বোধিসত্ত্ব চক্রবর্তী (১) কলকাতার নারকেলডাঙার থানায় সদ্য বদলি হয়ে আসা অফিসার অরিত্র বসু জানতেন না, এই বদলি তার জীবনের সব যুক্তি-পরম্পরাকে ভেঙে দেবে। সেই সময় বর্ষা শেষের দিন, আকাশে ছাইরঙা মেঘের স্তর ঝুলছে। সকালবেলা থানায় বসেই অরিত্রর হাতে এসে পড়ে এক বিশেষ চিঠি—দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ‘ছায়ামাটি’তে পরপর তিন বছর একদিনে আগুন লেগে গেছে, গ্রামের একাংশ ছাই হয়ে গেছে, এবং আজও কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। চিঠির নিচে স্বাক্ষর করেছেন ডি.এস.পি. গগন সরকার—অরিত্রকে বলা হয়েছে, ঘটনাটি তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। অরিত্র প্রথমে ভাবলেন, এ তো ফায়ার ব্রিগেডের ব্যাপার, পুলিশের কী? কিন্তু পড়তে পড়তে চোখ…
-
-
এক দুপুরটা আজ যেন একটু বেশি নিস্তব্ধ। বাইরের রাস্তায় ছায়া পড়েছে সামনের অশ্বত্থ গাছের পাতায়; বাতাস নেই, শুধু একটা অনুজ্জ্বল আলো জানালার কাচে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। অদ্রিজা কোলের উপর রাখা বইটার পাতায় চোখ রেখে বসে আছে, অথচ পড়া নয়, সে দেখছে পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির ছায়া—যেখানে ছেলেটি, অনির্বাণ, ঠিক দুপুর বারোটা নাগাদ এসে দাঁড়ায় একটা মগ হাতে। প্রতিদিনের মতো আজও সে এসেছে। হালকা নীল শার্ট, খোলা চুলের মধ্যে একটুখানি এলোমেলোতা—যা দেখে অদ্রিজার মনে হয়, ছেলেটি বুঝি কোনও কল্পনার বই থেকে উঠে এসেছে। ছেলেটির চোখ থাকে নিচে, কিংবা দূরে কোথাও—তাকে দেখে না ঠিক, কিন্তু অদ্রিজার মনে হয়, ওর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা আসলে…
-
১ ঋভু সেনগুপ্ত ভোরবেলা কলকাতা থেকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেই বুঝে গিয়েছিল—এই যাত্রা তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত আর অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে। সাংবাদিক জীবনে সে বহু ঘটনা দেখেছে, বহু মানুষ, কিন্তু এমন এক গুহার অস্তিত্ব—যেখানে আজও ‘দক্ষিণাগ্নি’ নামে তান্ত্রিক যজ্ঞ হয়, তা শুনে প্রথমে অবিশ্বাসই করেছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেই তার হাতে এসে পড়েছিল এক পুরনো চিঠি, যা লিখেছিলেন একজন মৃত প্রত্নতত্ত্ববিদ—ড. বিভাস মুখোপাধ্যায়। চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত এক অরণ্যঘেরা গুহার, যেখানে “দেহান্তরণ” নামক এক প্রাচীন তন্ত্রচর্চা আজও গোপনে চলে। চিঠিতে লেখা ছিল একটি মাত্র লাইন: “যদি সত্য জানতে চাও, তবে আগুনকে ভয় পেও না। দক্ষিণাগ্নি সব জানে।” সেই লাইন…
-
