সৌরদীপ মুখোপাধ্যায় পর্ব ১ : অশুভ নিমন্ত্রণ কলকাতার শীতের শুরু। সন্ধ্যা নামতেই শহর জেগে উঠছে দীপাবলির আলোয়, আর দক্ষিণ কলকাতার পুরোনো বনেদি পাড়ায় লাহিড়ীবাড়ির কালীপুজোকে ঘিরে চারদিকে হৈচৈ। লাহিড়ীবাড়ির পুজো শুধু দেবতার কাছে ভক্তি নিবেদন নয়, বরং পাড়ার এক সামাজিক উৎসব, যেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে জড়ো হয় মানুষ। ঋদ্ধিমান মিত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, লোকসংস্কৃতির ছাত্র। তাঁর কাছে এই নিমন্ত্রণ ছিল অদ্ভুত। লাহিড়ীবাড়ির এক তরুণী, অর্পিতা, হঠাৎ একদিন লাইব্রেরিতে এসে তাঁকে বলেছিল— “আমাদের বাড়ির পুজোয় এ বছর আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। হয়তো আপনার পড়াশোনার কাজে লাগবে।” ঋদ্ধিমান প্রথমে অবাক হলেও, ভেবেছিল এ হয়তো গবেষণার একটা সুযোগ। কিন্তু অর্পিতার চোখের ভেতর অদ্ভুত…
-
-
শুভময় ব্যানার্জী প্রথম পর্ব – বোর্ডের বুদ্ধি কলকাতার গরম দুপুর। ট্রামে চেপে, বাস ধরে, নানারকম বাহন পাল্টে অবশেষে অফিসে ঢোকার সময়টা প্রায় দুপুর গড়িয়ে যায়। অফিসে ঢুকেই বিমলবাবু নিজের কপালে ঘাম মুছে চেয়ার টেনে বসলেন। বসের চোখ তখন লাল টকটকে, যেন মশারির ভেতর আটকে পড়া মশা। —“বিমল, আবার দেরি?” বিমল হেসে বলল, —“স্যার, এবার কিন্তু দোষ আমার নয়। রাস্তায় বড়ো বোর্ডে লেখা ছিল—‘Slow: School Ahead’। আমি তো ভদ্রলোক, নিয়ম মানতেই হবে! তাই দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ না স্কুল ছুটি হলো।” অফিস একেবারে ফেটে পড়ল হাসিতে। পিয়ন হেসে চেয়ার ধরে বসেছে, টাইপিস্টের হাত কীবোর্ডে থেমে গেছে, আর পাশের টেবিলের শীলা দি হাসতে…
-
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ভাট্টা সবসময় একইরকম থাকে। পুরোনো বইয়ের গন্ধ, চায়ের ভাঁড় হাতে ছাত্রদের ঝাঁক, ফুটপাতের দোকানগুলোয় বইয়ের পাহাড়—সব মিলিয়ে শহরের একটুকরো জাদুর মতো লাগে। অর্ণব সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ধীরপায়ে হাঁটছিল। বই কেনা তার আসল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মনে মনে একটা অজানা টান তাকে এখানে টেনে এনেছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে অন্য কোনোদিন সে সোজা বাড়ি ফিরলেও আজকে কেন যেন এই রাস্তার টানে চলে এসেছে। দোকানদাররা গলা উঁচিয়ে ডাকছিল—“সেকেন্ড হ্যান্ড, সস্তার দামে, বিরল সংস্করণ!” অর্ণব এক-দুটি দোকানে থামল, বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল। তার চোখে হঠাৎ পড়ল এক পুরোনো ধূলো ধরা বই—চামড়ার মলাট ছেঁড়া, কাগজগুলো হলুদ হয়ে গেছে, তবু…
-
