অর্ঘ্য সেন ১ বিষ্ণুপুর স্টেশনে যখন ট্রেন থামল, তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। হালকা কুয়াশা, কাঁপা কাঁপা আলো, আর ছায়ার মতো লোকজন। অরণ্য সান্যাল ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল। তার চোখে ঘুম নেই, মাথায় ঘুরছে কেবল একটি পুরনো নথির লাইন—“মল্ল রাজাদের শেষ টেরাকোটা মন্দির, যার প্রবেশদ্বারেই আছে ‘চোখ’—যা দেখে, কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।” কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে পাওয়া শতবর্ষ পুরনো এক জার্নালে সে এই লাইন পড়েছিল, তারপর থেকেই যেন এক টান অনুভব করছে, একটা ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণ। টোটোয় বসে সে স্থানীয় হোমস্টের দিকে রওনা দেয়, সাথে তার সহকারী দেবাশীষ। ছেলেটা নতুন, কিন্তু উৎসাহে টগবগ করছে। “স্যার, ওই চোখটা কি…
-
-
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী কলকাতার গরম রোদের মধ্যে দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এক সাদা রঙের সেকেন্ড হ্যান্ড জিপ গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে দীপ, চশমার কাচে ঘাম জমে গেছে, কপালে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা পড়ছে। পাশে বসে অমিত, রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বেঁধেছে। ওদের দুজনের মুখেই রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার ছাপ। “আর কত দূর, দীপ?” অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে। “আর বেশি না। এই বুঝি মদনপুর পৌঁছে গেলাম,” দীপ বলে। রাস্তা সরু হয়ে এসেছে। দুপাশে বিস্তৃত ধানের মাঠ, মাঝে মাঝে নারকেল আর তালগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। একপাশ দিয়ে সরু খাল বয়ে চলেছে। হালকা বাতাসে ধানের শীষ দুলছে, যেন প্রকৃতির…
-
ত্রিসা ভট্টাচার্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট—চিরচেনা, চিরসজীব, আলো-আঁধারির এক নিটোল সহবাস। দিনের শেষে যখন রাজপথের হট্টগোল স্তিমিত হয়ে আসে, আর দোকানপাটগুলো একে একে ঝাঁপ ফেলে দেয়, ঠিক তখনই এই রাস্তার পেট থেকে জেগে ওঠে অন্য এক কলকাতা—যার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় ছায়া, স্মৃতি, আর কিছু হারিয়ে যাওয়া নাম। এই শহরের এক কোণে, এক ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানটা যেন শহরের ব্যস্ততা থেকে আলাদা, নিজের ছন্দে বাঁচে। নাম—”রিডিং রুম”। দোকানটা যত না বিক্রির জন্য, তার চেয়েও বেশি যেন অপেক্ষার জন্য বানানো। এখানে ধুলোমাখা বুকশেলফে ঠাসা পুরনো বই, কাঠের মেঝেতে বেজে ওঠা অদ্ভুত কড়মড় শব্দ, আর দোকানঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁসার ঘড়ির মতোই অপরিবর্তিত…
-
অর্ণব গুহ পর্ব ১: পুরনো পাতার গন্ধে বৃষ্টির পর বিকেলের আলোটা যেন গড়বেতার আকাশে রূপকথার পর্দা টেনে দিয়েছে। মাটি থেকে ধোঁয়ার মতো জলীয়বাষ্প উঠছে, যেন মাটিও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিমি জানালার পাশে বসে ছুঁয়ে দেখছিল তার ঠাকুরদার পুরনো নোটবুকটা। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর গায়ে ঘামের মতো ছাপ, পুরনো কালি ঝাপসা, কিন্তু কিছু লেখা এখনও পরিষ্কার— “যদি খুঁজে পাও সেই লাল পাথর, তার নিচে শুয়ে আছে কুড়ি কুড়ি স্বর্ণমুদ্রা—বজ্রসেনের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার। কিন্তু তার আগে পেরোতে হবে বাঘের গুহা, মৃত জলের কুয়া, আর রক্তলাল মহুল গাছ।” রিমি একগাল হেসে উঠে চিৎকার করে ডাকল, “আকাশ! ঈশান! তুহিন! তোরা একবার দেখ তো!” আকাশ, যে…
-
রুদ্রপ্রতিম সেন ১ কলকাতা বিমানবন্দর, সকাল ছ’টা দশ। মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একটি কালো সেডান গাড়ি ধীরে ধীরে থামে টার্মিনালের সামনে। চালক দরজা খুলে দেয়, এবং একটি উঁচু কাঁধ, রূপালি চুল আর ধীর পদক্ষেপে নামেন এক মধ্যবয়স্ক মানুষ—সমরেশ মিত্র, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পপতি। তাঁর গায়ে হালকা ধূসর স্যুট, চোখে এক জোড়া ধাতবচশমা। এক হাতে ছোট চামড়ার ব্রিফকেস, অন্য হাতে ধরা একটি পুরনো চামড়ার বাঁধাই করা বই—“দ্য লাস্ট সামার রেইন”, সম্ভবত তাঁর প্রিয়। সবসময় বিমানে ওঠার আগে এই বইটি তিনি পড়ে থাকেন, যেন আকাশের নির্জনে বইয়ের পাতার ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। সিকিউরিটি চেকিং, লাউঞ্জ, বোর্ডিং—সবকিছুতে ছিল অভ্যস্ত ও নিখুঁত শৃঙ্খলা।…
