এক গ্রামের নাম শালপুকুর। নদীর ধার ঘেঁষে, সবুজ ক্ষেত আর তালগাছে ঘেরা এই গ্রাম বরাবরই শান্ত, নিরিবিলি। কোলাহলহীন জীবনযাত্রায় মানুষজন এখনো প্রথা মেনে চলে। গ্রামের মাঝখানে একটি পুরনো পুকুর—যার নাম থেকেই গ্রামটির নামকরণ। শালগাছ আর পুকুরের শাপলা মিলেমিশে গ্রামটিকে সাজিয়ে রেখেছে অন্যরকম আবহে। আধুনিকতার ছোঁয়া খুব কমই পৌঁছেছিল এই গ্রামে। ইন্টারনেট ধরা দিত কেবল পাহাড়ি মেঘের মতো—কখনো আসত, আবার হঠাৎ হারিয়ে যেত। ঠিক এই কারণে সরকার ও মোবাইল কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে শালপুকুর গ্রামে একটি আধুনিক 5G টাওয়ার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামের মানুষজন প্রথমে খুশি হয়ে ওঠে। তারা ভাবে, অবশেষে তাদের ছেলে-মেয়েরা শহরের মতো ভিডিও কল করতে…
-
-
উপাসনা রায় উত্তর কলকাতার যে রাস্তার নাম বারবার বদলেছে, সেখানে একটা বাড়ি আছে যার নাম কখনও বদলায়নি—লোকমুখে “কালোজানালা বাড়ি”। অর্পণ যখন প্রথম দিন চাবিটা হাতে পেল, বিকেলের আলো তখন ছেঁকে পড়ছে ছাদের ধুলোতে; সিঁড়ির মুখে জোনাকি বাতির মতো ঝুলছে পুরনো বাল্ব, আর মেঝের কালো-সাদা মোজাইকের ফাঁক থেকে উঠছে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ—আদ্রতা আর শেওলার মিশ্রণ। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই, দালাল বাবু বলেছিল, “এখানে যারা থাকে তারা নিজ দায়িত্বে থাকে। পানীয় জল নিজের মতো জোগাড় করবেন, আর… কালো জানালাগুলো বন্ধ রাখবেন।” কথাটা বলে একটু থেমে হেসেছিল, যেন মজা করছে। অর্পণ ভেবেছিল, পুরনো বাড়ির দোষ। কিন্তু যে জানালাগুলোর কাঠে সরু লোহার…
-
অভিসাৰ দত্ত দিব্ৰুগড়ৰ উত্তৰে, ব্ৰহ্মপুত্ৰৰ কিনাৰত বিস্তৃত হৈ থকা এখন ঘন বনৰ নাম মানুহৰ মুখে মুখে খুব কমেই উচ্চাৰিত হয়—“বনভূতৰ বন”। মানচিত্রত তাৰ কোনো বিশেষ চিহ্ন নাই, কিন্তু স্থানীয়সকলৰ মনত ই এক ভয়ংকৰ অন্ধকাৰ সঁচা। বহু বছৰৰ পৰা কিম্বদন্তি চলি আহিছে যে এই বনতে প্ৰৱেশ কৰা মানুহবোৰ কেতিয়াও উলিয়াই আহে নে নাই, সেয়া কোৱা কঠিন। কেতিয়াবা গাঁওখনৰ মানুহে দূৰত বনৰ গাভুৰি অংশত পৰা বজ্ৰপাতৰ দৰে আলোৰেৰে নাচনিহে দেখা পায়, কেতিয়াবা আবার বাতাহৰ সৈতে ভেসি আহে এক অদ্ভুত গুঞ্জন—যেন শতাধিক লোক একেলগে হাঁহিছে আৰু কান্দিছে। কিন্তু এই সকলোবোৰ কাহিনী বাহিৰৰ মানুহে কেতিয়াও গম্ভীৰভাৱে নলয়, সেয়া মাথোঁ ভয়-ত্ৰাসৰ গাঁওৰ ধৰণৰ কথা বুলি…
-
তনিমা বসাক পর্ব ১: অজ্ঞাত সংলাপ কলকাতার গ্রীষ্মের বিকেল যখন কাচে ধাক্কা মারে, মনের ভেতরের অতীত-বর্তমানও তখন এক অদ্ভুত তাপমাত্রায় কাঁপে। ড. অরণ্য সেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাইরের ঝিম ধরা রোদ আর ঘামচাপা শহরের ভাঁজে ভাঁজে যতসব অদেখা গল্প জমা হচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে। তাঁর চেম্বারটি শহরের দক্ষিণে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছাকাছি, চতুর্থ তলায়, চুনে ধরা দেওয়ালের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া বিবর্ণ সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এক প্রাইভেট চেম্বার। এইখানেই তিনি মানুষের মন পড়েন—যেমন দারোয়ান পড়ে কাগজে মোড়া চা, কিংবা বইয়ের দোকানের ছেলে পড়ে পৃষ্ঠার ভাঁজ। আজ তাঁর টেবিলের সামনে বসে রয়েছে এক অদ্ভুত মেয়ে—নিপা বসু। চোখে সুরের মতো নরম অস্থিরতা,…
-
সঞ্জয় দে এক ঝর্ণাটির সামনে দাঁড়িয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে যুবকটি, যেন এই নির্জন জলপ্রপাত এক গভীর নিঃশব্দ ডাক ছুঁড়ে দিচ্ছে তার বুকের ভেতর। গ্রামের একপ্রান্তে ঘন জঙ্গলের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই বিশাল ঝর্ণা, দিনের আলোয় যেন স্বচ্ছ অথচ রহস্যে মোড়া। জনশ্রুতি বলে, এই ঝর্ণায় কেউ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না—আর এমন নিখোঁজের ঘটনা কেবল একজন নয়, বহুজনের। মানুষজন বলত, তারা নিজের চোখে দেখেছে—কে যেন একদিন হেঁটে হেঁটে ঝর্ণার ধার ঘেঁষে জলের ভেতরে ঢুকে গেল, কিন্তু জল কোনো গতি ছাড়াই স্থির থেকে গেল, আর সেই মানুষ আর ফিরে এল না। পঁচিশ বছর আগে এমনই একদিন যুবকের বাবা, একজন…
-
তিথি বসু পর্ব ১: তাবিজওয়ালা ঘর শহরের কোলাহলের মাঝখানে, যেখান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঝাপসা দেখা যায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে চৌরঙ্গীর একটি পুরনো হোটেল—‘হোটেল সম্রাট’। বাইরে থেকে দেখলে আধুনিক মনে হলেও ভিতরে ঢুকলেই যেন সময় পিছিয়ে যায়—ফিকে আলো, সাদা কাঠের জানালা, আর মোটা মোটা পর্দা যা আলো ঢুকতে দেয় না। সেই হোটেলের ৩১৫ নম্বর ঘর থেকে পাওয়া গেল এক মৃতদেহ। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেখে—একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ খাটে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। ঘরের ভিতর অদ্ভুত একটা গন্ধ—মাটির, ধূপের, আর যেন ভেজা ছাইয়ের গন্ধ। মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল একটি তাবিজ—লাল সুতোয় বাঁধা, তাতে শিকল দিয়ে আটকানো একটা ক্ষুদ্র রৌপ্য বাক্স। এই খুনের…
-
দেবযানী ভট্টাচার্য এক বীরভূমের প্রত্যন্ত এক গ্রামে অবস্থিত অরুণপুকুর—চারপাশে শাল, মহুয়া, আর শিমুল গাছে ঘেরা এক নিঝুম জলাশয়, যেটিকে ঘিরে রয়েছে শত গল্প, শত কানাঘুষো। দিনের বেলায় সেটি যেন নিরীহ; গ্রামের মহিলারা সেখানে জল তোলে, শিশুরা খেলে। কিন্তু সূর্য ঢলে যাওয়ার পর সেই পুকুরের ঘাট কেমন যেন থমকে যায়। পাখিরা উড়ে যায় অন্য দিকে, কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও কিছুক্ষণ পরেই চুপ করে যায়। গ্রামের মানুষ বলে—“ওই সময় কেউ যেও না ঘাটের দিকে, মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে জলে।” এই গল্পে সৌরভ মুখোপাধ্যায়, গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র, আদৌ বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞান, লজিক, নিউরোলজি, আর ইউটিউব ডকুমেন্টারির উপর দাঁড়ানো তার যুক্তিনির্ভর…
