দিব্যেন্দু দাশগুপ্ত
১৯৪৬ সালের কলকাতা। শহরটা তখন একটা আগ্নেয়গিরির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক উত্তাপ, ধর্মীয় বিদ্বেষ আর ক্ষমতার খেলায় শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে উঠছে এক অদৃশ্য আগুন। ছোটবেলার শহর, কলেজস্ট্রিটের মোড় থেকে শ্যামবাজার, বাঘবাজার থেকে চিৎপুর – সবকিছু ধীরে ধীরে অপরিচিত হয়ে উঠছে।
অভয়বাবু তখনও বুঝে উঠতে পারেননি যে এই উত্তাল সময় কেবল শহরটাকেই বদলে দেবে না, বদলে দেবে তাঁর জীবন, তাঁর পরিবারের সমস্ত চেনা গতিপথ।
অভয় মিত্র, পঞ্চান্ন বছরের একজন স্কুলমাস্টার। পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটে, কিন্তু গত বিশ বছর ধরে কলকাতার হাতিবাগানেই বসবাস। তাঁর স্ত্রী সরস্বতী, বড়ো ছেলে নিতাই, মেজো ছেলে হরিদাস আর মেয়ে মঞ্জরী – এই ছিল অভয়বাবুর সংসার। শান্ত, শিক্ষিত, আর আত্মমর্যাদায় ভরপুর এই পরিবার কল্পনাও করেনি যে হঠাৎ করেই ‘পরিচিত’ শব্দটার অর্থ বদলে যেতে পারে।
আগস্ট মাসের সেই এক দুপুরে দাঙ্গার খবর এল শ্যামবাজারের এক বই বিক্রেতার মুখে।
“শুনেছেন মাস্টারমশাই? নাখোদার কাছে ব্যাপক মারামারি! একদিকে হিন্দু, একদিকে মুসলমান… ছেলেমেয়েগুলোকে রাস্তায় নামাবেন না।”
অভয়বাবু বইটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করলেন। গোঁফের নিচে হালকা একটা চাপা নিশ্বাস পড়ল।
“যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু মানুষ এখনো যুদ্ধ করছে,” বললেন চুপচাপ।
সেদিন সন্ধ্যায় ছাদে বসে অভয় তাঁর ছেলেদের বলছিলেন, “দাঙ্গা শুধু মানুষ মারে না, ওটা মানুষকে পশুতে বদলে দেয়। নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারালে ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না।”
নিতাই বলেছিল, “বাবা, এই দাঙ্গা কি সত্যিই ধর্মের জন্য?”
অভয়বাবু মাথা নেড়ে বলেছিলেন, “ধর্ম নয়, ক্ষমতার জন্য। যারা লড়াই বাধায়, তারা উপরে বসে হাসে।”
তবে যতই জ্ঞানগর্ভ কথা বলুক অভয়বাবু, পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক। এক সপ্তাহের মধ্যে শহরের একাধিক পাড়ায় আগুন, লুঠ, ধর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়ল। দেশভাগের গুঞ্জন তখন বাস্তবের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
একদিন বিকেলে মেজো ছেলে হরিদাস এল রক্তমাখা জামা গায়ে।
“কি হয়েছে হরি?”
“সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে বন্ধুকে দেখতে গেছিলাম। হঠাৎ দাঙ্গাবাজরা চারপাশ ঘিরে ফেলে। এক মুসলমান বৃদ্ধকে ওরা কুপিয়ে মারল। আমি কোনোভাবে পালিয়ে এসেছি।”
অভয়বাবু ছেলের জামা খুলে দিলেন, পানি এনে মুখ ধুলেন। মাথার মধ্যে যেন বোমা ফাটছে।
“এই শহর আর আমাদের নেই,” অভয়বাবু বললেন।
কিছুদিন পর ঘোষণা এল – ভারত ভাগ হচ্ছে। একদিকে পাকিস্তান, আরেকদিকে স্বাধীন ভারত। কিন্তু সেই স্বাধীনতা কার জন্য? পাঞ্জাব, বাংলা – দুই প্রান্তেই শুরু হয়েছে দুঃস্বপ্নের যাত্রা।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর। দেশভাগ হয়ে গেছে। কলকাতার রিফিউজি ক্যাম্পে আসতে শুরু করেছে পূর্ববঙ্গ থেকে ছুটে আসা হিন্দু পরিবারগুলো। বিক্রমপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম – চেনা নামগুলোর পাশে লেগে গেছে রক্ত আর কান্নার গন্ধ।
একদিন সকালে অভয়বাবুর পুরনো বন্ধু কালীকিঙ্কর হাজরা এসে হাজির হলেন। মুখ থেতলানো, চোখ কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে।
“কি হয়েছে দাদা?” অভয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“ওই যে, ভিটেটা ছেড়ে চলে এলাম। রাতে গাঁয়ে হামলা হয়েছিল। ছোট ছেলেটা… আর বাঁচল না। মা-কে তো রেখে আসতে হল। নৌকা ধরেই চলে এলাম। এখন তো মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই।”
অভয়বাবু স্তব্ধ। বন্ধুর কান্নার মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ দেখলেন।
সেদিন রাতেই অভয়বাবু ঠিক করলেন – বিক্রমপুরের ভিটে তাঁরা আর ফিরে যাবেন না। দেশভাগের রেখা শুধুই কাগজে নয়, সেটা মানুষকে ভেতরে ভেতরে ছিন্নমূল করে দিয়েছে।
সেই থেকেই শুরু হল নতুন অধ্যায়। উদ্বাস্তু সমস্যা কেবল ছিন্নমূল মানুষের দুঃখের গল্প নয়, এটা নতুন করে জমি খোঁজার, নতুন করে ঘর বাঁধার, এক অসম লড়াইয়ের ইতিহাস।
অভয়বাবু বললেন, “চলো, এবার আমাদেরও কিছু করতে হবে।”
তাঁদের বাড়ির একতলায় কালীকিঙ্কর ও তাঁর পরিবার আশ্রয় পেল। মঞ্জরী তাঁর বোনের মতন হয়ে উঠল কালীকিঙ্করের বড়ো মেয়ে নির্মলার।
এই দুঃসময়ে একটিমাত্র কথা অভয়বাবু পরিবারে শিখিয়েছিলেন – “ভয় পেও না। আশ্রয় দিলে ঘর ছোট হয় না।”
