ঋদ্ধি সেনগুপ্ত পর্ব ১: ভোরট্রেন কলকাতার ভ্যাপসা গরম আর অনন্ত জটের ভিড়ের মধ্যে অর্ণার বুক ভরে উঠছিল এক অদৃশ্য ক্লান্তিতে। প্রতিদিন সকালেই সে অফিসের বাস ধরত, ফাইল আর কম্পিউটার স্ক্রিনে ডুবে থেকে সন্ধ্যার পরে ঘরে ফিরত। চারপাশের সবাই যেন শুধু ছুটছে, অথচ কোথাও পৌঁছোচ্ছে না। গত কয়েক মাসে সে বুঝতে পেরেছিল—তার নিজের ভেতরেও এক রকম শূন্যতা জমেছে, যা ভরাট করার মতো কিছু নেই। এই শহর তাকে আর টানে না। একরাতে ডেস্কে বসেই সে হঠাৎ বুকিং করেছিল দার্জিলিংয়ের ট্রেন টিকিট—আর ভাবেনি। সকাল সাড়ে তিনটেয় অ্যালার্ম বাজার আগেই তার ঘুম ভেঙে যায়। চারদিক তখনও অন্ধকার, কেবল ভেজা বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ।…
-
-
এক ড. অমিতাভ সেনগুপ্ত ছিলেন দেশের অন্যতম খ্যাতিমান পদার্থবিদ, যিনি সময় ও শক্তি-সম্পর্কিত গবেষণায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি, উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ি, যেন বিজ্ঞান আর প্রাচীনতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন—একদিকে আধুনিক ল্যাবরেটরি, অন্যদিকে কাঠের আসবাব, পুরনো বইয়ের তাক, আর দেয়ালে টাঙানো বিরল ঘড়ি। সেই বাড়ির স্টাডি রুমে, এক শীতল নভেম্বরের রাত, পুলিশ এসে দেখতে পেলেন—ড. সেনগুপ্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর ডান হাত ছড়ানো, মুখে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। চোখ আধখোলা, যেন মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি কিছু দেখেছিলেন যা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঘরের বাতাসে ভাসছে পুরনো কাঠের গন্ধ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা হাওয়া, আর দেয়ালে…
-
প্রিয়ম চক্রবর্তী শরতের শেষ ভাগ, আকাশে তুলোর মতো ভাসমান মেঘ আর বাতাসে ধানের গন্ধ মিশে আছে। কলকাতার ইতিহাসবিদ অনিন্দ্য মুখার্জী ও তাঁর স্ত্রী সায়ন্তী ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে, যেখানে স্থানীয় কলেজে আয়োজিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও লোককথা নিয়ে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হবে অনিন্দ্যকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন্তী ক্যামেরা হাতে ধানক্ষেত, নদীর ধারে চরাচর, আর মাটির ঘরের ছবি তুলছিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের সরলতা সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ রাখে, আর অনিন্দ্যর কাছে লোককথা মানে ইতিহাসের ভেতরে লুকোনো এক অদেখা দরজা। সেমিনার ভেন্যুটি ছিল গ্রামপঞ্চায়েত ভবনের বড় হলঘর, যেখানে বাঁশের মাচা দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, কাগজের…
-
প্ৰদীপ্ত গুহ ১ অভিজিৎ ও মীরা যখন নিউটাউনের নতুন ফ্ল্যাটে প্রথম দিন পা রাখল, তখন তাদের চোখে ছিল একেবারে অন্যরকম আলো। দীর্ঘদিন ধরে যেই মুহূর্তের অপেক্ষায় তারা ছিল—নিজেদের একান্ত ঘর, নিজেদের সাজানো সংসার, অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তব হলো। ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মীরা প্রথম হাসল, তার চোখে ছিল আনন্দ আর আবেগের মিশেল। লিভিং রুমে ঢুকেই বড় বড় জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া সকালের রোদ তাদের গায়ে পড়ল, যেন সেই আলোও তাদের নতুন সূচনার সাক্ষী হতে চাইছে। অভিজিৎ সবকিছু লক্ষ্য করে মনে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পেল, এতদিনের পরিশ্রমের পর অবশেষে সে…
-
পুলক বিশ্বাস নীলয় সেনের জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের স্তর থেকে, কিন্তু এবার তার গবেষণার পথ তাকে নিয়ে এল বাস্তবের ভেতরে জমে থাকা সময়ের ধুলোয় ঢাকা রহস্যে। কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে দীর্ঘ ভ্রমণের পর যখন মুর্শিদাবাদের মাটিতে পা রাখল, তার চোখের সামনে খুলে গেল এক অচেনা অথচ পরিচিত ইতিহাসের দরজা। রেলস্টেশনের পুরনো কাঠের বেঞ্চ, দেওয়ালে ঝুলে থাকা ম্লান বিজ্ঞাপন, আর মানুষের চেনা-অচেনা মুখগুলোর ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে যেন অনুভব করছিল—এই শহর কেবল ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি এক অদৃশ্য সময়ের ভাণ্ডার, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি পথ, প্রতিটি গাছ লুকিয়ে রেখেছে গল্প। মুর্শিদাবাদকে বলা হয় বাংলার মুঘল রাজধানীর উত্তরসূরি,…
