অভিরূপ মজুমদার
১
নভেম্বর মাসের এক সকালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে টানা রাত জেগে কাজ করছিলেন ডঃ অরিত্র সেন। টেবিলে ছড়িয়ে থাকা মানচিত্র, উপগ্রহ চিত্র এবং ল্যাপটপের পর্দায় জ্বলজ্বল করা তাপচিত্র তাঁর মনোযোগ কেড়ে রেখেছিল।
এক কাপ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই তিনি বলেন,
“অনিন্দিতা, এটা দেখো তো! এটা কি আমার চোখের ভুল, না কি সত্যিই একটা দ্বীপ?”
প্রফেসর অনিন্দিতা রায়, ভূগোল বিভাগের অভিজ্ঞ অধ্যাপিকা, মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। ছবি ছিল বঙ্গোপসাগরের এক গভীর অংশের—সেখানে সাধারণত কিছুই দেখা যায় না, শুধুই নীল জলরাশি। কিন্তু এই ছবিতে ধরা পড়েছে এক অস্পষ্ট, ছায়ার মত আকৃতি। যেন এক দ্বীপ।
“এই জায়গাটা তো আমাদের মানচিত্রে নেই,” অনিন্দিতা বললেন, কপালে ভাঁজ ফেলে। “এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর অস্তিত্ব কেন আগে ধরা পড়েনি?”
অরিত্র ইতস্তত করলেন, “হয়ত এটা ভূপৃষ্ঠের উপরে কোনো সাময়িক গঠন—জলমগ্ন আগ্নেয়গিরি? অথবা গ্যাস উত্তোলন?”
তাঁদের আলোচনা থামিয়ে দেয় রাহুল দত্ত, টেক বিশেষজ্ঞ, যিনি পাশের ডেস্কে বসে একই ছবি বিশ্লেষণ করছিলেন।
“না স্যার, এটা সাময়িক কিছু নয়। আমি গত তিন মাসের সমস্ত স্যাটেলাইট ইমেজ ঘেঁটে দেখেছি। এই ছায়া আগে কখনো ছিল না—এটা হঠাৎ করেই এসেছে, আর তিন দিন ধরে একই জায়গায় থেকে গেছে। এটা স্থির।”
ঘর জুড়ে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে।
“তাহলে… এটা একটা অদৃশ্য দ্বীপ?” ইরা চক্রবর্তী, পরিবেশ গবেষক, চুপচাপ বলে উঠল। সে এখনো স্ক্রিনে চোখ রেখেই বসে ছিল। “যেটা আমাদের চোখে ধরা দেয় না, কিন্তু স্যাটেলাইটে আসে?”
“বা…” রাহুলের কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে, “বা হয়ত এটা এমন কিছু, যা আমরা কখনও বোঝার কথা ছিল না।”
রাত তখন গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব তখন প্রায় ফাঁকা। অরিত্র, অনিন্দিতা, রাহুল আর ইরা ছাড়া কেউ নেই।
অরিত্র একটা পুরনো রেফারেন্স বই বের করলেন—ভারতের পূর্ব উপকূল সংলগ্ন সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে ১৯৪০-এর দশকে করা ব্রিটিশ নেভালের কিছু জরিপ রিপোর্ট।
হঠাৎ এক পাতায় চোখ আটকে যায় তাঁর।
সেখানে লেখা— “Sector B-13, approx. 17°41’N 88°12’E – known among local fishermen as ‘The Grave of the Sea’. All attempts to map the region have failed. Magnetic interference, sudden weather shifts, and multiple missing vessels have been reported since 1892.”
ইরা শ্বাস বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “সমুদ্রের কবর…”
অনিন্দিতা চমকে ওঠে, “এত বছর ধরে এটার কথা জানা ছিল? আর আমরা কিছুই জানতাম না?”
