Bangla - প্রেমের গল্প

নিরব ভালোবাসা

Spread the love

রুপালী সেনগুপ্ত


অধ্যায় ১

শহরের বাতাসে তখন বৃষ্টির গন্ধ। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। স্কুল মাত্র শুরু হয়েছে গ্রীষ্মের ছুটি শেষে। বৃষ্টি হলেও ক্লাস চলছে, শুধু জানালার বাইরের দৃশ্য যেন অনেক বেশি সুন্দর আজ। সবুজ মাঠ, ভেজা মাটি, আর ছাতা হাতে ছুটে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা।
অয়ন বসেছিল ক্লাস এইট–’সি’ সেকশনের জানালার ধারে, তার প্রিয় জায়গা। জানালা দিয়ে বাইরের মাঠটা ভালোভাবে দেখা যায়। শুধু মাঠ নয় — ওই পাশের করিডোরটা, যেখানে অন্বেষা প্রায় প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে।

অন্বেষা, ক্লাস টেন–’এ’–র ছাত্রী। মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল অয়ন নতুন ক্লাসে উঠেই। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে ওর মধ্যে এক আলাদা শান্ত সৌন্দর্য ছিল। সাদা ইউনিফর্ম, পরিপাটি চুলে সাদা ফিতে, কাঁচে গোঁজা। যেন এক নিঃশব্দ গল্প বলে যায়।

প্রথম কয়েক দিন ও শুধু তাকিয়েই ছিল। পরে বুঝল, অন্বেষা কোনোদিন সোজাসুজি চোখে তাকায় না, কথা খুব কম বলে। তার মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে, কিন্তু অহংকার নেই। সহপাঠীরা তাকে শ্রদ্ধা করে, শিক্ষকরা ভালোবাসে। সে ছিল ওই স্কুলের ‘আইডিয়াল স্টুডেন্ট’।

একদিন, ভেজা সকালে, প্রথম ঘণ্টার কিছু আগে, করিডোরে একসঙ্গে ছুটতে গিয়ে দুজনের কাঁধে লেগেছিল সামান্য ধাক্কা।
— “সরি!”
অন্বেষা বলেছিল।
অয়ন তো তখন কেমন যেন জমে গিয়েছিল। জবাবটা ঠিক সময়ে মুখ থেকে বেরোল না।

তারপর থেকেই ও অন্বেষাকে খুঁজে বেড়ায়। করিডোরে, লাইব্রেরিতে, এমনকি প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের মধ্যেও। কোথাও যেন একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, যেটা সে বোঝে না, শুধু অনুভব করে।

প্রতিদিন দুপুরবেলার টিফিনে অয়ন সেজে উঠত — শুধু একটা ঝলক দেখবে বলে। ছুটির ঘণ্টা বাজার আগে ওর চোখ বারবার ঘড়ির দিকে চলে যেত। ক্লাসে মন থাকত না। সব বিষয় তার কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠছিল — অঙ্ক, ইতিহাস, এমনকি প্রিয় ইংরেজি ক্লাসটাও।

বন্ধু সুমন বুঝেছিল ব্যাপারটা।
— “তুই প্রেমে পড়েছিস রে!”
— “ধুর… এমন কিছু না।”
— “মনে মনে তো নামটাও দিয়ে ফেলেছিস — সাদা জামা রাণী!”

অয়ন মুখে হাসলেও, ভিতরে কোথাও একটা কাঁপুনি উঠত। প্রেম? সেটা কি এত তাড়াতাড়ি হয়ে যায়? সে তো শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে চায়। কথা বলারও সাহস নেই।

একদিন সাহস করে ছুটির সময় লাইব্রেরির দিকের করিডোরে দাঁড়িয়েছিল। অন্বেষা তখন ক্লাস টেনের একটা ক্লাস টেস্ট দিয়ে বেরোচ্ছে। হাতে হালকা নীল রঙের একটা খাতা। ছেলেটা তার দিকে চেয়ে একটু হাসল। ও কি অয়নকে দেখল? না কি এটা কেবল কল্পনা?

ওই এক ফ্রেমে আটকে গেল পুরো দিন। অয়ন ফিরে এসে খাতার পেছনে লিখল —
“আজ তোমাকে দেখে দিনটা ভালো গেল।”

এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। অয়ন বুঝল, ও শুধু দেখেই খুশি নয় — কিছু বলতে চায়। কিছু অনুভূতি জমে আছে, যেটা সে রাখতে চায় না। একটা ছোট্ট নোটে লিখে দিতে চায়।

তাই এক শনিবার দুপুরে, খালি ঘরে বসে, সে তার প্রথম চিঠি লিখল— “তুমি আমাকে চিনবে না। হয়তো কখনো আমার দিকে তাকাওনি। তবু আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখি। জানালার ধারে বসে, করিডোরে দাঁড়িয়ে, মাঠের ওই প্রান্ত থেকে…
তোমার হেসে তাকানোটা ভালো লাগে। সাদা রিবনে তোমাকে পরীর মতো লাগে। তোমার খাতা হাতে হাঁটার ভঙ্গি, চোখে চশমা চাপিয়ে বই পড়ার মনোযোগ — সবই আমার মনে গেঁথে গেছে।

আমি জানি, এই লেখা তোমার কাছে কিছুই নয়। তবু এই কথাগুলো বলা দরকার। অন্তত জানো — কেউ একজন, খুব নিঃশব্দে তোমায় দেখছে।”

চিঠিটা লিখে অয়ন বারবার পড়ল। মুছল। আবার লিখল। শেষে একটানা সুন্দর হ্যান্ডরাইটিংয়ে লিখে রাখল একটা গোলাপি খাতার পাতায়। তারপর সেটাকে ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিল।

পরদিন স্কুল ছিল না — রবিবার। সোমবার সকালে অয়ন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে স্কুলে গেল। অন্বেষার ক্লাসের সময় বের করে খেয়াল করল, সে কোন বেঞ্চে বসে। তারপর দুপুরবেলা, সবাই টিফিনে বাইরে গেলে, সে চুপিচুপি গিয়ে চিঠিটা রেখে এল অন্বেষার বাংলা বইয়ের ভাঁজে।

হাত কাঁপছিল। বুক ধড়ফড় করছিল। কিন্তু তবু একটা অসম্ভব সাহস কাজ করল।

সেই দিনটা অয়নের কাছে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ দিন। অন্বেষা কি খেয়াল করবে? ও কি বুঝবে কে লিখেছে?