-
আরিফ রহমান পর্ব ১: কাবুলের ধ্বংসস্তূপে জন্ম বাতাসে ধুলো আর বারুদের গন্ধ মিশে ছিল। কাবুল শহরের ভাঙাচোরা ইট, অর্ধেক গুঁড়িয়ে যাওয়া মসজিদ আর অগ্নিদগ্ধ গলিপথ যেন যুদ্ধের পরও যুদ্ধের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিল। একসময় যেসব পথে শিশুরা হেসে খেলত, সেসব গলিতে এখন কেবল বুটের শব্দ আর ভয়ে কাঁপতে থাকা মানুষের নিশ্বাস। যুদ্ধ এখানে কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম নয়—এখানে যুদ্ধ ছিল দৈনন্দিন জীবন। সে ভাঙাচোরা গলির এক অন্ধকার কোণে, জন্ম নিল এক শিশু। জন্মের সময় তার চারপাশে কোনো আনন্দ ছিল না, বরং চারদিকে বেজে উঠেছিল কামানের গর্জন। মায়ের রক্তাক্ত শরীর, আতঙ্কিত চোখ—সেই ছিল শিশুটির প্রথম পৃথিবী দেখা। নাম রাখা হলো ইমরান। তার জন্ম…
-
এক অরিন্দমের পদধ্বনি যখন গ্রামের সরু মাটির পথগুলোতে প্রতিধ্বনিত হলো, তখন তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা জন্ম নিল। গ্রামটি এমন একটি স্থানে অবস্থিত, যেখানে সময় যেন নিজেই ধীরে চলার চেষ্টা করছে। চারপাশের ঘরবাড়ি প্রায়শই কাঁকড়া মাটির তৈরি, তার ছাদগুলো বাঁশের খোঁপায় ঘেরা, এবং প্রতিটি ঘর যেন গল্পের অংশ বহন করছে। গ্রামের প্রবেশদ্বার থেকে দেখা যায় প্রাচীন মন্দিরের সোনালী কল্পচিত্র—যেখানে সূর্য ওঠার সময় মন্দিরের গম্বুজে আলোর খেলা যেন এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। অরিন্দম গ্রামে এসেছিল তার গবেষণার জন্য, কিন্তু এখানে এসে তার মনে হলো যেন ইতিহাস ও বাস্তবের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে। সে শোনেছে, গ্রামবাসীর জীবন এই দেবীর মূর্তির চারপাশে…
-
ধ্রুব সাহা হিমেল সকাল। শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা দার্জিলিং মেল ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোলে ঢুকছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ঋত্বিক চৌধুরীর চোখে ছিল গভীর এক কৌতূহল—একটা অদ্ভুত টান। অভিষেক তার সঙ্গী, যার চোখে-মুখে রোমাঞ্চের ঝলক থাকলেও সে ছিল মূলত ছুটি কাটাতে এসেছে, হিমালয়ের শান্তি আর কিছু ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য ছবি তুলতে। ওরা দুজনেই কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু প্রকৃতির কাছে যেতে, কিন্তু ঋত্বিক জানে, এই ভ্রমণ শুধু অবকাশ নয়। গত ছ’মাসে তার হাতে কোনও ‘কেস’ আসেনি, অথচ এই পাহাড়ি গ্রাম ‘চান্দাক’-এর আশেপাশে কয়েকজন পর্যটক হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার খবর এক অখ্যাত অনলাইন ব্লগে পড়ে সে স্থির করে, এই ঘটনা…
-
ঋত্বিক বসু পর্ব ১: কুয়াশার ভিতর হারিয়ে যাওয়া মানুষ শীতের সকাল। কলকাতার উত্তর শহরতলির এক পুরনো গলির ভেতর অদ্ভুত কুয়াশা জমে আছে। লাল ইটের বাড়ি, কাঠের দরজা, ম্লান আলো—মনে হয় যেন সময় এখানে থমকে গেছে। গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক টালির ছাদওয়ালা পুরনো ডাকঘর। এই ডাকঘরের সামনে থেকেই নিখোঁজ হয়েছিল মানুষটা—সুদীপ্ত মল্লিক। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, পেশায় কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। ঘটনাটা ঘটেছিল মাত্র দু’দিন আগে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তিনি প্রতিদিনের মতো চিঠি পাঠাতে এসেছিলেন ডাকঘরে। তখনো কুয়াশা কাটেনি। তিনি ভেতরে ঢুকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েক মিনিট পর তাকে দেখা গেল না। আর বেরোলেন না তিনি। সবাই ভেবেছিল, হয়তো অন্য দরজা দিয়ে…
-
সোনালী দেব ১ রায়চৌধুরী বাড়ি যেন ইতিহাসের এক প্রাচীন দলিল, যার প্রতিটি দেয়ালে লুকিয়ে আছে গৌরব ও ক্ষয়ের মিলেমিশে থাকা কাহিনি। বিশাল ফটক পেরোলেই চোখে পড়ে দোতলা প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি—উঁচু খিলানওয়ালা জানালা, বারান্দার লোহার গ্রিলের কাজ, আর সিঁড়ির মাথায় শ্বেতপাথরের সিংহমূর্তি। একসময় এ বাড়ির জমিদারি ছড়িয়েছিল আশেপাশের বহু গ্রামে, ঘোড়ার গাড়ি, হস্তিদল, পালকি, এবং শত শত কৃষকের আনাগোনায় মুখর থাকত এই প্রাসাদ। এখন অবশ্য সময়ের সঙ্গে তার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু ছায়াঘেরা আঙিনা আর খসে পড়া দেওয়ালগুলো এখনো অতীতের গৌরবের সাক্ষী। সন্ধ্যা নামলেই যেন এই বাড়ি চারপাশের অন্ধকারকে গিলে নেয়; ঝুলে থাকা পুরোনো ঝাড়বাতি, কড়কড়ে দরজা আর বাতাসে…