রাহুল গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে, “জানানো হয়নি। এমন জায়গা অনেক সময় স্রেফ মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়। যাতে কেউ ভুলেও কাছে না যায়।”
“তবু, এখন যখন প্রযুক্তি এগিয়েছে, আমাদের উচিত…” অরিত্র থেমে যান। তাঁর চোখে কৌতূহল আর ভয়—দুটোই।
“আমরা expedition-এ যাবো,” সে হঠাৎ বললেন, “এই দ্বীপে পা রাখতে হবে আমাদের।”
পরদিনই, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সরকারি অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। পেশ করা হয় যে, এটি একটি ভূ-প্রাকৃতিক গবেষণা, যার উদ্দেশ্য সম্ভাব্য নতুন দ্বীপ গঠন, ভূমিকম্প বা সমুদ্রের তলদেশ পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ।
তিনদিনের মধ্যেই অনুমতি আসে, কারণ প্রস্তাবটি বিজ্ঞাননির্ভর এবং বিশ্লেষণাত্মক।
অভিযান-দল গঠন করা হয়—
অরিত্র সেন – দলনেতা ও প্রধান সমুদ্রবিজ্ঞানী।
অনিন্দিতা রায় – ভূগোল ও প্রাচীন মানচিত্র বিশারদ।
ইরা চক্রবর্তী – সামুদ্রিক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।
রাহুল দত্ত – প্রযুক্তি ও ড্রোন/সেন্সর অপারেটর।
ক্যাপ্টেন মনোহর শর্মা – অভিজ্ঞ নৌপথ পরিবাহক, যিনি আগেও বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলে বহুবার গিয়েছেন।
অরিত্র জাহাজের নাম ঠিক করেন—RV Sagarika (Research Vessel Sagarika)। এটি একটি বিশেষভাবে তৈরি জাহাজ, যা ডীপ-ওশান রাডার ও কমিউনিকেশন সিস্টেমে সজ্জিত। কিন্তু ক্যাপ্টেন মনোহর শুরুতেই দ্বিধা প্রকাশ করেন।
“এই অঞ্চলটা ভালো নয়। আমি ১৯৮৯ সালে একবার গিয়েছিলাম এই রুটে, তখন এক জাহাজ হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমার নিজের ক্রু-র তিনজন মানুষ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। রাডারে একটা অদ্ভুত ছায়া ছিল—ঠিক এমন।”
অরিত্র শান্ত গলায় বলেন, “আমরা কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না ক্যাপ্টেন। এটা এক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। আর আপনি হচ্ছেন আমাদের অভিজ্ঞ নেভিগেটর।”
মনোহর শুধু বলেন, “যদি এটাই আপনার সিদ্ধান্ত… তবে ঈশ্বর আপনাদের রক্ষা করুন।”
নির্ধারিত দিন সকালে “RV Sagarika” কলকাতা বন্দর ছেড়ে সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেয়। চারিদিকে জলরাশি, নীল আকাশ আর ঠাণ্ডা হাওয়া।
প্রথম দিন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। ইরা সমুদ্রের জল পরীক্ষায় ব্যস্ত, রাহুল ড্রোন উড়িয়ে সারফেস ম্যাপিং করছে, অনিন্দিতা প্রাচীন নেভাল ম্যাপ তুলনা করছেন।
কিন্তু দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় আচমকা সব বদলে যায়।
রাডারে ভেসে ওঠে সেই ছায়া—এক দ্বীপের মত গঠন, স্থির, স্পষ্ট, যেন ঠিক তাদের সামনেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—নগ্ন চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ইরা বলল, “আমরা যেন এক অদৃশ্য কিছুর কাছে চলে এসেছি।”
রাহুল গলার স্বর নিচু করে বলে, “এই দ্বীপ কি আমাদের দেখছে?”
ক্যাপ্টেন মনোহর চুপচাপ শুধু বলেন,
“এটাই ‘Grave of the Sea’… এখান থেকে ফিরে যাওয়াই ভালো ছিল।”
২
“ড্রোন আবার নামিয়ে দাও, রাহুল,” অরিত্র উত্তেজিত কণ্ঠে বলল। “আমরা দ্বীপের উপর দিয়ে ওড়াবো। যদি কিছু থাকে, সেটা থার্মাল সেন্সরে ধরা পড়বেই।”
রাহুল দ্রুত ড্রোন অপারেট করল। স্ক্রিনে তাপমাত্রার ভিন্নতা দেখা গেল—একটা তীব্র ঠান্ডার স্তর, প্রায় -৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওই অঞ্চলের জন্য সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
“এটা সম্ভব না,” ইরা কপালে হাত দিয়ে বলল, “এই জায়গায় এতটা হিমশীতল এলাকা কীভাবে থাকতে পারে?”
“আরও আশ্চর্যের কথা,” অনিন্দিতা যোগ করল, “এই অবস্থানে এমন দ্বীপের কথা কোনো প্রাচীন মানচিত্রে নেই। শুধু একটা ফ্লিট রিপোর্ট ছিল ১৮৯৬ সালে, যেখানে বলা হয়েছিল—‘অনেক আগে এখানে কিছু ছিল, যা সমুদ্র গিলে নিয়েছে।’”
সকাল গড়িয়ে এল। সূর্য উঠেছে, কিন্তু আকাশ অস্বাভাবিক ধূসর। বাতাস ঠাণ্ডা আর ভারি। এবং… জল সম্পূর্ণ নিশ্চল। এমন নিস্তরঙ্গ সমুদ্র গবেষকরা আগে দেখেনি।
“এইভাবে সমুদ্রের জল কখনও স্থির থাকে না,” মনোহর বিড়বিড় করে বলল। “এটা কোনও স্বাভাবিক জিনিস নয়…”
