এক অমল মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর কলমে সমাজ, মানুষ, প্রেম আর রহস্য নতুন মাত্রা পেত। দীর্ঘদিনের সাহিত্যচর্চার শেষে তিনি এক বিশাল উপন্যাসের কাজে মন দিয়েছিলেন, যার নাম এখনও প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু সাহিত্য মহলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে এ হবে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অমলের বয়স বাড়ছিল, স্বাস্থ্যও তেমন ভাল ছিল না, তবু তিনি নিয়ম করে প্রতিদিন লিখতেন। তাঁর ছোট্ট পড়ার ঘরে পুরনো কাঠের টেবিলের উপর রাখা থাকত ডায়েরি, খাতা, এবং টাইপরাইটার—যেখানে শব্দগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। আশেপাশের প্রতিবেশীরা জানতেন, রাত গভীর হলে তাঁর ঘরে আলো জ্বলত, আর কলমের খসখস শব্দ শোনা যেত। কিন্তু একদিন ভোরে, যখন…
-
-
সৌমিলি দত্ত চন্দননগরের আলো উৎসবের রাতটি এক অন্যরকম জাদু উপহার দিচ্ছিল। নদীর ধারে ছড়িয়ে থাকা রঙিন আলো যেন জলরাশিকে আলোকিত স্বপ্নের মতো পরিণত করেছে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি রাস্তা, এমনকি ছোট্ট সরু গলিগুলোও আলোতে ভেসে ওঠে—লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ রঙের ঝলমলে বাতিগুলো এক ধরনের মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি স্থাপত্যে ভরা পুরনো ভবনগুলো তাদের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য ধরে রেখেছিল, কিন্তু রাতের আলো তাদের আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। সেতার আর ঢোলের সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন প্রতিটি সুর বাতাসে মিলেমিশে নাচছে। লোকেরা উৎসবমুখর, হাসি-আনন্দে ভরা, আর প্রতিটি মানুষের মুখে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর আনন্দের ছাপ। শহরটি যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম হয়ে উঠেছে,…
-
নির্মলেন্দু বিশ্বাস ১ দূর পশ্চিমবঙ্গের অরণ্যঘেরা অঞ্চলে, যেখানে ঘন বনভূমি আর ভাঙাচোরা ধ্বংসাবশেষ প্রকৃতির আঁচলে লুকিয়ে থাকে, সেখানে এসে পৌঁছেছিল একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. অনিরুদ্ধ, এক সুপরিচিত কিন্তু রহস্যময় গবেষক, যিনি ইতিহাসের হারানো অধ্যায়গুলো উন্মোচন করার জন্য প্রায় অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—প্রাচীন মন্দিরগুলোর ধ্বংসস্তূপের ভেতর শুধু পাথরের স্তূপ নয়, লুকিয়ে আছে সভ্যতার অজানা কাহিনি, অদেখা প্রতীক আর অব্যাখ্যাত গোপন রহস্য। দলের সদস্যরা, যাদের মধ্যে ছিলেন তরুণ গবেষক, আলোকচিত্রী এবং স্থানীয় গাইডরা, সবাই এক অদ্ভুত উদ্দীপনায় ভরপুর ছিলেন। তাঁরা যখন লতাপাতায় আচ্ছাদিত, কালের ভারে নুয়ে পড়া সেই মন্দিরে প্রবেশ করলেন, চারপাশে নিস্তব্ধতা আর পাখির ডানার শব্দ…
-
সৌরভ বসু এক শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায় আর গলিপথের শেষে ঝোপঝাড়ে ঢাকা অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে দত্তবাড়ি। এককালে প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর গৌরবের প্রতীক ছিল এই প্রাসাদসদৃশ বাড়িটি, যার বিশাল খিলান, রঙচটা বারান্দা আর কাঠের দরজাগুলো একসময় শহরের মানুষকে বিস্ময়ে মুগ্ধ করত। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে যেন ইতিহাসও তাকে বিস্মৃত করেছে। কেউ আর কাছে আসে না, ধীরে ধীরে চারদিকের দেওয়ালে শেওলা জমেছে, ছাদ থেকে ইট খুলে পড়ে যায়, জানালার কাঁচ ভেঙে ঝুলে থাকে বাতাসে আর ভিতরের ঘরগুলো ধুলোয় ঢাকা অন্ধকারে ডুবে থাকে। মানুষ বলে—দত্তবাড়ি অভিশপ্ত, আর সেই অভিশাপের ছায়া পুরো বাড়িটার…
-
এক গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে, বাঁশঝাড়ের আড়ালে এক বিস্মৃত কূপ বহুদিন ধরে অচল পড়ে আছে। সময়ের ভারে তার ইটগুলো ভেঙেচুরে এক অদ্ভুত শৈবাল-ঢাকা রূপ নিয়েছে, যেন প্রকৃতি নিজেই কূপটিকে ঢেকে রাখতে চায়। চারপাশে গজিয়ে ওঠা কাঁটাঝোপ, শুকনো ডালপালা আর বনলতা মিলেমিশে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে দিনের আলোও প্রবেশ করতে চায় না। গ্রামের শিশুরা দূর থেকে কূপটিকে দেখে আঁতকে ওঠে, আর বয়স্করা ভয়ে নামও মুখে আনে না। শোনা যায়, একসময় এ কূপই ছিল গ্রামের প্রধান পানির উৎস। মানুষজন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা জল তুলতে আসত, কূপপাড়ে হাসি-ঠাট্টার আসর বসত। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এক ভয়াবহ ঘটনার পর হঠাৎ করেই কূপটি অশুভের প্রতীক…