কিন্তু পরদিন… পরদিন কিছুই হয়নি।

অন্বেষা আগের মতোই করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। বই হাতে, শান্ত চোখে, তার মুখে কোনো পরিবর্তনের ছাপ ছিল না।

পরের ক’দিনও অয়ন শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থেকেছে। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খালি লাগছিল। হয়তো অন্বেষা অবহেলা করেছে, হয়তো পাত্তাই দেয়নি। কিংবা হয়তো ও বুঝতেই পারেনি। তবু সে হাল ছাড়েনি।

এক সপ্তাহ পর, শুক্রবার দুপুরে, অন্বেষার চোখে চোখ পড়ল। এবার মেয়েটি সামান্য একটু হেসে বলল— “তোমার হাতের লেখা খুব সুন্দর।”

তারপর একটুও থেমে না থেকে চলে গেল। অয়নের মনে হয়েছিল, সে যেন হাওয়ায় ভাসছে।

অধ্যায় ২

বৃষ্টির দিন পেরিয়ে গেছে। আকাশ এখন কিছুটা পরিষ্কার, কিন্তু অয়নের মনে রোজ যেন অন্যরকম একটা মেঘ জমে থাকে—হালকা, নরম, ঠিক যেমনটা হয় মন ভালোলাগার সময়।
সেই এক পলকের হাসি, সেই ছোট্ট বাক্য— “তোমার হাতের লেখা খুব সুন্দর”—এখন অয়নের মগজে রিলে দৌড়ের মতো ঘুরছে। একটাই প্রশ্ন: অন্বেষা কি জানে কে লিখেছিল সেই চিঠি?

প্রশ্নটা অয়নকে অস্থির করত। তার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা গরম ভাব—মিশ্র আবেগে টানাপোড়েন। আবার ভয়ও কাজ করত। যদি ওর নাম জেনে নেয়, আর বন্ধুদের বলে দেয়? অপমান করে? কিংবা শিক্ষককে জানিয়ে দেয়?

তবে মনের একটা কোণ থেকে কণ্ঠস্বর বলত—
“না… সে মেয়ে এমন নয়।”

অন্বেষার চরিত্রটা অয়ন যতদূর দেখে এসেছে, সে কখনো কোনো ছাত্রকে অপমান করেনি, না কাউকে ছোট করে কথা বলেছে। ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি ছিল, যেন সমস্ত শব্দের ওপরে থাকা নীরবতা। তবু তাতে যে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়, তাও অস্বীকার করা যায় না। অনেকটা যেমন নদী দেখলে মনে হয়, হাত দিলেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে—কিন্তু ছুঁতেই সে সরে যায়। অয়ন আরও গভীরে অন্বেষাকে জানার চেষ্টা শুরু করল।

প্রথমে সে লাইব্রেরিতে খোঁজ করল। কে জানে, যদি মেয়েটা নিয়মিত যায়, তার প্রিয় বইগুলো কী, কী ধরনের গল্প পড়ে, সব জানা যাবে। লাইব্রেরিয়ান মেহেরা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রথম জানল — “অন্বেষা তো রবীন্দ্রনাথ পড়তে খুব ভালোবাসে। বেশিরভাগ সময় ছুটি নিলে কবিতার বই নেয়, কখনো কখনো নাটক।”

এই তথ্যটা যেন অয়নের কাছে একটা গুপ্তধনের মতো। সে বাড়ি ফিরে সোজা বাবার বইয়ের তাক ঘেঁটে বের করল ‘সোনার তরী’, ‘স্মরণ’, ‘শেষের কবিতা’। প্রথমদিকে ওর পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন হচ্ছিল, তবু সাহস করে সে প্রতিটি শব্দ গিলে নিতে থাকল।

পরের সপ্তাহে স্কুলে, লাইব্রেরিতে বসে ‘শেষের কবিতা’ হাতে রেখে সে অন্বেষার পছন্দের পাতাগুলো খুঁজে খুঁজে পড়তে থাকল। এমন সময় হঠাৎ করেই করিডোর দিয়ে পায়ে হেঁটে আসা অন্বেষার পায়ের শব্দ পেল।

মেয়েটা ঢুকেই থামল। চোখে একরাশ কৌতূহল।
— “তুমি… ‘শেষের কবিতা’ পড়ছো?”
অয়ন চোখ তুলে তাকাল। হাসিমুখে বলল না, কিছু বললও না। শুধু হালকা মাথা নাড়ল।
— “ভালো লাগছে?”
— “হ্যাঁ…” অয়ন বলল। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার প্রিয় চরিত্র কোনটা? লাবণ্য, না অমিত?”
অন্বেষা কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল,
— “লাবণ্য। ওর মধ্যে স্থিরতা আছে। বাস্তবতা বোঝে। অমিত তো অনেকটা… যেন অস্থির নদী।”
তারপর একটা হালকা হাসি দিয়ে চলে গেল।

অয়ন তন্দ্রা থেকে যেন জেগে উঠল। এতটা কথা সে কখনো অন্বেষার সঙ্গে বলেনি। তার কথা, হেসে যাওয়ার ভঙ্গি—সব কিছু সিনেমার মত দৃশ্য হয়ে মনের পর্দায় খেলে যেতে লাগল।

পরবর্তী দিনগুলোতে অয়ন লক্ষ্য করতে লাগল, অন্বেষা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় স্কুলে আসে। ওর ব্যাগ সবসময় গুছানো, বই খাতাগুলো আলাদা আলাদা রঙের কভারে মোড়া। অনেকটা OCD টাইপ মনোভাব, তবে সহপাঠীরা এটাকে সম্মানই করে। অন্বেষা কোনো ঝগড়ায় পড়ে না, গসিপে থাকে না, কাউকে অপমান করে না।

শুধু একটাই বিষয় যা অয়নকে সবচেয়ে বেশি টানত — ওর সাদা রিবন। প্রতিদিন একরকম। পরিপাটি, কড়া হাতে বাঁধা চুলের দুই পিঠে সাজানো। অয়ন খেয়াল করত, অন্বেষা রোজ চুল বাঁধার আগে আয়নায় মুখ দেখে একটু হাসে। যেন নিজের সঙ্গে কোনো চুক্তি করে নেয়।