সকাল ৯টা নাগাদ, হঠাৎ করে ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে একটি ছায়াময় গঠন ভেসে ওঠে।
প্রথমে মনে হল এক ধরনের মরীচিকা। তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল—নুড়ি পাথরে ঢাকা তটভূমি, মাঝখানে উঁচু একটা পাথুরে গঠন, যেন পুরনো কোন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
“আমরা দ্বীপের কাছে চলে এসেছি,” অরিত্র বলল। “এটা বাস্তব।”
জাহাজ থেকে একটি ছোট বোট নামানো হল। অভিযানের পাঁচ সদস্য দ্বীপে নামার জন্য প্রস্তুত হলেন।
মনোহর শেষবার বলে উঠলেন, “আমি যাব না। এই জায়গায় পা রাখার সাহস আমার নেই। আমি এখানেই থাকবো। কিছু হলে সিগন্যাল দিও।”
অন্যরা মাথা নেড়ে সায় দিল। পাঁচ মিনিট পর তারা পা রাখল দ্বীপের মাটিতে।
তারা নামার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঠাণ্ডা স্রোত তাদের গায়ে বয়ে গেল। চারপাশে কোনো পাখি নেই, কিচির-মিচির নেই, এমনকি বাতাসেরও কোনো শব্দ নেই। শুধু এক ধরনের বোবা নীরবতা।
“এই বালি খুব অদ্ভুত,” ইরা বালির উপর হাত বুলিয়ে বলল, “এটা যেন বালির চেয়ে নরম, তবুও ভেজা নয়। আর এতে প্রচুর লৌহের গন্ধ রয়েছে।”
রাহুল ছবি তুলতে শুরু করল। তার ক্যামেরার স্ক্রিনে কিছুমাত্র বিকৃতি দেখা গেল। চিত্রগুলো অদ্ভুতভাবে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
“এইটা কি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফেয়ারেন্স?” সে জিজ্ঞাসা করল।
অরিত্র বলল, “হতে পারে। এমনটা অরোরা বা ব্ল্যাক স্যান্ড অঞ্চলে দেখা গেছে। কিন্তু এর উৎস খুঁজতে হবে।”
তারা এগিয়ে গেল দ্বীপের মাঝখানের সেই ধ্বংসাবশেষের দিকে। ধ্বংসাবশেষের পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে অদ্ভুত সব প্রতীক—সেগুলো প্রাচীন দ্রাবিড় লিপির সাথে মিলে, আবার নয়ও। কিছুটা যেন সুমেরীয় প্রতীকের মত।
অনিন্দিতা বলল, “এগুলো একটা প্রাচীন উপনিবেশের হতে পারে—কিন্তু আমাদের ইতিহাসে এর কোনো উল্লেখ নেই।”
একটা বড় পাথরের গায়ে একটা মূর্তি খোদাই ছিল—এক বিশাল মুখ, যার চোখ নেই, কেবল গভীর অন্ধ গহ্বর, আর ঠোঁট খোলা—যেন সে এক চিৎকারে থেমে আছে।
ইরা ফিসফিস করে বলল, “এটা কোনো দেবতার মূর্তি না? এর মুখ দেখে গা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
অরিত্র বলল, “বহু সভ্যতা সমুদ্র-দেবতা পূজা করত। হতে পারে, এরা এমন কোনো দেবতার উপাসক ছিল… যার নাম বা অস্তিত্ব আমরা জানি না।”
তারা দ্বীপে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। রাহুল রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট বসায়, ইরা জল ও বালির নমুনা সংগ্রহ করে।
কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই অস্বাভাবিকতা শুরু হয়। প্রথমে ক্যাম্পের আলো নিভে যায়—একসাথে সব।
পরে, চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কেউ কিছু বলতে পারছে না, যেন গলায় কেউ হাত দিয়ে চেপে ধরেছে।
রাহুল গম্ভীর গলায় বলল, “আমি কিছু একটা শুনছি… দূর থেকে… অনেকগুলো কণ্ঠ… ফিসফিস করে কিছু বলছে।”
“কী বলছে?” ইরা চমকে প্রশ্ন করল।
সে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না… শুধু একটা শব্দ বারবার আসছে—‘আরণিয়… আৰণিয়…’”
রাত বাড়তেই আরো ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। রাহুল ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যায়, বলেছিল, সে রেকর্ডার চেক করবে।
পঁচিশ মিনিট কেটে যায়, সে ফেরে না।
অরিত্র বাইরে গিয়ে দেখে, শুধু তার জুতো পড়ে আছে বালির উপর। আশেপাশে কোনও পায়ের ছাপ নেই।
“এটা কিভাবে সম্ভব?” অরিত্র শঙ্কিতভাবে বলল, “এখানে তো নরম বালি—কেউ হাঁটলে ছাপ পড়বে! সে হঠাৎ উড়ে গেল?”
অনিন্দিতা থরথর করে কাঁপতে থাকে, “এই জায়গায় কিছু আছে। আমরা যা জানি, তার বাইরে…”
“আমাদের এখুনি ফিরে যাওয়া উচিত,” ইরা বলল, চোখে জল চলে এসেছে তার।
কিন্তু ক্যাপ্টেন মনোহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জাহাজের রেডিও-তে শুধু গর্জন, শোঁ শোঁ শব্দ। রাত তখন গভীর।
অন্ধকারে হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে এক ঝলক পূর্ণিমার আলো পড়ে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর।
তখনই দেখা যায়—একটা গোপন প্রবেশপথ, যা আলোয় প্রতিফলিত হয়ে দৃশ্যমান হয়েছে।
