢেউ। অরণ্যের দিনও শুরু হয় ঠিক সেভাবেই—আলোর ফোঁটায় ভেসে ওঠা সল্টলেকের এক অচেনা ফ্ল্যাটবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে, অগণিত মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষে দক্ষিণমুখী মেট্রোরেলের কোচে উঠে বসা। অফিসের টাইমকার্ড, মিটিং, ল্যাপটপ—সবই যেন এক অদৃশ্য নিয়মের বাঁধনে বাঁধা। অথচ এই অচেনা যাত্রার মাঝেই কখন যে একটা মুখ ধীরে ধীরে তার দিনের শুরু আর শেষ হয়ে উঠতে লাগল, সে নিজেও টের পেল না। প্রথম দিনটিতে কিছু বিশেষ ছিল না। এসপ্ল্যানেডের ভিড়ভাট্টার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অরণ্য হঠাৎ…
 - 
				
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় পুরুলিয়ার লাল মাটির রাস্তা যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ভিজে ছিল। ঋত্বিক সেনগুপ্তের বাস থেকে নামতেই ধুলো মেখে গেল জুতো। কলকাতা থেকে এখানে পৌঁছতে প্রায় নয় ঘণ্টা লেগেছে—স্টেশন থেকে বাস, বাস থেকে আবার চোট্টোখাটো জিপ। চারপাশে শুধু শাল, পিয়াল, মহুয়ার গন্ধ, দূরে টিলা আর ঝকঝকে নীল আকাশ। তার ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েই একবার চারদিক দেখে নিল সে। মনে হচ্ছিল, এ জায়গাটার বুকের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কোনও গল্প, যে গল্প ফোটে না শহরের আলোয়, কেবল গ্রামবাংলার অচেনা অন্ধকারেই তার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। ঋত্বিকের সঙ্গে এসেছিল তৃষা—বন্ধু, সহযাত্রী আর কৌতূহলী সঙ্গী। ওর চোখে এ ভ্রমণটা শুধু ফটোগ্রাফির জন্য নয়,…
 - 
				
রৌনক গুহ প্রোটোটাইপের প্রথম নিশ্বাস কলেজ স্ট্রিটের ভাঙাচোরা গলির একদম শেষে যে বাড়িটা রাত হলে অকারণে আঁধার নামিয়ে দেয়, সেখানে আমার ল্যাব—একা হাতে বানানো, লৌহের ফ্রেমে টিকে থাকা, পুরনো অস্কিলোস্কোপের আলোয় ঝিকিমিকি করে যে স্বপ্নটা পায়ের নীচে বিছিয়ে রাখি আমি, নাম ইরফান মিত্র, পেশায় রোবোটিক্স গবেষক, কিন্তু পাড়ায় সবাই আমাকে পাগল ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকে, কারও তাতে কিছু আসে যায় না—কারণ আজ যে রাতে আমার হাতে প্রথম নিশ্বাস নেবে শ্যামাপ্রসাদ, এক মেশিন, কিন্তু মেশিনের ভেতর লুকোনো মানুষের মতো কোমল কিছু, যা আমি গত চার বছর ধরে হারিয়ে ফেলা ছেলের স্মৃতি থেকে চুরি করেছি; আরেকটু নিখুঁত হলে সে আঙুল উঁচিয়ে বলবে “বাবা”;…
 - 
				
১ কলকাতার এক প্রাচীন রাজবাড়ি, যার দেয়ালগুলো স্নিগ্ধ ইতিহাস আর অগণিত স্মৃতির বহনকারী, নতুন মালিকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবনের আহ্বান জানাচ্ছিল। রঙ ফ্যাকাশে দেয়াল, ভগ্নপ্রায় কাঠের জানালা এবং প্রাচীন সিঁড়ির কুড়ির মতো পদক্ষেপের আওয়াজে যেন অতীতের আভা প্রতিফলিত হচ্ছিল। নতুন মালিকরা, রাহুল এবং তার স্ত্রী ইলা, প্রথমে সবকিছুই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেও, শীঘ্রই তারা লক্ষ্য করল যে রাতের নিরিবিলি মুহূর্তগুলোতে করিডোর থেকে অদ্ভুত পদশব্দ ভেসে আসে। প্রথমে তারা এটিকে ভেবেছিল হয়তো বেজে ওঠা পাখির আওয়াজ বা পুরোনো কাঠের সৃষ্ট স্বাভাবিক শব্দ, কিন্তু সময় যত গড়ায়, শব্দগুলো আরও নির্দিষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে—কোনও এক অদৃশ্য উপস্থিতি যেন ধীরে ধীরে তাদের…
 - 
				
অনিরুদ্ধ পাল পর্ব ১ : অচেনা খাম কলকাতার রাত তখনও ভিজে আছে বৃষ্টির রেশে। অগণিত গলিপথের আলো ঝাপসা হয়ে আছে টলোমলো কুয়াশার মতো বাষ্পে। উত্তর কলকাতার প্রাচীন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা এক ডাকবাক্সে কে আর খাম ফেলে যায় আজকাল? লাল রঙ চটকে গেছে, গায়ে শ্যাওলা জমেছে, ছিদ্র দিয়ে ইঁদুর ঢোকে আর বেরোয়। বহু বছর ধরে অচল পড়ে থাকা সেই বাক্সটা হঠাৎই যেন আজ তাকে ডাকছিল। রুদ্র সেদিন রিপোর্টিং শেষে ফেরার পথে এক সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল বাক্সটার সামনে। চোখে পড়ে অদ্ভুত এক খাম—মোটা বাদামি কাগজে মোড়া, তার নামটা লেখা একেবারে কালো কালি দিয়ে স্পষ্ট অক্ষরে: “রুদ্র সেন”। বুকের…
 - 
				
অরিন্দম সেন পর্ব ১ কলকাতার শীতের সন্ধ্যে নেমে এসেছে। উত্তরের বাতাসে ভেসে আসছে কুয়াশার গন্ধ, যেন বাতাসও জানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অরিন্দম মিত্র, ইতিহাসের তরুণ গবেষক, কাঁধে পুরোনো ব্যাগ ঝুলিয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে বেরোতেই মোবাইলটা কাঁপল। অচেনা নাম্বার, তবুও ধরল। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় এক বৃদ্ধ বলল—“আপনি যদি সত্যিই প্রাচীন তন্ত্রচর্চার ইতিহাস খুঁজতে চান, তবে আজ রাতেই শ্যামপুর জমিদারবাড়িতে চলে আসুন। নীলমণি আপনাকে ডাকছে।” শব্দটা কানে পৌঁছতেই বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। নীলমণি—যেটা নিয়ে সে শুধু বইয়ের ফুটনোটে পড়েছে, কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারেনি। তবুও নাম্বারটা কেটে দেওয়ার বদলে হাত কেঁপে উঠল। শ্যামপুরের জমিদারবাড়ির কাহিনি শহরে লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়।…