সৌভিক রায়চৌধুরী পর্ব ১ বর্ষার বিকেল। গৌড়ের আকাশে কেবলই মেঘ জমছে। দূরে বাজ পড়ে, নদীর ধারে শাল, সেগুন আর কদম গাছের পাতা ভিজে নেমে আসে। দূর থেকে দেখা যায়, নদী যেন আছড়ে পড়ছে নিজেই নিজের বুকের ওপর। সেই জলপথ ধরে ধেয়ে আসছে এক একলা ঘোড়সওয়ার—ঘোড়ার খুরের শব্দ ডুবে যাচ্ছে বৃষ্টির ছন্দে। তার মাথায় পাগড়ি, চোখে তীক্ষ্ণ ছায়া, কপালে গাঢ় চিন্তার রেখা। সে কালাপাহাড়, নবাব সুলেমান কররানির সেনাপতি। কিন্তু তার জন্মনাম ছিল রামপ্রসাদ। একদা হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রদের এক—ভাঙন, রূপান্তর, এবং আগুনের প্রতীক। এই পথ আজ যুদ্ধের জন্য নয়। এই পথ আজ তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার…
-
-
চন্দ্রবিন্দু সেন পর্ব ১: মালবিকার প্রথম দৃশ্য কলকাতা, ১৮৭৫। গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষার কোলে ঢুকে পড়েছে শহর। ঘোড়ার গাড়ির চাকা যখন জমাট জল গলিয়ে এগোচ্ছিল, তখন শ্যামবাজার থেকে জোড়াসাঁকোর দিকে হাঁটছিল এক তরুণ—নীলরুদ্র ঘোষ। সঙ্গীতের জন্য যার হৃদয়ে আগুন, কিন্তু পকেটে পাঁচ পয়সা নেই। তার কাঁধে ছিল এক পুরনো হারমোনিয়াম, হাতে লেপার কাঠির মতো রোল করা একটি পুরনো স্ক্রিপ্ট। আজই প্রথম—সে ডাক পেয়েছে শ্যামল থিয়েটারে—বিখ্যাত নাট্যকার রঘুপতি ঘোষালের নতুন নাটকে গান গাওয়ার সুযোগ। শোনামাত্রই তার মায়ের মুখে ঈশ্বরে বিশ্বাস ফিরেছিল; আর বাবার অভিমানী চোখে একটু গর্বের ঝিলিক উঠেছিল—যেটা হয়ত ছোটবেলায় শেষবার দেখেছিল সে। থিয়েটারটির সদর দরজা কালো কাঠের, নীচে ধুলো জমে…
-
অরিত্র চক্রবর্তী পর্ব ১: আগমনের দিন আকাশটা ছিল ধূসর, পাহাড়ের কোলে জমে থাকা কুয়াশা গড়িয়ে পড়ছিল রাস্তার ধারে। কালিম্পং শহরের মূল অংশ থেকে গাড়ি ছুটেছে প্রায় পঁচিশ মিনিট, তখনই প্রথম দেখা মিলল সেই বাংলোর—একটা কাঠের দু’তলা বাড়ি, পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে। নাম তার “শিল কালিম্পং”—একটা লেখকদের রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রাম, যেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে দশজন লেখক এসে জড়ো হয় প্রতিবছর, দশ দিনের জন্য। গাড়ি থেকে প্রথম নেমেছিলেন সুচেতা ব্যানার্জি—পঁয়ত্রিশ পেরোনো, শহর কলকাতার কবি, মুখে গম্ভীর ছায়া। পাহাড়ের নিঃশব্দতা তাকে কেমন অসহ্য লাগছিল প্রথমে, তারপর হঠাৎ শব্দ শুনলেন—ঝিঁঝিঁ পোকার, পাতা নড়ার, দূরের ঝরনার। মনে পড়ল কোনো এক কবিতার লাইন, “যেখানে ভাষা থেমে যায়,…
-
অনিরুদ্ধ ঘোষ পর্ব ১ দুপুর গড়িয়ে বিকেল। উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির জানালার পাশের ঘরটায় বসে আছে অরিত্র। চোখে তার একধরনের শূন্যতা, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে টেবিলের কোণে, আর গিটারের তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে যেন কোনো স্মৃতি ছুঁতে চাইছে। হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল মৃণাল, অরিত্রর ছোটবেলার বন্ধু, এখনকার থিয়েটার ডিরেক্টর। “তুই এখনো ওই পুরনো গানের সুরটা নিয়ে পড়ে আছিস? কতবার বলেছি, নাটকটা নিয়ে সিরিয়াস হতে হবে,” বলে মৃণাল চেয়ারে বসে পড়ল। অরিত্র হালকা হেসে বলল, “এই সুরটা গেলে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে রে। মা যখন ছোটো ছিলাম, এই গানের সুরেই ঘুম পাড়াতো। এখন এটা ছাড়া কিছুই ভালো…