অরিত্র বলে, “আমাদের ভেতরে ঢুকতে হবে। হয়ত রাহুল ওখানে গেছে।”
তারা তিনজন প্রবেশ করে সেই গহ্বরে।
ভেতরটা পাথরের সুড়ঙ্গ, গায়ের দেয়ালে আগুনের দাগ, রক্তের ছোপ—আর কিছু খুদে প্রতিমা, যাদের চোখে অদ্ভুত কালো পাথর বসানো।
সুড়ঙ্গের একেবারে শেষে, এক গম্বুজাকার ঘরে তারা দাঁড়ায়—মাটির নিচে বিশাল এক বেদি, যার ওপর এক হাড়ের স্তূপ। আর তার পেছনে সেই বিশাল মূর্তি—চোখহীন, মুখ হাঁ।
তখনই অনিন্দিতা ফিসফিস করে বলল—
“এই মূর্তি… এর পেছনে কিছু নড়ছে।”
তারা চমকে দেখে—পাথরের পেছনে অন্ধকারে এক ছায়া।
ছায়াটি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে।
একটা কুয়াশার কোল থেকে বেরিয়ে আসে এক ছায়ামূর্তি। চোখ নেই, মুখ নেই, কেবল দীর্ঘ দুটো হাত। সে একটানা শুধু বলে—
“তোমরা দেখেছো… এখন তোমাদের মনে রাখতে হবে… আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই…”
সব আলো নিভে যায়। শুধু ইরা’র চিৎকার শোনা যায়।
৩
ঘোর অন্ধকার। অরিত্র চোখ খুললেন ধীরে ধীরে। তাঁর শরীর ঠান্ডা, যেন হিমশীতল পানিতে ভিজে গিয়েছেন। মনে পড়ল—সেই ছায়ামূর্তিটি, ইরার চিৎকার, আর তারপর এক প্রচণ্ড শূন্যতা। তিনি উঠে বসে দেখলেন—তিনি এক গুহার মধ্যে আছেন। পাথরের দেয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত প্রতীক—প্রতিটিই যেন হাড়ের আঙ্গুল দিয়ে আঁকা। কোথাও ইরার বা অনিন্দিতার কোনো চিহ্ন নেই।
কিন্তু সামনে একটি পাথরের বেদি। তার ওপরে একটি পুরনো খাতা পড়ে আছে।অরিত্র ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সেটি তুলে নিলেন।
খাতাটির প্রথম পাতায় লেখা—
“বছর ১৮৬৯। আমি ক্যাপ্টেন লুইস কার্টার, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান নেভাল ফোর্সের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যিনি এই দ্বীপ থেকে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারিনি। এই দ্বীপে আমি যা দেখেছি… তা মানুষ জানলে পাগল হয়ে যাবে।”
খাতার পাতাগুলোতে লেখা ছিল—
“এই দ্বীপের নাম তখন ছিল আরানিয়া। একটা ছোট সভ্যতা ছিল এখানে, যারা বিশ্বাস করত ‘অরণিয়’ নামের এক সমুদ্রদেবতায়। তাদের মতে, অরণিয় ছিল এমন এক অস্তিত্ব, যার শরীর নেই, মুখ নেই, কিন্তু মন আছে—এক ভয়ংকর চেতনা, যা মানুষের ভয় খেয়ে বেঁচে থাকে।”
“প্রতি দশ বছরে একবার, তারা একজন ‘দর্শক’ উৎসর্গ করত অরণিয়ের কাছে। কারণ তারা বিশ্বাস করত—যদি কেউ দ্বীপের রহস্য জানে, তবে সে আর বেঁচে থাকতে পারে না। তাকে ‘অরণিয়’ নিতে আসবে।”
“তবে ১৮৬৯ সালে এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে—এক ‘দর্শক’ পালিয়ে যায়। ফলে দ্বীপে শুরু হয় মৃত্যু, পাগলামি, আত্মহত্যা। সভ্যতা নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু অরণিয়… রয়ে যায়। সে ঘুমিয়ে পড়ে, অপেক্ষায় থাকে নতুন দর্শকের।”
খাতা পড়তে পড়তে অরিত্রর শরীর কাঁপতে লাগল। হঠাৎ পিছন থেকে একটা কাঁপা কণ্ঠ ভেসে এল— “তুমি জানো এখন। ও তোমাকে নেবে।”
অরিত্র ঘুরে দেখেন—অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ফাঁকা, ক্লান্ত, যেন বহু বছর ধরে জেগে আছে।
“তুমি কোথায় ছিলে?” অরিত্র জিজ্ঞেস করল।
“আমিও এসেছিলাম এখানে… ও আমাকে দেখেছে… এখন আমি আর আগের মতো নই,” অনিন্দিতা ফিসফিস করে বলল।
“ইরা কোথায়?” অরিত্র জিজ্ঞেস করল।
অনিন্দিতা চুপ। তারপর বলল, “সে… আর নেই।”
“না!” অরিত্র কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল। “আমি ওকে ছাড়বো না!”
তখন অনিন্দিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি পালাতে পারো না। ওর চোখ নেই, মুখ নেই… কিন্তু ও তোমার মনে দেখতে পায়। তুমি ভয় পাচ্ছো… এটাই ও চায়।”
গুহা থেকে বের হতেই চারপাশ অন্ধকার। কিন্তু শোনা যায় এক অদ্ভুত আওয়াজ—জলের গর্জন, আর ফিসফিসানি।
অরিত্র হঠাৎ বুঝতে পারে—এই দ্বীপ এখন তার সাথেই কথা বলছে।
তার মাথার ভেতরে কেউ ফিসফিস করে বলছে—
“তুমি দেখেছো… এখন তুমিও আমার হবে…”
এক দৌড়ে সে পৌঁছায় সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে এক বিশাল ছায়ামূর্তি। মানুষের মত নয়—এক বিকৃত আকার, যার মুখ নেই, কেবল এক ফাঁকা গহ্বর, যা থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া আর কান্নার শব্দ।
এই ছায়াটি… অরণিয়!
