সৌম্যজিৎ বসু অধ্যায় ১: কলকাতার শহরটা যখন প্রথম সূর্যকিরণে লালচে আভা পেতে শুরু করে, তখনও ময়লা পলিথিন, ইটের টুকরো আর টিনের ছাউনি ঘেরা বস্তি ঘুম থেকে পুরোপুরি জাগেনি। তবে বস্তির মধ্যে কুমুদ আগেই জেগে উঠেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল দূর থেকে হালকা করে শোনা যায় ট্রামের ঘণ্টার টুং টুং শব্দ, আর মাঝে মাঝে কোনো বাসের গর্জন। কুমুদ একহাত দিয়ে চোখের ঘুমের ছাপ মুছে নিয়ে অন্য হাতে চোঙা প্যান্টটা ঠিক করে পরে নেয়। গায়ে পরনের ছেঁড়া গেঞ্জিটা রাতের ঘাম আর বস্তির ধুলোবালিতে আরও বিবর্ণ হয়ে গেছে। সে জল আনার পিতলের কলসি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সরু গলিটা পেরিয়ে পাশের পাম্পের দিকে। পাম্পের…
-
-
মৃণালিনী ধর অধ্যায় ১: কলকাতার শহরতলির প্রান্তে ছোট্ট একটি দোতলা বাড়িতে একা থাকে অরণ্যা সেন। বাইরের চোখে সে নিছকই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত তরুণীর মতো—একজন কলেজে ইতিহাস পড়ানো প্রভাষক, যার দিন শুরু হয় এক কাপ চা দিয়ে আর শেষ হয় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে। কিন্তু অরণ্যার রাতের ঘুম আর দিনের স্বপ্ন এক অদ্ভুত বৃত্তে আটকে আছে—সে দেখতে পায় আগুনে ঘেরা শঙ্খ, সাদা পাথরের মন্দিরের স্তম্ভ, আর কোনো এক নারী যার কণ্ঠস্বর ঝড়ের মতো ফুঁপিয়ে ওঠে। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল ক্লান্তির পরিণাম, কিংবা ইতিহাস বইয়ের অতিরিক্ত প্রভাব। কিন্তু যখন তার শরীর নিজের অজান্তেই মাটি ছুঁয়ে ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে বসে পড়ে, যখন তার ঠোঁট কাঁপতে…
-
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী কলকাতার গরম রোদের মধ্যে দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এক সাদা রঙের সেকেন্ড হ্যান্ড জিপ গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে দীপ, চশমার কাচে ঘাম জমে গেছে, কপালে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা পড়ছে। পাশে বসে অমিত, রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বেঁধেছে। ওদের দুজনের মুখেই রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার ছাপ। “আর কত দূর, দীপ?” অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে। “আর বেশি না। এই বুঝি মদনপুর পৌঁছে গেলাম,” দীপ বলে। রাস্তা সরু হয়ে এসেছে। দুপাশে বিস্তৃত ধানের মাঠ, মাঝে মাঝে নারকেল আর তালগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। একপাশ দিয়ে সরু খাল বয়ে চলেছে। হালকা বাতাসে ধানের শীষ দুলছে, যেন প্রকৃতির…
-
