প্রবীর দাস ১ কলকাতার ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। শহরের ব্যস্ততা, ট্রামের ঘণ্টা, চায়ের দোকানের ধোঁয়া—সবকিছু যেন এক অচেনা বিষণ্ণতার আবরণে ঢাকা। অনিরুদ্ধ ব্যাগ গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সে জানে, এ যাত্রা শুধু পাহাড় দেখার ভ্রমণ নয়, বরং এক অদৃশ্য টানের সাড়া দেওয়া। কতদিন ধরেই যেন তার বুকের ভেতর ফিসফিস করে চলেছে কোনো অচেনা সুর—“আয়, চলে আয়, পাহাড়ের ডাক শুনে।” ডায়েরি আর কলম, ক্যামেরা আর কয়েকটা বই—এই নিয়েই তার সম্বল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সে খেয়াল করে, চারপাশের লোকেরা তাদের নিজস্ব গন্তব্যে ব্যস্ত। অথচ তার গন্তব্য কোনো শহর নয়, কোনো চেনা জায়গা নয়—বরং অরুণাচলের অরণ্য, যেখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আছে…
-
-
অরিন্দম ভট্টাচার্য পর্ব ১ : যাত্রার ডাক হাওড়া স্টেশন সেই চিরচেনা ভিড়, অথচ প্রতিবারই যেন নতুন এক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। বিশাল গম্বুজের নীচে হুড়োহুড়ি মানুষ, ঘোষণার ভাঙা ভাঙা শব্দ, স্টিম আর ধোঁয়ার গন্ধ, ভেজা রেলের চাকার ধাতব আওয়াজ—সব মিলিয়ে এক অস্থির, অথচ জীবন্ত ছন্দ। সেই ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে অনির্বাণ। হাতে মাঝারি মাপের ট্রলি ব্যাগ, কাঁধে বহুদিনের সঙ্গী কালচে ব্যাকপ্যাক, যার চেইন একপাশে খানিক ঢিলে হয়ে গেছে। অফিসের নিরন্তর ফাইলের বোঝা, ডেডলাইনের অবসাদ, যান্ত্রিক নিস্তব্ধতার পর এই মুহূর্তটা যেন তার কাছে মুক্তির প্রথম নিশ্বাস। বহুদিন ধরে ভেবে আসছিল, এক মাসের এক অনিশ্চিত ভ্রমণ—যেখানে থাকবে না কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য, থাকবে না ট্যুর…
-
সৌরদীপ মুখোপাধ্যায় পর্ব ১ : যাত্রার প্রথম সকাল ভোর পাঁচটা নাগাদ কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর–এর চতুর্থ নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতে শক্ত করে ধরা ছিল এক পুরনো খাতা—যে খাতায় আমি এতদিন যাবৎ সব ভ্রমণকাহিনি লিখে রেখেছি। শৈশব থেকেই সমুদ্রের প্রতি আমার অদ্ভুত টান, অথচ যতবার সমুদ্র দেখেছি, তা সবই দীঘা কিংবা পুরীর মতো চেনা জায়গায়। এবার প্রথমবার আন্দামান। নামটা শুনলেই আমার কানে বাজে নীল জলের ফিসফিস, ঝড়ের রাতে ইংরেজ জাহাজের ঘণ্টাধ্বনি আর অন্ধকার সেলের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া বন্দিদের আর্তনাদ। চেক-ইন শেষে বিমানে উঠে বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছিল। আমার পাশের সিটে ছিলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি—দু’জনেই পোর্ট…
-