অরণিয় কথা বলে না, কিন্তু অরিত্র তার মনের মধ্যে ভয় অনুভব করে—নিজের পুরনো দুঃখ, ব্যর্থতা, নিজের বাবার মৃত্যু, মায়ের একাকীত্ব, নিজের গবেষণা নিয়ে সন্দেহ—সব যেন এক এক করে তার মাথায় ভেসে উঠছে।
“এটাই আমার শক্তি…”—অরণিয়র কণ্ঠে নেই কোনো আওয়াজ, কিন্তু অরিত্র বোঝে।
সে কাতর হয়ে পড়ে যায়। চোখ বেয়ে জল গড়ায়।
“আমার ভুল ছিল… আমাকে ক্ষমা করো…”
অরণিয় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, হাত বাড়ায়— তখনি হঠাৎ এক বিকট আওয়াজে চারপাশ আলোয় ভরে যায়।
ক্যাপ্টেন মনোহর, যিনি জাহাজে অপেক্ষায় ছিলেন, কোনো এক অজানা ইশারায় সেদিন দ্বীপে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি লং রেঞ্জ সিগন্যাল থেকে বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা ভয়ংকর ঘটেছে।
একসাথে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আলো দিয়ে মন্দির এলাকা আলোকিত করা হয়। তার তীব্র আলোয় অরণিয় কিছুক্ষণের জন্য অস্পষ্ট হয়ে যায়—সে যেন আলো সহ্য করতে পারে না।
অরিত্র উঠে দাঁড়ায়, দৌড়ে ক্যাম্পের দিকে ফিরে যায়, যেখানে ক্যাপ্টেন অপেক্ষা করছিলেন।
RV Sagarika দ্বীপ ত্যাগ করে সেই রাতেই। শুধু অরিত্র আর মনোহর ফিরেছে। ইরা, রাহুল, অনিন্দিতা—তারা কেউ ফিরেনি।
ফিরে আসার পথে, ক্যাপ্টেন শুধু বলেছিল, “ও জানে তুমি ফিরে যাচ্ছো। কিন্তু সে শুধু তোমাকে ভয় দেখায় না… সে তোমার মনে বাঁচে। তাই ওর হাত থেকে মুক্তি নেই…”
অরিত্র কিছু বলে না। তার শুধু মনে হয়, এখনও তার কানের ভেতর কেউ ফিসফিস করে বলছে—
“আরণিয়… আরণিয়… আর তুমি একা নও…”
৪
ফিরে আসার তিন সপ্তাহ পেরিয়েছে। কলকাতা শহর যথারীতি ব্যস্ত, কোলাহলময়। কিন্তু অরিত্রর কাছে সব কেমন যেন নিস্তরঙ্গ। সব কিছুর মধ্যে একটা অদৃশ্য স্তর—একটি চুপ চাপ ছায়া যেন সব আলো গিলে নিচ্ছে।
ওর চারপাশে মানুষ আছে, ট্র্যাফিক আছে, হাসি-আলোচনাও আছে। কিন্তু অরিত্রর মধ্যে যেন কিছু নেই। প্রথমে সে মনে করেছিল সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো ওর অভিজ্ঞতা এক মানসিক আঘাত, যা ধীরে ধীরে ধুয়ে যাবে।
কিন্তু কিছু ঠিক হচ্ছিল না। বরং… কিছু অদ্ভুত ঘটনা শুরু হয়েছে। সে লক্ষ্য করল—ঘরের কোণায় মাঝে মাঝে একটুকরো ছায়া জমে থাকে, এমন জায়গায় যেখানে আলো সরাসরি পড়ে।
দেয়ালের একটা কোণ, খাটের নিচে, ফ্রিজের পাশের ফাঁকা জায়গায়—সেখানে ছায়া থেকে যায়, নাড়াচাড়া করে না, অথচ চেয়েও থাকে।
প্রথমে সে চোখের ভুল ভেবেছিল। কিন্তু একদিন সকালে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেভ করতে গিয়ে, সে দেখতে পেল—আয়নার ভিতর নিজের প্রতিচ্ছবি নেই। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা তার ঘর আর পেছনের সেই কোণ, যেখানে আবার সেই ছায়া।
সে ঘামতে শুরু করল। পিছনে ঘুরে দেখল, কেউ নেই। আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে—নিজেকে দেখতে পেল। কিন্তু মনে হল, নিজের প্রতিচ্ছবিটি যেন এক সেকেন্ড দেরিতে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।
অরিত্র নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। সে ভাবল, “যা ঘটছে, তা আমাকে নথিভুক্ত করতে হবে। না হলে কেউ বিশ্বাস করবে না।”
সে ঘরের বিভিন্ন কোণে ছোট ক্যামেরা বসাল। রাতে সে রেকর্ড চালু রাখল।
পরদিন সকালে রেকর্ড চেক করতে গিয়ে সে দেখতে পেল—রাত ৩:১৭ মিনিটে ঘরের আলো নিভে যায় নিজে থেকে।
তখন ক্যামেরার ফ্রেমে, দরজার পাশে এক ছায়া ঢোকে। ধীরে ধীরে ঘরের এক কোণায় চলে যায়। এবং কয়েক মিনিট শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। ছায়াটির কোনো মুখ নেই। আকার অস্বচ্ছ, কুয়াশার মতো, কিন্তু যেন দৃষ্টি ছিল।
তারপর হঠাৎ করে ক্যামেরা ব্ল্যাকআউট। ফ্রেমে আবার দৃশ্য ফিরলে—ছায়াটি আর নেই।
অরিত্র এই ফুটেজ নিয়ে মনোরোগ চিকিৎসক, ডঃ সায়ন্তন সেন-এর সঙ্গে দেখা করল।
ডঃ সেন বললেন, “অরিত্র, তুমি একটা ট্রমার ভেতর দিয়ে গেছো। এটা পোস্ট-ট্রমাটিক হ্যালুসিনেশনও হতে পারে। মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে নিজের ভয় থেকে বাস্তব সৃষ্টি করে।”
“কিন্তু ক্যামেরায় যে ধরা পড়েছে?”
