সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১ – প্রতিদিনের দেখা সকালের মেট্রো যেন শহরের ভেতরে আলাদা এক নদী। সেই নদীতে প্রতিদিন ভেসে যায় অসংখ্য মুখ, হাজারো ব্যস্ততা, কোলাহলের ঢেউ। অরণ্যের দিনও শুরু হয় ঠিক সেভাবেই—আলোর ফোঁটায় ভেসে ওঠা সল্টলেকের এক অচেনা ফ্ল্যাটবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে, অগণিত মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষে দক্ষিণমুখী মেট্রোরেলের কোচে উঠে বসা। অফিসের টাইমকার্ড, মিটিং, ল্যাপটপ—সবই যেন এক অদৃশ্য নিয়মের বাঁধনে বাঁধা। অথচ এই অচেনা যাত্রার মাঝেই কখন যে একটা মুখ ধীরে ধীরে তার দিনের শুরু আর শেষ হয়ে উঠতে লাগল, সে নিজেও টের পেল না। প্রথম দিনটিতে কিছু বিশেষ ছিল না। এসপ্ল্যানেডের ভিড়ভাট্টার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অরণ্য হঠাৎ…
-
-
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় পুরুলিয়ার লাল মাটির রাস্তা যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ভিজে ছিল। ঋত্বিক সেনগুপ্তের বাস থেকে নামতেই ধুলো মেখে গেল জুতো। কলকাতা থেকে এখানে পৌঁছতে প্রায় নয় ঘণ্টা লেগেছে—স্টেশন থেকে বাস, বাস থেকে আবার চোট্টোখাটো জিপ। চারপাশে শুধু শাল, পিয়াল, মহুয়ার গন্ধ, দূরে টিলা আর ঝকঝকে নীল আকাশ। তার ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েই একবার চারদিক দেখে নিল সে। মনে হচ্ছিল, এ জায়গাটার বুকের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কোনও গল্প, যে গল্প ফোটে না শহরের আলোয়, কেবল গ্রামবাংলার অচেনা অন্ধকারেই তার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। ঋত্বিকের সঙ্গে এসেছিল তৃষা—বন্ধু, সহযাত্রী আর কৌতূহলী সঙ্গী। ওর চোখে এ ভ্রমণটা শুধু ফটোগ্রাফির জন্য নয়,…
-
সুজন কর্মকার ১ কলকাতার এক শীতল বিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অডিটোরিয়ামে জমে উঠেছিল এক বিশেষ বক্তৃতা। উপস্থিত দর্শকদের ভিড় ভরিয়ে দিয়েছিল সাদা দেয়ালঘেরা হলে, যেখানে একদিকে ছাত্রছাত্রীরা তাদের খাতায় দ্রুত নোট নিচ্ছিল, অন্যদিকে কিছু অধ্যাপক কপালে ভাঁজ ফেলে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলেন ড. অরিত্র মুখার্জী—একজন প্রখ্যাত পদার্থবিদ, যিনি গবেষণায় যেমন কড়া, তেমনি মতামতে দৃঢ়। লম্বাটে চেহারা, নাকের উপর সোনালি ফ্রেমের চশমা, আর হাতে একটি সাদা চক—এমন ভঙ্গিমায় তিনি যেন একাই এক অদম্য শক্তি। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল স্বচ্ছ, কঠিন অথচ প্রলুব্ধকর। তিনি বোর্ডে জটিল সমীকরণ লিখে বলছিলেন, “এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তার পেছনে আছে গণনা, সূত্র, এবং ব্যাখ্যাযোগ্য পদার্থবিদ্যা।…
-