সে হাসিটা অনেকটাই আয়নার জন্য হলেও, অয়নের মনে হতো, ওটা তার জন্যই। একদিন দুপুরবেলায় হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ক্লাস চলাকালীন হালকা শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল টিনের ছাদে। সবাই কিছুটা চুপ হয়ে পড়ল। শিক্ষক পড়াতে পড়াতে একটু থেমে গেলেন। আর অয়ন… সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল।

সেই মুহূর্তে অন্বেষা ছাতা ছাড়া মাঠ পার হচ্ছিল। হাতে একটা নীল খাতা, আর মাথার উপর দিয়ে ঝরে পড়ছিল বৃষ্টি। তবু সে দৌড়ায়নি। ধীরে ধীরে হাঁটছিল। চুল ভিজে গেছে, কিন্তু সাদা রিবন ঠিকঠাক বাঁধা। তার হাসিতে ছিল একধরনের প্রশান্তি।

সেই দৃশ্যটাই হয়ে উঠল অয়নের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি। পরদিন সে নিজের ডায়েরিতে লিখল: “আজ ওকে বৃষ্টিতে হেঁটে যেতে দেখলাম। কাঁচা রোদে যেমন পুকুরের জল ঝিলমিল করে, ওর চুলের ভেজা সুতোগুলোর মধ্যে ঠিক তেমন আলো পড়ছিল। রিবনের সাদা আভা সেই সবুজ স্কুল ইউনিফর্মের উপরে যেন দেবদূতের ডানা।”

বন্ধু সুমন একদিন হেসে বলল,
— “তুই তো এখন পুরো কবি হয়ে যাচ্ছিস রে! ওকে বলবি কবে?”
— “বলার সাহস এখনও পাইনি।”
— “দেখ, বেশি দেরি কোরে ফেলিস না। ক্লাস টেনের ফাইনাল হয়ে গেলে ও তো আর থাকবে না।”
এই কথাটা যেন বিদ্যুৎ হয়ে বাজল অয়নের মাথায়। হ্যাঁ! অন্বেষার স্কুলজীবন শেষ হতে চলেছে। অয়ন তখন ক্লাস এইটে, আর অন্বেষা ক্লাস টেনের ছাত্রী। আর কয়েক মাস পরেই সে বিদায় নেবে। এরপর কী হবে? দেখা হবে? যোগাযোগ থাকবে?

সে রাতটায় অয়ন ঘুমোতে পারেনি। পরের দিন স্কুলে গিয়েই সে অন্বেষার ডেস্কে চুপিচুপি একটি ফুল রেখে এল— একটা ছোট গাঁদা ফুল।
কোনো চিঠি নয়, কোনো নাম নয়, শুধু একটা ইঙ্গিত।

দুপুরে যখন সে করিডোরে দাঁড়িয়েছিল, অন্বেষা হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে বলল,
— “তুমি কী সব সময় চুপ করে থাকো?”
অয়ন হতভম্ব হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
— “সবাই কিছু না কিছু বলার সাহস রাখে। চুপ করে থাকলে তো কেউ কিছু বোঝে না।”
তারপর একটু থেমে বলল,
— “তোমার ফুলটা সুন্দর ছিল। কিন্তু এটা শেষবার।”
অয়ন কাঁপা গলায় বলল,
— “শেষবার… মানে?”
— “তুমি জানো না, তোমার চোখ অনেক কিছু বলে দেয়। আর সাদা জামার মধ্যে চিঠি লুকিয়ে রাখা সহজ নয়।”

এই প্রথম অন্বেষা স্বীকার করল, সে জানে কে চিঠি দিয়েছিল, কে ফুল রেখেছিল।

অয়ন একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল যেন।
কিন্তু অন্বেষা হেসে বলল, — “শোনো, পড়াশোনা শেষ করো। যেদিন সাহস পাবে, সেদিন সামনে এসে বলো। চিঠি বা ফুল নয়… মুখে বললে বুঝব তুমি সত্যিই বড় হয়েছো।”
তারপর সোজা চলে গেল।

সেদিন বিকেলে অয়ন বাড়ি ফিরে জানালার ধারে বসে ছিল। বাইরের আকাশ মেঘলা, তার মনে শুধু সেই কথা বারবার বাজছিল — “মুখে বললে বুঝব তুমি সত্যিই বড় হয়েছো।”

অধ্যায় ৩

জুলাই মাসের কলকাতা মানেই রোদ–বৃষ্টির খেলাঘর। সকালে রোদ, দুপুরে হঠাৎ ঝড়ো বৃষ্টি। স্কুলে ঢুকতে ঢুকতে জামার কাঁধ ভিজে যেত, আবার ছুটির সময় রোদের তাপে চোখ বন্ধ হয়ে আসত। এমন এক দিনে অয়ন জানত—তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।

সেদিন অন্বেষার বলা শেষ কথাগুলো— “যেদিন সাহস পাবে, সেদিন সামনে এসে বলো।”
এই বাক্যটা যেন ভিতর থেকে পাথরের মত ভারি হয়ে বসে ছিল। এখন আর চিঠি রেখে যাওয়ার খেলা চলবে না। এবার বলতে হবে মুখোমুখি—সোজাসুজি।

কিন্তু কীভাবে বলবে?

স্কুলের পরিবেশে এমন কিছু বলা চাট্টিখানি কথা নয়। বন্ধুদের হাসাহাসি, শিক্ষকদের চোখ, সহপাঠীদের কান—all too alert. তবু অয়ন জানত, যদি কিছু না বলে সে, অন্বেষা হারিয়ে যাবে… স্কুল ছেড়ে যাবে… আর সেই সুযোগ কখনোই আসবে না।

প্রথম কাজ, অন্বেষাকে আরও ভালোভাবে জানা। সে কীভাবে ভাবে, কোন সময় বেশি একা থাকে, তার প্রিয় জায়গা কোনটা—সব খুঁটিনাটি এখন জরুরি।
তাই সে বানিয়ে ফেলল এক গোপন ডায়েরি—”অন্বেষা সময়পত্র”।
প্রতিদিন কী সময় সে লাইব্রেরিতে যায়, কোন বেঞ্চে বসে, কোন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে, কোন বই বেশি করে দেখে—সব কিছু সে নোট করতে শুরু করল। যেন গোয়েন্দা হয়ে উঠেছে সে।