সব্যসাচী পাল সকাল হলে গ্রামের ছোট্ট হোটেলের দরজার বাইরে অর্ণব, মেহুল, ইশিতা, রাহুল ও মায়া একত্রিত হয়। প্রত্যেকের মুখে ভরপুর উদ্দীপনা, যেন পাহাড়ের কোল তাদের রোমাঞ্চের প্রতীক্ষায় রেখেছে। রাহুল ক্যামেরা হাতে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে, পাহাড়ের চূড়ার ছবি কল্পনা করছে। মায়া তার ব্যাগ চেক করছে, ছোটখাটো জিনিসগুলো ঠিক মতো প্যাক করা আছে কি না। মেহুল তার জুতো ভালোভাবে বাঁধছে, যেন এই পথচলায় কোনো অসুবিধা না হয়। ইশিতা তার স্কেচবুক নিয়ে ব্যস্ত, পাহাড়ের ছবি আঁকার চিন্তায় মগ্ন। আর অর্ণব, যিনি দলটির প্রাকৃতিক নেতা, সকলকে খুঁজে খুঁজে ছোটো ছোটো পরামর্শ দিচ্ছেন। পাহাড়ের তাজা বাতাস তাদের মুখে লাগছে, এবং সেই বাতাস যেন এক…
-
অমিত ধর ১ সকালবেলার ট্রেন থেকে নেমে দলটি যখন বিষ্ণুপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল, তখনো শহরের আকাশে ছিল কুয়াশার হালকা চাদর। শীতের সকালের সেই আর্দ্র ও শীতল বাতাসের মধ্যে দূরে কোথাও বাজছিল মন্দিরের ঘণ্টা, যা মিলেমিশে এক ধরনের মিষ্টি শান্তি এনে দিচ্ছিল মনকে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিল ধূসর কুয়াশার আচ্ছাদন, আর তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল লাল ইটের প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরের মাথা, যেন ইতিহাসের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। অরিজিৎ কাঁধের ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল—কুয়াশার মধ্যে উঁকি মারা শিখর, প্রাচীন অলঙ্করণে ভরা মন্দিরের দেওয়াল, আর সকালের হাটে আসা মানুষের ভিড়। প্রিয়া নোটবুক খুলে…
-
ঋত্বিক দত্ত পার্ট ১: যাত্রার প্রথম সকাল শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে সমুদ্রের দিকে যাত্রা শুরু করার মুহূর্তটাই যেন এক অদ্ভুত মুক্তি। কলকাতা বিমানবন্দরের জানালার কাচের ওপার থেকে ভোরবেলা আকাশের নীলচে আলো যখন সোনালি হতে শুরু করছিল, তখন আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছিলাম আন্দামান যাওয়া হবে—কেবল হাভলক বা নীল দ্বীপের সমুদ্রস্নান নয়, আমি চেয়েছিলাম খুঁজে বের করতে অজানা এক কোণ, যেখানে পর্যটকদের কোলাহল নেই, নেই রঙিন বিজ্ঞাপনমাখা হোটেলের ছায়া, আছে কেবল নির্জনতার ঘন অরণ্য আর সমুদ্রের শ্বাস। বিমান মেঘ কাটিয়ে নামতে শুরু করতেই জানালার বাইরে নীলের উপর সবুজের ছোপ দেখা গেল। দূর থেকে যেন অসংখ্য…
-
ঋদ্ধি সেনগুপ্ত পর্ব ১: ভোরট্রেন কলকাতার ভ্যাপসা গরম আর অনন্ত জটের ভিড়ের মধ্যে অর্ণার বুক ভরে উঠছিল এক অদৃশ্য ক্লান্তিতে। প্রতিদিন সকালেই সে অফিসের বাস ধরত, ফাইল আর কম্পিউটার স্ক্রিনে ডুবে থেকে সন্ধ্যার পরে ঘরে ফিরত। চারপাশের সবাই যেন শুধু ছুটছে, অথচ কোথাও পৌঁছোচ্ছে না। গত কয়েক মাসে সে বুঝতে পেরেছিল—তার নিজের ভেতরেও এক রকম শূন্যতা জমেছে, যা ভরাট করার মতো কিছু নেই। এই শহর তাকে আর টানে না। একরাতে ডেস্কে বসেই সে হঠাৎ বুকিং করেছিল দার্জিলিংয়ের ট্রেন টিকিট—আর ভাবেনি। সকাল সাড়ে তিনটেয় অ্যালার্ম বাজার আগেই তার ঘুম ভেঙে যায়। চারদিক তখনও অন্ধকার, কেবল ভেজা বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ।…