***
১৯৪৮ সালের গোড়া। দেশ ভাগ হয়েছে বছরখানেক, কিন্তু উদ্বাস্তুদের ঢল থামেনি। প্রত্যেক ট্রেনে, নৌকায়, গোরুর গাড়িতে পূর্ববঙ্গ থেকে আসছে মানুষ – কেউ বেঁচে ফিরছে, কেউ হারিয়ে যাচ্ছে পথে।
অভয় মিত্রর বাড়ির নিচতলায় তখন চারটি পরিবার একসঙ্গে থাকে – কালীকিঙ্কর হাজরা, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে; ফরিদপুর থেকে পালিয়ে আসা বৃদ্ধ সুধাংশু পাল; আর সদ্যবিবাহিত এক দম্পতি, মেয়েটির নাম উমা।
তাদের কেউ কারও আত্মীয় নয়, কিন্তু ভাগ্য একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে। সেই বাড়িতে তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত সমাজ – যাদের পেছনে কেবল পুড়ে যাওয়া ভিটের স্মৃতি, আর সামনে অনিশ্চয়তার মরুভূমি।
উত্তর কলকাতার বহু এলাকা তখন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। গড়িয়াহাট, কাশীপুর, তপসিয়া – খোলা মাঠে বানানো হচ্ছে খড়ের ঘর, বাঁশের কুঁড়েঘর, যেখানে দশজনের জায়গায় পঞ্চাশজন ঠাসাঠাসি করে থাকে।
মেজো ছেলে হরিদাস তখন কলেজ ছেড়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিদিন যায় বেলগাছিয়ার শিবিরে। সেখানেই পরিচয় হল এক অদ্ভুত চরিত্রের সঙ্গে – নাম রশিদ আলি।
“তুমি মুসলমান? তাহলে এখানে কাজ করছ কেন?” হরিদাস একদিন সরাসরিই প্রশ্ন করেছিল।
রশিদ হেসেছিল।
“মানুষের ধর্ম থাকলেও, দুঃখের তো নেই। আমি খুলনার মুসলমান, ওরাও আমার ভাইবোন ছিল। এখন যদি কারও উপকার করতে পারি, তাতেই শান্তি।”
হরিদাস চুপ করে গিয়েছিল। দেশে ধর্মের নামে যে বিভাজন, সেটা রশিদের মধ্যে ছিল না। অনেক রাত অবধি তারা বসে কথা বলত – দেশ, ভাষা, ঘর আর ঘরছাড়া মানুষের কথা।
এদিকে অভয়বাবুর বড়ো ছেলে নিতাই সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। সে এখন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরে কেরানি। প্রতিদিন সে দেখে – কিভাবে কাগজ, ফর্ম, সিল আর সইয়ের খেলায় জীবনকে নতুন করে লেখার চেষ্টা চলছে।
“বাবা, জানো? কুমিল্লার এক লোক তাঁর পুরো পরিবার হারিয়েছেন। তবু আবেদন করছেন একটা দোকানের জায়গা পাওয়ার জন্য। বলছিলেন—যদি একটা চা-দোকান পাই, নতুন করে শুরু করব।”
অভয়বাবু বললেন, “মানুষের মনের জোরই জাতিকে টিকিয়ে রাখে।”
কিন্তু সমাজ তো সবসময় সহানুভূতিশীল নয়। পাড়ার লোকজন বলতে শুরু করেছে, “এই যে বাড়িতে এত উদ্বাস্তু, এতে বিপদ হতে পারে। চোর-ডাকাত আসতে পারে, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই।”
অভয়বাবু মাথা নিচু করে শুনেছেন। প্রতিবাদ করেননি, শুধু মঞ্জরীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন –
“মানুষ যখন অমানুষ হয়, তখন ভাষা থেমে যায়।”
মঞ্জরী তখন কলেজে পড়ে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বদলে যাচ্ছে। নির্মলা, কালীকিঙ্করের মেয়ে, তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গিনী হয়ে উঠেছে। একদিন দু’জনে বসে ছবি আঁকছিল – মঞ্জরীর হাতে কলকাতার দৃশ্য, আর নির্মলার ক্যানভাসে কেবল ভাঙা ঘর আর একঝাঁক শূন্য চোখ।
“তুই কী আঁকছিস?”
“আমার গাঁয়ের ছবি। এখন তো শুধু স্মৃতি।”
মঞ্জরী নির্মলার চোখে জল দেখতে পেল। চুপচাপ হাত ধরল।
“তোর ছবি আমি নিজের সঙ্গে রাখতে চাই,” বলল মঞ্জরী।
সে প্রথমবার বুঝল, দেশভাগ শুধু রাজনীতির খেলা নয়, এটা চেতনারও ছিন্নভাগ।
এই সময় কলকাতার একটি আশ্চর্য উদ্যোগ অভয়বাবুর নজর কাড়ে। কিছু শিক্ষক, কবি আর শিল্পীরা মিলে ‘উদ্বাস্তু সংস্কৃতি কেন্দ্র’ তৈরি করেছেন। যেখানে উদ্বাস্তুদের শিল্প, গান, কবিতা শেখানো হচ্ছে। অভয়বাবু সেখানে যান বক্তৃতা দিতে।
“আমরা কেবল ভিটেমাটি হারাইনি,” বললেন তিনি, “আমরা আমাদের কল্পনার জমিও হারিয়েছি। তাই চাই, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখা।”
তাঁর কথায় হাততালি পড়ল না, কিন্তু কজনের চোখ ভিজে উঠল।
শীতকাল পড়েছে। এক রাতে হঠাৎ উমার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হল। অভয়বাবুর স্ত্রী সরস্বতী তখন মধ্যরাতে বেরিয়ে গিয়ে দাই এনে আনলেন। গলির লোকজন গজগজ করছিল – “এইসব উদ্বাস্তুদের জন্যই সব ঝামেলা।”
কিন্তু পরদিন সকালে উমার কোলে ফুটফুটে মেয়ে এল। অভয়বাবু সেই শিশুকে কোলে নিয়ে বললেন,
“নতুন জীবনের প্রতীক – এই আমাদের আশ্রয়।”
নাম রাখা হল – আশা।
এক সন্ধ্যায় অভয়বাবু ছাদে বসে আকাশ দেখছিলেন। হরিদাস এসে বলল –
“বাবা, তুমি জানো? আজ খুলনা থেকে একটা ট্রেন এল – নাম মাত্রই ‘রিফিউজি ট্রেন’। কিন্তু পৌঁছেছে কেবল ৬৫ জন, বাকি সব খুন হয়ে গেছে পথে।”
অভয়বাবু স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
তিনি বললেন না কিছু, শুধু আকাশের দিকে চেয়ে ভাবলেন – “এই দেশ কি সত্যিই আমাদের দেশ?”
