অলীক ছায়ার ঘর রোজকার আলোচ্য বিষয়ের বাইরে কলকাতার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট, বালিগঞ্জের গলিতে। জানালার পাশে বসে শিউলি তাকিয়ে থাকে একঘেয়ে আকাশের দিকে। মেঘ জমেছে, কিন্তু বৃষ্টি আসে না। যেমন তার জীবনে জমেছে ক্লান্তি, কিন্তু উপশম নেই। দশ বছর হয়ে গেল বিয়ের। রঞ্জনের সঙ্গে একসময় প্রেম ছিল, হাতে হাত রেখে সিনেমা দেখা, ট্রামে চেপে লেকের ধারে হাওয়া খাওয়া। এখন সেইসব স্মৃতি যেন পুরোনো কাপড়—আছে, কিন্তু ব্যবহার হয় না। রুটিনে বেঁধে গেছে জীবন। সকালে উঠে রান্না, অফিস, বিকেলে ফিরে টিভির আওয়াজ, রাতে নিঃশব্দ বিছানা। রঞ্জন বলে, — “আজ আবার টিফিনে ঝোল কম ছিল।” শিউলি মৃদু হেসে বলে, — “তুমি তো এমনিতেও কম…
-
-
মিতালী চট্টোরাজ নীল জানালার পাশে শীতের সকালটা ঠিক যেন অলস হয়ে উঠেছিল। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলিতে এমন গা-ছুঁয়ে যাওয়া শীত খুব বেশি পড়ে না, তবু জানালার ধারে বসে ঐন্দ্রিলা নিজের শাড়ির আঁচলটাকে একটু ভালোভাবে গায়ে জড়াল। জানালার বাইরে একটা কৃষ্ণচূড়ার গায়ে রোদ পড়েছে, লালচে পাতাগুলো ঝলমল করছে। চুপচাপ বসে থাকা ঐন্দ্রিলার মনে হচ্ছিল, অনেকদিন এমনভাবে নিজেকে ছুঁয়ে দেখেনি সে। চারপাশে স্বাভাবিক জীবনের নিস্তরঙ্গতা। স্বামী সুজয় সকালেই বেরিয়ে গেছেন, বরাবরের মতোই। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন এখন প্রায় শুধুই প্রয়োজনীয়তায় সীমাবদ্ধ। ছেলে তমাল ব্যাঙ্গালোরে—আইটি কোম্পানির চাকরিতে ব্যস্ত। ঐন্দ্রিলা এখন আর কারো ‘মা’, ‘স্ত্রী’, ‘ম্যাডাম’ হয়ে বাঁচতে চায় না। নিজের নামটা আবার নিজের মতো করে…
-
অঙ্কুর বিশ্বাস বৃষ্টির দিনে দেখা কলকাতার আকাশটায় সেই বিকেলটা যেন ভেজা ক্যানভাস হয়ে ছিল। মেঘে ঢাকা আকাশ, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, আর একরাশ ধোঁয়াটে আলো—তাতে শহরটা কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা স্বপ্নালু লাগছিল। কলেজের ফটকের বাইরে, ছাতাহীন অনুরাধা হাঁটছিল ধীরে ধীরে। সোনালি সালোয়ারটা হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর নেমে এসেছে। সে তাড়াহুড়ো করছিল না। বৃষ্টি আর স্মৃতির মিশেলে একটা অদ্ভুত আবেশ ছিল তার মধ্যে। সে হাঁটছিল ঠিক সেই সময়, এক অচেনা কণ্ঠস্বর তাকে থামিয়ে দিল। “তুমি অনুরাধা?” কণ্ঠটা ভদ্র, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, এক ছেলেকে। হাতে ক্যামেরা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ। তার মুখটা একেবারে পরিচিত…
-