“এটা পারেডোলিয়া হতে পারে। মানুষের মস্তিষ্ক এলোমেলো প্যাটার্নে চেনা আকার খোঁজে। তুমি যা দেখছো তা হয়তো ফ্রেমের বিকৃতি। অথবা…” ডঃ সেন থেমে গেলেন।
“অথবা?” অরিত্র চেপে ধরল।
“অথবা… তোমার মন যা ভাবছে, তার সত্যতাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ মানুষ যা ভাবতে পারে, বাস্তবতা মাঝে মাঝে তাকে অনুসরণ করে।”
দুই দিন পর, অরিত্রর বাড়ির ডাকবাক্সে একটি খাম আসে। প্রেরকের নাম নেই।
ভেতরে আছে একটি ছোট চিঠি। হাতের লেখা পরিচিত… ইরার।
“তুমি পালাতে পারো না। দ্বীপ এখন তোমার ভেতরে।
আমি নেই, কিন্তু আমি দেখছি।
ও এখন শোনে না… বেছে নেয়।
ভয় রেখ না মনে। নাহলে তুমি ওকে আহ্বান করবে।
– ইরা”
অরিত্রর হাত থেকে চিঠিটা পড়ে যায়। সে জানে, ইরা মারা গেছে।
তবে?
এই চিঠি কি মৃত্যুর পরেও লেখা?
নাকি… ইরা এখনও কোথাও আছে—ভিন্ন কোন স্তরে? ভিন্ন এক বাস্তবতায়?
সেদিন রাতে, RV Sagarika-র ক্যাপ্টেন মনোহরের পাঠানো একটি স্ক্যান অরিত্রর মেলে আসে। এটি ছিল ১৮৯৬ সালের এক ব্রিটিশ জাহাজ HMS Heron–এর লগ বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা।
লেখা ছিল: “১৪ই সেপ্টেম্বর। আমরা দ্বীপ দেখেছি। একজন নাবিক সেখানে গিয়েছিল। সে আর ফেরেনি। রাতে অদ্ভুত শব্দ শোনা গেছে। কেউ যেন জাহাজের ডেকে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
সকালে দেখি, ক্যাপ্টেনের খাটের পাশে পায়ের ছাপ—কিন্তু কোনও দরজা খোলা ছিল না।
আমরা পেছন ফিরেছি। কিন্তু আমি জানি, আমরা দ্বীপ থেকে আসিনি… দ্বীপই আমাদের সঙ্গে এসেছে।”
সেই রাত। ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ।
অরিত্র বুঝতে পারে, কিছু একটা ঘরের ভেতর আছে। নিঃশ্বাসের শব্দ… ভারি, ঠাণ্ডা। সে জ্বলন্ত চোখে দেখে—ঘরের কোণায় ছায়াটি দাঁড়িয়ে। কিন্তু এবার সেটা স্পষ্ট।
এক চোখহীন মুখ, যার গহ্বর থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। দুটো হাড়ের মত হাত—পিছনে হেলে দাঁড়িয়ে, আর এক ফিসফিসানি— “তুমি জানো… তুমি দেখেছো… এবার পালাবে কোথায়?”
অরিত্র চিৎকার করে উঠে পড়ে। ঘরে আলো জ্বলে, আর কেউ নেই। কিন্তু দেয়ালের কোণে, এখনও এক টুকরো ছায়া জমে আছে। নড়ছে না। তবে… পলক ফেলছে।
অরিত্র জানে, পালানোর পথ নেই। সে আর সাধারণ মানুষের একজন নয়। সে একজন দর্শক। আর এক দর্শক কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফেরে না। কারণ তার ভেতরে এক অদৃশ্য সত্তা বাসা বেঁধে নেয়— “অরণিয়”।
৫
কলকাতার শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অরিত্র এখন নিজেকে এক দ্বীপবাসী বলে মনে করে। সে আর কারো সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলে না। ফোন বন্ধ, দরজা বন্ধ, আলো নিভিয়ে রাখে দিনের বেলাতেও। ঘুমোতে গেলেই এক স্বর শোনা যায়— “আবার এসো… আমরা এখনও অপেক্ষায় আছি…”
তবে এই স্বর এখন কেবল তার কানে আসে না, আসে সে যখন লিখতে বসে, ভিডিও রেকর্ড করে, এমনকি রান্না করতে গেলেও। সে জানে—এখন তার শরীর একখানা খালি খোলস, এবং ‘অরণিয়’ ভিতর থেকে কথা বলছে।
এক সন্ধ্যায়, সে নিজের টেবিলের সামনে ক্যামেরা বসিয়ে বসে। শুরু করে রেকর্ডিং। স্ক্রিনে তার চোখগুলো যেন ফাঁকা, কিন্তু মুখে একটা শান্ত হাসি।
সে বলে— “আজ আমি একটা সত্য রেকর্ড করছি। হয়তো এই ফাইল কেউ শুনবে না। আর যদি শোনেও—সে যেন ভুলেও আমার পথ অনুসরণ না করে। কারণ আমি যা বলছি, তা শোনার পর কেউ আর আগের মতো থাকতে পারে না।”
পাশে টেবিলের উপর খোলা আছে ইরার চিঠি। পাশে অনিন্দিতার একটি পুরনো নীল খাতা। আর তার পেছনে রাখা—দ্বীপের সেই উপগ্রহ চিত্র।
অরিত্র সিদ্ধান্ত নেয়—সে ফিরবে।
কিন্তু কেন?