-
১ নদীর ধারে নৌকো এসে ভিড়ল যখন, তখন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। গোধূলির আলো মিশে আছে মেঘলা আকাশের গায়ে, আর দূরে জলপাখিদের দল ভেসে যাচ্ছে মেঘের মতো। অর্ণব সেন নৌকার গা থেকে ক্যামেরার ব্যাগ নামালেন, তাঁর চোখে এক ধরনের উজ্জ্বল উত্তেজনা—যে উত্তেজনা কেবল নতুন জঙ্গল, নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। ভিতরকনিকা ন্যাশনাল পার্কের নাম তিনি বহুবার শুনেছেন, বহু বইয়ে পড়েছেন, নানা নেচার ডকুমেন্টারিতেও দেখেছেন। কিন্তু এই প্রথমবার, নিজ চোখে, নিজ ক্যামেরা হাতে তিনি প্রবেশ করছেন সেই রহস্যময় ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভেতরে, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লবণাক্ত জলের কুমিরেরা থাকে। চারপাশে নদীর খালবিল, কাদাজল, আর শ্বাসমূলের…
-
অরুণোদয় দত্ত ১ ঢাকার ব্যস্ত রেলস্টেশনে তখন সকাল গড়িয়ে আসছে। কোলাহলের ভেতরেও চারজন মানুষ যেন নিজেদের ছোট্ট এক পৃথিবীতে ডুবে আছে। অরিন্দম—ইতিহাসের অধ্যাপক—চোখে চশমা, হাতে একটি পুরনো নোটবুক, যেখানে সে বছরের পর বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর সম্পর্কে নোট লিখে রেখেছে। তার মধ্যে এক ধরনের দৃঢ়তা, যা ছাত্রদের সামনে লেকচার দেওয়ার সময়ের মতোই নির্ভীক। পাশে বসে আছে অনন্যা, পিঠে ঝোলানো কালো ব্যাগে রাখা ক্যামেরার লেন্স উঁকি দিচ্ছে। সে বারবার আশেপাশের দৃশ্যগুলো দেখছে, যেন প্রতিটি মুহূর্তকে ফ্রেমে ধরে রাখতে চায়। সায়ন একটু গম্ভীর চেহারায় টিকিট পরীক্ষা করে, আরেকবার ব্যাগের ভেতরের গবেষণার নথি গুছিয়ে রাখে। তার কাছে এই ভ্রমণ নিছক আনন্দ নয়, বরং…
-
ঊর্মি রায়চৌধুরী ১ সকালটা ছিল শান্ত, যেন প্রকৃতির বুক জুড়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা ছড়িয়ে আছে। অর্ণব চৌধুরী ও মৃণালিনী সেন সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে পৌঁছেই সে শূন্যতাকে অনুভব করেছিল, যেন এ জঙ্গল কেবল সবুজ আর বন্য প্রাণে নয়—গভীর কোনো গোপন স্মৃতিতে পূর্ণ। ওডিশার মায়াবী ঘন বনপথ পেরিয়ে যখন তাদের জিপ গাড়িটা বন বিভাগের অনুমতিপত্রসহ রেঞ্জ অফিসে পৌঁছায়, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা একদিকে শান্তিদায়ক, আর অন্যদিকে অজানা কিছুর পূর্বাভাসের মতো ঠেকছিল। রেঞ্জার রুদ্র বেহেরা, মাঝবয়সী এক চৌকস বন আধিকারিক, সংক্ষিপ্ত হাসি আর কাঠখোট্টা চোখে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। পরিচয়পর্বের পর তিনি তাদের জানালেন, “তোমরা যে জায়গায় যেতে চাইছো সেটা একটু গভীর অঞ্চল, কম লোক…