মেঘলা দাশগুপ্ত পর্ব ১ কলকাতার গরমটা জুনে এসে যেভাবে গায়ে লেগে থাকে, মেঘলার কাছে সেটা অস্বস্তিকর নয়, বরং একধরনের আশ্বাসের মতো। সে ভালোবাসে বিকেলের ছায়া যেভাবে জানালার পাল্লা ফুঁড়ে ঘরে ঢোকে, সেই রকম নিঃশব্দ আলো, যেটা কারও চোখে পড়ে না, কিন্তু মনটা একটু একটু করে ধুয়ে দেয়। এই বাড়িটা সে ভাড়া নিয়েছে এক মাসের জন্য—লেখালেখির কাজে মন বসবে ভেবেছিল। দক্ষিণ কলকাতার এই পুরনো বাড়িটা, কাঠের জানালা, ধুলো জমে থাকা বারান্দা, দেওয়ালে ধস নামা চুন—সব মিলিয়ে একটা একাকীত্বের ঠিকানা। মালকিন, বৃদ্ধা মৃণালিনী দেবী বলেছিলেন, “ঘরটা আগে এক কবি মেয়ের ছিল, নাম ছিল রত্না। বড় অন্যরকম মেয়ে ছিল, কবিতা লিখত সারাদিন। তখনকার…
-
পল্লব দাস এক রোদ ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায় বেণীমাধবের। দোকানের পাশেই তার ছোট্ট এক কামরা, সেখানেই শুয়ে শুয়ে ভোরের পাখির ডাক শোনেন তিনি। প্রতিদিনের মতো আজও সকালটা এক অদ্ভুত মায়ায় মোড়া—মৃদু কুয়াশা, রোদ উঠবার মুখে, আর দূরের ফুলের গাছগুলো থেকে ভেসে আসা একরাশ সুবাস। দোকানটা খুব বড় নয়। বাঁশ আর টিনের চালের ছোট্ট ঘর। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো মেলার অস্থায়ী দোকান। কিন্তু বেণীমাধবের কাছে এটা তার জীবনের চেয়ে বেশি। “ফুলের দোকান”—নামটা সেভাবে কেউ দেয়নি, শুধু একটা ছোট কাগজের বোর্ডে হাতে আঁকা ‘ফুলের দোকান’ লেখা। দোকানজুড়ে সারি সারি ফুলের ঝুড়ি—রজনীগন্ধা, বেলি, জুঁই, গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, অর্কিড—যেন রঙের…
-
পর্ব ১ বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। একটানা, নিরলস। ছাদের টিনে পড়ছে টুপটাপ, জানলার পাশে পেতলের ঘণ্টার মত ঝিকিয়ে উঠছে শব্দগুলো। রূপা চুপচাপ বসে আছে বারান্দার এক কোণে, চায়ের কাপ হাতে। ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা কাপের গায়ে ধোঁয়া ওঠা ফাটল দেখা যাচ্ছে, যেমন ফাটল দেখা দেয় সম্পর্কেও—মাঝেমধ্যে চুপিসারে, না-বলা কিছু জমানো কথা জমে জমে। রূপার বয়স এখন ছত্রিশ। আট বছর হল বিয়ে হয়েছে রতনের সঙ্গে। ছেলে নেই, মেয়ে নেই, সংসারটা চলে যায় দিনের পর দিন, ফেসবুক স্ক্রল আর ওটিটির গ্লানি নিয়ে। রতনের ভালোবাসায় কোনো অভাব নেই, তবু কোথায় যেন কিছু অনুপস্থিত—কথার গভীরে, চোখের ভাষায়, কিংবা ছুঁয়ে দেওয়ার ব্যাকরণে। আজ দুপুরে, সেই একঘেয়ে স্ক্রলের…
-
ঈশিতা সেনগুপ্ত জানলার ওপারে কলকাতার উত্তরের এক পুরনো পাড়ায়, লাল ইটের তিনতলা বাড়িটা বহু দিনের সাক্ষী। উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরনো ফুলদানি, জং ধরা বাইসাইকেল, আর সবথেকে দৃষ্টিনন্দন—একটা ঘন পাতা কদমগাছ। সেই গাছের নিচে প্রতিদিন সকালে বসে এক ছেলেটা, তার কোলে একটা স্কেচবুক, হাতে পেন্সিল—নিস্তব্ধ ঘোরে ডুবে যায় নিজের আঁকায়। ছেলেটির নাম অয়ন। অয়নের জীবনের ছন্দ বড়ো একঘেয়ে ছিল। আঁকাআঁকি আর কদমগাছের নিচে বসে থাকা ছাড়া সে খুব একটা কারো সঙ্গে মেশে না। পড়াশোনার দিন পেরিয়ে, সে এখন ঘরে বসেই গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে। পাড়ায় বহুদিনের বাসিন্দা, তাই কারও চোখে নতুন নয়। তবে হঠাৎ করেই সব বদলে গেল, যেদিন জানালায় সে…