অন্বেষা চৌধুরী অধ্যায় ১ আগমনের দিন কলকাতা থেকে শিলংয়ের ফ্লাইটটা ধরার সময় অরণ্যার চোখে একধরনের অদ্ভুত নির্লিপ্তি ছিল। সানগ্লাসের আড়ালে লুকোনো চোখে যেন ক্লান্তির ছায়া ছিল, আবার কোথাও একটা উন্মুখ প্রত্যাশার কাঁচা আলোর রেখাও। গত তিন বছর ধরে মুম্বইয়ের কর্পোরেট জীবন তাকে কেবল কাজের বোঝা আর অনিদ্রার অভিশাপই দিয়েছে। সৃষ্টিশীল মানুষ হয়েও, নিজের মধ্যেকার সৃষ্টিকে সে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করে এসেছে; সবকিছু যেন স্বয়ংক্রিয় হয়ে গিয়েছিল—এক রোবোটিক দিনের পর দিন। তাই এক সকালে, চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে মুম্বইয়ের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল—আর নয়। কিছুতেই আর নয়। অফিসে ই-মেইল করে দিয়েছিল, “I resign, effective immediately.”…
-
অভিষেক মজুমদার অধ্যায় ১: সুন্দরবনের প্রান্তসীমায় ছোট্ট গ্রাম কুয়াখালির ভোরবেলা আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। সেই সকালটায় বাতাসে যেন অদ্ভুত গন্ধ, নদীর জলে অশান্ত ঢেউ, আর আকাশে পাখিদের ডাকেও এক অজানা আশঙ্কার সুর মিশে ছিল। অদ্বৈত ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে দূরের জঙ্গলের দিকটা দেখছিল, চোখে ছিল স্বপ্ন আর মনে দুরু দুরু কাঁপন। সোনার নদীর গল্প শোনা সেই রাতের পর থেকে তার মনের মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকা অজানা সাহস বেরিয়ে এসেছিল। লালু, কৃষ্ণ, চিনু আর শিবু—চারজন মিলে অদ্বৈতের সঙ্গে রাতভর আলোচনা করে ঠিক করেছে, এবার তাদের যাত্রা শুরু হবে। বুড়ো হরিপদ মৎস্যজীবী, যে কিনা প্রায় অন্ধ আর সর্বক্ষণ মদ খেয়ে থাকে, সেই…
-
শ্রীজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রেন ছাড়ার হুইসেল যখন শিয়ালদহ স্টেশনের কোলাহল কেটে রাতের নিস্তব্ধতাকে চিরে দিল, তখন আমি জানলার পাশে বসে সামনের সাত দিনের চিন্তায় ডুবে ছিলাম। ব্যাগে জুতসই জামাকাপড়, হাতে একটা নোটবুক, মাথায় শুধু একটাই ইচ্ছা—নিজেকে একটু খুঁজে পাওয়া। নামটা আগেই ঠিক ছিল—কালিম্পং। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, মিরিক ঘুরে ফেলেছি অনেকবার, কিন্তু এই পাহাড়ি শহরটা আমার কাছে ছিল এক রহস্য। ট্রেন ছুটছে—কাঁচের বাইরে শহরের আলো এক এক করে ফিকে হয়ে আসছে। পাশে বসা সত্তরোর্ধ্ব ভদ্রলোক হঠাৎ কথা বলে উঠলেন, “উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন?” আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, কালিম্পং।” তিনি চোখ মুছলেন, “কালিম্পং মানে আমার শৈশব। আপনার ভালো লাগবে, খুব ভালো।” রাত বাড়ছে, ট্রেন এগোচ্ছে শিলিগুড়ির…
-
রাতুল কোনার ধুলেশ্বরীর সকাল ধুলেশ্বরী গ্রামের সকালটা এককালে ছিল পাখির ডাক, লোনা হাওয়ার সুবাস, আর নারকেল পাতার ফিসফিসে কথার মধুর মিলনমেলা। এখন? এখন শুধু নোনাজলের ঝাঁঝ, ভাঙা কুঁড়েঘরের পাশে ছড়িয়ে থাকা বস্তার টুকরো, আর হঠাৎ হঠাৎ কাঁদা জমির বুকে ফুটে ওঠা লালচে ফাটল—যেন মাটির নিজস্ব হাহাকার। জহর শেখ, পঁইত্রিশ বছরের জেলে, গামছা দিয়ে কাঁধ মুছতে মুছতে নৌকা ঘাটে পৌঁছল। চোখে-মুখে গভীর ক্লান্তি, আর একটা অপরাধবোধ—কাল রাতে সে ঘুমোতে পারেনি। সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ, আর মাথার মধ্যে জমে থাকা দুশ্চিন্তার ঝড়—এই দুটোই তাকে ঘুমোতে দেয়নি। তার ছেলে রায়হান, ক্লাস সেভেনে পড়ে, গতকাল বলছিল, “আব্বা, স্কুলে মাস্টার মশাই বলেছে, এইভাবে সমুদ্র বাড়তে থাকলে…