দুই সপ্তাহ কেটে গেল। প্রতিদিন সে শুধু দেখেছে, কিন্তু সামনে গিয়ে কিছু বলেনি। তবে অন্বেষার দিক থেকে আর অবহেলা আসেনি। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হলে মেয়েটি হেসে নেয়। একদিন অয়ন রসায়নের খাতা ভুল করে লাইব্রেরির টেবিলে রেখে এসেছিল। যখন ফিরে পেল, দেখল তার ভিতরে ছোট্ট একটা কাগজ রাখা— “সব কিছু লিখে ফেলো খাতায়? না একটু মুখে বলতেও পারো?”
এই প্রথমবার অন্বেষা ওকে লেখা দিল! খুব ছোট্ট, কিন্তু প্রত্যুত্তর! অয়নের শরীর যেন তখন বিদ্যুৎচমক খেয়ে উঠেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় ডায়েরির পাতায় সে লিখল— “অন্বেষা কথা বলে। সে হাসে। সে বোঝে। এখন শুধু আমাকে প্রস্তুত হতে হবে।”

অয়ন জানত—এমন মুহূর্ত তৈরি করতে হবে, যখন কেউ থাকবে না, কেউ দেখবে না, এবং সে কিছু বলে উঠলে মেয়ে একেবারে পালিয়ে যাবে না।
তাই সে পরিকল্পনা করল স্কুলের বার্ষিক বইমেলা সপ্তাহে, যখন ক্লাস কিছুটা ঢিলা থাকে, আর ছাত্রছাত্রীরা লাইব্রেরি ও সভাঘরের মাঝামাঝি যাতায়াত করে।

মেলা চলছিল স্কুল অডিটোরিয়ামে। নানা পত্রিকা, বই, স্টল—সবকিছুর মধ্যে একটা সরব উচ্ছ্বাস।
অয়ন জানত, অন্বেষা ‘বইপত্র’ স্টলে সাহায্য করে। সেখানেই পরিকল্পনা করতে হবে।

প্রথমে সে অন্বেষার পছন্দের একটা বই কিনে রাখল—“গীতবিতান”। ভিতরে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখল— “তোমার মুখের ভাষা সুরের মত। গানের মত। শুধু একবার, চোখে চোখ রেখে বলার সুযোগ চাও—তাহলে বলব। আজ শেষ সময়।”
— অয়ন

তবে সে চিঠিটা অন্বেষাকে সরাসরি দেয়নি। সে বইটা তুলে রাখল সেই স্টলের সবচেয়ে কোণার অংশে, যেখানে সে জানত, অন্বেষা পৌঁছবেই। চিরকুটটা ছিল প্রথম পাতার নিচে, ঠিক পাতা আর কভারের মাঝখানে, একটু অস্পষ্টভাবে রাখা।বুকের ভিতর কাঠের ঢাক বাজছিল, যখন সে বাড়ি গেল।
পরদিন সে ঠিক করেছিল—যদি সে চিরকুট পড়ে, যদি সাড়া দেয়, তাহলে দুপুরে লাইব্রেরির পাশে ছাদঘরের নিচে দেখা হবে। না হলে—সব শেষ। সেই দুপুরে, বুক ধড়ফড় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অয়ন। চোখ বারবার ছাদঘরের সিঁড়ির দিকে চলে যাচ্ছিল।

পাঁচ মিনিট… দশ মিনিট… তারপর হঠাৎ পায়ের শব্দ।ছিপছিপে শরীর, সবুজ ইউনিফর্ম, আর সেই সাদা রিবনে বাঁধা চুল। অন্বেষা। চুপচাপ এগিয়ে এল। পাশে দাঁড়িয়ে বলল—

— “তুমি কী বলবে ভাবছো?”
অয়ন মুখ তুলে তাকাল। মেয়েটার চোখ শান্ত, তবু গভীর।
সে কাঁপা গলায় বলল—
— “আমি… অনেকদিন ধরে তোমায় ভালোবাসি।”

এই কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর কেঁপে গেল, কিন্তু ও বলল।

— “জানি।”
— “তুমি যদি না বলো, আমি আর কিছুই বলব না।”
— “তুমি এত ভয় পাও কেন?”
— “কারণ তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালো লাগা। আমি জানি না এটা ঠিক কি না, কিন্তু এটা মিথ্যে নয়।”

অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপরে বলল—
— “তুমি জানো, আমার এই বছরেই মাধ্যমিক। তারপরে স্কুল ছাড়তে হবে। আমি পড়াশোনার বাইরে কিছু ভাবিনি কোনোদিন।”
— “জানি। তাই তো এখন বলছি। যাতে কোনো আক্ষেপ না থাকে।”

অন্বেষা মুখ নিচু করে বলল—
— “তুমি যে চিঠিগুলো দিয়েছিলে, সেগুলো আমি রেখে দিয়েছি। ফুলটাও।”

অয়ন তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে।
— “তুমি তাহলে রাগ করোনি?”
— “না। কারণ তোমার ভালোবাসায় জোর ছিল না। ছিল মায়া।”

তারপর মেয়ে চুপ করে একটা কাগজ এগিয়ে দিল।
একটি চিরকুট— “আমি হয়তো অপেক্ষা করব না। কিন্তু তুমি যদি সত্যি ভালোবাসো, সময় বুঝে আবার আসবে। তখন আর সাদা জামা থাকবে না। থাকবে সত্যিকারের আমি।”

তারপর অন্বেষা চলে গেল। অয়ন দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তার হাতে সেই চিরকুট, আর মনে একটিই কথা— সত্যি ভালোবাসা সময়কে অপেক্ষায় দাঁড় করায়।

অধ্যায় ৪

ডিসেম্বরের কলকাতা। সকালের কুয়াশা, বাতাসে একটা নরম ঠান্ডা, আর স্কুলে এক অদ্ভুত গন্ধ—বিদায়ের।
যদিও আনুষ্ঠানিক বিদায় অনুষ্ঠান আরও এক সপ্তাহ পর, তবু অন্বেষা আর তার ক্লাসমেটদের চোখে সেই অদৃশ্য তারিখটিই যেন প্রতিদিন এগিয়ে আসছিল। নতুন ক্লাসের রুটিন আসছে, নতুন বইয়ের তালিকা ঝুলছে, ক্লাস টেনের রেজাল্টের চাপ—সব মিলিয়ে এক অস্থিরতা কাজ করছিল। তবে সবচেয়ে অস্থির ছিলেন অয়ন।

কেননা সে জানত, এই মায়ার সময়টা শেষ হতে চলেছে। আর হয়তো আর কোনোদিন স্কুল ইউনিফর্মে অন্বেষাকে দেখবে না। সেই বাঁধা সাদা রিবন, সবুজ জামা, গলা ভর্তি ঝিনুকের মত শব্দে হাসি—সবই এক এক করে ফিকে হয়ে যাবে।

