রূপালী মিত্র ১ অজানা শহরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রধান চরিত্রটি একটি নতুন জীবন এবং নতুন সম্ভাবনার সামনে নিজেকে খুঁজে পায়। শহরের বুকে হাঁটতে হাঁটতে সে বিভিন্ন রাস্তার গন্ধ, মানুষের ব্যস্ততা, এবং অচেনা কোলাহলের মাঝে ডুবে যায়। প্রতিটি দোকান, প্রতিটি রাস্তার কোণা যেন তাকে বলে, এখানে কিছু বিশেষ আছে, কিছু অজানা অপেক্ষা করছে। মূল চরিত্রটি নিজেকে হঠাৎ এক ধরণের স্নিগ্ধ উত্তেজনার মধ্যে পায়। হালকা লাজুক হলেও চোখে ভর করে কৌতূহল। সে লক্ষ্য করে, শহরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট ব্যানার, রঙিন বাতাসে উড়তে থাকা ফ্ল্যাগ, আর দূরে একটি বড় তাঁবুর ছায়া—সবই যেন তাকে আহ্বান করছে। তার পদচারণার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে শহরের…
-
-
অদিতি চক্রবর্তী (১) ঋতমের কাছে গোধূলি বেলা সবসময়ই এক অদ্ভুত আকর্ষণের সময়। সূর্যের শেষ সোনালি আলো যখন নদীর জলে গিয়ে মিশে যায়, তখন আকাশ, জল আর বাতাস মিলেমিশে তৈরি করে এক রঙিন ক্যানভাস, যা তার আঁকার খাতায় ধরা পড়ে না, কিন্তু তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। সেদিনও সে স্কুলের ব্যাগ ঘরে ফেলে দিয়ে হাতে স্কেচবুক আর পেন্সিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সেই পরিচিত বাঁকের দিকে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনতে পায় পাখিদের বাসায় ফেরার ডাক, দূরে কারো গরু ফেরানোর বাঁশি, আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো এসে তার গায়ে পড়ছে। নদীর ধারের কাশফুলগুলো তখন গোধূলির আলোয় যেন রুপালি আভা…
-
অদ্রিজ লাহিড়ী ১ নতুন বছরের প্রথম সকালটা যেন অলিখিত এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এল জলপাইগুড়ির ছোট্ট শহরতলি এলাকায়। চারদিকে কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা, গাছের পাতা থেকে জলের ফোঁটা টুপটাপ পড়ছে, আর দূরে কোথাও একটি কাঠঠোকরার ডাক শোনা যাচ্ছে। সকাল ছ’টার সময় বাজারে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছিলেন তুষার দে’র কাকা, সুশোভন দে। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। প্রথমে তুষার ভেবেছিল, হয়তো কাকা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছেন, কিংবা ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ ঘনিয়ে আসে। কাকার মোবাইল বন্ধ, বাজারের দোকানিরা বলে, তাঁরা তাঁকে দেখেইনি। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে মা একসময় বললেন, “আবার কী ১…
-
নীলাঞ্জনা রায় বর্ধমান শহরের জানুয়ারির সকালগুলোয় কুয়াশা যেন চাদরের মতো শহরটাকে ঢেকে রাখে। স্কুলের মাঠটা তখনো ঘুমঘুম, কেবল কয়েকটা কাক আর গাছের ডালে বসে থাকা রংচটা ধোঁয়াশার ভেতর কিছু চেনা-অচেনা আওয়াজ। সেই রকম এক সকালে ঊর্মিলা সাইকেল ঠেলে স্কুলে ঢুকল, কানটুপি ঢাকা মুখে একরাশ মনোযোগ—তবে বাইরের নয়, তার নিজের ভিতরের কোনো অজানা ভাবনায়। ভেতরের কাঁপুনি ঠেকিয়ে সে সাইকেলটা লাইব্রেরির পাশে রেখে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটতে লাগল, মেঝেতে জমে থাকা শিশিরে পা পিছলে যাবার মতো টান, আর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে হঠাৎ থেমে গেল। ছেলেটা, নীল টুপি আর ধূসর সোয়েটারে আবৃত, জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল—হয়তো কুয়াশার ভেতর কিছু একটা…
-
ঐন্দ্রিলা চক্রবর্তী কলকাতার সাউথ সিটি কলেজে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ। ঐশী চৌধুরী ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল, তখন বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। দক্ষিণ কলকাতার এক কোণায় অবস্থিত ‘সুবর্ণ পল্লী আবাসন’ – চারতলা একটি পুরনো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, বাইরের রঙ প্রায় উঠে গেছে, জানালার লোহার রেলিংয়ে জং ধরেছে আর ছাদের ড্রেনপাইপ থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে টুপটাপ। ঐশী নিজের নতুন ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল—দরজার কপাটটা একটা ধাতব আর্তনাদের মতো শব্দ তুলে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাকে অভ্যর্থনা জানাল, তবে সে এমন গন্ধে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই সে পুরনো জিনিসে টান…