এক মুহূর্তে তিনি যেন বুঝে ফেললেন – ইতিহাস একদিন বইয়ে পড়ানো হবে, কিন্তু এই দুঃখ – এই অভিজ্ঞতা – থাকবে রক্তে, মজ্জায়, জিনে।
***
১৯৪৯ সাল। দেশভাগের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির সময়। স্বাধীনতা তখনও তরতাজা, কিন্তু বাস্তবের ভাঁজে স্বাধীনতার অর্থ বড়ো জটিল হয়ে উঠেছে। উদ্বাস্তুদের একটা বড় অংশ এখনও ঠিকানাবিহীন, পরিচয়হীন, রাষ্ট্রের চোখে ‘স্থানান্তরিত প্রজন্ম’।
তবে অভয় মিত্রর বাড়ির দোতলা এখন যেন একটা মিনি ভারতবর্ষ – রক্তপাতের গল্প, ভাষার টান, ধর্মের দ্বন্দ্ব, আর এক অদ্ভুত মিলনের হাওয়া যেখানে কেউ কারো খুঁটি নয়, অথচ একে অপরের ভরসা।
সেই সময়ে অভয়বাবুর কাছে এক চিঠি আসে – অনেকদিনের পুরনো ছাত্র জাকির হোসেনের লেখা।
“প্রিয় অভয় মশাই,
আপনি কেমন আছেন? আমি এখন ঢাকায় থাকি। বাড়ির চারপাশ বদলে গেছে। শোনা যায় আপনি অনেক উদ্বাস্তু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন। আপনি যেভাবে মানুষ গড়েছিলেন, এখন বুঝি কেন সবাই আপনাকে ভালোবাসত।
আপনার আশীর্বাদ নিয়ে বেঁচে আছি।
— জাকির।”
চিঠিটা পড়ে অভয়বাবুর চোখে জল চলে আসে। তিনি চিঠিটা যত্ন করে নিজের ডেস্কে রেখে দেন। সেই চিঠি যেন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পুরস্কার।
মঞ্জরী তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার মনে তখন সাহিত্য আর চিত্রকলার টান। সে লিখতে শুরু করেছে – ছোটগল্প, ডায়েরি, কবিতা। তার লেখায় বারবার ফিরে আসে উদ্বাস্তুদের কষ্টের কথা, ঘরের সন্ধান, মানুষের সংকীর্ণতা, আর আশার ক্ষীণ আলো।
একটা ছোট ম্যাগাজিনে তার লেখা ছাপা হল – ‘একটি জানালা, যা খুলে না’।
সেই গল্পে ছিল এক ছোট মেয়ের কথা, যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে, আর এক বন্ধ জানালার ভেতর পৃথিবী দেখার চেষ্টা করছে। সম্পাদকীয়তে লেখা হল –
“দেশভাগ নিয়ে এক তরুণীর গভীর বীক্ষণ – মঞ্জরী মিত্রের কলমে উঠে এসেছে এক ভয়ানক নৈরাশ্য, যার ভেতরেও বাঁচার ডাক রয়েছে।”
অভয়বাবু সে লেখা পড়ে মুগ্ধ হলেন না, বরং কিছুটা চুপচাপ। তিনি বললেন,
“দুঃখকে লেখায় পরিণত করা সাহসের কাজ। কিন্তু সাবধান মঞ্জু – সাহিত্য যেন ক্ষত না চাটে, বরং চিকিৎসা করে।”
মঞ্জরী বলেছিল, “আমি শুধু দেখতে চাই, আমরা কোথায় ভুল করলাম, আর কীভাবে বাঁচব।”
এদিকে কালীকিঙ্কর হাজরার মেয়ে নির্মলার বিয়ে ঠিক হয়। পাত্রও উদ্বাস্তু – চট্টগ্রাম থেকে আসা রেশন অফিসের কেরানি। বিয়ে হবে খুব সাদামাটা, কিন্তু বাড়ির সবার মধ্যে একরকম উদ্দীপনা।
বিয়ের দিন হরিদাস একটা সাদা কাপড়ে লিখে টাঙিয়ে দেয় বারান্দায় – “আশ্রয় শুধু দেওয়া নয়, গড়ে তোলারও নাম।”
সন্ধ্যায় যখন সানাই বাজছে, তখন পাড়ার বহু লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই বিয়ে – খুব সাধারণ, কিন্তু চোখে জল আনা আনন্দে ভরা।
নির্মলা চলে যাওয়ার সময় মঞ্জরীকে জড়িয়ে বলেছিল,
“তুই থাকলে আমি আজ এতটা একা লাগত না।”
মঞ্জরী বলেছিল, “তুই যাবি তো এক বাড়ি, আমি তো যাচ্ছি না কোথাও। তবে তোদের হাসি থাকলে, আমি ঠিক পথ পেয়ে যাব।”
বছরের শেষদিকে সরকারি জরিপে দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সংখ্যা দশ লক্ষ ছাড়িয়েছে। নতুন করে উদ্বাস্তু কলোনি তৈরি হচ্ছে: কাঁকুরগাছি, নাকতলা, শান্তিনিকেতন কলোনি, কল্যাণী। সেখানে বাড়ি নয়, ছাউনি – স্বপ্ন নয়, হিসেব।
নিতাই এসব ফাইল তৈরি করে, চোখে গ্লানি নিয়ে বাড়ি ফেরে।
“বাবা, এসব পড়ে আর ভালো লাগে না। এত শোক, এত অভিযোগ… কোনো ফাইলেই আনন্দ নেই।”
অভয়বাবু বললেন,
“জীবন তো আর শুধু আনন্দ নয়, নিতাই। এ তো একটা কাল, যে আমাদের চোখে চোখ রেখে বলছে – তুমি এখনো বেঁচে আছো কিনা?”