-
সুদীপ্তা পাল এক কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে টালিগঞ্জের এক পুরনো গলিতে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট এক ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপ—”লেন্সস্কেপ”। একতলা, লাল ইটের পুরনো বাড়ি, যার বাইরের দেওয়ালে সাদা রঙে আঁকা ক্যামেরার স্কেচ। গলির শেষে একটি বড় অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় ঢাকা জায়গাটা যেন আলাদা এক পৃথিবী। বাইরের কোলাহল, বাস-অটো-রিকশার শব্দ পেরিয়ে এখানে পা রাখলে যেন শহরের এক ব্যস্ত দুপুরও স্তব্ধ হয়ে যায়। ওয়ার্কশপের ভেতরে ঢুকলেই প্রথম চোখে পড়ে দেয়ালজুড়ে সাজানো শত শত ছবি—কখনো উত্তর কলকাতার ছাদে বৃষ্টিভেজা কাপড় শুকোনোর দৃশ্য, কখনো কলেজস্ট্রিটের মোড় ঘেঁষে পুরনো বইয়ের দোকানের ছবি, আবার কখনো দক্ষিণেশ্বর ঘাটে চায়ের কাপে ধোঁয়ার রোম্যান্টিকতা। টেবিলজুড়ে ছড়ানো লেন্স, ত্রিপড, ফিল্ম ক্যামেরা আর আধুনিক…
-
শর্মিষ্ঠা বসু অধ্যায় ১: ট্রেনে দেখা রাত ৯টা ৪৫। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ৮ যেন শহরের শব্দশূন্য এক দ্বীপ। মেঘলা বিকেলের পর রাতটাও কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে, শুধু কখনো কখনো হুইসেল বাজে আর প্ল্যাটফর্মের গায়ে এসে ধাক্কা খায় হালকা বাতাস। ট্রেনটা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল—উদয়পুর সিটি এক্সপ্রেস। অনিরুদ্ধ ব্যাগটা টানতে টানতে এসি ২-টায় উঠে বসল। সিট নম্বর ছিল ৪২, জানালার পাশে। তার পাশে ছিল ৪১ নম্বর সিট, এখনো ফাঁকা। সে ব্যাগ থেকে বই বার করল, “The Little Prince”, তার প্রিয় ভ্রমণের সঙ্গী। প্ল্যাটফর্মে হালকা কুয়াশা, আলো আর ছায়ার মিশেলে যেন একটা চলচ্চিত্র চলছে। দশ মিনিট পর যখন ট্রেন ছেড়ে দেয়ার শেষ হুইসেল…
-
অরিজিৎ মুখার্জি বেলপাহাড়ি শহরটা যেন ছোট্ট একটা রঙিন খাঁচা—চারপাশে পাহাড় ঘেরা, মাঝখানে বয়ে চলেছে শান্ত নদীটা। বর্ষার সময় নদীটা ফুলেফেঁপে ওঠে, যেন শহরটাকে নিজের ভালোবাসায় ভাসিয়ে রাখে। আর ঠিক সেই নদীর পাড়েই তৈরি হয়েছিল রুদ্র আর মায়ার শৈশবের রঙিন ক্যানভাস। রুদ্র আর মায়া—দুজনেই ছোটবেলা থেকে একই পাড়ায় বড় হয়েছে। স্কুলের ছুটি মানেই নদীর পাড়ে বসে গল্প করা, সাদা কাগজ ছিঁড়ে নৌকা বানানো আর বৃষ্টি হলে সেই নৌকা ভাসানো। রুদ্র বরাবরই একটু শান্ত স্বভাবের, ভাবুক, বইপাগল। আর মায়া ঠিক তার উল্টো—চঞ্চল, প্রাণবন্ত, নদীর ঢেউয়ের মতো খোলা হাসি। রুদ্রের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। তার মা সংগীতশিল্পী, বাবা সাহিত্যানুরাগী। ছেলেবেলা থেকেই রুদ্রের হাতে বই…