হিয়া মিত্র পর্ব ১: পূর্ণিমার আগে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে ওঠার সময় অরণ্য ভাবছিল, শহরের শব্দকে যদি কাগজে বন্দি করে রাখা যেত, তবে হয়তো সে বুঝতে পারত নীরবতার প্রকৃত মানে কী। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল চা-বাগানের ঢেউ, দূরে নীলচে পাহাড়, আর মাঝেমাঝে রাতের বৃষ্টির পর জমে থাকা কাদা। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই কুয়াশা ওড়ার মতো ভেসে এসে তার গায়ে লাগল—ঠাণ্ডা, কিন্তু দংশনহীন। এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: একান্তে বসে নতুন কবিতার বইয়ের খসড়া শেষ করা। কিন্তু উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলেই কি পথ অনাড়ম্বর থাকে? গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে বসে সে অল্প চিনি দিয়ে চা খাচ্ছিল। দোকানদার, বলিষ্ঠ গড়নের, গায়ের ওপর মোটা সোয়েটার টেনে, জিজ্ঞেস…
-
-
অন্বেষা দত্ত শীতের মেঘলা সকালটা যেন নিজের ভিতরেই কথা বলছিল। জলপাইগুড়ির ছোট শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সৃজনী ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অব্যক্ত ঘুম ভাঙার শব্দ শুনতে পেল। দূরের মাঠে পৌষমেলা বসেছে— বাঁশের খুঁটি, তালপাতার ছাউনি, বেলুন, হাতে আঁকা ফেস্টুন; চায়ের ভাপ ওঠা কাপে দোকানিরা চুন-সুরক্ষা দেওয়া আঙুলে গরম গরম গোলমরিচ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সৃজনীর লালচে কোটের ওপর ভেজা কুয়াশা বসে আছে, তবু সে থামল— শুধু মেলার গন্ধটা ভালো করে নেবার জন্য। কাঁচা কাঠ, তাজা উলের শাল, শুঁটকি নুডলসের হালকা ধোঁয়া, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা “পর্যটকগণ, সামলে হাঁটুন”— এমন সব গন্ধ-শব্দে সকালটা তীব্র, কিন্তু শান্ত। কলকাতার চৌকো জীবনে সব আছে—…
-
অনন্যা চক্রবর্তী পর্ব ১ : স্টেশন নম্বর সাত শীতের বিকেল নামছিল একরকম ধীর অনুতাপে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের চতুর্থ প্ল্যাটফর্মটা অকারণে নির্জন হয়ে উঠেছিল — যেন এই শহর, এই ট্র্যাক, এই হুইসেল, এই কুয়াশার ভেতর লুকিয়ে রাখা হয়েছে কারও একান্ত চিঠির মতো কিছু, যা কেউ পড়ে না, তবুও লিখে যায়। ঈশিতা প্রথম দিন এই স্টেশনের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভাবেনি, সে কবে নিজে এই শহরের নির্জনতায় মিশে যাবে। তার বুকে তখনও কলকাতার জ্যাম ছিল, ট্রামলাইনের শব্দ ছিল, আর ছিল ব্যস্ততা — যা ভেতরে ভেতরে তাকে ফাঁপা করে তুলছিল। দার্জিলিং কলেজ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন একমাস হলো। কোয়ার্টারে বই খুলে বসতে গিয়ে যেসব…
-
ঋদ্ধিমান চক্রবর্তী পর্ব ১: চিঠির খামে কাঞ্চনজঙ্ঘা পুজোর ঠিক আগের দিন সকালে মিঠির চিঠিখানা হাতে আসে—একটা পুরোনো বাদামি খামে, অদ্ভুত সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ‘মিতালী সেন’ নামটা ঠিক তার ছেলেবেলার ডাকনামের পাশে। তবে এই ডাকনামটা আজ বহু বছর কেউ ডাকে না, এমনকি নিজের কাছেও মিঠি অনেককাল হয়ে গেছে মিসেস মিতালী বসু। কিন্তু চিঠিটা খুলতেই মনে হল, সময় যেন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রেরক: প্রমথেশ চৌধুরী। ঠিকানা: সেন ভিলা, হিলকার্ট রোড, দার্জিলিং। তারিখ: ১৯৮৬। মিঠি শিউরে উঠেছিল। ১৯৮৬? তা হলে এই চিঠিটা এখন তার হাতে পৌঁছেছে ৩৯ বছর পরে? চিঠির ভাঁজে আরও ছিল একটি ছোট স্কেচ—হাতের আঁকা, পেনসিলে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া, এক…
-
রক্তিম জানা বাড়িটা একটু বেশিই ঠান্ডা বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই চারজন দাঁড়িয়ে ছিল পাণ্ডুগ্রামের পুরনো ‘সিংহবাড়ি’র সামনে। সাদা রঙের ছোপ ছোপ দেয়াল, বড় বড় কাঠের জানালা, আর ছাদের কিনারা দিয়ে বেয়ে নামা আগাছা দেখে মনে হচ্ছিল বাড়িটা কাঁদছে। “এই বাড়িতেই না তোর মামাবাড়ি ছিল, বুদু?”— প্রশ্ন করল চঞ্চল, যার চশমার কাঁচের পেছন থেকে সবসময় একটা অবিশ্বাস ফুটে বেরোয়। “হ্যাঁ রে… কিন্তু তোরা জানিস না, আমার মামারা কেন এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে গেল,”— গলায় অদ্ভুত এক থমথমে ভাব এনে বলল বুদু। “ভূতের গল্প করিস না,”— বলল তোতন, যার বুকের মধ্যে বাঘ থাকলেও পোকা দেখলে চেঁচিয়ে উঠে। “ভূত হলে তো…