একদিন সন্ধ্যায় এক বৃদ্ধ পণ্ডিত আসেন অভয়বাবুর কাছে – তাঁর নাম সত্যব্রত লাহিড়ী। কুমিল্লা থেকে এসেছেন, হাতে দুটো পুরনো সংস্কৃত পুঁথি আর একটি গীতা।
“মশাই, এগুলো বাঁচান। বাড়ি পুড়ে গেছে, শুধু এগুলো নিয়ে এসেছি। আমি আর কিছু চাই না – শুধু চাই, এগুলো কেউ পড়ুক।”
অভয়বাবু সেই বইগুলো একটা খালি আলমারিতে রাখলেন। একদিন হয়ত কেউ তা পড়বে, বুঝবে – এইই আমাদের উত্তরাধিকার।
গভীর রাতে অভয়বাবু একদিন তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন—
“আমি আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু এ আশ্রয় শুধু গৃহ নয় – মন, বিশ্বাস, ভবিষ্যতের ওপর আস্থা।
আজ জানালার ওপাশে যুদ্ধ নেই, কিন্তু ছায়া আছে।
আমাদের কাজ, সেই ছায়ার পেছনে আলো খোঁজা।”
সেই ডায়েরি খুলেই পরের দিন সকালে মঞ্জরী দেখে বাবার শেষ লেখাটি –
“ভিটে হারালে কিছু যায় না, যদি ভিত থাকে। ভিত মানেই বিশ্বাস।”
***
১৯৫০ সালের জানুয়ারি। এক নতুন দশকে পা রেখেছে ভারত, নতুন সংবিধান রচিত হয়েছে, নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে চারদিকে। কিন্তু অভয়বাবুর বাড়ির দোতলায় বসে বসে এক বৃদ্ধ শিক্ষক ভাবছেন—এই দেশ, এই নতুন ভারত, তার উদ্বাস্তু সন্তানদের কি নতুন করে চিনতে পারবে?
নতুন বছরে সরকারের পক্ষ থেকে ‘পরিচয়পত্র’ বিতরণ শুরু হয়েছে উদ্বাস্তুদের জন্য। প্রতিটি পরিবারকে নিজেকে ‘অবস্থানরত উদ্বাস্তু’ হিসাবে নিবন্ধন করতে হবে।
নিতাই দপ্তর থেকে এক গাদা ফর্ম নিয়ে এল।
“বাবা, আজ থেকে পরিচয় মানে একটা নাম, জন্মস্থান, আর তার পাশে একটা ছাপ: উদ্বাস্তু।
আর কিছু না।”
অভয়বাবু চুপ করে ফর্ম হাতে নিলেন। গরম জলের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
“জন্মভূমি হারানোর পর যে পরিচয় বাঁচে, সেটা শুধু হৃদয়ে লেখা থাকে—ফর্মে নয়।”
এই সময়েই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। মঞ্জরী কলেজ থেকে ফিরছিল, রাস্তায় এক দল লোক তাকে ঘিরে ধরল।
“এই যে, নাম কী তোমার? হিন্দু না মুসলমান? বাড়ি কোথায়?”
মঞ্জরী অবাক হয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, “আমার নাম মঞ্জরী মিত্র। কলকাতায় থাকি।”
তাদের একজন বলে উঠল, “চেহারায় তো দেখছি ওপার বাংলার মতো লাগছে।”
মঞ্জরী উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমার মায়ের বাড়ি বরিশালে ছিল। কিন্তু আমি তো এখানকার মানুষ।”
লোকগুলো চলে গেল। কিন্তু মঞ্জরীর ভেতরে একটা ঝড় বয়ে গেল।
সেদিন সে প্রথম বুঝল—পরিচয় কেবল নাম বা ধর্ম নয়, এখন সেটা সন্দেহের বিষয়।
সে বাড়ি ফিরে কাঁদল না। একটা সাদা কাগজে লিখল:
“আমার নাম মুছে ফেলো। যদি তাতে তোমাদের নিরাপত্তা থাকে, মুছে দাও আমার ভূগোল।
আমি শুধু একজন মানুষ, যে জন্মাতে চেয়েছিল আলোয়।”
হরিদাস তখন রশিদের সঙ্গে এক নতুন উদ্যোগে নেমেছে—উদ্বাস্তু শিশুদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা। কলকাতার উপকণ্ঠে, ট্যাংরা অঞ্চলের এক পুরনো গোদামে তারা চালু করল ‘আলোর পাঠশালা’।
প্রথম দিনই এল পঞ্চাশ জন শিশু—কারো নাম নেই ঠিকমতো, কারো বাবা নেই, কারো মনে শুধু গুলির শব্দ।
হরিদাস তাদের নাম শেখাল—“তুমি তোমার নাম বলো। আর মনে রাখো, কেউ যদি তা কেড়ে নিতে চায়, তাহলে তুমি নিজের নাম নিজেই লিখে ফেলো নতুন করে।”
একদিন এক ছোট ছেলেকে সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
সে চুপ করে রইল। পরে বলল, “আমার মা বলে, এখন নাম রাখার সময় নয়, এখন পালাবার সময়।”
অভয়বাবুর বাড়িতে তখন নতুন একটি মুখ এসেছে—নাম রেবতী, ফরিদপুরের একজন স্কুলশিক্ষিকা। তিনি তাঁর এক বোনকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন সাম্প্রতিক দাঙ্গা থেকে।
রেবতী অন্যরকম। চোখে স্থির দৃষ্টি, গলায় দৃঢ়তা। অভয়বাবুর স্ত্রী সরস্বতী প্রথমে একটু দ্বিধা করলেও পরে তাঁকে বোনের মতো আপন করে নেন।
রেবতী বললেন, “আমাদের জীবনে শিক্ষার চেয়ে বড় যুদ্ধ এখন—মনে করিয়ে দেওয়া যে আমরা মানুষ। সেটাই কি আপনারা শেখান?”