সে জানে, সেই দ্বীপে এমন কিছু আছে যা কখনও বাইরে আসতে চায়নি। কিন্তু সে নিজে সেই জিনিসটাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন তার একমাত্র কাজ—তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া। সে আবার যোগাযোগ করে ক্যাপ্টেন মনোহরের সঙ্গে।
মনোহর শুরুতে অস্বীকার করেন। বলেন, “তুমি যা চাইছো, তা মৃত্যু নয়—তা হল তোমার বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া।”
অরিত্র জবাব দেয়— “তাহলে সেটাই হোক। কিন্তু এই ভয় নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারছি না। আমি রোজ মরছি। অন্তত এবার নিজে গিয়ে মুখোমুখি হবো।”
পাঁচ দিন পর, অরিত্র আর ক্যাপ্টেন মনোহর ছাড়ে চেন্নাই বন্দর। তাদের লক্ষ্য সেই অদৃশ্য দ্বীপ—যাকে এখন অরিত্র শুধু “আরণিয়” বলে ডাকে।
সাগরে চলার সময়, অরিত্র প্রতিদিন রাতে ভিডিও রেকর্ড করে। সে বলে— “আজ তৃতীয় রাত। আমি আর স্বপ্নে অরণিয়কে দেখছি না। তার মানে হয়তো সে জানে, আমি ফিরছি। এখন সে অপেক্ষায় নেই… সে প্রস্তুত।”
ক্যাপ্টেন মনোহর চুপচাপ। জাহাজের বাকি ক্রুরা কিছুই জানে না—তারা ভেবেছে কোনো গবেষণা অভিযান।
কিন্তু একদিন মাঝরাতে জাহাজে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।
রাত ২টা ৩৪ মিনিট। জাহাজের অদূরেই হঠাৎ ফগ জেনারেটর অটোমেটিক চালু হয়ে যায়। চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে যায়।
রাডারে কোনও বস্তু নেই, কিন্তু সবাই টের পায়—কিছু একটা খুব কাছে আছে। হঠাৎ করে একজন ক্রু পানির মধ্যে কিছু দেখে—এক মানুষ-মতো ছায়া। কিন্তু জলে নামার পরও, সে ডুবে যাচ্ছে না। সে হেঁটে আসছে জল পেরিয়ে। ক্রু চিৎকার করে ওঠে। জাহাজে হুলস্থুল পড়ে যায়। কিন্তু তখন ক্যাপ্টেন মনোহর কন্ট্রোল কেবিনে বসে বলেন— “ও আমাদের পথ দেখাচ্ছে। দ্বীপ কাছেই।”
অরিত্র দাঁড়িয়ে জানালার কাছে, চোখ বন্ধ করে বলে— “আমি জানি… আমি বাড়ি ফিরছি।”
যখন তারা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছায়, জিপিএস সিগন্যাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চাঁদের আলোয় দেখা যায় দ্বীপের ছায়া।কিন্তু এবার দ্বীপ আগের মতো নীরব নয়। এবার যেন দ্বীপও অপেক্ষায়। অরিত্র একা নেমে পড়ে দ্বীপে। ক্যাপ্টেন আর কারও নামতে দেয় না। অরিত্র শেষবারের মতো রেকর্ডিং চালু রাখে।
সে হেঁটে যায় সেই পুরনো মন্দিরের দিকে। সেই ফাটল, সেই বেদি, সেই খোদাই।
আর তখনই… সে বলে— “আমি এসেছি, অরণিয়। এবার যা চাও, নিও। কিন্তু আমার বাকি পৃথিবীকে ছেড়ে দাও। আমাকে নিও। আমিই শেষ দর্শক।”
রেকর্ডিংয়ের শেষে ক্যামেরায় দেখা যায়— অরিত্র দাঁড়িয়ে আছে এক খোলা বেদির সামনে। চারপাশ কুয়াশা, কিন্তু হঠাৎই সব আলো নিভে যায়। ক্যামেরার ফ্রেমে কেবল একটা ছায়া দেখা যায়—বিপুল, আকারহীন, অন্ধকার—যা ধীরে ধীরে অরিত্রকে ঢেকে নেয়।
আর ক্যামেরার শেষ শব্দ… “আমি এখন… তার… ভেতরে।”
বিপ… ক্যামেরা বন্ধ।
RV Sagarika ফিরে আসে। কিন্তু অরিত্র ফেরে না।
মনোহর পরে রিপোর্টে লেখেন— “আমরা দ্বীপে পৌঁছাই। সে একা নামে। সে আর ফেরে না। আমরা কোনও সিগন্যাল পাইনি। শুধু তার ক্যামেরার রেকর্ড। সে যা বলেছে, তার পরের গল্প কেউ জানে না। তবে আমি জানি… সে আমাদের জন্যেই গিয়েছিল। এবং সে হয়তো সফল হয়েছে। কারণ তখন থেকে… আমি আর অরণিয়কে শুনি না। কিন্তু মাঝরাতে এখনো আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি।আর কুয়াশার ভিতর দেখি… একটা ছায়া, চুপচাপ পাহারা দিচ্ছে।”
৬
কলকাতা শহরে বর্ষাকাল। জানালার কাঁচে টিপ টিপ করে জল পড়ছে। ডঃ সায়ন্তন সেনের চেম্বারে আজ একজন নতুন রোগী এসেছে—নাম রীমা পাল, পেশায় সাউন্ড ডিজাইনার।
সে নিয়ে এসেছে একটি অদ্ভুত অডিও ফাইল, যার শব্দ শুনে সে মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে।
ডঃ সেন প্রশ্ন করেন, “কোথায় পেলেন?”
