সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১ – প্রতিদিনের দেখা সকালের মেট্রো যেন শহরের ভেতরে আলাদা এক নদী। সেই নদীতে প্রতিদিন ভেসে যায় অসংখ্য মুখ, হাজারো ব্যস্ততা, কোলাহলের ঢেউ। অরণ্যের দিনও শুরু হয় ঠিক সেভাবেই—আলোর ফোঁটায় ভেসে ওঠা সল্টলেকের এক অচেনা ফ্ল্যাটবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে, অগণিত মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষে দক্ষিণমুখী মেট্রোরেলের কোচে উঠে বসা। অফিসের টাইমকার্ড, মিটিং, ল্যাপটপ—সবই যেন এক অদৃশ্য নিয়মের বাঁধনে বাঁধা। অথচ এই অচেনা যাত্রার মাঝেই কখন যে একটা মুখ ধীরে ধীরে তার দিনের শুরু আর শেষ হয়ে উঠতে লাগল, সে নিজেও টের পেল না। প্রথম দিনটিতে কিছু বিশেষ ছিল না। এসপ্ল্যানেডের ভিড়ভাট্টার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অরণ্য হঠাৎ…
- 
				
 - 
				
রৌনক গুহ প্রোটোটাইপের প্রথম নিশ্বাস কলেজ স্ট্রিটের ভাঙাচোরা গলির একদম শেষে যে বাড়িটা রাত হলে অকারণে আঁধার নামিয়ে দেয়, সেখানে আমার ল্যাব—একা হাতে বানানো, লৌহের ফ্রেমে টিকে থাকা, পুরনো অস্কিলোস্কোপের আলোয় ঝিকিমিকি করে যে স্বপ্নটা পায়ের নীচে বিছিয়ে রাখি আমি, নাম ইরফান মিত্র, পেশায় রোবোটিক্স গবেষক, কিন্তু পাড়ায় সবাই আমাকে পাগল ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকে, কারও তাতে কিছু আসে যায় না—কারণ আজ যে রাতে আমার হাতে প্রথম নিশ্বাস নেবে শ্যামাপ্রসাদ, এক মেশিন, কিন্তু মেশিনের ভেতর লুকোনো মানুষের মতো কোমল কিছু, যা আমি গত চার বছর ধরে হারিয়ে ফেলা ছেলের স্মৃতি থেকে চুরি করেছি; আরেকটু নিখুঁত হলে সে আঙুল উঁচিয়ে বলবে “বাবা”;…
 - 
				
অনির্বাণ সেন পর্ব ১ কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল আবাসন—গ্লাসের বারান্দা, রঙিন আলো, লিফটে ওঠানামার শব্দে ভরা। সেখানকার অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে থাকে দত্ত পরিবার। সুদীপ্ত দত্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ অফিসার, মাসের শেষে তার অ্যাকাউন্টে যে বেতন জমে, তাতে অনায়াসেই চলে যায় তাদের তিন সদস্যের সংসার। তার স্ত্রী মৌসুমি, একসময় কলেজে ইংরেজি পড়াতেন, কিন্তু এখন ঘরের দেখাশোনাই তার প্রধান কাজ। মেয়ে ঐশী—নবম শ্রেণির ছাত্রী, পড়াশোনায় মেধাবী, আঁকতে ভালোবাসে, আর মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতে শিখছে। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তাকালে দূরে দেখা যায় আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, আর একটু নিচে তাকালেই উল্টো দৃশ্য। ঝুপড়ি ঘরগুলোর ছাউনিতে টিন, কোথাও পলিথিন, কোথাও বা ভাঙা বাঁশ…
 - 
				