ঋতুপর্ণা ঘোষাল ১ পাঞ্জাবের গরম তখন তীব্র, কিন্তু আকাশজুড়ে ছড়ানো এক অপূর্ব বিকেলের আলো। চারপাশে সরষে ফুলের হলুদ ঢেউ, আর তার মাঝে একটি মাটির পথ—যেটা সোজা চলে গেছে একটি ছোট্ট গ্রামে। গ্রামটির নাম ছিল হুসেনওয়ালা, সীমান্তের অনেকটা কাছেই, কিন্তু তখনো সীমান্ত বলে কিছু নেই। এপাশ-ওপাশের মানুষ তখনো ‘একটাই দেশ’ ভাবত। সেই গ্রামে একটি পুরনো, আধাবসতি জমিদার বাড়িতে থাকতেন এক নিঃসন্তান শিক্ষক দম্পতি। তাঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন তাঁদের একমাত্র ভাইঝি—অরুন্ধতী। অরুন্ধতী তখন ষোলো কি সতেরো হবে। বড় বড় চোখ, শাড়ি পরে চুলে বেণী বাঁধে, কিন্তু চোখেমুখে শহরের পড়ুয়া মেয়ে বলেই স্পষ্ট বোঝা যেত। সে লাহোরের কুইন্স কলেজের ছাত্রী, গ্রীষ্মের ছুটিতে…
-
সমীর বাউড়ি এক পুরুলিয়ার চরীদা গ্রামের আকাশে যখন সূর্য ডুবে যেতে থাকে, তখন লাল মাটির উপর এক ধরনের নরম আলো পড়ে, যেন প্রকৃতি নিজেই নৃত্যের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ছোট্ট গ্রামটি পাহাড়, শাল-পিয়াল আর বিস্তীর্ণ ধুলিধূসর পথের মাঝে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়ের নাম—যেখানে মুখোশ পরে নাচে পুরুষেরা, যেখানে ছৌ নাচ কেবল শিল্প নয়, আত্মার প্রকাশ। গ্রামের এক কোণে থাকে অরিত্র—এক কিশোর, যার চোখে মুখে জেদ, আর ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হওয়া এক আগুন। সে ছেলেবেলা থেকেই ছৌ নাচের প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু সেই ভালোবাসা যেন চোরাগোপ্তা সম্পর্কের মতো—জানাজানি হলে শাস্তি। তার মা, এক সাধারণ কিন্তু কঠোর নারী, নিজের চুল কাটার দোকান চালিয়ে কোনোরকমে…
-
কৌস্তভ রায়চৌধুরী সকালের আলোর মতো প্রতি শুক্রবার বিকেলে যোধপুর পার্কের একটু ভিতরের দিকে যে কোচিং সেন্টারটা, সেখানে একদল অভিভাবক এসে জড়ো হন। ঠিক চারটের দিকে একটা চাপা ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়ে — স্কুলব্যাগে ঠাসা স্বপ্ন, টিফিনের শেষটুকু গন্ধ, মায়েদের তাড়াহুড়ো করা চোখ, বাবাদের ফোনে নিমগ্ন মুখ। আমি অরিত্র, প্রতি শুক্রবারের মতোই আমার ছেলে অর্ককে নিয়ে এসেছি ক্লাসে বসাতে। আজকের দিনটা আলাদা ছিল না, আবার ছিলও। সেই প্রথম দেখেছিলাম তাকে। একটা হালকা ধূসর রঙের তাঁতের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে মাটি ছোঁয়া দৃষ্টি। এমনভাবে দাঁড়ানো, যেন তিনি কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন না—তবু অপেক্ষা তাঁর চারপাশে ছায়ার মতো জড়িয়ে। আমি সেদিনই প্রথম লক্ষ…
-
অনির্বাণ দত্ত সেই বিকেলের দেখা গড়িয়াহাট মোড়ের ব্যস্ততা তখন বর্ষার বৃষ্টিতে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। পথঘাট কাদা আর জলের প্যাচপেচে স্রোতে ভারাক্রান্ত, অথচ সেই মেঘলা বিকেলে কলকাতার আকাশে যেন কোনো অচেনা অপেক্ষার আলো ছড়িয়ে ছিল। ভিড় ঠেলে হাঁটছিল ঈশিতা। হাতে ধরা ছাতাটা বারবার উল্টে যাচ্ছিল হাওয়ায়, আর তার চশমার কাচে জলের ছিটে জমে অদ্ভুত একটা ঝাপসা দৃষ্টি তৈরি করছিল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের সবকিছু যেন ভুল ঠিকানায় রাখা ছবি—একটু চেনা, একটু অচেনা। হঠাৎই চোখে পড়ল সেই মুখটা—অরণ্য। পাঁচ বছর পর। মাথার চুলে হালকা পাক ধরেছে, চোখের কোণে একটু বয়সের রেখা, কিন্তু হাসিটা এখনও তেমনই—একটু লাজুক, একটু ঠোঁটের কোণে অসমাপ্ত। তার হাতে কাগজে…