তাই সে ঠিক করেছিল—আজ কিছু একটা করতে হবে। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। স্কুলে পরীক্ষা শেষ, কিন্তু উপস্থিত থাকতে বলেছে টিচাররা। সাজসজ্জার কাজ চলছে, বিদায় অনুষ্ঠানের মহড়া চলছে।
অন্বেষা নাটক সেকশনে নাম লিখিয়েছিল। একটি রবীন্দ্রনাট্যে লাবণ্যের চরিত্রে অভিনয় করছে। অয়ন দূর থেকে রোজ মহড়া দেখে। সে জানে, জীবনে শেষবারের মতই হয়তো এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারবে। বসে বসে সে চিঠির খসড়া লিখছিল বহুদিন ধরে।
তবে এবার আর কবিতা নয়, চটজলদি প্রেম নয়—এটা হবে এক চিঠি যা এক বন্ধুর মত, এক ভালোবাসার বন্ধনের মত লেখা। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। তার বন্ধুরা কেউই জানত না সে আজ চিঠি দেবে। এমনকি সুমনও না। এই সিদ্ধান্ত একান্ত তার নিজের।

সকাল দশটার সময় সে স্কুলে ঢুকল। ব্যাগে রাখা ছিল একটি মোটা খাম। ভিতরে এক চিঠি—হাতের লেখা, নিচে তার নাম, আর সেই ছোট্ট গাঁদা ফুল যা অনেকদিন আগের স্মৃতি হয়ে গিয়েছিল। ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর, সে লাইব্রেরির করিডোরে অপেক্ষা করছিল। ঠিক জানত না, অন্বেষা আসবে কি না। কিন্তু তখন সে দেখতে পেল মেয়েটা একা একা হেঁটে আসছে।

আজও ওর মাথায় সেই সাদা রিবন। কিন্তু আজ একটু আলাদা রকম করে বাঁধা—একপাশে ঘুরিয়ে ফুলের মত করে সাজানো। অন্বেষা যখন তার সামনে এল, তখন মুখে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু চোখে একরাশ স্বস্তি।

— “তুমি আজ কথা বলবে তো?”
অয়ন মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ। শেষবার।”
তারপর ব্যাগ থেকে খামটা বের করে বলল,
— “এটা রেখে দিও। পরে পড়ো। এখন নয়।”
অন্বেষা একটু থমকে গেল। তারপর খামটা হাতে নিয়ে তাকাল। কিছু বলল না। শুধু জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কবে বড় হবে?”
অয়ন কিছুটা চুপ করে বলল,
— “যেদিন তোমার মতো করে কেউ আমাকে ভালোবাসবে, সেদিন।”

অন্বেষা হেসে ফেলল। একটা নরম, মিষ্টি হাসি। তারপর খামটা ব্যাগে রেখে বলল,
— “তুমি জানো, তোমার ভালোবাসা আমার জীবনের প্রথম পাওয়া ছিল। কিন্তু আমি তখন প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তোমার অপেক্ষা করতে পারব না, কিন্তু তোমার কথা কখনো ভুলব না।”

অয়ন বলল,
— “আমিও তোমায় ভুলব না। তুমি আমার প্রতিদিনের রুটিনে ছিলে, প্রতিটা চিঠির পাতায় ছিলে, এমনকি যেদিন ক্লাসে পড়া হতো না, সেই ফাঁকা জায়গাটায়ও তুমি ছিলে।”

দুজনের চোখে তখন অদ্ভুত নীরবতা। চারপাশে ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল থাকলেও, এই করিডোর যেন দুইজন মানুষ ছাড়া আর কারো ছিল না।

অন্বেষা ধীরে ধীরে চলে যেতে যেতে বলল—
— “ভালো থেকো, অয়ন। চিঠির শেষ লাইনে তোমার নামটা যেন আমার মনে গেঁথে থাকে।”

অয়ন কিছু বলল না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকল।

সেদিন সন্ধ্যায়, বাড়ি ফিরে চুপচাপ ডায়েরি খুলে লিখল— “আজ সে চিরকুট দিল না। দিল না চিঠির জবাব। তবু তার চোখে আমি আমার নামে লেখা শেষ অধ্যায়ের শুরু দেখে এলাম।”

বিদায় অনুষ্ঠানের দিন আসল। অন্বেষা সেই নাটকে অভিনয় করছিল—”শেষের কবিতা”। অয়ন দর্শকসারিতে বসে ছিল।

যখন অন্বেষা মঞ্চে উঠে অমিতকে বিদায় জানায়, তখন তার গলায় যে ব্যথা ছিল—সেটা শুধু অভিনয় ছিল না। অয়ন জানত, ওর মধ্যে একটা সত্যি অনুভূতি লুকিয়ে ছিল।

প্রোগ্রাম শেষে যখন সবাই ছবি তুলছে, অয়ন এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন অন্বেষা তার দিকের একবার তাকাল। চোখে একটা ক্লান্ত হাসি। তারপর একবার হালকা করে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। আর সেই ছিল শেষ দেখা।

পরবর্তী সপ্তাহে, অয়ন যখন লাইব্রেরির এক পুরনো বইয়ের মধ্যে কিছু খুঁজছিল, তখন সে খুঁজে পেল একটা ছোট্ট পেপার—চোখের সামনে পড়ে গিয়েছিল হয়ত কোনো বইয়ের ভিতর থেকে। ওটা একটা গানের লাইন ছিল, হাতে লেখা:

“সে যে আমার পাশে ছিল, আমি কি তা জানতাম না?
সে যে আমার ভালোবাসা, আমি কি তা মানতাম না?”