রীমা জবাব দেয়, “আমার বন্ধু একজন নৌবাহিনীতে। তাদের সিস্টেমে একটি ‘corrupted’ ফাইল আপলোড হয়েছিল—বোঝা যাচ্ছিল না, কে করেছে।
আমি শোনার পর রাতেই এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখি। তখনই বুঝি, এটা কোনো সাধারণ ফাইল নয়।”
ডঃ সেন অডিও চালান। প্রথমে শুধু সাদা শব্দ, বাতাসের গর্জন, দূরের বজ্রধ্বনি।
তারপর— “আমি অরিত্র। আমি দ্বীপে এসেছি। তুমি কি শুনছো, অরণিয়?”
এক ফিসফিসানির শব্দ। তারপর… এক বিকট দীর্ঘশ্বাস, যেন সমুদ্র নিজে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
এরপর আবার সেই কণ্ঠ: “আমার চোখ খুলে যাচ্ছে… এত আলো… না, এত অন্ধকার… এটা মানুষ দেখতে পারে না!”
রীমা তখন কাঁপতে থাকে। ডঃ সেন হঠাৎ লক্ষ করেন—রেকর্ড প্লেয়ারের গায়ে ফ্রস্ট জমেছে। চেম্বারের তাপমাত্রা হঠাৎ ১২ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে।
রীমার মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়। সে বলে—সে এখন মাঝরাতে এক জলমগ্ন শহর দেখে, যেখানে মানুষ নেই, শুধু ছায়া-মানবরা হাঁটে। সে স্কেচ করতে শুরু করে সেই দ্বীপ, অথচ সে কখনো যায়নি।
সে জানে দ্বীপে পাথরের ভিতরে কী খোদাই ছিল। জানে সেই “খিলানযুক্ত বেদি”-র ডিজাইন, জানে সেই কুয়াশায় মোড়ানো খোলা চক্রাকার স্থান, যেখান থেকে অন্ধকার বেরোতো।
ডঃ সেন বুঝতে পারেন, অরণিয় একজন নয়—এটি এক সত্তা, এক মেমেটিক সংক্রমণ। শুধু দেখলে নয়, শুনলেই, জানলেই সে ঢুকে পড়ে মানুষের চেতনায়।
আর অরিত্র সেই সংক্রমণের প্রথম বাহক হয়ে গেছে। নৌবাহিনী পরে দ্বীপ খুঁজতে গেলে তারা আর কিছু খুঁজে পায় না। সেই স্থান এখন নিখালি সমুদ্র।
কিন্তু… স্যাটেলাইটে মাঝেমধ্যে দেখা যায় এক ছায়াময় ধোঁয়ায় ঢাকা অংশ—যা ধীরে ধীরে সরছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—RV Sagarika-র সেই শেষ রেকর্ড, যা অরিত্র তুলেছিলেন, তার ব্যাকআপ পাওয়া যায় না।
তবে কেউ কেউ বলে—কখনও কখনও গভীর ওয়েবের এক বিশেষ সার্ভারে মাঝেমাঝে এক ভিডিও দেখা যায়।
অরিত্রের ক্লান্ত মুখ। তার পাশে সেই ছায়া। আর শেষে, তার চোখে সেই অরণিয় ঢুকছে।
ডঃ সেন একদিন নিজের ডায়েরিতে লেখেন— “ভেবেছিলাম ওর (অরিত্রর) সঙ্গে সব শেষ হয়েছে। ভুল ভেবেছিলাম। মানুষ যা জানে না, তা কখনও নিখোঁজ হয় না— বরং তারা অপেক্ষা করে… জানার আগ্রহই হল দরজা। আর আমরা সেই দরজা খুলে ফেলেছি।”
তার ঘরের কোণায় ক্যামেরায় দেখা যায়, একটি ছায়া দাঁড়িয়ে।সেই রেকর্ড কেউ কখনো পুরো দেখে না। কারণ যারা দেখে… তারা আর আগের মত থাকে না।
সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে থাকা সেই কালো দ্বীপ।
আকাশ কালো, জলের গায়ে কুয়াশা নেমে এসেছে।
একটি নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নৌকার মাথায় দাঁড়িয়ে এক তরুণ—হাতে একটি নোটবুক।
সেটা ছিল রীমার ভাই, যে এখন সেই অডিও শুনে গেছে। দূরে দ্বীপের পাথরের গায়ে দেখা যায় একটি নতুন খোদাই:
“সমুদ্র যা গিলে খায়, তা শুধু শরীর নয়… তা হলো স্মৃতি, ভয়… আর সময়।”
সেই গায়ে লেখা— “সমুদ্রের কবর”
সমাপ্ত