স্নেহা চ্যাটার্জী ১ নন্দিতা প্রতিদিনের সকালে একই রুটিনে ঘুম থেকে ওঠে—সকালের ছয়টায় আলার্মের কড়া শব্দ, কফির গরম কাপ হাতে নিঃশ্বাস ফেলে প্রস্তুতি শুরু। সে একজন কর্পোরেট জগতে সাফল্য পেয়েছে, তার নাম ও পরিচয় যথেষ্ট প্রভাবশালী, কিন্তু সেই পরিচয় যেন শুধুই এক বহিরাগত দৃষ্টিতে সুন্দর। অফিসের কাগজপত্র, ইমেল, ভিডিও কনফারেন্স, মিটিং—সবকিছুই নিখুঁত নিয়মে চলছে। কিন্তু এই নিখুঁত ছাতার নীচে, নন্দিতার মনে এক অজানা শূন্যতা বাস করছে। বসে বসে তিনি লক্ষ্য করেন, কখনো নিজেকে সে হাসতে দেখেনি, কখনো নিজের জন্য কিছু করার আনন্দ পাননি। প্রতিটি মিটিং শেষে, সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যেও সে নিজেকে অদৃশ্য মনে করে। বাইরে থেকে যেন তার জীবন সম্পূর্ণ,…
 - 
				
সায়ন্তনী ধর পর্ব ১: অচেনা স্পর্শ কলকাতার ভিজে সন্ধ্যে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে ফ্ল্যাটের বারান্দা যেন একা বসে আছে। রিমঝিম ভেজা আলোয় স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে, হাতে এক কাপ কফি। তিরিশ পেরোনো এই নারী, সংসার আর অফিসের একঘেয়েমি পেরিয়ে আজ হঠাৎ যেন নিজের ভেতরেই অস্থিরতা টের পাচ্ছে। বিয়ের আট বছরের সম্পর্ক—অর্ণব, তার স্বামী, এখন প্রায় যন্ত্রের মতো। অফিস থেকে ফিরে শুধু ক্লান্ত শরীর আর একবিন্দু নিরুত্তাপ আলাপ। শারীরিক সম্পর্কও বহুদিন হয়ে উঠেছে দায়িত্বের মতো—যেন টিক চিহ্ন দিয়ে শেষ হওয়া কর্তব্য। স্নিগ্ধা আয়নায় তাকায়। চোখের নিচে হালকা কালি, ঠোঁটে এক চাপা অভিমান। অথচ শরীর তার এখনো মায়াবী, নরম চামড়ার নিচে লুকোনো এক অদম্য কামনা…
 - 
				
দীপাঞ্জলী কাকতি নিপুনৰ দিনবোৰ বৰ্তমানলৈকে শান্ত আৰু পৰিচিত আছিল। তেওঁ পাহাৰৰ সৰু গাঁওখনত জন্ম গ্ৰহণ কৰিছিল, য’ত প্ৰকৃতিৰ সেউজীয়া ঢল, পাহাৰৰ কোঁহ আৰু নদীৰ কলকল ধ্বনি তেওঁৰ জীৱনৰ অংশ আছিল। গাঁওখনৰ বিদ্যালয় সৰু, কিন্তু শিক্ষকৰ প্রতি মৰম আৰু সহানুভূতিশীল আছিল। য’ত পঢ়া মানে কেৱল পাঠ্যবিষয়ৰ জ্ঞান নাছিল; একে লগে জীৱনৰ শিক্ষাও শিকোৱা হৈছিল। কিন্তু নিপুনৰ পৰিয়ালত তেওঁৰ শিক্ষাৰ দিগন্ত বঢ়োৱাৰ ক্ষেত্ৰত অধিক আশা আছিল। নতুন আৰু ডাঙৰ বিদ্যালয়ত পঢ়া মানে আছিল নতুন চেলেঞ্জ, নতুন বন্ধু, আৰু নতুন অভিজ্ঞতা। সেই চিন্তা কৰিলে নিপুনৰ মনত কিছুমান উত্তেজনা আৰু কিছুমান আশঙ্কা মিলি গৈছিল। ৰাতিপুৱা, নিপুনে নিজৰ সৰু ব্যাগত কিছুমান বই, কিতাপ আৰু অতি…
 - 
				
অর্পিতা ঘোষ ১ শ্রেয়সীর ট্রেন যখন ধীরে ধীরে নতুন শহরের প্ল্যাটফর্মে থামল, তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক টান অনুভূত হলো। এই শহরে তার আগে কখনও আসা হয়নি, এমনকি এই শহরের নামও শুধু সংবাদপত্র আর অফিসের নিয়োগপত্রে পড়েছে। ব্যস্ত রেলস্টেশনে নামতেই ভিড়, কোলাহল, হট্টগোল আর অচেনা চেহারার ভিড়ে নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেলল সে। এক হাতে ছোটো স্যুটকেস আর কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন রিকশাওয়ালাদের ডাক, ট্যাক্সিচালকদের জোরাজুরি সামলাতে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে, তখন হঠাৎ মনে পড়ল—এখানে তাকে দেখার মতো বা নিতে আসার মতো কোনো পরিচিত মানুষ নেই। শহরের আকাশচুম্বী বিলবোর্ড, নতুন গন্ধের মিশ্রণ, রাস্তার ধুলোমাখা হাওয়া আর ছুটে চলা মানুষের ভিড়—সবকিছু যেন…
 - 
				