অধ্যায় ৫

পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কলেজ, নতুন বন্ধু, নতুন ক্লাসরুম, নতুন শহরের অভ্যাস—সব মিলিয়ে অয়নের চারপাশটা বদলে গেছে।
তবে একটা জিনিস বদলায়নি—তার সেই পুরোনো ডায়েরি।
প্রথম পাতায় অন্বেষার নাম, দ্বিতীয় পাতায় সেই চিঠির কপি, আর শেষ পাতায় একটা গাঁদা ফুল, যার রঙ আজ বিবর্ণ।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষে পড়ছে অয়ন। তার লেখা আজকাল ছোট পত্রিকায় ছাপা হয়। কলেজ ম্যাগাজিনের কবিতাগুলোয় প্রায়ই একটা নাম আসে বারবার—”সে”।
বন্ধুরা জানতে চায়,
— “কে সে?”
অয়ন হেসে বলে,
— “একটা সময়, যা আর নেই।”

তবে একটা কথা অয়ন জানত না—সময় মাঝে মাঝে ফিরে আসে।

সেই নভেম্বরের এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে হাঁটছিল অয়ন। ছুটির দিন, হাতে সময়, মনটা ফাঁকা। তখন হঠাৎ চোখে পড়ল পরিচিত হাতের লেখা একটা খাম—
তার নাম লেখা—”অয়ন মৈত্র”।
কিন্তু প্রেরকের নাম নেই। সে থেমে খামটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর খুলল। ভিতরে একটা পাতলা পৃষ্ঠা, হাতে লেখা অদ্ভুত চেনা অক্ষরে—

“প্রিয় অয়ন,
অনেকদিন আগে তুমি একবার বলেছিলে—‘যেদিন সাহস পাবে, সেদিন সামনে এসে বলো।’

আজ আমি বলছি। আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। শহর পাল্টেছি, স্কুলের স্মৃতি পেছনে ফেলে রেখেছিলাম। কিন্তু তবু তোমার চিঠিগুলো রেখেছিলাম। মাঝে মাঝে পড়তাম, তোমার আঁকা গাঁদা ফুলে এখনো গন্ধ পাই।

তুমি জানো? আমি বিশ্বাস করতাম না ভালোবাসায়। তখন না, এখনো পুরোপুরি নয়।
তবে তোমার সেই নীরব চাওয়া, তোমার প্রতিটি শব্দে যে কোমলতা ছিল—তা আজও মনে পড়ে।

আমি জানি না তুমি এখন কেমন আছো। তুমি হয়তো কাউকে ভালোবেসেছ। হয়তো ভুলে গেছ আমায়।

তবু যদি কোথাও, কোনো কোণে তোমার মনে আমি থেকে থাকি, তবে এই চিঠি তুমি বুঝবে।

আমি এখন শান্তিনিকেতনে পড়াই। বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করি। হঠাৎ এক ছাত্র তোমার কবিতা পড়ে আমাকে বলল—‘এই লেখক তো আপনার মতোই কারো কথা বলেছেন।’
তখন আমি তোমার নাম আবার খুঁজে পাই।

ভালো থেকো।

— অন্বেষা”

অয়ন চিঠি পড়ে থেমে যায়। তার ভেতরে যেন ছুটে যায় এক নদী। এই চিঠির শব্দগুলো যেন চেনা কোনো স্বপ্নের পুনর্জন্ম।সে জানত না কী ভাববে। তবে সে জানত, এই চিঠি এসেছে কোনো বিচারের জন্য নয়—এটা এসেছে স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

সেই রাতটা অয়ন কাটাল পুরোনো ডায়েরির পাতা উল্টে।
তখন সে বুঝল, সময় কেটে গেলেও কিছু অনুভব কখনো পুরনো হয় না।

সে তার ডায়েরির এক ফাঁকা পাতায় লিখল—

“অন্বেষা লিখেছে।
সে চলে গিয়েছিল, তবু ভুলে যায়নি।
আমি তার নাম আবার জিভে এনেছি।
এখন শুধু জানি—সে কোনো ঠিকানায় নেই,
সে আছে—মনে, কবিতায়,
এক সাদা জামার নোটের দেশে।”

পরদিন সকাল। অয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছোট্ট দোকানে গিয়ে একটা খাম কিনল, আর একটা কাগজ।

সে লিখল—

“অন্বেষা,
তুমি ফিরে এসেছ, যদিও শুধু চিঠিতে।আমার কাছে সেটা যথেষ্ট। আমি কাউকে ভালোবাসিনি এরপর। তুমি ছিলে, আছো, থাকবে। তবে আমি জানি, সময় আমাদের জন্য আর অপেক্ষা করবে না। আমরা যেমন ছিলাম, তেমন থাকব না।

তাই আমি বলছি—

তোমার চিঠি আমি রাখলাম সেই ডায়েরির পাশে,
যেখানে একদিন আমি প্রথম তোমায় লিখেছিলাম। তুমি ভালো থেকো। যদি আবার কোনোদিন, কোনো করিডোরে দেখা হয়,
তবে আবার শুরু করব নতুন করে।

— অয়ন”

চিঠিটা সে পোস্ট করল। নিশ্চিত নয়, পৌঁছবে কি না।
তবে মনে মনে জানত—এই চিঠিটাও এক নীরব সাদা জামার নোট হয়ে থাকবে।

অধ্যায় ৬

ফেব্রুয়ারির শান্তিনিকেতন। বসন্তোৎসবের আগে শহরের আকাশে রঙের ইশারা লেগে আছে। শান্ত হাওয়া, সোনালি রোদ, রাস্তার দু’ধারে পলাশের দাহ। একটা কবিতার মতো শহর—নির্জন, আবার মুগ্ধ করা।

এই শহরেই এবার বসেছে বার্ষিক “আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন”। সারাদেশ থেকে কবি, লেখক, অধ্যাপক এসেছেন। অয়ন মৈত্র—বর্তমানে পরিচিত কবি ও সাহিত্য সমালোচক, তিনিও এসেছেন বিশেষ বক্তা হিসেবে। তার কবিতার সংকলন “চিঠির ভিতরে দুপুর” সমালোচকদের মধ্যে আলোড়ন ফেলেছে। কিন্তু নিজের ভিতরে সে এখনো আগের সেই স্কুলপড়ুয়া অয়ন—যার মন বাঁধা এক সাদা জামার ছায়ায়।

যেদিন সে শান্তিনিকেতনে পৌঁছাল, তার বুকের ভেতরটা হালকা কাঁপছিল। কারণ সে জানত—এই শহরেই অন্বেষা আছে।

তবে দেখা হবে কি? হঠাৎ? না কি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই?