অভ্রনীল দত্ত পর্ব ১ – যাত্রা শুরু সকালবেলা কোলাহলমুখর শিয়ালদহ স্টেশনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে যখন তারা সবাই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল, তখনও কারও মাথায় ছায়ামাত্রও ছিল না কী অপেক্ষা করছে সামনে। কলকাতার এই পাঁচজন কলেজ–বন্ধু—অনিক, সুমিত, তন্ময়, দেবলীনা আর রুদ্র—দীর্ঘদিন পর আবার মিলে একসঙ্গে কোথাও বেরোচ্ছে। গন্তব্য সুন্দরবন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য একটাই—দু–একদিন শহরের কোলাহল ভুলে প্রকৃতির নির্জন অরণ্যে কিছুটা সময় কাটানো, বাঘ দেখার ভাগ্য হলে আরও ভালো, আর সবার ওপরে একধরনের অদেখাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা। রুদ্র, যে দলের মধ্যে সবচেয়ে উচ্ছল, আগেই পরিকল্পনা করেছিল গোটা ট্রিপ। সে বলেছিল—“এইবার তো পুজোর ভিড় নেই, একেবারে নিস্তব্ধ জঙ্গলে গিয়ে আসব। কী রোমাঞ্চ বলো তো!” বাকিরা তার কথায়…
-
তনয়া সেন বিকেলের শেষ আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে ধূসর হয়ে গলে আসছিল, তখনই অরণ্যের বাস এসে পৌঁছল ছোট্ট গ্রামটায়। বাস বলতে আসলে একটা পুরোনো মিনিবাস, জানালার কাচ ঝাপসা, সিটের চামড়ায় ফাটল। গাঁয়ের নাম রাধাপুর—এমন নাম মানচিত্রে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবু অরণ্যের মতো ফটোগ্রাফারের কাছে এই জায়গার টান ছিল অন্যরকম। শহরের কোলাহল, নামজাদা প্রকল্প, নামী রিসর্ট নয়—বরং অচেনা, অনাবিষ্কৃত জায়গার মধ্যে লুকোনো প্রকৃতির ছবি তুলতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে। অরণ্যের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ভারী, ভিতরে ক্যামেরা, লেন্স, ত্রিপড আর কিছু নোটবুক। বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, এই গ্রাম যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের ঘর, বাচ্চাদের…
-
হিয়া মিত্র পর্ব ১: পূর্ণিমার আগে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে ওঠার সময় অরণ্য ভাবছিল, শহরের শব্দকে যদি কাগজে বন্দি করে রাখা যেত, তবে হয়তো সে বুঝতে পারত নীরবতার প্রকৃত মানে কী। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল চা-বাগানের ঢেউ, দূরে নীলচে পাহাড়, আর মাঝেমাঝে রাতের বৃষ্টির পর জমে থাকা কাদা। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই কুয়াশা ওড়ার মতো ভেসে এসে তার গায়ে লাগল—ঠাণ্ডা, কিন্তু দংশনহীন। এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: একান্তে বসে নতুন কবিতার বইয়ের খসড়া শেষ করা। কিন্তু উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলেই কি পথ অনাড়ম্বর থাকে? গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে বসে সে অল্প চিনি দিয়ে চা খাচ্ছিল। দোকানদার, বলিষ্ঠ গড়নের, গায়ের ওপর মোটা সোয়েটার টেনে, জিজ্ঞেস…
-
অনির্বাণ দত্ত সেই বিকেলের দেখা গড়িয়াহাট মোড়ের ব্যস্ততা তখন বর্ষার বৃষ্টিতে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। পথঘাট কাদা আর জলের প্যাচপেচে স্রোতে ভারাক্রান্ত, অথচ সেই মেঘলা বিকেলে কলকাতার আকাশে যেন কোনো অচেনা অপেক্ষার আলো ছড়িয়ে ছিল। ভিড় ঠেলে হাঁটছিল ঈশিতা। হাতে ধরা ছাতাটা বারবার উল্টে যাচ্ছিল হাওয়ায়, আর তার চশমার কাচে জলের ছিটে জমে অদ্ভুত একটা ঝাপসা দৃষ্টি তৈরি করছিল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের সবকিছু যেন ভুল ঠিকানায় রাখা ছবি—একটু চেনা, একটু অচেনা। হঠাৎই চোখে পড়ল সেই মুখটা—অরণ্য। পাঁচ বছর পর। মাথার চুলে হালকা পাক ধরেছে, চোখের কোণে একটু বয়সের রেখা, কিন্তু হাসিটা এখনও তেমনই—একটু লাজুক, একটু ঠোঁটের কোণে অসমাপ্ত। তার হাতে কাগজে…