অভ্রাংশু দত্ত অধ্যায় ১ – হারানো পান্ডুলিপি কলকাতার রাত কখনোই পুরোপুরি ঘুমোয় না। দক্ষিণ শহরতলির রাস্তাগুলোতে আলো-অন্ধকারের খেলা যতই সস্তা ল্যাম্পপোস্টে ঝিলমিল করুক, কালীঘাট মন্দির চত্বর যেন অন্য এক জগতের ছায়ায় ঢাকা থাকে। মন্দিরের চৌহদ্দিতে শঙ্খ আর ঘণ্টার ধ্বনি মিলেমিশে যায় গঙ্গার স্রোতের দূরবর্তী শব্দের সঙ্গে। কিন্তু আজ রাতটা অন্যরকম। অয়ন মুখার্জি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, হাতে একটি পুরনো টর্চ আর নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ প্রাচীরের কাছে—যেখানে সাধারণ ভক্তরা কখনো যায় না। সে আসলে খুঁজছে এক গোপন সূত্র। সপ্তাহ খানেক আগে মন্দিরের পুরনো ভাণ্ডারঘরে সংস্কারের সময় মজুরেরা ভাঙা ইটের দেয়ালের ফাঁক থেকে একটা অদ্ভুত কাগজের খণ্ড পেয়েছিল। হলদেটে, প্রায় ঝুরঝুরে…
-
অদ্রীশ সেনগুপ্ত পর্ব ১ : পূর্ণিমার রাত পূর্ববঙ্গ থেকে ভেসে আসা লোককথার মতোই যেন গল্পটা শুরু হয়েছিল। নদীর ধার ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম—দেবীপুর। এই গ্রামে আজও অনেক পুরনো আচার চলে, আর আছে নানারকম অদ্ভুত গল্প, যেগুলো নিয়ে লোকেরা আড্ডা দেয় সন্ধেবেলা পুকুরঘাটে বা মাঠের আলপথে বসে। তবে সবচেয়ে বেশি ফিসফাস হয় যে কাহিনী নিয়ে, তা হলো চতুর্দোলার কনে। এই গ্রামে বছর পঁচিশ আগে একটা বিয়ে ভেস্তে যায়। কনে সীতারা—সাদা মুখশ্রী, টকটকে লাল শাড়ি পরা, চোখে ভয় আর লজ্জার ছায়া। হঠাৎই বিয়ের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকের মতে সে বিষ খেয়েছিল। কিছুদিন পর মৃতদেহকে গ্রামের লোকেরা মন্দিরের পাশে এনে চার বাঁশে বাঁধা…
-
সুদীপ্ত পাল ১ অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে এই মুহূর্তটি ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং অস্থিরতার মিশ্রণ। তার দীর্ঘদিনের গবেষণার অবসানপ্রাপ্তি তাকে এক নতুন অভিযানে নিয়ে আসছে—পুরুলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলের গভীরে লুকানো একটি প্রাচীন নগরীর সন্ধানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির আবর্জনায় তিনি বহু পুরনো মানচিত্র এবং বিভিন্ন ধরণের প্রাচীন খণ্ডচিত্র পরীক্ষা করেছিলেন। নিখুঁত বিশ্লেষণ এবং শতাধিক নথি পরীক্ষা করার পরও নগরীর অবস্থান আজও রহস্যময় ছিল। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীদের মুখে ছড়িয়ে থাকা কাহিনী এবং মূর্তিভঙ্গিতে উপস্থিত সতর্কবার্তাগুলি তাকে ভয় দেখাতে পারেনি; বরং প্রতিটি গল্পে লুকানো রহস্য তাকে আরও উত্তেজিত করে তুলেছিল। গ্রামের বৃদ্ধরা বলেন, “যারা সেই বনপথে প্রবেশ করেছে, তারা আর ফিরে আসেনি, কিংবা ফিরে এলে…
-
অধ্যায় ১: অশরীরীর আগমন ধনপুর নামের ছোট্ট গ্রামটি যেন প্রকৃতির এক নিভৃত কোলে বসে আছে। শরৎকালের শুরুতে গ্রামজুড়ে এখন পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে, মেঘের আড়াল থেকে নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে, কাশফুলে ঢাকা মাঠে বাতাসের খেলায় দুলছে সাদা ফেনার মতো শিরীষের তুলো। গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর দুর্গাপুজোর প্রতিমা গড়ার দায়িত্ব থাকে মৃৎশিল্পী নিবারণ পাল ও তাঁর পরিবারের হাতে। নিবারণের হাতে তৈরি মূর্তির খ্যাতি আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে বহু বছর ধরেই। গাঁয়ের মানুষ বিশ্বাস করে, নিবারণের আঙুলের ছোঁয়ায় যেন দেবীর জীবন্ত ছায়া ফুটে ওঠে। দিনভর কাদা মাটি আর রঙের ঘ্রাণে ভরা কর্মশালায় চারদিক গমগম করে, কিন্তু রাত নামলেই সে ঘর একেবারে…