সকাল দশটায় সম্মেলনের মূল মঞ্চে প্রথম অধিবেশন। অয়ন বক্তৃতা দিতে মঞ্চে ওঠার আগে দর্শকসারির দিকে তাকিয়ে ছিল। অজস্র মুখ, নানা বয়সের মানুষ, তবে সে খুঁজছিল শুধু একটাকে।

তবে সে জানত না, সেই চেনা মুখও তাকিয়েছিল তার দিকেই—কিন্তু আরেক প্রান্ত থেকে, ছদ্মনামে, নির্লিপ্ত হয়ে।

বক্তৃতার শেষে অয়ন যখন মঞ্চ থেকে নামল, এক বৃদ্ধা অধ্যাপিকা এসে বললেন,
— “তোমার কবিতায় যেন এক ধরণের অসমাপ্ত চিঠির গন্ধ আছে।”
অয়ন হেসে বলল,
— “কারণ কিছু চিঠি শুধু পাঠানোর জন্য নয়—প্রতীক্ষার জন্যও লেখা হয়।”

দুপুরের খাবার সময় অয়ন বটতলার পাশ দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ একটা হাওয়ার ঝাপটায় তার দিকে ভেসে এল সেই পুরোনো গন্ধ—গাঁদা ফুল, পৃষ্ঠা ঘেঁটে ফেলা চিঠির, আর কেমন যেন পরিচিত পারফিউম।

সে থেমে গেল। হঠাৎ পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠ—
— “তুমি কি এখনও কবিতা লেখো শুধু চিঠির উত্তর পাওয়ার আশায়?”

অয়ন ধীরে ঘুরে তাকাল। অন্বেষা। একটা অফ-হোয়াইট কাঠের কাজের শাড়ি, খোলা চুল, চোখে ছোট ফ্রেমের চশমা, কাঁধে সুতির ব্যাগ। এত বছরেও সেই একই উজ্জ্বলতা। চোখ দুটো একটু শান্ত, একটু ক্লান্ত, কিন্তু সেই ছায়া ছিল—যেটা একসময় অয়নকে দহন করত।

কয়েক সেকেন্ড দুইজনের মুখে কোনো শব্দ ছিল না। শুধু তাকিয়ে থাকা।

তারপর অয়ন বলল,
— “তুমি কি এখনও চিঠির উত্তর না দিয়েই চলে যাও?”
অন্বেষা হেসে ফেলল।
— “তোমার শেষ চিঠির জবাব আমি দিয়েছিলাম। সেই শিউলি পাতার নিচে রেখে।”
— “সেইটা তো কবিতার মতো। বাস্তব নয়।”
— “তুমি তো কবিরা বাস্তবের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করো কল্পনায়।”

দুজনেই হেসে ফেলল।

বটগাছের নিচে তারা চুপচাপ বসে ছিল। পাশ দিয়ে ছোটো ছোটো স্কুল পড়ুয়া দল বসন্তোৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুইজনেই কিছু বলছিল না।

অয়ন বলল,
— “তুমি এখনো এখানে? শান্তিনিকেতনেই থাকো?”
অন্বেষা বলল,
— “হ্যাঁ, বিশ্বভারতীতে পড়াই। আর মাঝে মাঝে লেখালিখিও করি। তুমি তো এখন বিখ্যাত হয়ে গেছো।”
— “না, শুধু একটু পরিচিত। কিন্তু আজও সবচেয়ে বড় পরিচয়—তোমার জন্য লেখা এক অসমাপ্ত চিঠির লেখক।”
— “তুমি কি জানো, সেই প্রথম চিঠিটা আমি অনেকবার পড়েছি। এমনকি এখনো মাঝে মাঝে?”
— “তুমি তো কখনো বলোনি!”
— “তখন সাহস ছিল না। এখনো পুরোপুরি নেই। শুধু এইটুকু জানি—তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে। আর আমিও ভালোবেসেছিলাম, শুধু বলিনি।”

অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “আমরা কি একে ভালোবাসার দেরিতে পৌঁছানো বলব? নাকি ভাগ্যের এক অতিরিক্ত ঠাট্টা?”
অন্বেষা চুপ করে বসে ছিল। তারপর বলল,
— “আমরা দুজনেই সময়ের আগে লিখে ফেলেছিলাম সেই শেষ চিঠিটা। আসলে আমাদের গল্প শেষ হয়নি। শুধু থেমে গিয়েছিল।”
— “তাহলে আজ আবার শুরু হবে?”
— “হয়তো হবে, হয়তো না। কিন্তু আজকের দিনটায় আমরা আবার সেই স্কুলের করিডোরে ফিরে যেতে পারি—তুমি, আমি, আর একখানা সাদা জামার নোট।”

অন্বেষা বলল,
— “আমি কাল যাচ্ছি। সম্মেলন শেষ, আবার ক্লাস শুরু হবে।”
অয়ন ধীরে মাথা নোয়াল।
— “আমিও ফিরব কলকাতায়।”
— “তবে একটা অনুরোধ।”
— “কি?”
— “আমার জন্য আর কোনো কবিতা লিখো না।”
— “কেন?”
— “কারণ আমি চাই, এবার তুমি বাস্তবকে লিখো। আমি যে আছি—এটা বিশ্বাস করো।”
— “তাহলে কি এবার ঠিকানা দেবে?”
অন্বেষা হেসে বলল,
— “চিঠির জন্য ঠিকানা দরকার হয়, দেখা করার জন্য নয়। দেখা আবার হবে।”

অয়ন কিছু বলল না। শুধু চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

সেদিন রাতে অয়ন তার ডায়েরির এক নতুন পাতা খুলে লিখল— “আজ তার সাথে দেখা হলো। বহু বছর পরে।
সে হেসে বলল, আমি এখন বাস্তবে বিশ্বাস করি।
আমিও বললাম, তুমি আজও আমার কল্পনার সত্যি।

আমরা আবার স্কুলে ফিরে গেলাম—
যেখানে একটি নোট বদলে দিয়েছিল দুইটা জীবন।”

অধ্যায় ৭

ডিসেম্বরের কলকাতা যেন কুয়াশার পাতায় ঢাকা এক পুরনো কবিতা। বেলার রোদ ঠোঁটের কোণে হাসে, আর রাতের বাতাসে কনকনে শীত শোঁ শোঁ করে বেজে ওঠে। এই শহরেই আজকাল অয়ন বসবাস করে। নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাট, বইয়ের তাক, কবিতার কাগজ, আর একজোড়া গাঁদা ফুলের শুকনো গন্ধ—তার প্রতিদিনের সঙ্গী।

অন্বেষার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে, প্রায় দেড় বছর আগে। সেই বসন্তমাখা বিকেল তার স্মৃতিতে দগদগে হয়ে থাকে। তারা কথা বলেছিল, হাঁটছিল, কিন্তু কিছুই স্থির করেনি। যেন দুই নৌকা পাশাপাশি ভেসে চলেছিল, কিন্তু নোঙর ফেলার সাহস দুজনের কারও ছিল না।

