তিথি বসু পর্ব ১ – আগমন ভাগীরথীর জলরাশি তখন সোনালি রোদে ঝিকমিক করছে। দূরে গঙ্গার বুকে ভেসে ওঠা এক বিশাল জাহাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে চন্দননগরের ঘাটের দিকে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি, ফরাসিদের বাণিজ্য উপনিবেশ তখন নবীন কিন্তু প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে—তাদের কাছে বিদেশী জাহাজ মানেই নতুন গল্প, নতুন পণ্যের আগমন, আবার ভয়ও—যদি নতুন করে দখলদারি শুরু হয়! আঁতোয়ান, জাহাজের এক তরুণ ফরাসি সৈনিক, জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো বাংলার মাটিকে দেখছিল। তার চোখে তখন অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি—অপরিচিত ভূমির বিস্ময়, অচেনা মানুষের ভিড়, আর ভেতরে ভেতরে জন্ম নিতে থাকা এক…
-
-
সৌভিক রায়চৌধুরী পর্ব ১ বর্ষার বিকেল। গৌড়ের আকাশে কেবলই মেঘ জমছে। দূরে বাজ পড়ে, নদীর ধারে শাল, সেগুন আর কদম গাছের পাতা ভিজে নেমে আসে। দূর থেকে দেখা যায়, নদী যেন আছড়ে পড়ছে নিজেই নিজের বুকের ওপর। সেই জলপথ ধরে ধেয়ে আসছে এক একলা ঘোড়সওয়ার—ঘোড়ার খুরের শব্দ ডুবে যাচ্ছে বৃষ্টির ছন্দে। তার মাথায় পাগড়ি, চোখে তীক্ষ্ণ ছায়া, কপালে গাঢ় চিন্তার রেখা। সে কালাপাহাড়, নবাব সুলেমান কররানির সেনাপতি। কিন্তু তার জন্মনাম ছিল রামপ্রসাদ। একদা হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রদের এক—ভাঙন, রূপান্তর, এবং আগুনের প্রতীক। এই পথ আজ যুদ্ধের জন্য নয়। এই পথ আজ তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার…
-
তন্ময় পাল ঘটনাটা শুরু হয়েছিল বর্ষার ঠিক আগের সময়ে, যখন আকাশ সারাদিন ধরেই ঝিম মেরে থাকে আর বাতাসে একটা ভিজে মাটির গন্ধ হালকা হালকা দোলা দেয়। আমি, শীর্ষ, তখন সদ্য কলেজে উঠেছি। আমার বাবা একজন পুরাতত্ত্ববিদ, মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের হাড়গোড় জোগাড় করাই তার কাজ। সেবার বাবার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আমরা গেলাম নদিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, নাম—চৌবাগান। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা ভাঙাচোরা খাজাঞ্চিঘর, যেখানে ব্রিটিশ আমলে নাকি রাজবাড়ির সম্পদ রক্ষিত থাকত। সেই ঘরটা নিয়েই যত রহস্য। আমরা যে বাড়িটায় উঠলাম, সেটা ছিল একটা পুরোনো বনেদি দোতলা, লাল ইটের দেয়াল, আর জংধরা লোহার দরজা। ঘরের চারদিকে ঘন অশ্বত্থ আর পাকুড় গাছ, আর…
-
অনিরুদ্ধ বাগচী নীলচাষের আঘ্রাণ ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশে, যেন আষাঢ়ের শেষের এই সন্ধ্যেটা কোনো অশনি সংকেত নিয়ে এসেছে। শিবপুর গ্রামের গলির মাথায় দাঁড়িয়ে রেণুকা তাকিয়ে ছিল দূরের মাঠের দিকে। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামবে—সে নিশ্চয় জানত। কিন্তু বৃষ্টির থেকে বড় ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছে আজকাল—নীল সাহেবদের ভয়। এই গ্রামের সব জমিতে এখন আর ধান চাষ হয় না। নীল চাষ হয়। সাহেবরা এসে জমিদারদের সাথে হাত মিলিয়ে গ্রামটাকে বদলে দিয়েছে। আগের সেই সোনালি মাঠ আর নেই। এখন কেবল নীল গাছের শালপাতা রঙের পাতা আর কুয়াশার মত গন্ধমাখা নিঃশ্বাস। রেণুকার স্বামী হরিদাস যখন জীবিত ছিল, তখনো সে প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি…
-
অর্ণব গুহ অধ্যায় ১: হারিয়ে যাওয়া নোটবই গহনপুর – নামটায় এক রকম রহস্য আছে। বাঁকুড়া জেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামটার ইতিহাস কতদূর ছড়িয়ে, কেউ তা স্পষ্ট বলতে পারে না। জঙ্গলে ঘেরা, পিচঢালা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই এই গহনপুর। গ্রামের মধ্যে এখনও কিছু টালির ছাউনি ঘর, একটা ভাঙা জমিদার বাড়ি আর একটা প্রাচীন শিবমন্দির—কোনটা কবে তৈরি, সঠিক কেউ জানে না। সেই গহনপুরেই পৌঁছল তিনজন বন্ধু—সুদীপ্ত, ঐন্দ্রিলা আর বাপি। কলকাতার স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব এখন কাজের চাপে একটু আলগা হলেও, এই রহস্যময় আমন্ত্রণ তাদের আবার এক করল। “এই বাড়িটা তো একেবারে হন্টেড সিনেমার মতো!”—বাপি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলে। ঐন্দ্রিলা একটু…