-
অনির্বাণ সেনগুপ্ত ১ রাত দশটা পঁচিশ। হাওড়া স্টেশনের শেষ লোকাল ট্রেনটা বাঁশদ্রোণীর দিকে ছেড়ে গেল। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হতে হতে হঠাৎ দেখা গেল এক মাঝবয়সী লোক দৌড়ে এসে থামল, যেন কিছু ফেলেছে বা কাউকে খুঁজছে। হাতে একটা লাল খাম। চোখে আতঙ্ক, মুখে ঘাম, পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে—একটা ছোট্ট ফটো, দুটো গুচ্ছ চাবি আর একটা মলিন নোট। গার্ড আর পুলিশ এগিয়ে এলো। “কি হয়েছে?” লোকটা বলল, “উনি… আমার স্ত্রী… ওই ট্রেনেই উঠেছিলেন। কিন্তু কিছু একটা ঠিক ছিল না। আমি ভুল করিনি। কেউ ওঁর পিছু নিয়েছিল। আমি… আমি এখনই রিপোর্ট করতে চাই।” পুলিশ অফিসার সন্দেহের চোখে তাকাল, “আপনার নাম?”…
-
পারমিতা রায় ছাদের উপর সেই পাথরের বাক্স কলকাতার উত্তর শহরতলিতে, শ্যামবাজার থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই যে গলিটার মোড়ে বিশাল এক পামগাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার ঠিক পাশেই অবস্থিত “দত্ত ভিলা”। দু’শো বছরের পুরনো এক জমিদারবাড়ি, আজ যার অর্ধেকটা পরিণত হয়েছে কুয়াশা ও কালের ক্ষয়ে ধূসর এক ভগ্নদশা স্তূপে। মেঝেতে ফাটল, দেওয়ালে শ্যাওলা, আর কাঠের জানালায় কেবল বাতাসের ছোঁয়ায় গুনগুন শব্দ—সব মিলিয়ে যেন অতীত নিজে এসে বাসা বেঁধেছে এখানে। এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন অর্ণব দত্ত—বয়সে প্রায় তিরিশ, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইতিহাস বিভাগে পিএইচডি শেষ করে সদ্য ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর এই পুরনো বাড়িটি তার দায়িত্বে পড়েছে। যদিও…
-
জয় ভট্টাচার্য চুপচাপ বাতাস কালিম্পঙের এক কোণে, কুয়াশা মোড়া ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম বাতাসিয়াপুর। চারদিকে পাহাড়, গাছগাছালি আর নিঃস্তব্ধতা—শহরের ব্যস্ততা থেকে যেন একেবারে পালিয়ে আসার জায়গা। ঠিক সেখানেই শীতের ছুটিতে ঘুরতে এসেছিল চার বন্ধু—সৌরভ, অরিত্র, তিয়াসা আর মেহুল। দার্জিলিং থেকে ছোট গাড়িতে এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে, শেষ বিকেলে তারা পৌঁছালো বাতাসিয়াপুর। গ্রামের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কাঠের বাংলো—“হিমালয় ভিউ লজ”। নামের সঙ্গে মিলে বাংলোর বারান্দা থেকেই দেখা যায় কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়ের চূড়া। বাংলোর কেয়ারটেকার বুড়ো গনেশবাবু, মুখে চিরকালীন ধূসরতা। “রাতের দিকে বেশি বাইরে যাইয়েন না বাবুরা,” বললেন চা এগিয়ে দিতে দিতে। “এই পাহাড়ে কুকুরও কখনও কখনও হাওয়ায় ঘেউ ঘেউ…
-
প্রিয়াঙ্কা অধিকারী পর্ব ১ কলকাতার অফিসপাড়ায় ব্যস্ত সপ্তাহগুলো পেরিয়ে চার বন্ধু—সুমিত, অর্ণব, তনয় আর নিলয়—একসাথে ছুটি নিয়ে উত্তরবঙ্গের এক অজানা জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের মধ্যে সুমিত একটু বেশিই ঘুরে বেড়ায়, ভৌতিক আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পে তার দারুণ আগ্রহ। অর্ণব ছিল দলটার প্ল্যানার, সবকিছু গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসে। তনয় একটু চুপচাপ, কিন্তু দরকার হলে ওর মাথা ঠান্ডা থাকে। আর নিলয়? ও হল হাসির রসদ, দলটাকে চাঙা রাখে সবসময়। ওরা গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয় ‘দূর্গাপুর ফরেস্ট রেঞ্জ’—এই নামটা এতটা পরিচিত না হলেও নেট ঘাঁটতে গিয়ে সুমিত একটা পুরনো ব্লগে তার উল্লেখ পেয়েছিল। ব্লগের লেখক এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী, যার কথায় নাকি এই জঙ্গলে…
-
অমিতাভ গোস্বামী অচেনা শোরগোল বৃষ্টিটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যেন হঠাৎ আকাশের কান্না ভেঙে পড়ল মাটিতে। দুপুরের স্কুল ছুটি হতেই তৃষা সোজা রওনা দিয়েছিল সেই পুরনো লাইব্রেরিটার দিকে। বাইরের বৃষ্টি থেকে বাঁচতে নয়, বরং ভিতরের একটা অদ্ভুত টান তাকে বারবার সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রাম্য এই লাইব্রেরিটা প্রায় সবাই ভুলে গেছে, পুরনো কাঠের তাকগুলো ধুলোতে ভরা, কিছু বইয়ের পাতায় ছেঁড়া রং, কোথাও কোথাও সাদা পোকা, তবুও তৃষার চোখে এটা ছিল জাদুর ঘর। পন্ডিত বরদা চক্রবর্তী, লাইব্রেরির একমাত্র দেখভালের লোক, ছিলেন অদ্ভুত একজন মানুষ। গায়ে সাদা ধুতি, চুল-দাড়ি পাকা, কথাবার্তায় যেন একেকটা শব্দ উঠে আসে অন্য সময় থেকে। আজ তিনি লাইব্রেরির পেছনের ঘরে…