-
শ্রেয়সী বসাক অধ্যায় ১: লগইন লবিতে প্রথম দেখা RealM-EVE। একটা নাম, একটা দুনিয়া, একটা ছায়া বাস্তবতা। জয় ততক্ষণে দশ ঘণ্টার কোডিং শিফট শেষ করে, মাথার ব্যথাটা উপেক্ষা করে নিজের মডিফায়েড VR হেলমেটটা মাথায় চাপিয়ে নিয়েছে। ওর জীবনটা গত কয়েক বছরে রুটিনের মধ্যে আটকে পড়েছে—ডে জব ইন IT, নাইট জব ইন গেমিং। RealM-EVE তার কাছে শুধু একটা খেলা নয়, ওটা ছিল একধরনের নির্জনতা, যেখানে সে হারিয়ে যেতে পারে নিজের মতো করে। হেডসেটে কান ঢেকে যাওয়া মাত্রই, চোখের সামনে খুলে গেল রঙিন এক লবি—আধা-জীবন্ত, সাইবার ফ্যান্টাসি আর রেট্রো ফিউচারিজমে মেশানো পরিবেশ, যেখানে প্রথমবারেই জয় খেয়াল করল, একটা চরিত্র খুব চুপচাপ তাকিয়ে আছে…
-
অয়ন চক্রবর্তী ১ গ্রীষ্মের দুপুর যেন রোদে গলে যাওয়া মিছরি। দক্ষিণ কলকাতার অলি-গলি পেরিয়ে রবীন্দ্র সরোবরের ঘন ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া যেন শীতলতার অভিজ্ঞান। আজ ছিল স্কুলের শেষ দিন। আর আজ থেকেই শুরু সেই কাঙ্ক্ষিত ছুটি। তিন বন্ধু—ঋভু, সোহিনী আর আদিত্য—প্রায় রোজের মতোই দেখা করল লেকের কাছে। তাদের তিনজনের ছুটির প্রথম দিনের আড্ডা শুরু হলো পাথরের বেঞ্চে বসে পাঁপড় ভাজা খেতে খেতে। হালকা বাতাসে কদমগাছের পাতা দুলছিল, আর জলের ওপরে সূর্যের আলো রুপোর মাছরাঙার মতো লাফিয়ে পড়ছিল। ঋভু বলল, “এই লেকের নিচে যদি কিছু লুকানো থাকে রে? ধর, কোনো গুপ্তধন বা পুরনো রহস্য?” আদিত্য এক চুমুক দিয়ে বলল, “তোর গোয়েন্দাগিরির শুরু…
-
তিয়াস চক্রবর্তী ১ বটগাছটা ছিল বিশাল, ছায়াময় আর পুরনো। বনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাছটাকে পাখিরা ডাকে “আকাশদ্বার”—যেন তার ডালপালায় সিঁড়ি বেয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়। সেখানে বাস করত রকমারি পাখি—নীল টিয়া, সবুজ বেনেবউ, সোনালি ঘুঘু আর শাদা পায়রা। প্রত্যেকের নিজের গান ছিল, নিজের আভিজাত্য। গাছজুড়ে প্রতিদিন সকালবেলা এক অপূর্ব সঙ্গীতসন্ধ্যা বসত—কারও কণ্ঠে মিষ্টি রাগ, কারও গলায় ঝংকারের ঝরনা। এই সংগীতের মাঝেই বসবাস ছিল একমাত্র সেই পাখিটির—যার গলায় ছিল না কোনো সুর, যার গায়ে ছিল না কোনো রং। তার নাম কেউ নেয় না—সবাই তাকে বলে “ওই কাকটা।” সে নিজে নিজের নাম রেখেছিল কাকু। কাকু কালো, সাধারণ, আর তুচ্ছ—এই তিন অভিধায়…
-
সন্দীপন সাহা ১ জলতলার আকাশটা সকাল থেকেই ধূসর হয়ে ছিল। মেঘগুলো যেন জমাট বাধা দুঃখের মতন মাথার ওপর ঝুলছিলো, আর ঠিক বেলা এগারোটা নাগাদ প্রথম বৃষ্টি নামে। টিনের ছাউনি মাথায় চাপিয়ে থাকা ছোট ছোট ঘরগুলোর ওপর বৃষ্টির শব্দ ধাতব ঘন্টাধ্বনির মতো বাজতে থাকে। সজল জানালার ফাঁকে মুখ গলিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে তখন ঈশ্বরের খেলা—যেন নীলের বদলে আকাশের রং হয়ে গেছে রুপালি। ঘন জলকণা মাটিতে পড়তেই কাঁচা রাস্তা একাকার হয়ে যাচ্ছে, নালার জল ফুলেফেঁপে উঠছে, আর বৃষ্টির ধারায় সেই জল যেন দিকবিদিক ছুটে যাচ্ছে। সজল ভাবে—”এই জলে যদি একখানা নৌকা ভাসাই, কোথায় যাবে সেটা?” তার মা তখন ভাঙা বাসনের ওপরে…
-
সুব্রত দাশগুপ্ত ১ রিমার চোখে এই শহর ছিল এক স্বপ্নময় চিত্রপট — বড় বড় বিল্ডিং, আলোর রোশনাই, গাড়ির একটানা শব্দ, আর ছাদের ওপর নীল আকাশে উড়তে থাকা সাদা পায়রার মতো সুখ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগেনি। মায়ের মৃত্যুর পরে মামা তাকে শহরে নিয়ে আসে, একটা “ভালো” বাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। বয়স দশ হলেও, রিমা জানত কাজ বলতে কী — খাটুনি, হাঁটু পর্যন্ত ঝাঁপ দেওয়া, বকুনি খাওয়া আর সবশেষে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুতে ঘুমিয়ে পড়া। প্রথম দিন শহরে এসে মালবিকার বাড়িটা দেখে তার মনে হয়েছিল, এ যেন এক রাজপ্রাসাদ। চারপাশে ঝকঝকে কার্পেট, অচেনা গন্ধে ভরা ঘর, দেয়ালে টাঙানো ছবি আর…