প্রিয়াংশু মুখোপাধ্যায় অধ্যায় ১ গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে কাঁদামাটি ধীরে ধীরে কালচে ধূসর বালিতে মিশে গেছে, আর গঙ্গার একটি পরিত্যক্ত শাখা নদী যেন মৃত সাপের মতো স্থির হয়ে শুয়ে আছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রাচীন শ্মশান। দিনের বেলাতেও এখানে ছায়া ঘন হয়, আর রাত নামলে মনে হয় যেন অদৃশ্য কোনো প্রহরী অন্ধকারের চাদর মেলে দিয়েছে। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এই শ্মশান একসময় জমিদারদের পারিবারিক চিতা স্থল ছিল, পরে ধীরে ধীরে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। তার ভাঙাচোরা প্রবেশদ্বারের ওপরের পাথরের খোদাইয়ে ক্ষীণভাবে এখনও দেখা যায় কালো দাঁত বের করা দেবীমূর্তি, যার চোখে লাল সিঁদুর লেপ্টে আছে। আশেপাশের পুরনো শিমুল, শিরীষ আর…
-
-
প্রিয়ম চক্রবর্তী শরতের শেষ ভাগ, আকাশে তুলোর মতো ভাসমান মেঘ আর বাতাসে ধানের গন্ধ মিশে আছে। কলকাতার ইতিহাসবিদ অনিন্দ্য মুখার্জী ও তাঁর স্ত্রী সায়ন্তী ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে, যেখানে স্থানীয় কলেজে আয়োজিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও লোককথা নিয়ে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হবে অনিন্দ্যকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন্তী ক্যামেরা হাতে ধানক্ষেত, নদীর ধারে চরাচর, আর মাটির ঘরের ছবি তুলছিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের সরলতা সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ রাখে, আর অনিন্দ্যর কাছে লোককথা মানে ইতিহাসের ভেতরে লুকোনো এক অদেখা দরজা। সেমিনার ভেন্যুটি ছিল গ্রামপঞ্চায়েত ভবনের বড় হলঘর, যেখানে বাঁশের মাচা দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, কাগজের…
-
অর্ঘ্য দত্ত আগমন বিকেলের আলো তখনো জমে আছে গাছের পাতায়, যখন শুভম দাস ট্রেন থেকে নামল। ছোট্ট একটা স্টেশন—নাম ‘মাহেশচর’। আশেপাশে ঝিম ধরা সবুজ মাঠ, দূরে একটা নদীর রেখা দেখা যায়, আর ঝাঁক বেঁধে উড়ছে সাদা বক। শুভম শহরের ছেলে, কলকাতার এক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। পিএইচডির বিষয় “লোকজ কৃষিপদ্ধতি ও তার সামাজিক প্রভাব”, আর সেই সূত্রেই আজ এই প্রত্যন্ত জায়গায় তার পদার্পণ। এতটা ভিতরে ঢুকতে হবে, তা আগে আন্দাজ করেনি। স্থানীয় এক শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছে গ্রামের নাম—গোপীনাথপুর, আর সেই গ্রামের পাশেই একটি রহস্যময় ধানখেত, যেখানে প্রতি বছর নবান্নর আগের রাতে কেউ পা রাখে না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই…
-
ঋজু বসু সাঁইবাবা মন্দিরের পেছনের সরু গলি দিয়ে ঢুকলেই একখানা বাড়ি চোখে পড়ে, তার তিন তলা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন নিজের অস্তিত্বের প্রতিবাদে, অথচ প্রতিটি জানালায় জীর্ণ কাচ, প্রতিটি দেয়ালে কুয়াশার দাগ। রামেশ্বর লেন ৩। লোকেরা বলে, ওটা ঘড়িওয়ালা বাড়ি। কারণ বাড়িটার ভেতর যত ঘড়ি আছে, সব থেমে আছে—ঠিক রাত বারোটায়। কেউ বলে সেগুলো আর চলে না, কেউ বলে এগুলো নতুন কারও জন্য অপেক্ষায়। ইতিহাসের গবেষক সায়ন্তিকা সাহা এসব কুসংস্কার মানে না, কিন্তু অলৌকিক স্থাপত্য নিয়ে তার থিসিসের জন্য এই বাড়িটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, একরাত কাটিয়ে যাবে। সঙ্গে ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার আর তার বন্ধু চন্দন, যার একটাই…
-
ঋতবান চ্যাটার্জী হারিয়ে যাওয়া সকাল পুরুলিয়ার ঘাঘরা গ্রাম যেন একটানা নিঃশব্দে বেঁচে থাকে। এই গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে শীতল সুবর্ণরেখা, আর মাথার ওপর ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র শাল-সেগুন। এখানে দিনের আলো পড়ে নরম, আর রাতের অন্ধকার গাঢ়, জ্যোৎস্নাতেও কালো। কেবলই যেন কেউ দেখে, তবু ধরা পড়ে না। বিপ্লব দাস ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক। গ্রামের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু ভালোবাসার চোখে—যেন তিনি তাঁদের আশার বাতি। সকাল সাতটায় উঠোনে লাল চায়ের কাপ হাতে বসে থাকতেন, পোষা কুকুর ‘রাঙা’ পায়ের পাশে বসে। সেদিন সকালে রাঙা ছিল, কাপটাও ছিল, শুধু মানুষটা ছিল না। অরুন্ধতী, বিপ্লবের স্ত্রী, প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বাজারে…