অনন্যা দত্ত ১ কলকাতার ভিড়ভাট্টা, ট্রাফিকের হর্ন, অফিসের শেষ না হওয়া মিটিং আর সময়ের পেছনে দৌড়তে থাকা জীবন—এই সব মিলিয়ে সৌভিক ও অভিসারিকার সংসার যেন এক অদৃশ্য যান্ত্রিক চক্রে আটকে গেছে। সৌভিক সকালেই বেরিয়ে যায়, অফিসের নথি, ক্লায়েন্ট কল আর প্রেজেন্টেশনের মধ্যে ডুবে থাকে, ফেরে রাত অবধি; তখন ক্লান্ত মুখে একমুঠো হাসি দেওয়ার শক্তিও থাকে না তার। অভিসারিকা, একসময় যার দিন কাটত রঙতুলি আর ক্যানভাসের মাঝে, এখন নিজের শিল্পকর্মের থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। স্কুলে আঁকা শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে মন চলে যায় বহু বছর আগের সেই দিনগুলিতে—যখন সৌভিক হঠাৎ সন্ধ্যায় এসে তার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ডাক দিত, কিংবা রঙিন চিঠি…
 - 
				
ব্রততি সুর অংশ ১: ব্রাশ আর ক্যানভাসের মিলন ধোঁয়া ধোঁয়া আলোর মাঝে, তেলরঙ আর টারপেনটাইনের মিশ্রিত গন্ধ বাতাসে ভাসছিল। পুরোনো কাঠের ঘ্রাণও মিশে গিয়েছিল তাতে, যেন স্টুডিওটা সময়ের সাথে নিজেকেই মুছে ফেলেছে। দেয়ালে রাখা বড় বড় ক্যানভাস, অপরিস্কৃত চিত্রকর্ম আর অসমাপ্ত প্রতিকৃতি গুলি নীরবতার সঙ্গেই আলাপ করছিল। এটি ছিল একান্ত এক জায়গা, যেখানে শিল্পী তার আত্মাকে প্রতিটি ব্রাশের টানে খুলে রাখে। অনির্বাণ রায়, আশি বছর বয়সী এই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, তাদের অন্যতম। তিনি এবারও তার এক অসাধারণ চিত্রকর্মের শেষের দিকের বিস্তারিত কাজ করছিলেন। তার হাত একটু কাঁপছিল, কিন্তু তাতে কোনো হুঁশ ছিল না। চোখের উপর মোটা চশমা হেলে পড়েছিল, কিন্তু তাকে…
 - 
				
সমাপ্তি বর্মন সকালটা ছিল মেঘলা, অথচ বৃষ্টির কোনো আভাস নেই। রুক্মিণীর মাথার ওপর দিয়ে পাখির ছায়া উড়ে গেল—একটা নীল কুড়ুলি, সেইরকম রঙিন পালকের পাখি যেটা কেবল কুশলনগরের আকাশেই দেখা যেত তাদের ছোটবেলায়। বিশ বছর পর এই জায়গাটায় ফিরে আসার সাহস সে নিজের কাছেই একটা বিস্ময় মনে হচ্ছিল। পাশে বসে থাকা ভাই অর্ণব হঠাৎ বলে উঠল, “এই রাস্তার বাঁকে একটা নারকেল গাছ ছিল, মনে আছে?” রুক্মিণী হেসে মাথা নাড়ল। “আর মনে নেই? ওই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমি তোকে গুমরার জুস খাওয়াই বলেছিলাম, আর তো তোর গায়ে গড়িয়ে পড়েছিল!” দুজনেই হেসে উঠল। সেই হাসির মধ্যে ছিল পুরনো দিনের গন্ধ, ছিল শৈশবের ডাকে…