অর্ণব গুহ অধ্যায় ১: হারিয়ে যাওয়া নোটবই গহনপুর – নামটায় এক রকম রহস্য আছে। বাঁকুড়া জেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামটার ইতিহাস কতদূর ছড়িয়ে, কেউ তা স্পষ্ট বলতে পারে না। জঙ্গলে ঘেরা, পিচঢালা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই এই গহনপুর। গ্রামের মধ্যে এখনও কিছু টালির ছাউনি ঘর, একটা ভাঙা জমিদার বাড়ি আর একটা প্রাচীন শিবমন্দির—কোনটা কবে তৈরি, সঠিক কেউ জানে না। সেই গহনপুরেই পৌঁছল তিনজন বন্ধু—সুদীপ্ত, ঐন্দ্রিলা আর বাপি। কলকাতার স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব এখন কাজের চাপে একটু আলগা হলেও, এই রহস্যময় আমন্ত্রণ তাদের আবার এক করল। “এই বাড়িটা তো একেবারে হন্টেড সিনেমার মতো!”—বাপি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলে। ঐন্দ্রিলা একটু…
-
-
কৌশিক দে ১ সকাল নয়টা বাজতেই টয় ট্রেন-এর চেনা বাঁশির শব্দে কেঁপে উঠেছিল দার্জিলিং শহর, কিন্তু সেই শব্দও যেন পৌঁছাতে পারেনি কুয়াশার মোটা চাদর ভেদ করে। পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে ওঠা রাস্তার দু’পাশে পাইন গাছের সারি যেন দিনের আলোকে আড়াল করে রেখেছিল। শীতে জমে যাওয়া আঙুলগুলো পকেটেই রাখা থাকলেও, ঈশান চট্টোপাধ্যায়ের মন ছিল উত্তেজনায় গরম। এই শীতে পাহাড়ে আসা পর্যটকেরা হয়তো ঘোরাঘুরি আর হট চকোলেটে মশগুল, কিন্তু ঈশানের ভ্রমণ ছিল একেবারেই অন্যরকম। সে ইতিহাসের ছাত্র, এখন গবেষক—কলকাতার প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার। তার থিসিস: “নকশাল আন্দোলনের আঞ্চলিক বিস্তার ও অপ্রকাশিত স্মৃতি”। এই বিষয়েই তথ্য খুঁজতে সে পৌঁছেছে ডার্জিলিংয়ের কাছে, ঘন বন…
-
হেমন্ত সরকার পর্ব ১ রিয়ান জানালার পাশে বসে ট্রেনের ধুকধুক শব্দ শুনছিল। গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে মাত্র দু’দিন, আর তাতেই বাবা-মায়ের পরিকল্পনা—তাকে আর তার কাজিন উজ্জ্বলকে গ্রামের বাড়ি পাঠানো হবে ঠাকুরদার কাছে। সে যেন এক আলাদা জগৎ—চাঁপারপুকুর। শহুরে শব্দহীনতা আর মোবাইলের ‘নেট নেই’ বোঝা এই গ্রামেরই অন্য নাম হতে পারে। “এই গ্রামে কি সত্যিই রাতে জোনাকি দেখা যায়?” পাশের সিটে বসে থাকা উজ্জ্বল হঠাৎ প্রশ্ন করল। রিয়ান চোখ সরিয়ে বলল, “দাদু বলেছিল, পুরো বাঁশঝাড়ে টিমটিমে আলোয় ভরে যায়। তবে এখন কি আর আগের মতো জিনিস থাকে?” উজ্জ্বল একটু ভাবল, তারপর হেসে বলল, “আমি কিন্তু সন্ধে নামলেই দেখব। সত্যিই যদি জোনাকি…
-
অভিষেক মজুমদার অধ্যায় ১: সুন্দরবনের প্রান্তসীমায় ছোট্ট গ্রাম কুয়াখালির ভোরবেলা আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। সেই সকালটায় বাতাসে যেন অদ্ভুত গন্ধ, নদীর জলে অশান্ত ঢেউ, আর আকাশে পাখিদের ডাকেও এক অজানা আশঙ্কার সুর মিশে ছিল। অদ্বৈত ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে দূরের জঙ্গলের দিকটা দেখছিল, চোখে ছিল স্বপ্ন আর মনে দুরু দুরু কাঁপন। সোনার নদীর গল্প শোনা সেই রাতের পর থেকে তার মনের মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকা অজানা সাহস বেরিয়ে এসেছিল। লালু, কৃষ্ণ, চিনু আর শিবু—চারজন মিলে অদ্বৈতের সঙ্গে রাতভর আলোচনা করে ঠিক করেছে, এবার তাদের যাত্রা শুরু হবে। বুড়ো হরিপদ মৎস্যজীবী, যে কিনা প্রায় অন্ধ আর সর্বক্ষণ মদ খেয়ে থাকে, সেই…
-
অর্ঘ্য সেন ১ বিষ্ণুপুর স্টেশনে যখন ট্রেন থামল, তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। হালকা কুয়াশা, কাঁপা কাঁপা আলো, আর ছায়ার মতো লোকজন। অরণ্য সান্যাল ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল। তার চোখে ঘুম নেই, মাথায় ঘুরছে কেবল একটি পুরনো নথির লাইন—“মল্ল রাজাদের শেষ টেরাকোটা মন্দির, যার প্রবেশদ্বারেই আছে ‘চোখ’—যা দেখে, কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।” কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে পাওয়া শতবর্ষ পুরনো এক জার্নালে সে এই লাইন পড়েছিল, তারপর থেকেই যেন এক টান অনুভব করছে, একটা ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণ। টোটোয় বসে সে স্থানীয় হোমস্টের দিকে রওনা দেয়, সাথে তার সহকারী দেবাশীষ। ছেলেটা নতুন, কিন্তু উৎসাহে টগবগ করছে। “স্যার, ওই চোখটা কি…
-