অভয়বাবু বললেন, “আমরা শেখাই, কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যখন চারপাশ ধ্বসে পড়ে।”
একদিন পাড়ায় একটি চিঠি ঘুরতে থাকে। কারো অজানা হাতে লেখা, ছড়ার মতো:
“যারা এলো ওপার থেকে, তারাই ছিনিয়ে নিল সব
ভাত নেই, চাকরি নেই, কে রাখে কার হদিস কব?”
সেই চিঠি হাতে নিয়ে অভয়বাবু পাড়ার মিটিং ডাকলেন।
তিনি বললেন,
“আজ যাদের উদ্বাস্তু বলে চেনেন, কাল তারা কারখানা চালাবে, ডাক্তার হবে, শিক্ষক হবে।
অথচ আপনারা তাদের ঘাড় থেকে নামাতে চান এই কলঙ্ক!
ভেবেছেন কখনো—আপনারা জন্মভূমির অহংকার পেয়েছেন বিনা দামে। ওরা পেয়েছে দুঃখের বদলে সাহস।”
মিটিংয়ে অনেকেই চুপ করে গিয়েছিল।
মঞ্জরী এরপর নতুন গল্প লিখল—‘নামতা’।
এক ছোট ছেলের গল্প, যে গুনতে শেখে না এক-দুই-তিন, বরং শেখে নতুন করে নিজের আত্মপরিচয়।
গল্পটি কলকাতার এক নামকরা ছোটগল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়। সাহিত্যসমালোচকরা লিখল—
“মঞ্জরী মিত্রর কলম দেশভাগের ভাঙা দালান থেকে তুলে এনেছে মানুষের আত্মার কঙ্কাল।”
অভয়বাবু চুপ করে বললেন, “এভাবেই ওরা ইতিহাস লিখছে, আমাদের না বলেই।”
সেই শীতে একদিন অভয়বাবু রেবতীকে বললেন, “একটা স্কুল খুলতে চাই, একদম ছোটদের জন্য—যেখানে কেউ জানতে চাইবে না ‘তুমি কোথাকার’।”
রেবতী বললেন, “তাহলে নাম রাখি—ছায়া স্কুল। যেখানে নাম নেই, ঠাঁই আছে।”
সেই স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল এক বিকেলে। রশিদ, হরিদাস, রেবতী, এমনকি মঞ্জরী সবাই হাতে হাত রেখে বলল,
“আমরা দাঁড়াবো, যতবার প্রয়োজন।”
অভয়বাবু শুধু বলেছিলেন,
“নতুন দেশের জন্য, নতুন ভিত চাই। এই স্কুল হোক সেই ভিত্তি।”
***
১৯৫১ সাল। ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চারদিকে প্রচার, নতুন নতুন দল, নানারকম প্রতিশ্রুতি—কিন্তু অভয় মিত্রর মত বহু মানুষ জানেন, ভোট আসলেই সব সমস্যা মেটে না। ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের কাছে গণতন্ত্র একটা নতুন জিনিস, অনেকটা সেই কাদার মতো—যা দিয়ে কিছু গড়া যায়, আবার যা পায়ে আটকে দিয়ে হাঁটতে বাধা দেয়।
কলকাতার নতুন গজিয়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর মানুষ নির্বাচন নিয়ে দ্বিধায়—নাগরিকত্ব কী, ভোটার তালিকায় নাম উঠবে কি না, এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চারদিকে।
অভয়বাবুর বাড়িতে সেদিন এক জমাটি আলোচনা।
রেবতী, হরিদাস, মঞ্জরী, এমনকি রশিদও উপস্থিত। কথা হচ্ছে—“উদ্বাস্তুদের ভোটাধিকার কীভাবে বাস্তব হবে?”
রেবতী বললেন, “কতজনের তো জন্মের সার্টিফিকেট নেই, কে কোথা থেকে এসেছে সেটাও ঠিক জানা যায় না। রাষ্ট্র কাগজ খোঁজে, আর মানুষ খোঁজে ঠাঁই।”
রশিদ বলল, “আমার এক পরিচিত, বাগেরহাট থেকে এসেছে। সে ভোট দিতে চায়, কিন্তু তাকে বলা হয়েছে সে ‘বিদেশি’। অথচ সে জন্মেছে এই মাটিতে, বড় হয়েছে এই বাংলা ভাষায়।”
অভয়বাবু ধীরে বললেন,
“এই রাষ্ট্র যদি একদিন তার নিজের সন্তানদেরই চিনতে না পারে, তাহলে সে রাষ্ট্রের জন্ম বৃথা।”
এক সকালে নিতাই বাড়ি ফিরেই বলল,
“বাবা, আজ রিফিউজি দপ্তরে একজন বৃদ্ধ এসেছিলেন। ফর্মে নিজের নামের জায়গায় লিখেছেন—‘আমি ছিলাম, এখন শুধু আছি।’”
অভয়বাবু তাকালেন। “যে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করে, তার কাছ থেকে রাষ্ট্র কিছু ধার নিতে পারে না। আমাদের কাজ, তাকে আবার মানুষ করে তোলা।”
এদিকে ‘ছায়া স্কুল’ দিন দিন বিস্তার পাচ্ছে। নতুন করে আরও পঁচিশ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। স্কুলে এখন পড়ানো হয় বাংলা, অঙ্ক, কিছু কিছু ইংরেজি, আর প্রতিদিন সকালে একটি গান:
“আমরা হারাইনি, শুধু পথ বদলেছি।
আকাশটা এক, রোদটা সেই।
মাটির গন্ধে আজও মা আছে,
শুধু মুখটা অন্য, নামটা নতুন।”
এই গান রচনার নেপথ্যে ছিল মঞ্জরী। সে এখন শুধু লেখক নয়, শিশুদের শিক্ষকও।
একদিন একটি ছেলেকে পড়াতে পড়াতে সে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?”