তবুও তারা একে অপরকে চিঠি লিখত। ইমেল নয়, হোয়াটসঅ্যাপ নয়—সত্যিকারের হাতে লেখা চিঠি। অয়ন লিখত, “তুমি জানো? তোমার লেখা এখনো আমার শব্দে ঢেউ তোলে।
আমি একেকটা লাইনে তোমার চুলের গন্ধ খুঁজি।”

অন্বেষা লিখত, “তোমার কবিতা আমার সকালকে গুল্ম করে তোলে। আমি জানি, ভালোবাসা শব্দ নয়—তবু তোমার শব্দগুলোই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।”

তবে এত চিঠি চলতে চলতে, বাস্তব একটু একটু করে ঢুকে পড়ছিল। অয়নের চাকরি, সাহিত্যিক ব্যস্ততা, আর অন্বেষার একঘেয়ে অধ্যাপনাজীবন—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। তারা কথা বলত, কিন্তু দেখা করত না। যেন ভয় পেত—যদি সেই দেখা আর কল্পনার মতো না হয়?

ডিসেম্বরের এক সকালে অয়নের মোবাইল বেজে উঠল।
নাম: অন্বেষা ঘোষ।

— “হ্যালো?”
— “অয়ন, আমি কলকাতায় এসেছি। আজ-কাল তিন দিনের জন্য একটা সাহিত্য কর্মশালায় এসেছি। সময় আছে একটু?”

অয়ন যেন থমকে গেল।
— “তুমি কলকাতায়? কোথায় আছো?”
— “গোলপার্কের কাছে এক হোমস্টেতে। ভাবছিলাম, যদি চা খেতে পারি কখনো…”
— “আজ বিকেলেই দেখা হবে? দক্ষিণাপণে, পুরোনো বইয়ের দোকানের সামনে?”
— “সেই তো আমাদের গল্পের শুরু হয়েছিল…”
— “তবে শেষটাও সেখানেই হোক।”

সেই দক্ষিণাপন। এখন একটু পাল্টেছে। নতুন ক্যাফে, একটু উঁচু দাম, কিন্তু পুরোনো সেই বইয়ের দোকানটা এখনো আছে। অয়ন আগে পৌঁছে চুপ করে তাকিয়ে ছিল পেছনের সেই দেয়ালে, যেখানে কবি জীবনানন্দের ছায়ামূর্তি আঁকা।

অন্বেষা এল ধীরে ধীরে। গাঢ় নীল তসর শাড়ি, ছোট্ট টিপ, এক হাতে পুরোনো কাপড়ের ব্যাগ। অয়নকে দেখে সে একটু হাসল—কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল অনেকটা অভিমান, অনেকটা শান্তি।

— “তুমি বদলে যাওনি একটুও।”
— “তুমি তো বরং আরো স্পষ্ট হয়েছো। কেমন এক নির্ভারতা।”
— “আজ আমি বলতে এসেছি… কিছু কথা। আজ চুপ থাকব না।”

অয়ন কফির অর্ডার দিল দুটো। ক্যাফেটা নীরব, শুধুই হালকা রবীন্দ্রসঙ্গীত। তারা চুপ করে বসে থাকল কয়েক মুহূর্ত।

অন্বেষা বলল,
— “জানো অয়ন, এতগুলো বছর কেটে গেল, কিন্তু আজও মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আমি তোমার সেই প্রথম চিঠিটা পড়ি।”
— “আমিও আজো সেই চিঠিটা নতুন করে লিখি। ভাবি, যদি আজ দিতাম, তবে তুমি কী বলতে?”

অন্বেষা ধীরে বলল,
— “তখন বলিনি। কারণ ভয় ছিল। তুমি যদি প্রত্যাখ্যান করো?”
— “আর আমি বলিনি কারণ ভাবতাম, তুমি যদি আরেকটা চিঠি না দাও?”

দুজনেই হেসে ফেলল। হাসির মধ্যে তেমন শব্দ নেই, কিন্তু চোখে জল টলমল করে।

— “অয়ন, এবার আমি আর পালাতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি—ভালোবাসা মানেই একসাথে থাকা নয়, তবে একসাথে থাকা হলে, সেটাকে আটকানো উচিত নয়।”
— “তুমি বলতে চাইছো, এবার…?”
— “তুমি যদি চাও, আমি তোমার সাথে থেকে যেতে চাই। পাশে বসে চুপ করে কবিতা পড়তে চাই। আর মাঝেমাঝে চিঠি লিখতে চাই। এইবার উত্তর দিতেই চাই।”

অয়ন তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,
— “অন্বেষা, এই সাদা জামার নোট একদিন আমার প্রথম প্রেমের চিহ্ন ছিল। এখন সেটা আমাদের জীবনের শুরু হয়ে উঠুক।”

সেদিন রাতে, অয়ন ও অন্বেষা বসেছিল লেকের পাশে। বাতাসে শীত, কিন্তু তাদের চোখে এক উষ্ণতা।

অয়ন একটি খাম এগিয়ে দিল।
— “তোমার জন্য শেষ চিঠি। তারপর আর চিঠি নয়—বাস্তব হবে। সকাল-দুপুর-রাত।”

অন্বেষা খাম খুলল। ভেতরে একটি সাদা পৃষ্ঠা—

“অন্বেষা,

তুমি ফিরে এসেছো। তোমার নীরবতা এবার কথা বলেছে।আমি চাই, আমরা আর হারিয়ে না যাই। চাই, একসাথে সেই গল্পটা লিখি। যেখানে সাদা জামার ভাঁজে ভাঁজে শুধু কবিতা নয়, একটা পুরো জীবন লুকিয়ে থাকে।

— তোমার অয়ন”

এক বছর পর, অয়ন ও অন্বেষা শান্তিনিকেতনের এক ছোট্ট বাড়িতে একসাথে থাকেন। তারা চিঠি লেখেন, তবে এখন পাঠানোর জন্য নয়—পড়ার জন্য।
একসাথে চা খায়, সকালে হেমন্তের আলোয় হাঁটতে যায়, আর মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় লেখা রেখে দেয় পরস্পরের জন্য।

আর সেই প্রথম সাদা জামার নোট? ওটা আজও রাখা আছে।ফ্রেমে বাঁধানো, তাদের লেখার টেবিলের ওপরে।

 

শেষ

WhatsApp Image 2025-06-04 at 5.29.26 PM

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *