সন্ধ্যা নামতেই সেই ছোট্ট গ্রামের চিত্র যেন এক জাদুকরী রূপকথার মতো ভেসে ওঠে। চারদিক অন্ধকারে ডুবে যেতে না যেতেই গাছপালা, ধানখেত আর কুয়াশায় ঢাকা সরু পথগুলো ভরে ওঠে অসংখ্য জোনাকির ঝিলমিল আলোয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন আকাশের তারারা নেমে এসেছে মাটির বুকে, মিশে গেছে মানুষের জীবনে। গ্রামের বাচ্চারা প্রতিদিনের মতো আজও মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, তাদের হাসির শব্দ মিশে যাচ্ছে আলোছায়ার খেলায়। বৃদ্ধরা পানের পাত্র হাতে বসে নিজেদের পুরনো গল্প শোনাচ্ছে, অথচ এই আলোকিত রাত যেন সবার চোখে কেবল বিনোদনের মতো। কিন্তু মায়া নামের সেই তরুণী এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে। তার কাছে জোনাকির এই…
-
-
অঙ্কিতা প্রধান কলেজের ব্যস্ত ক্যাম্পাসে ভোরের প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে ঐশীর। সে তখনই লক্ষ্য করে, প্রতিদিন যেন এক নিয়মিত ছায়া, একটি অচেনা মেয়ে লাল চুড়ি পরে ভিড়ের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়। প্রথম দিনটি কেবল নজরকাড়া এক ঘটনা মনে হয়েছিল—কোনো ক্লাসের ছাত্রী কিংবা পরিচিত মুখের মতো নয়, তবু যেন তার উপস্থিতি পুরো ক্যাম্পাসকে আলাদা রঙে ভাসিয়ে দেয়। ঐশী প্রথমে ভেবে নেয় এটি হয়তো কারো ব্যক্তিগত স্টাইল, অথবা শুধু কৌতূহল। কিন্তু পরের দিন, ঠিক একই সময়, একই লাল চুড়ি, একই ধীরে ধীরে ভিড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া—এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। ঐশীর মনে কৌতূহল…
-
অমিয় রায় এক শৈশবের সেই গ্রামের সকালটা একেবারে জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল, কিন্তু তার আলো কখনোই চোখে আঘাত করে না। পলাশ আর তারকা, দুজনেই ছেলেবেলার অদ্ভুত সাহস আর কৌতূহলের সঙ্গে ধানখেতের মধ্যে দৌড়াচ্ছে। ধানের কাঁচা গাছগুলো যেন তাদের হাতছানি দিচ্ছে, আর তাদের খেলা যেন প্রকৃতির সাথে মিশে যাচ্ছে এক অদ্ভুত সমন্বয় তৈরি করে। গ্রামের ঘরে এখনও কেবল ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে, কয়েকটা হাঁস কষ্টে হাঁসছে, আর পথের ধুলো কৌতূহল নিয়ে সূর্যের আলোয় ঝকঝকে করছে। নদীর ধারে সোনালী রোদ পড়ছে, আর তার মধ্যে ছোট ছোট মাছেরা ঝলমল করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পলাশ হেসে চিৎকার করে বলল, “তারকা, ধরা পড়বি না!” আর তারকা হাসি…
-
কৌস্তভ হালদার মেগাসিটি—এক আধুনিক নগরী, যেখানে একদিকে ঝকঝকে আকাশচুম্বী ভবন, অন্যদিকে দমবন্ধ করা বর্জ্যের পাহাড়। দিনের আলো ফোটার আগেই গাড়ির হর্ণ, ফ্যাক্টরির ধোঁয়া আর মানুষের ভিড়ে শহর জেগে ওঠে। কিন্তু সেই ভোরের সৌন্দর্য অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে। সূর্যের আলো ধোঁয়া আর কুয়াশার মতো জমাট ধুলায় আটকে যায়, আকাশের নীল রঙ চাপা পড়ে থাকে ধূসর চাদরের নিচে। রাস্তার ধারে যেখানেই তাকানো যায়, সেখানেই প্লাস্টিকের রঙিন ব্যাগ, বোতল, খাবারের মোড়ক, একবার ব্যবহার করা চামচ বা গ্লাস। প্লাস্টিক এতটাই জায়গা দখল করে নিয়েছে যে মানুষ যেন তার ভেতরে বাস করছে—এ শহর এখন কংক্রিটের নয়, এক অদৃশ্য প্লাস্টিকের কারাগার। নদী-খালগুলো কেবল নামমাত্র থেকে…
-
রূপালী মিত্র ১ অজানা শহরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রধান চরিত্রটি একটি নতুন জীবন এবং নতুন সম্ভাবনার সামনে নিজেকে খুঁজে পায়। শহরের বুকে হাঁটতে হাঁটতে সে বিভিন্ন রাস্তার গন্ধ, মানুষের ব্যস্ততা, এবং অচেনা কোলাহলের মাঝে ডুবে যায়। প্রতিটি দোকান, প্রতিটি রাস্তার কোণা যেন তাকে বলে, এখানে কিছু বিশেষ আছে, কিছু অজানা অপেক্ষা করছে। মূল চরিত্রটি নিজেকে হঠাৎ এক ধরণের স্নিগ্ধ উত্তেজনার মধ্যে পায়। হালকা লাজুক হলেও চোখে ভর করে কৌতূহল। সে লক্ষ্য করে, শহরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট ব্যানার, রঙিন বাতাসে উড়তে থাকা ফ্ল্যাগ, আর দূরে একটি বড় তাঁবুর ছায়া—সবই যেন তাকে আহ্বান করছে। তার পদচারণার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে শহরের…
-
অদিতি চক্রবর্তী (১) ঋতমের কাছে গোধূলি বেলা সবসময়ই এক অদ্ভুত আকর্ষণের সময়। সূর্যের শেষ সোনালি আলো যখন নদীর জলে গিয়ে মিশে যায়, তখন আকাশ, জল আর বাতাস মিলেমিশে তৈরি করে এক রঙিন ক্যানভাস, যা তার আঁকার খাতায় ধরা পড়ে না, কিন্তু তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। সেদিনও সে স্কুলের ব্যাগ ঘরে ফেলে দিয়ে হাতে স্কেচবুক আর পেন্সিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সেই পরিচিত বাঁকের দিকে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনতে পায় পাখিদের বাসায় ফেরার ডাক, দূরে কারো গরু ফেরানোর বাঁশি, আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো এসে তার গায়ে পড়ছে। নদীর ধারের কাশফুলগুলো তখন গোধূলির আলোয় যেন রুপালি আভা…
-
অদ্রিজ লাহিড়ী ১ নতুন বছরের প্রথম সকালটা যেন অলিখিত এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এল জলপাইগুড়ির ছোট্ট শহরতলি এলাকায়। চারদিকে কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা, গাছের পাতা থেকে জলের ফোঁটা টুপটাপ পড়ছে, আর দূরে কোথাও একটি কাঠঠোকরার ডাক শোনা যাচ্ছে। সকাল ছ’টার সময় বাজারে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছিলেন তুষার দে’র কাকা, সুশোভন দে। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। প্রথমে তুষার ভেবেছিল, হয়তো কাকা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছেন, কিংবা ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ ঘনিয়ে আসে। কাকার মোবাইল বন্ধ, বাজারের দোকানিরা বলে, তাঁরা তাঁকে দেখেইনি। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে মা একসময় বললেন, “আবার কী ১…
-
নীলাঞ্জনা রায় বর্ধমান শহরের জানুয়ারির সকালগুলোয় কুয়াশা যেন চাদরের মতো শহরটাকে ঢেকে রাখে। স্কুলের মাঠটা তখনো ঘুমঘুম, কেবল কয়েকটা কাক আর গাছের ডালে বসে থাকা রংচটা ধোঁয়াশার ভেতর কিছু চেনা-অচেনা আওয়াজ। সেই রকম এক সকালে ঊর্মিলা সাইকেল ঠেলে স্কুলে ঢুকল, কানটুপি ঢাকা মুখে একরাশ মনোযোগ—তবে বাইরের নয়, তার নিজের ভিতরের কোনো অজানা ভাবনায়। ভেতরের কাঁপুনি ঠেকিয়ে সে সাইকেলটা লাইব্রেরির পাশে রেখে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটতে লাগল, মেঝেতে জমে থাকা শিশিরে পা পিছলে যাবার মতো টান, আর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে হঠাৎ থেমে গেল। ছেলেটা, নীল টুপি আর ধূসর সোয়েটারে আবৃত, জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল—হয়তো কুয়াশার ভেতর কিছু একটা…
-
ঐন্দ্রিলা চক্রবর্তী কলকাতার সাউথ সিটি কলেজে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ। ঐশী চৌধুরী ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল, তখন বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। দক্ষিণ কলকাতার এক কোণায় অবস্থিত ‘সুবর্ণ পল্লী আবাসন’ – চারতলা একটি পুরনো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, বাইরের রঙ প্রায় উঠে গেছে, জানালার লোহার রেলিংয়ে জং ধরেছে আর ছাদের ড্রেনপাইপ থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে টুপটাপ। ঐশী নিজের নতুন ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল—দরজার কপাটটা একটা ধাতব আর্তনাদের মতো শব্দ তুলে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাকে অভ্যর্থনা জানাল, তবে সে এমন গন্ধে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই সে পুরনো জিনিসে টান…
-
শ্রেয়সী বসাক অধ্যায় ১: লগইন লবিতে প্রথম দেখা RealM-EVE। একটা নাম, একটা দুনিয়া, একটা ছায়া বাস্তবতা। জয় ততক্ষণে দশ ঘণ্টার কোডিং শিফট শেষ করে, মাথার ব্যথাটা উপেক্ষা করে নিজের মডিফায়েড VR হেলমেটটা মাথায় চাপিয়ে নিয়েছে। ওর জীবনটা গত কয়েক বছরে রুটিনের মধ্যে আটকে পড়েছে—ডে জব ইন IT, নাইট জব ইন গেমিং। RealM-EVE তার কাছে শুধু একটা খেলা নয়, ওটা ছিল একধরনের নির্জনতা, যেখানে সে হারিয়ে যেতে পারে নিজের মতো করে। হেডসেটে কান ঢেকে যাওয়া মাত্রই, চোখের সামনে খুলে গেল রঙিন এক লবি—আধা-জীবন্ত, সাইবার ফ্যান্টাসি আর রেট্রো ফিউচারিজমে মেশানো পরিবেশ, যেখানে প্রথমবারেই জয় খেয়াল করল, একটা চরিত্র খুব চুপচাপ তাকিয়ে আছে…