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী কলকাতার গরম রোদের মধ্যে দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এক সাদা রঙের সেকেন্ড হ্যান্ড জিপ গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে দীপ, চশমার কাচে ঘাম জমে গেছে, কপালে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা পড়ছে। পাশে বসে অমিত, রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বেঁধেছে। ওদের দুজনের মুখেই রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার ছাপ। “আর কত দূর, দীপ?” অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে। “আর বেশি না। এই বুঝি মদনপুর পৌঁছে গেলাম,” দীপ বলে। রাস্তা সরু হয়ে এসেছে। দুপাশে বিস্তৃত ধানের মাঠ, মাঝে মাঝে নারকেল আর তালগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। একপাশ দিয়ে সরু খাল বয়ে চলেছে। হালকা বাতাসে ধানের শীষ দুলছে, যেন প্রকৃতির…
-
ত্রিসা ভট্টাচার্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট—চিরচেনা, চিরসজীব, আলো-আঁধারির এক নিটোল সহবাস। দিনের শেষে যখন রাজপথের হট্টগোল স্তিমিত হয়ে আসে, আর দোকানপাটগুলো একে একে ঝাঁপ ফেলে দেয়, ঠিক তখনই এই রাস্তার পেট থেকে জেগে ওঠে অন্য এক কলকাতা—যার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় ছায়া, স্মৃতি, আর কিছু হারিয়ে যাওয়া নাম। এই শহরের এক কোণে, এক ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানটা যেন শহরের ব্যস্ততা থেকে আলাদা, নিজের ছন্দে বাঁচে। নাম—”রিডিং রুম”। দোকানটা যত না বিক্রির জন্য, তার চেয়েও বেশি যেন অপেক্ষার জন্য বানানো। এখানে ধুলোমাখা বুকশেলফে ঠাসা পুরনো বই, কাঠের মেঝেতে বেজে ওঠা অদ্ভুত কড়মড় শব্দ, আর দোকানঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁসার ঘড়ির মতোই অপরিবর্তিত…
-
অর্ণব গুহ পর্ব ১: পুরনো পাতার গন্ধে বৃষ্টির পর বিকেলের আলোটা যেন গড়বেতার আকাশে রূপকথার পর্দা টেনে দিয়েছে। মাটি থেকে ধোঁয়ার মতো জলীয়বাষ্প উঠছে, যেন মাটিও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিমি জানালার পাশে বসে ছুঁয়ে দেখছিল তার ঠাকুরদার পুরনো নোটবুকটা। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর গায়ে ঘামের মতো ছাপ, পুরনো কালি ঝাপসা, কিন্তু কিছু লেখা এখনও পরিষ্কার— “যদি খুঁজে পাও সেই লাল পাথর, তার নিচে শুয়ে আছে কুড়ি কুড়ি স্বর্ণমুদ্রা—বজ্রসেনের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার। কিন্তু তার আগে পেরোতে হবে বাঘের গুহা, মৃত জলের কুয়া, আর রক্তলাল মহুল গাছ।” রিমি একগাল হেসে উঠে চিৎকার করে ডাকল, “আকাশ! ঈশান! তুহিন! তোরা একবার দেখ তো!” আকাশ, যে…
-
রুদ্রপ্রতিম সেন ১ কলকাতা বিমানবন্দর, সকাল ছ’টা দশ। মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একটি কালো সেডান গাড়ি ধীরে ধীরে থামে টার্মিনালের সামনে। চালক দরজা খুলে দেয়, এবং একটি উঁচু কাঁধ, রূপালি চুল আর ধীর পদক্ষেপে নামেন এক মধ্যবয়স্ক মানুষ—সমরেশ মিত্র, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পপতি। তাঁর গায়ে হালকা ধূসর স্যুট, চোখে এক জোড়া ধাতবচশমা। এক হাতে ছোট চামড়ার ব্রিফকেস, অন্য হাতে ধরা একটি পুরনো চামড়ার বাঁধাই করা বই—“দ্য লাস্ট সামার রেইন”, সম্ভবত তাঁর প্রিয়। সবসময় বিমানে ওঠার আগে এই বইটি তিনি পড়ে থাকেন, যেন আকাশের নির্জনে বইয়ের পাতার ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। সিকিউরিটি চেকিং, লাউঞ্জ, বোর্ডিং—সবকিছুতে ছিল অভ্যস্ত ও নিখুঁত শৃঙ্খলা।…
-
অনির্বাণ সেনগুপ্ত ১ রাত দশটা পঁচিশ। হাওড়া স্টেশনের শেষ লোকাল ট্রেনটা বাঁশদ্রোণীর দিকে ছেড়ে গেল। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হতে হতে হঠাৎ দেখা গেল এক মাঝবয়সী লোক দৌড়ে এসে থামল, যেন কিছু ফেলেছে বা কাউকে খুঁজছে। হাতে একটা লাল খাম। চোখে আতঙ্ক, মুখে ঘাম, পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে—একটা ছোট্ট ফটো, দুটো গুচ্ছ চাবি আর একটা মলিন নোট। গার্ড আর পুলিশ এগিয়ে এলো। “কি হয়েছে?” লোকটা বলল, “উনি… আমার স্ত্রী… ওই ট্রেনেই উঠেছিলেন। কিন্তু কিছু একটা ঠিক ছিল না। আমি ভুল করিনি। কেউ ওঁর পিছু নিয়েছিল। আমি… আমি এখনই রিপোর্ট করতে চাই।” পুলিশ অফিসার সন্দেহের চোখে তাকাল, “আপনার নাম?”…