আকাশ সরকার অধ্যায় ১: পরিকল্পনার শুরু শহরের ভিড়, যানজট আর ব্যস্ততার মধ্যে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একঘেয়ে ছন্দে। প্রত্যেকেই যেন যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল—সকালে ঘুম ভেঙে কাজে বের হওয়া, সারাদিন অফিস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ সামলে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরা। সপ্তাহান্তে হয়তো কেউ সিনেমা দেখে বা ক্যাফেতে সময় কাটায়, তবু মনের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা জমে যাচ্ছিল। বন্ধুদের মধ্যে সেই শূন্যতার কথাই সবচেয়ে বেশি অনুভব করছিল অনিক। এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আড্ডাখানায়, ধূসর আলোয় মোড়া চায়ের দোকানে বসে থাকতে থাকতে সে হঠাৎ বলে উঠল, “আমাদের কিছু আলাদা করা দরকার। এইভাবে শহরে বসে থেকে আমরা কেবল আরও ক্লান্ত হচ্ছি। যদি কোথাও যাওয়া…
- 
				
 - 
				
সৌম্যদীপ হালদার অধ্যায় ১ : অজানার ডাক কলকাতার ভিড়ভাট্টা আর নিরন্তর দৌড়ঝাঁপের মধ্যে তরুণ নায়কের দিনগুলো যেন ক্রমশ একরঙা হয়ে উঠছিল। প্রতিদিনের সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দ, অফিসের ফাইলের পাহাড়, এবং রাতের শেষ প্রহরে ফাঁকা বারান্দায় সিগারেটের ধোঁয়া—সবকিছুই যেন তাকে এক অদৃশ্য শিকলে বেঁধে ফেলেছিল। কলেজজীবনে সে যে স্বপ্ন দেখেছিল—দূরদেশের পাহাড়ে চড়বে, অচেনা জনপদে রাত কাটাবে, নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজবে—সেই স্বপ্নগুলো এখন কেবল পুরনো ডায়েরির পাতায় বন্দি। একঘেয়েমির এই জীবন তার ভেতরের কৌতূহল, দুঃসাহস, আর স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিচ্ছিল। একদিন হঠাৎ বিকেলের অচেনা বৃষ্টি আর মেট্রোরেল স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, শহরের এই…
 - 
				
অধ্যায় ১: মন্দিরের নিস্তব্ধতা গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক ভগ্নপ্রায় পুরনো মন্দির, যেটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত হয়ে আছে। মানুষজন দূর থেকে দেখলেও এর ভেতরে ঢোকার সাহস করে না কেউ, কারণ এ মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা গুজব, নানা অলৌকিক কাহিনি। কেউ বলে, এখানে দেবতার অভিশাপ আছে, কেউ বলে রাতে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসে ভেতর থেকে, যেন কেউ অন্ধকারে হাঁটছে। গ্রামবাসীরা তাই মন্দিরকে ভয় পায়, আর দিনের আলো থাকলেও এর কাছাকাছি কেউ যায় না। নায়ক অর্ণব, পেশায় প্রত্নতত্ত্ব গবেষক, এ মন্দিরের নাম শুনে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। শৈশব থেকে তার প্রবল আকর্ষণ ইতিহাস ও পুরনো ধ্বংসাবশেষের প্রতি, আর সে বিশ্বাস করে প্রতিটি ধ্বংসস্তূপের…
 - 
				
আকাশ ধর ১ গ্রীষ্মের বিকেল তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যার দিকে গড়াচ্ছে। গ্রামের প্রান্তের ফাঁকা মাঠ আর অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ধারে ছড়িয়ে থাকা বাতাসে ধুলো উড়ছে। অরিন, ষোল বছরের কিশোর, একা একাই হাঁটছিল। পড়াশোনায় মাঝারি মানের হলেও তার মন ছিল অন্য জগতে—আকাশে। প্রায়ই সে চুপচাপ মাঠে বসে তারাগুলো গুনত, কল্পনা করত ওপারে কী আছে। সেইদিনও সে একই অভ্যাসে মাঠের কিনারায় চলে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎই তার চোখে পড়ে গেল একটি অদ্ভুত দৃশ্য। ঝড়ে ভেঙে পড়া একটি পুরোনো বটগাছের শেকড়ের নিচে কিছু যেন জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে প্রথমে মনে হলো হয়তো কাচের টুকরো, সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে। কিন্তু কাছে যেতেই অরিন দেখল,…
 - 
				
ঋত্বিক দাশগুপ্ত পর্ব ১ : হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি কোলকাতার পুরোনো উত্তর শহরের ভাঙাচোরা গলির ভেতর এক নিস্তব্ধ বিকেলে অরিন্দম দত্ত নিজের বাবার কাঠের আলমারিটা খুলে বসেছিল। ধুলো জমে থাকা পুরোনো কাগজ, শুকনো কালির দাগ, আর অচেনা হিজিবিজি আঁকায় ভর্তি খাতাগুলো সবসময়ই তাকে টানত। বাবা ছিলেন একসময়ের ভ্রমণপিপাসু, যিনি চাকরি আর সংসারের চাপে সেই টানকে গুছিয়ে রেখেছিলেন আলমারির অন্ধকারে। বাবার মৃত্যুর দু’বছর পরেও অরিন্দম প্রায়ই এই আলমারিটা খুঁজে খুঁজে দেখত, যেন কোথাও লুকিয়ে আছে বাবার জীবনের অজানা কোনো গল্প। সেই বিকেলেই তার চোখে পড়ল চামড়ার মলাট বাঁধানো এক ডায়েরি। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো ছুঁয়ে অরিন্দমের শরীরে কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ জাগল।…
 - 
				