-
অধ্যায় ১ – পুরনো পাঠশালা মফস্বলের সেই ছোট্ট শহরটা যেন সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কোনো পুরোনো ছাপ রেখে গেছে। নতুন রাস্তা, দালান-কোঠা, আধুনিক দোকানপাট গজালেও শহরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক শতাব্দী প্রাচীন পাঠশালা, যার বয়সের ভাঁজগুলো গুনে বের করা যায় দেয়ালের ফাটল আর খসে পড়া চুনকাম থেকে। পাঠশালাটির বিশাল দোতলা কাঠামোতে মিশে আছে ব্রিটিশ আমলের গন্ধ, লম্বা বারান্দা, কাঠের দরজা-জানালা, আর ঘন ছায়াময় আঙিনা। দিনের বেলায়ও ভেতরে ঢুকলে অদ্ভুত একটা স্যাঁতসেঁতে শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে, যেন অদৃশ্য চোখ কেউ তাকিয়ে আছে। স্থানীয় মানুষের মুখে শোনা যায়, এই পাঠশালার প্রতিটি ইট নাকি কোনো না কোনো স্মৃতির সাক্ষী, আর তার কিছু স্মৃতি অন্ধকারে…
-
অধ্যায় ১ – পুরনো পাঠশালা মফস্বলের সেই ছোট্ট শহরটা যেন সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কোনো পুরোনো ছাপ রেখে গেছে। নতুন রাস্তা, দালান-কোঠা, আধুনিক দোকানপাট গজালেও শহরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক শতাব্দী প্রাচীন পাঠশালা, যার বয়সের ভাঁজগুলো গুনে বের করা যায় দেয়ালের ফাটল আর খসে পড়া চুনকাম থেকে। পাঠশালাটির বিশাল দোতলা কাঠামোতে মিশে আছে ব্রিটিশ আমলের গন্ধ, লম্বা বারান্দা, কাঠের দরজা-জানালা, আর ঘন ছায়াময় আঙিনা। দিনের বেলায়ও ভেতরে ঢুকলে অদ্ভুত একটা স্যাঁতসেঁতে শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে, যেন অদৃশ্য চোখ কেউ তাকিয়ে আছে। স্থানীয় মানুষের মুখে শোনা যায়, এই পাঠশালার প্রতিটি ইট নাকি কোনো না কোনো স্মৃতির সাক্ষী, আর তার কিছু স্মৃতি অন্ধকারে…
-
সোনালী গুপ্ত অধ্যায় ১ – নিখুঁত প্রারম্ভ রচনার জীবন শুরু হয়েছিল এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তির আভায়, যা অনেক দিন ধরে সে অনুভব করছিল। সকালগুলো নরম আলোয় ভরে ওঠা রঙিন কফির গন্ধ এবং অরুণের সঙ্গে হালকা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে শুরু হতো। শহরের মাঝারি আয়ের একটি বস্তিতে বসবাস করলেও তাঁদের জীবনযাত্রা সবসময়ই সরলতার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেত। রচনা এবং অরুণের সম্পর্ক দেখলে মনে হতো, তাঁদের সুখী দাম্পত্য জীবন যেন এক নিখুঁত ছায়া যা কখনও ফাটে না। রান্নাঘরে অরুণের হাসি, রচনার চোখে তার মৃদু দৃষ্টি, ছোট্ট বিকেলের খোলা জানালার বাইরে পাখির ডাক—সবকিছুই যেন এক নিরবসঙ্গীতের মতো। তবে, রচনার মন কিছুটা অশান্ত থাকত এমন সময়গুলোতে।…