নীলয় বসাক এক অরণ্যের আঁকাবাঁকা রাস্তায় ভোরের প্রথম আলো ভেসে আসছিল। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ধরে বহুটা পথ পেরিয়ে রিচার্ড অবশেষে পৌঁছাল সেই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে, যাকে স্থানীয়রা ‘রংভ্যালি’ বলে ডাকে। গ্রামের নাম মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না, পর্যটন গাইডবুকেও তার উল্লেখ নেই। তবু পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় মোড়া জায়গাটির প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ টেনেছিল তাকে। মেঘলা আকাশের নিচে সিঁড়ির মতো সাজানো ধানক্ষেত, কুয়াশায় আধঢাকা ছোট ছোট কুঁড়েঘর আর মাটির রাস্তার ধারে পাথর বসানো ঢাল—সবকিছু যেন রিচার্ডের চোখে এক অলৌকিক দৃশ্যের মতো ভেসে উঠল। লম্বা দেহ, খয়েরি দাড়ি আর গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে গ্রামের সীমানায় পা রাখতেই লোকেরা থমকে তাকাল। এত দূরে, এত…
- 
				
 - 
				
দেবাশিস রায় পুরোনো নদীর ঘাটটি এখন যেন সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া একটি জায়গা। দিনের বেলায়ও মানুষের পদচারণা খুবই কম, রাতে তা যেন আরও একাকী হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের তীব্র রোদ কিংবা বর্ষার ঝড়—সবকিছু মিলিয়ে ঘাটের কাঠের ডেক, ছেঁড়া দোলনা, এবং ভাঙা নৌকা-সবকিছুই অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। নদীর ধারে ধুলো মিশ্রিত কাদামাটি, নরম বাতাসে পানি ধীরে ধীরে ধোঁয়া হয়ে ওঠে, আর নীরবতা এতটাই ঘন যে মাঝে মাঝে দূরের জঙ্গলের পাতা হেলানো শব্দও স্পষ্ট মনে হয়। রাতের অন্ধকারে ঘাট যেন এক রহস্যময় স্থান, যেখানে সময় থেমে গেছে—প্রতিটি সোপান, প্রতিটি নৌকা যেন অতীতের কোনো গল্পের সাক্ষী। অরুণ, একমাত্র নৌকাওয়ালা, এখানে দিনরাত কাটায়। সে নিজেকে এই…
 - 
				
অমিত পাল রাতের অন্ধকার গ্রামটিকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করেছিল। চারপাশে নীরবতা, যেন পৃথিবীর সব শব্দ মুছে গেছে। পাতাগুলোর উপর হালকা শিশির জমে আছে, আর বাতাস নীরবভাবে গাছের পাতা দুলাচ্ছে। ছোট্ট গ্রামটির মাটির রাস্তাগুলো এখনো দিনের আলো থেকে দূর্যোগের মতো ফাঁকা। ঘরগুলো নিস্তেজ, জানালার পাশে কোনো আলো জ্বলছে না। তবে গ্রামের এক কোণে, নদীর ধারে, রূপসা একা বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে অদ্ভুত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এক অচেনা ভয়ও জমেছে। সে জানে, এই রাত অন্য রকম। প্রতিবার এই সময় যখন আকাশে চাঁদের আলো নরম হয়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সে অনুভব করে গ্রামের সাধারণ নীরবতার মধ্যে লুকানো একটি অদ্ভুত শক্তি। সে…
 - 
				
অমিয় মল্লিক ১ ভোরের ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন আকাশের গাঢ় নীল ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে রঙ নেয় কমলা-সোনালি আভা, গ্রামের মানুষদের ঘুম যেন এক অদৃশ্য শক্তি ভেঙে দেয়। একে একে কুঁড়েঘরের দরজা খুলে যায়, উঠোনে আলো ফোটার আগেই গৃহস্থরা চমকে ওঠে—দূর থেকে ভেসে আসছে এক অদ্ভুত সুর, এক চণ্ডীপাঠের গম্ভীর ধ্বনি। মাটির ভেতর থেকে যেন শিকড় টেনে আনে সেই শব্দ, আর সকালের শিউলি গাছের ফুলের মতো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামবাসী জানে, সেই বাড়িটা বহু বছর ধরে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে, তাতে আর কেউ থাকে না। তবু প্রতি মহালয়ার ভোরেই শোনা যায় এই পাঠ। বৃদ্ধারা চোখে আতঙ্ক মাখে, কিশোররা সাহস দেখাতে…
 - 
				
সমীর দাস ১ শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন কুঠিবাড়ি—জমকালো অতীতের ক্লান্ত ছায়া যেন তার শরীরজুড়ে বসে আছে। কাঁচা রাস্তা ধরে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঈশান ও মিতালি প্রথম দিন বাড়িটায় পা রাখল। চারপাশে নির্জনতা, কেবল পাখির ডাক, আর মাঝেমধ্যে ঝোপের মধ্যে কী যেন সরসর শব্দ। দূরে ধীরে বয়ে চলেছে একটি অলস নদী—তার পাড়ে শাল, সেগুন আর করমচা গাছে ঘেরা এই প্রাসাদসমান কাঠামোটি যেন নিঃশ্বাস ফেলে। ঈশান, একজন শহরের স্থপতি, পুরনো স্থাপত্য ভালোবাসে। বহুদিন ধরেই ওর ইচ্ছে ছিল এমন এক নিঃসঙ্গ জায়গায় থাকা, যেখানে আধুনিক দুনিয়ার ছোঁয়া কম, এবং নিজের কাজের জন্য নির্মল নিঃশব্দতা পাওয়া যাবে।…
 - 
				
সিদ্ধাৰ্থ ঘোষাল এক দূর রাজস্থানের মরুপথ পেরিয়ে ড. সায়ন মিত্র সেই পরিত্যক্ত দুর্গে পৌঁছেছিলেন এক গ্রীষ্মসন্ধ্যায়, যখন সূর্যাস্তের আগুনে মিশে যাচ্ছিল বালি ও ইটের স্তম্ভ। চারপাশে ধ্বংসস্তূপের নীরবতা, কেবল মাঝে মাঝে বালুর ঝোড়ো বাতাসের শব্দ, আর পুরনো দরজার কঁকিয়ে ওঠা। এই দুর্গটি, লোকমুখে “রক্তবিন্দু মহল” নামে পরিচিত, মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পরিত্যক্ত হয়। স্থানীয় কাহিনি অনুসারে, এখানে রাজা বিক্রমসিংহের পুত্রবধূ প্রতিভাদেবী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে—তাঁর রক্তে ভেজা একটি নেকলেস আজও কোথাও লুকিয়ে আছে, এমনটাই দাবি করে লোককথা। কিন্তু সায়নের আগ্রহ রূপকথায় নয়—তিনি খুঁজছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ, ইতিহাসের দলিল। সঙ্গে ছিল তার পুরোনো খাতাগুলি, ক্যামেরা, এক বোতল জল…