অয়ন চক্রবর্তী পর্ব ১: উত্তরাধিকার কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে অনেক দূরে, পুরোনো গ্রাম বাড়িটায় পা রাখতেই অর্কের মনে হল যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল বাতাসে খেজুরপাতার শোঁ-শোঁ শব্দ। অর্ক বহু বছর পর ফিরেছে এখানে—তার ঠাকুরদার মৃত্যুর খবর পেয়েই। ছোটবেলা কেটেছিল এই বাড়িতেই, তারপর বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরে উঠে যাওয়া। ঠাকুরদা ছিলেন একেবারে গ্রামীণ মানুষ, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি ছিল, যেন তিনি অনেক অজানা কিছু জানতেন। বাড়ির ভেতর পা রাখতেই ধুলোমাখা গন্ধ নাকে এল। মাটির দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, সিঁড়িতে শেওলা জমেছে। কিন্তু ঠাকুরদার ঘরটা ছিল যেমন ছিল, তেমনই আছে। বাঁশের খাট, একপাশে বইয়ের তাক, আর পুরোনো কাঠের…
-
-
সোনালী দেব ১ রায়চৌধুরী বাড়ি যেন ইতিহাসের এক প্রাচীন দলিল, যার প্রতিটি দেয়ালে লুকিয়ে আছে গৌরব ও ক্ষয়ের মিলেমিশে থাকা কাহিনি। বিশাল ফটক পেরোলেই চোখে পড়ে দোতলা প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি—উঁচু খিলানওয়ালা জানালা, বারান্দার লোহার গ্রিলের কাজ, আর সিঁড়ির মাথায় শ্বেতপাথরের সিংহমূর্তি। একসময় এ বাড়ির জমিদারি ছড়িয়েছিল আশেপাশের বহু গ্রামে, ঘোড়ার গাড়ি, হস্তিদল, পালকি, এবং শত শত কৃষকের আনাগোনায় মুখর থাকত এই প্রাসাদ। এখন অবশ্য সময়ের সঙ্গে তার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু ছায়াঘেরা আঙিনা আর খসে পড়া দেওয়ালগুলো এখনো অতীতের গৌরবের সাক্ষী। সন্ধ্যা নামলেই যেন এই বাড়ি চারপাশের অন্ধকারকে গিলে নেয়; ঝুলে থাকা পুরোনো ঝাড়বাতি, কড়কড়ে দরজা আর বাতাসে…
-
বিপ্লব দে ১ বারাণসীর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গঙ্গার ধারে মণিকর্ণিকা ঘাটে সেই রাতটা যেন মৃত্যুর গন্ধে মোড়া। শতাব্দীপ্রাচীন ঘাটের ভাঙাচোরা সিঁড়িগুলোয় অগ্নিশিখা নেচে বেড়াচ্ছে, মৃতদেহ দাহের ধোঁয়া গঙ্গার কুয়াশার সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে ভয়ঙ্কর অথচ পবিত্র আবহ। আগুনের লাল আভায় নদীর জল কালো রঙে চকচক করছে, যেন গঙ্গাই আজ এক মহাশ্মশান। সেই শ্মশানের প্রান্তে, এক জরাজীর্ণ ঘাটঘরে শায়িত মহেশ্বর নাথ—অঘোর তন্ত্রের এক প্রবীণ সাধক। তাঁর শরীর ক্ষয়ে গেছে, হাড়গোড় বেরিয়ে এসেছে, তবুও মুখে এমন এক দীপ্তি যা মৃত্যুকেও হার মানায়। বুক ওঠানামা করছে কষ্টে, চোখের গভীরে জ্বলছে অন্তিম আলো। পাশে বসে অরিন্দম, গুরুপ্রেমে ভিজে চোখে জল। শিষ্য হাত দিয়ে গুরুজীর পা…
-
চৈতালি লাহিড়ী এক প্রতিভার জীবনের প্রথম স্মৃতি যেন সেই গন্ধ—হলুদের, ধূপের, আর নতুন শাড়ির আলতো কলকার। বাল্যবিয়ে তার জন্য ছিল এক নীরব আনুষ্ঠানিকতা, চোখের কোনায় জল জমলেও মন বোঝেনি এর অর্থ। ছোট্ট গ্রামের মাটির বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির লাল ইটের প্রাচীরের মধ্যে পা রাখার মুহূর্তে সে অনুভব করেছিল পৃথিবীটা কত বড়, আর সেই বড় পৃথিবীতে সে কতটুকু ক্ষুদ্র। প্রতিভার বয়স তখন মাত্র তেরো, বইয়ের পাতায় এখনও তার হাতের গন্ধ লেগে ছিল, অথচ জীবনের নতুন পাঠশালায় তাকে পা রাখতে হলো অনিচ্ছায়। স্বামী অরুণমাধব, দশ বছরের বড়, শুরুর দিকে মুখে কথাই বলতেন না; শ্বশুরবাড়ির রীতিনীতি, শাশুড়ির কড়া চোখ, আর গৃহস্থালির দায়িত্ব একসঙ্গে যেন…
-
অর্ঘ্য দত্ত অধ্যায় ১: অজানা উত্তরাধিকার তীর্থর জীবনের সেই দিনটি যেন অন্য সব দিনের মতোই শুরু হয়েছিল, অথচ শেষ হয়েছিল এমন এক ঘটনার মধ্যে যা তার ভাবনার সীমার অনেক বাইরে। সকালে কলেজের ক্লাস শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরতেই কাকা এসে বলল, দাদুর পুরনো ঘরের জিনিসপত্র কিছু বাছাই করতে হবে, আর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তীর্থকে, কারণ দাদু নাকি প্রায়ই বলতেন কিছু জিনিস কেবল তার প্রিয় নাতির হাতেই থাকা উচিত। দাদুর সেই ঘরটায় ঢুকতেই তীর্থর মনে হল যেন পুরনো কালের গন্ধে ভিজে আছে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি আসবাব। টালির চালের নীচ দিয়ে হালকা আলো এসে পড়ছে ধুলো জমা ট্রাঙ্ক আর বুকশেলফের ওপরে।…