-
তিথি বসু পর্ব ১: সেই ভগ্নপ্রায় দরজার শব্দ নদীয়ার কুয়াশা ঢাকা বিকেলে ট্রেন থেকে নামতেই শুভমর মনে হলো সময়টা যেন হঠাৎ করে থমকে গেছে। বাইরের হাওয়া ঠান্ডা, কিন্তু বাতাসের মধ্যে কিছু একটা গুমোট। সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রিকশাওয়ালার দিকে এগোল। “চৌধুরীবাড়ি যাবেন?” জিজ্ঞেস করতেই রিকশাওয়ালার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। “চৌধুরীবাড়ি? ওই যে শ্মশানের পাশে যেটা?” শুভম মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, ওটাই। আমি গবেষণার জন্য এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি আছে।” রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি ওইদিক যাই না বাবু। ওখানে এখন কেউ থাকেও না।” শেষমেশ অনেক বোঝানোর পরে একজন রাজি হলো। অন্ধকার নেমে আসছিল, আর চৌধুরীবাড়ির পথটা খড়ি গাছ…
-
সঞ্জয় দে পর্ব ১: বাড়ির রহস্য অভিজিৎ ছিল ইতিহাসের ছাত্র। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পুরনো বাড়িগুলোর ইতিহাস খোঁজা, বিশেষত সেগুলোর যেগুলো সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে অথবা কেউ তাদের কাহিনী জানে না। একদিন, তার বন্ধু প্রীতম তাকে একটি পুরনো বাড়ির কথা জানায়, যে বাড়ি সম্পর্কে নানা গুজব ছড়িয়ে আছে। লোকজন বলে, এখানে অদ্ভুত হাসির শব্দ শোনা যায় এবং অনেক মানুষ এখানে হারিয়ে গেছে। সেই রাতের পর থেকেই বাড়িটির নাম তার মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। অভিজিৎ ভেবেছিল, এই বাড়ির রহস্য উন্মোচন করতে পারলে তার গবেষণায় নতুন একটি দিক যোগ হবে। তাই এক সকালে, তার গবেষণার জন্যই সেদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত…
-
অনির্বাণ ঘোষ অদ্ভুত ধ্বনি গাঁয়ের শেষ সীমানায়, ঘন জঙ্গল আর বুনো পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল বহুতলা ভুতের বাড়ি, যেখানে কোনোদিন মানুষের পা পড়েনি। গাঁয়ের বয়স্করা বলতেন, “এ বাড়ি শাপিত, এখানে বাস করা লোকের ভাগ্য বিপর্যস্ত।” কিন্তু আধুনিক যুবকরা এসব অন্ধবিশ্বাসকে গা ছেড়ে দিয়েছিল, আর তার মধ্যে এক জন ছিল আরিফ। এক রহস্যপ্রেমী সাংবাদিক, যিনি শহর থেকে এই গ্রামে এসেছিলেন কিছু অদ্ভুত ঘটনা অনুসন্ধান করতে। আরিফের প্রথম দিনের সন্ধ্যায় যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছিল, তখন গাঁয়ের বাজারের এক কনফেকশনারি দোকানে বসে শুপ্রা নামক এক স্থানীয় মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। শুপ্রা কথায় কথায় বলল, “আপনি কি বহুতলা ভুতের বাড়ি সম্পর্কে জানেন?”…