ছেলেটি বলল, “ভোটার হতে চাই, নাম থাকতে চাই খাতায়।”
মঞ্জরী সেদিন প্রথমবার ভেবেছিল—এই ছোট্ট স্বপ্নই একদিন হবে জাতির ভিত।
এই সময় পাড়ার একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। এক মাঝবয়সী মহিলা এসে হাজির হন অভয়বাবুর বাড়ির সামনে। নাম—জয়নব খাতুন। হাতে ছেঁড়া কাপড়, মুখে রোদে পোড়া দাগ, চোখে বিষাদ।
“আপনি অভয় মিত্র?”
“হ্যাঁ, বলেন মা।”
“আমি ছিলাম আপনার ছাত্রের মা—জাকির হোসেনের। সে আজ নেই। ঢাকায় মারা গেছে এক দাঙ্গায়। যাওয়ার আগে বলে গেছে—আপনার কাছে গেলে আশ্রয় পাবো।”
অভয়বাবু স্তব্ধ। সেই জাকির, যে একদিন চিঠি লিখেছিল!
তিনি জয়নবকে ভেতরে ডাকলেন। সরস্বতীদেবী একটু থমকে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরে বললেন,
“মানুষ তো মানুষই—ধর্মে ভাগ হলে, ঘর বাড়ি গড়ে না।”
জয়নব রয়ে গেলেন এক খালি ঘরে। তিনি সেলাই জানতেন, অভয়বাবু তাঁকে ছায়া স্কুলের ইউনিফর্ম বানানোর দায়িত্ব দিলেন।
এখন ছায়া স্কুলের সব শিশু বলে—
“আমাদের জামা বানিয়েছেন জয়নব দিদিমা।”
সেই সময় একটি বড় খবর এল। সরকার ঘোষণা করল—উদ্বাস্তুদের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসনের জমি বরাদ্দ হবে। কিন্তু শর্ত, তারা শহরের বাইরে যাবে—শিলিগুড়ি, বনগাঁ, বারুইপুর, বসিরহাটের দিকে।
অভয়বাবু জানতেন, এ সহজ হবে না। উদ্বাস্তু মানে শুধু ভিটে হারানো নয়, মানে একটা গতি হারানো জীবন।
রেবতী বললেন,
“এই শহরে ওরা গড়ে তুলেছে একটা ছাঁদ, একটুকরো চেনা আকাশ। ওদের আবার ‘অচেনায়’ পাঠাতে চাওয়া মানে, অস্তিত্বকে ফের বিপন্ন করা।”
অভয়বাবু ঠিক করলেন—এই নিয়ে শহরের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। একটি খোলা চিঠি পাঠাবেন পত্রিকায়, সরকারের উদ্দেশে।
চিঠির খসড়া লেখা শুরু করলেন মঞ্জরী। তাতে লেখা হল—
“শুধু বেঁচে থাকা নয়, মানুষের দরকার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার।
উদ্বাস্তু যদি নিজের ছায়া খুঁজে পায়, তবেই রাষ্ট্র সফল হয়।”
চিঠিটি ছাপা হল দেশ পত্রিকায়। অনেকেই পড়লেন, আলোচনা হল। কেউ প্রশংসা করল, কেউ কটাক্ষ।
কিন্তু শহরের এক কোণে, ছায়া স্কুলে, সেই চিঠির প্রিন্টআউট টাঙিয়ে রাখা হল।
এক রাতে অভয়বাবু ছাদে উঠে দেখলেন, রশিদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গান শেখাচ্ছে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে—
“মাটির মানুষ, কাদার শহর,
তবু গড়ে নিচ্ছে নতুন ঘর।
চোখে জ্বলে আলো মিশে
একটা নতুন ভোরের ভর।”
অভয়বাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন। মৃদু হাওয়ায় চুল উড়ে যাচ্ছে। তাঁর মনে হল, এত কিছুর পরেও এই শহর বাঁচবে, এই মানুষগুলো টিকবে—কারণ তারা এখন শুধু উদ্বাস্তু নয়, ইতিহাসের গড়া মানুষ।
***
১৯৫২ সালের গ্রীষ্ম। কলকাতার আকাশে ধুলোর কুয়াশা, মাটিতে জলের অভাব। চারদিকে রাজনৈতিক আলোচনার গুঞ্জন, ভাষার দাবিতে আন্দোলন, রাষ্ট্র গঠনের এক দমবন্ধ প্রক্রিয়া—কিন্তু অভয় মিত্রর চোখে এখনো ঘোরাফেরা করে একটি প্রশ্ন: “মানুষ কোথায় দাঁড়াবে, যদি তার পায়ের নিচে মাটি না থাকে?”
সেই সময় ছায়া স্কুলে পড়ুয়াদের জন্য একটি প্রজেক্ট চালু হয়—ছাত্ররা নিজের শিকড়ের কথা বলবে, মানচিত্র আঁকবে। কিন্তু খুব দ্রুতই বোঝা গেল, শিশুগুলোর কাছে ‘মানচিত্র’ মানেই কেবল একটি হারানো গল্প।
একটি বাচ্চা মেয়ে, নাম কুসুম, তার আঁকা মানচিত্রে লিখেছিল—
“আমার বাড়ি ছিল, এখন নেই। যেখানে বাবা খুন হয়েছিলেন, সেটাই আমার দেশ।”
হরিদাস সেই আঁকাগুলো দেখে কাঁদছিল প্রায়। সে বলল মঞ্জরীকে,
“এই যে ছোট ছোট মানুষগুলো, ওদের ভিতরে যে ক্ষত, সেটা কখনও মুছে যাবে না।
তবু, ওরাই হয়তো নতুন দেশকে বুঝতে শেখাবে।”
এই সময় অভয়বাবুর বাড়িতে আবার নতুন কেউ আসে। এবার এক যুবক—নাম ভূপাল দে, জন্মস্থান—সুন্দরবন ঘেঁষা সাতক্ষীরা। সে বলে,
“আমার বাবা জমির মালিক ছিলেন, কিন্তু দেশভাগে মুসলমান পরিচয়ে বাংলাদেশে থেকে গেলেন। আমি এখানে এলাম পায়ে হেঁটে। আমি হিন্দু হয়েও বিদেশি হয়ে গেলাম নিজের মাটিতে।”
ভূপালকে প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখলেও, অল্পদিনেই বোঝা গেল—সে কাজ পারে। ছায়া স্কুলে হাত লাগাল, গণপাঠাগারের ভাবনা আনল, পুরনো খবরের কাগজ থেকে রেকর্ড তৈরি করতে লাগল—কে কোথা থেকে এসেছে, কে কোন বছর এসেছিল, কার ঠিকানা ছিল কোথায়।
মঞ্জরী বলল, “তুমি তো ইতিহাস ধরে রাখছো, অথচ নিজে ইতিহাসের বাইরে চলে গেছ!”