-
বটুকেশ্বর পাল পটাশপুর গ্রামের নাম যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন—এই গ্রামে জিনিসপত্র যত পুরনো, তার চেয়ে বেশি পুরোনো মানুষের বিশ্বাস। কিন্তু এই প্রাচীন চিন্তার ঢেউয়ে মাঝেমাঝে উঠে আসে এক-একটা অদ্ভুত ঢেউ, যেমন হরিপদ কাকা। উনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নিজেকে “গাঁয়ের গ্যালিলিও” বলেই দাবি করেন। যদিও কাকার অঙ্কে তেমন হাত ছিল না—শ্রেণি সাত অবধি পড়েছেন, তারপরে খাজাঞ্চির দোকানে হিসেব রাখার বদলে লোকের পকেট ভুল করে গুণে গুণে ফাঁকা করে ফেলেছিলেন। সেই থেকে “গণিত ত্যাগ” করে, মন দিয়েছেন বিজ্ঞানে—অর্থাৎ, নিজের মতো করে সব কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টায় দিনরাত বিভোর। কাকার এই বিজ্ঞানমনস্কতা আসলে এল আকাশ থেকে। কয়েক বছর আগে এক ঝড়বৃষ্টির রাতে…
-
অরিন্দম বসু লালগ্রাম—একটা ছোট্ট, প্রায় ভুলে যাওয়া গ্রাম দক্ষিণবঙ্গের এক প্রান্তে। জনসংখ্যা হাতে গোনা, কিন্তু কাহিনির অভাব নেই। দিন যতই আধুনিক হোক, লালগ্রাম সন্ধ্যা নামতেই আজও হারিয়ে যায় অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়। কেউ বলে, এই সময়ে কেউ আসে। কাকে বলা হয় “কেউ”? কেউ জানে না। দেখা যায় না তাকে। কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়—মনে হয় ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের কাছ ঘেঁষে। এই গল্প ঠিক এখান থেকেই শুরু। রুদ্র বসু—একজন তরুণ চিত্রনাট্যকার। শহুরে জীবন থেকে ক্লান্ত হয়ে কয়েক মাস আগে এসেছিল লালগ্রামে, একটি সিনেমার লোকেশন দেখতে। তারপর হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল। পুলিশ, সাংবাদিক, বন্ধু—সবাই খুঁজেছে। কিছুই মেলেনি।…
-
ঋজু বসু সাঁইবাবা মন্দিরের পেছনের সরু গলি দিয়ে ঢুকলেই একখানা বাড়ি চোখে পড়ে, তার তিন তলা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন নিজের অস্তিত্বের প্রতিবাদে, অথচ প্রতিটি জানালায় জীর্ণ কাচ, প্রতিটি দেয়ালে কুয়াশার দাগ। রামেশ্বর লেন ৩। লোকেরা বলে, ওটা ঘড়িওয়ালা বাড়ি। কারণ বাড়িটার ভেতর যত ঘড়ি আছে, সব থেমে আছে—ঠিক রাত বারোটায়। কেউ বলে সেগুলো আর চলে না, কেউ বলে এগুলো নতুন কারও জন্য অপেক্ষায়। ইতিহাসের গবেষক সায়ন্তিকা সাহা এসব কুসংস্কার মানে না, কিন্তু অলৌকিক স্থাপত্য নিয়ে তার থিসিসের জন্য এই বাড়িটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, একরাত কাটিয়ে যাবে। সঙ্গে ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার আর তার বন্ধু চন্দন, যার একটাই…