প্রিয়ম চক্রবর্তী শরতের শেষ ভাগ, আকাশে তুলোর মতো ভাসমান মেঘ আর বাতাসে ধানের গন্ধ মিশে আছে। কলকাতার ইতিহাসবিদ অনিন্দ্য মুখার্জী ও তাঁর স্ত্রী সায়ন্তী ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে, যেখানে স্থানীয় কলেজে আয়োজিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও লোককথা নিয়ে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হবে অনিন্দ্যকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন্তী ক্যামেরা হাতে ধানক্ষেত, নদীর ধারে চরাচর, আর মাটির ঘরের ছবি তুলছিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের সরলতা সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ রাখে, আর অনিন্দ্যর কাছে লোককথা মানে ইতিহাসের ভেতরে লুকোনো এক অদেখা দরজা। সেমিনার ভেন্যুটি ছিল গ্রামপঞ্চায়েত ভবনের বড় হলঘর, যেখানে বাঁশের মাচা দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, কাগজের…
 - 
				
অরিন্দম ঘোষ পর্ব ১ : প্রথম সূত্র কলকাতার গরম বিকেলটা অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ ছিল। কলেজ স্ট্রিটের বুকশপগুলোতে ভিড় কমে আসছিল, বই হাতে নিয়ে দু-চারজন ছাত্র পায়ে টেনে হাঁটছিল। রক্তিম সেনের চোখ তীক্ষ্ণ, তার হাতের পাতায় ধরা এক মলিন খাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আর্কাইভ ঘেঁটে এইমাত্র সে খাতাটা পেয়েছে—ভুলে যাওয়া এক জমিদারবাড়ির দলিল। হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ, তার ভেতরে খসখসে অক্ষরে লেখা নাম—“রায়বাহাদুর শশাঙ্ক মুখার্জি, ১৮৬৪।” রক্তিমের ভ্রু কুঁচকে গেল। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সে জানে, শশাঙ্ক মুখার্জি ছিলেন মুর্শিদাবাদের এক বিত্তশালী জমিদার, যিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে হঠাৎ করে পুরো বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিংবদন্তি আছে, তার ভিটেবাড়ির ভেতর…
 - 
				
শুভ্রজিত ঘোষাল অধ্যায় ১ – সূর্যের ডাক ২১শ শতকের শেষ দিকে, পৃথিবীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে সূর্যের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনও শনাক্ত করা সম্ভব। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ISRC) কলকাতা শাখায় সেই রাতে সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। রাত দুইটা পেরিয়ে গেছে, পর্যবেক্ষণ ঘরে শুধুই যন্ত্রের মৃদু শব্দ, আর কম্পিউটার স্ক্রিনে অনবরত ভেসে আসা ডেটা। হঠাৎ, স্যাটেলাইট “সৌরবিকাশ–৭” থেকে আসা লাইভ ফিডে দেখা গেল এক অদ্ভুত সিগন্যাল—তীব্র তাপের সমুদ্রের মাঝে যেন একটি স্থির, ঠান্ডা বিন্দু। ডিউটি অফিসার প্রথমে ভাবলেন, হয়তো সেন্সর ত্রুটি। কিন্তু চেক করার পর দেখা গেল, সব সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করছে। সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাঠানো হল ড. সৌম্যদীপ…
 - 
				
প্রতুল মন্ডল ১ নভেম্বরের হিমেল সকাল। শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা দার্জিলিং মেল ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোলে ঢুকছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ঋত্বিক চৌধুরীর চোখে ছিল গভীর এক কৌতূহল—একটা অদ্ভুত টান। অভিষেক তার সঙ্গী, যার চোখে-মুখে রোমাঞ্চের ঝলক থাকলেও সে ছিল মূলত ছুটি কাটাতে এসেছে, হিমালয়ের শান্তি আর কিছু ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য ছবি তুলতে। ওরা দুজনেই কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু প্রকৃতির কাছে যেতে, কিন্তু ঋত্বিক জানে, এই ভ্রমণ শুধু অবকাশ নয়। গত ছ’মাসে তার হাতে কোনও ‘কেস’ আসেনি, অথচ এই পাহাড়ি গ্রাম ‘চান্দাক’-এর আশেপাশে কয়েকজন পর্যটক হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার খবর এক অখ্যাত অনলাইন ব্লগে পড়ে সে স্থির করে,…
 - 
				
ঋতব্রত সেন [১] জুলাইয়ের এক মেঘলা দুপুরে মিহির তার ঠাকুরদার পুরনো কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখান থেকে ধুলোমাখা বই আর ভাঙা পুতুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। ঠাকুরদা, বিশ্বেশ্বর পাল, এককালে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন—তার চোখে এখনও সেই অতীতের আলো জ্বলে। মিহির ছুটির দিনে তার কাছ থেকে নানা কাহিনি শুনতে ভালোবাসত, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরের পুতুলশিল্প ও রাজাদের গোপন ইতিহাস। সেই দিন, যখন বৃষ্টি বাইরের দিগন্ত ঘিরে রেখেছিল, ঠাকুরদা হঠাৎ এক গল্প শুরু করলেন—একটা পরিত্যক্ত বাড়ির, যেটি সবাই ‘পুতুলবাড়ি’ বলে চিনত। সেই বাড়ি নাকি এক কালে ছিল রামানন্দ পাল নামের এক পুতুলশিল্পীর, যিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দরবারে কাজ করতেন। কথিত আছে, রাজপরিবারের গুপ্তধন…