ভূপাল হেসে বলল,
“আমি হদিস খুঁজছি। তাই হদিসহীনদের কাছে এসেছি।”
একদিন রেবতী অভয়বাবুকে বললেন,
“এইসব ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্থায়ী জায়গা চাই। একটা ভবিষ্যৎ চাই।
ওদের বলার মতো ঠিকানা চাই।”
অভয়বাবু বললেন,
“ঠিকানা মানে শুধু বাড়ি নয়, ঠিকানা মানে সম্মান।
চলো, শুরু করি একটা ‘নথিভুক্তি অভিযান’। যেন ওরা রাষ্ট্রের কাছে অদৃশ্য না থাকে।”
ছায়া স্কুলে এবার বিশেষ ক্লাস শুরু হল—যেখানে শেখানো হল নিজের পরিচয় কীভাবে লিখতে হয়, নিজের নামটা কিভাবে উচ্চারণ করতে হয় আত্মবিশ্বাসে।
একটি ছেলে বলেছিল,
“আমি তো স্কুলে ছিলাম না কখনও, আমার নামও নেই কোনও খাতায়।”
হরিদাস বলেছিল,
“তবে আজ থেকে তুমি নিজেই নিজের নাম লেখো—আর যেদিন রাষ্ট্র তোমাকে চিনবে, জানবে তুমি এই দেশেরই সন্তান।”
এদিকে শহরে নানা জায়গায় উদ্বাস্তু-বিরোধী বক্তব্য বাড়ছে। পোস্টারে লেখা হচ্ছে—
“উদ্বাস্তু মানেই চুরি, দখল, বিশৃঙ্খলা।
ওদের আলাদা বসবাসের বন্দোবস্ত হোক।”
মঞ্জরী এসব দেখে বলল,
“আমরা শুধু স্থানচ্যুত নই, এখন আমরাই শত্রু।
রাষ্ট্র আমাদের নাগরিকত্ব দেয়, আর সমাজ আমাদের খুঁজে বেড়ায় অপরাধীর চোখে।”
রেবতী বললেন,
“তবে লেখো, বলো, আওয়াজ তোলো।
ভয় পেলে ইতিহাস আবার ভুল লেখা হবে।”
এই সময় মঞ্জরী একটি নাটক লেখে—‘হদিসহীন মানচিত্র’। নাটকে ছিল এক উদ্বাস্তু কিশোর, যে সারা জীবন নিজের ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। শেষ দৃশ্যে সে একটা খালি মানচিত্রে দাঁড়িয়ে বলে—
“এইখানে আমার ঘর ছিল। এইখানে আমি প্রথম কান্না কেঁদেছিলাম।
এখন কেবল হাওয়া আছে, ছায়া আছে।
তবু আমি থাকব, কারণ আমি এই মাটির সন্তান।”
নাটকটি ছায়া স্কুলে অভিনীত হয়। দর্শকদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক, শিক্ষক, আর কিছু সরকারি কর্মচারী। নাটকের পর অভয়বাবু মঞ্চে উঠে বললেন—
“আপনারা এই ছেলেমেয়েদের দেখে ভাববেন না ওরা কেবল উদ্বাস্তু।
ওরা এই দেশের গলার স্বর—যা বুকে ব্যথা হলে জোরে চিৎকার করে ওঠে।
ওদের মুখ বন্ধ করলে, ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ হবে।”
একদিন অভয়বাবুর ঘরে বসে ভূপাল, হরিদাস আর মঞ্জরী একটি পুরনো মানচিত্রের ওপর কাজ করছিল। ভূপাল দেখাচ্ছিল—“এইখানে ছিল নদী, এখন নেই। এখানে ছিল বাজার, এখন স্মৃতি।”
মঞ্জরী হঠাৎ বলল,
“তুমি বলো না, আমরা সবাই ছিন্নমূল।
আমার মনে হয়, আমরা ছিন্নমূল নই—আমরা মূল খোঁজার মানুষ।”
ভূপাল তাকিয়ে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছ। ছিন্নমূল হওয়া মানে শেষ নয়—ওটা তো শুরু।”
এক সন্ধ্যায় অভয়বাবু নিজের ডায়েরিতে লেখেন—
“মানচিত্রে হদিস থাকে, কিন্তু হৃদয়ে থাকে দিকনির্দেশ।
আমার ছাত্ররা এখন দিক দেখাচ্ছে।
হয়তো একদিন, এই শহর ওদের দেখে বলবে—তোমরা আমাদেরই রক্ত।”
আকাশে তখন সন্ধ্যার আলো মিশে যাচ্ছে, শহরের কোলাহল থেমে যাচ্ছে। অভয়বাবু জানেন না আগামী দিনে কী আছে, কিন্তু এটুকু জানেন—এই হদিসহীন মানচিত্র একদিন নতুন পথের জন্ম দেবে।
***
১৯৫৩ সাল। ছায়া স্কুল এখন শুধু একটি শিক্ষাকেন্দ্র নয়, এক আশ্রয়, এক প্রতিরোধ। কলকাতার দক্ষিণে, ঢাকুরিয়ার এক চৌরাস্তার ধারে এই স্কুলকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এক আশ্চর্য জগৎ—যেখানে কেউ কারো আপন নয়, তবু এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে সবাই একে অপরের আত্মীয়।
এমনই এক সকাল। ছায়া স্কুলে তখন হরফ চর্চা চলছে। শিশুদের অক্ষর শেখানোর পাশাপাশি শেখানো হচ্ছে দেশের ইতিহাস—কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান নয়, জীবিত ইতিহাস, যার রক্ত এখনো শুকোয়নি।
মঞ্জরী চিঠির মতো লিখতে বলেছিল—“তোমরা নিজের বাড়ির স্মৃতি লেখো, যদি মনে থাকে।”