-
শহরটা ছোট, অথচ তার বুকের ভেতরে লুকিয়ে আছে অগণিত অদ্ভুত গল্প। প্রতিদিন ভোরের আলো যখন কুয়াশার চাদর সরিয়ে দিয়ে বাড়ি-বাজার, রাস্তাঘাটের ওপর তার সোনালি আভা ছড়াতে শুরু করে, তখনই ডাকঘরের পুরোনো লোহার গেট খুলে ঢোকেন অবসরপ্রাপ্ত ডাকপিয়ন শম্ভু মণ্ডল। যদিও অবসরের পর তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, তবুও আজও ভোরবেলা পুরোনো অভ্যাসে সে এসে বসে পড়ে ডাকঘরের কাঠের বেঞ্চে। নতুন প্রজন্মের ডাকপিয়নেরা ব্যাগে চিঠি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে আর শম্ভু তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, এও যেন এক নেশা—চিঠির কালি, খামের ভাঁজ, আর মানুষের অগণিত গল্পের গন্ধ তার নাকে লেগে আছে আজও। সেই সকালটিও অন্য দিনের মতোই ছিল। ঝুপ…
-
অর্ণব দত্ত পর্ব ১ — রাতের সেতু হাওয়ায় গন্ধ ছিলো গরম লোহা আর নদীর শ্যাওলার। কলকাতার শহরতলির পুরনো লোহার সেতুটি রাত নামার পর যেন অন্য রকম হয়ে যায়—দিনে সে কত ব্যস্ত, ট্রাক, বাস, ভ্যানগাড়ি সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খলা। অথচ গভীর রাতে, হঠাৎ করেই যেন সেতুর গায়ে সময় থেমে যায়। বাতাসে ভিজে ধাতব শব্দ বাজতে থাকে, দূরে নদীর স্রোত কালো তেলের মতো ঘন হয়ে বইতে থাকে, আর হাওয়ার ফাঁক দিয়ে মনে হয়, কারা যেন অদৃশ্য পায়ে সেতুর গায়ে হাঁটছে। অনিকেত দাঁড়িয়ে ছিলো সেতুর মাঝখানে। হাতে সিগারেট, চোখ নদীর দিকে। সে একজন সাংবাদিক, তিরিশ পেরিয়েছে, জীবন তাকে খুব একটা সহজ কিছু দেয়নি।…
-
অধ্যায় ১ – গঙ্গার বুকে তৈরি সেই প্রাচীন সেতুটি এক অদ্ভুত সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে, প্রায় দেড়শো বছর আগে, সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল কলকাতার সাথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ সহজ করার জন্য। গাঢ় ধূসর পাথরে গড়া এই সেতুটি শুধু পরিবহনের জন্য নয়, ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শক্তির প্রতীক। গঙ্গার স্রোতকে যেন অমানুষিক জোরে বেঁধে রাখার এক দম্ভ দেখাতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। বিশাল খিলান, উঁচু খুঁটি, আর পাথরের গায়ে খোদাই করা সেই সময়কার নকশা এখনও মানুষের বিস্ময় জাগায়। দিনের বেলায় সেতুটা যতই দৃঢ় আর স্থায়ী মনে হোক, রাতের অন্ধকারে তার রূপ একেবারে পাল্টে যায়। গঙ্গার কুয়াশায় ঢাকা সেই পাথরের খিলানগুলো অদ্ভুত ভৌতিক…
-
নীলয় বসাক এক অরণ্যের আঁকাবাঁকা রাস্তায় ভোরের প্রথম আলো ভেসে আসছিল। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ধরে বহুটা পথ পেরিয়ে রিচার্ড অবশেষে পৌঁছাল সেই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে, যাকে স্থানীয়রা ‘রংভ্যালি’ বলে ডাকে। গ্রামের নাম মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না, পর্যটন গাইডবুকেও তার উল্লেখ নেই। তবু পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় মোড়া জায়গাটির প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ টেনেছিল তাকে। মেঘলা আকাশের নিচে সিঁড়ির মতো সাজানো ধানক্ষেত, কুয়াশায় আধঢাকা ছোট ছোট কুঁড়েঘর আর মাটির রাস্তার ধারে পাথর বসানো ঢাল—সবকিছু যেন রিচার্ডের চোখে এক অলৌকিক দৃশ্যের মতো ভেসে উঠল। লম্বা দেহ, খয়েরি দাড়ি আর গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে গ্রামের সীমানায় পা রাখতেই লোকেরা থমকে তাকাল। এত দূরে, এত…
-
অধ্যায় ১: রাজবাড়ির ধনভাণ্ডার রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের চারপাশে বিকেলের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হাওয়ার সাথে সাথে মলিন দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে শুকনো পাতা উড়ে এসে জমছে, যেন সময়ের স্তূপে চাপা পড়া একেকটি স্মৃতি। বহুদিন ধরে গ্রামবাসীর কাছে এই রাজবাড়িকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত—কেউ বলে এখানে নাকি রাতে অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে, আবার কেউ বলে রাজপরিবারের অশান্ত আত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায়। এসব কাহিনি শুনে অনেকে ভয়ে পা বাড়ায় না, কিন্তু নায়ক/নায়িকা ভেতরে এক ধরনের রহস্যময় টান অনুভব করে। আজ সেই টানেই সে প্রবেশ করেছে পুরনো রাজবাড়ির গা ছমছমে করিডোরে। ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলো ঢুকে পড়ছে, আর অচেনা আঁধারের সাথে মিলেমিশে তৈরি…