একটা ছেলের লেখা:
“আমাদের বাড়ির উঠোনে একটা আমগাছ ছিল। বাবা বলতেন, আমটা পাকলে আমার জন্মদিন হয়। এখন আমি জানি না, আমার জন্মদিন কখন।”
মঞ্জরীর হাতে খাতাটা কাঁপছিল।
সেই সময় রেবতীর কাছে একটি চিঠি আসে—ঢাকার ধানমন্ডি থেকে। প্রেরক: লুৎফর রহমান, একসময় রেবতীর সহপাঠী।
“রেবতী,
তোমাদের খোঁজ পাই না। আজকাল কিছুই আগের মতো নেই। শহরের দেয়ালেও ভয় ঢুকে পড়েছে।
তবে তোমরা যদি ফিরতে চাও, জানিও—এই শহরও এখন উদ্বাস্তু। শুধু আমরা বুঝি না, আমরা সবাই হারিয়েছি কিছু না কিছু।
—লুৎফর”
চিঠিটা রেবতী পড়েন বারবার, তারপর তুলে দেন অভয়বাবুকে।
অভয়বাবু শুধু বলেন,
“এই চিঠি ভবিষ্যতের প্রমাণ—দেশভাগ কাগজে হয়েছিল, হৃদয়ে নয়।”
এদিকে ভূপাল দে চালু করেছে ছায়া স্কুলে একটি নতুন ক্লাস—‘দেশের চিঠি’।
এই ক্লাসে ছেলেমেয়েরা চিঠি লেখে—কখনো বাবাকে, কখনো দেশকে, কখনো হারিয়ে যাওয়া নদীকে।
একদিন কুসুম লিখল,
“প্রিয় পদ্মা নদী,
তুমি কি আমাকে চেনো? আমি যে সেই মেয়েটি, যার মা তোমার পাশে একদিন কাঁদতে বসেছিল। তুমি কি আমার কান্না শুনেছিলে?”
ভূপাল সেই চিঠি পড়ে বলেছিল,
“তুমি যখন নদীকেও চিঠি লিখতে পারো, তখন তোমার দেশও একদিন তোমাকে উত্তর দেবে।”
রশিদ এসময় যুক্ত হয়েছে একটি নতুন কাজে—জেলে কলোনির ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাট্যচর্চা।
প্রথম নাটক: ‘দুই পাড়ার আলো’
গল্প দুটি ভাইয়ের, যারা দুই পাড়ায় থেকে একে অপরকে ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু একদিন এক স্বপ্নে আবার মিলিত হয়।
নাটকে একটি সংলাপ ছিল:
“তুই ওপারে আছিস, আমি এপারে। কিন্তু আলো কি কোনো পাসপোর্ট মানে?”
এই নাটক দেখার পর একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছিলেন,
“এটা তো শুধু নাটক নয়—এটা তো আমাদের ব্যর্থতার খোলা দলিল।”
এদিকে অভয়বাবু গোপনে একটি উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তিনি কলকাতার বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনির পঞ্চায়েত নেতাদের নিয়ে তৈরি করতে চাইছিলেন একটি সমন্বয় পরিষদ—‘উদ্বাস্তু অধিকার সমন্বয় মঞ্চ’।
উদ্দেশ্য:
শিশুদের জন্য শিক্ষার নিশ্চয়তা
নারীদের জন্য কাজের ব্যবস্থা
পুনর্বাসন জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত
রাজনৈতিকভাবে উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধিত্বের দাবি
রেবতী বলল,
“এটা বিপজ্জনক হতে পারে।”
অভয়বাবু উত্তর দিলেন,
“ভয় দেখিয়ে যারা চুপ করাতে চায়, তারা জানে না—একবার ঘরহারা হলে, মানুষকে আর ভয় দেখিয়ে থামানো যায় না।”
সেই সময় মঞ্জরীর কলেজে এক বিতর্কের আয়োজন হয়: “দেশভাগ ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজন, না মানবিক ব্যর্থতা?”
মঞ্জরী বলল,
“দেশভাগের চেয়ে বড় ভয়াবহতা ছিল, আমাদের ভিতরে বিশ্বাসের মৃত্যু।
একটি দেশ ভাগ হয়েছিল মানচিত্রে, কিন্তু আমরা ভাগ হয়ে গেছি হৃদয়ে।”
তার বক্তৃতা হল ঠাণ্ডা, স্পষ্ট, কিন্তু তাতে ছিল আগুনের ছায়া। শেষে একজন প্রফেসর উঠে বললেন,
“মঞ্জরী, তুমি কেবল লেখো না, তুমি আমাদেরকে আমাদের ভুল স্মরণ করিয়ে দাও।”
একদিন বিকেলে ছায়া স্কুলে সব ছেলেমেয়েকে একসাথে জড়ো করা হল। অভয়বাবু বললেন,
“আজ তোমরা প্রতিজ্ঞা করো—তোমাদের কাছে এই দেশ শুধু তোমাদের ‘থাকার’ জায়গা নয়, এই দেশ তোমাদেরও, যেমন অন্যদের। তোমরা শুধু এই দেশের মানুষ নও, তোমরা এই দেশের গড়ন।”
সবাই বলল—“আমরা থাকবো, আমরা গড়ব।”
মনে হচ্ছিল, এক নতুন জাতির জন্ম হচ্ছে—যাদের পাসপোর্ট নেই, জন্মসনদ নেই, তবু আত্মপরিচয় আছে।
রাতে মঞ্জরী নিজের ডায়েরিতে লিখল—
“আজ রেবতীদি বললেন, ওর সেই পুরোনো বন্ধু ঢাকায় একা থাকে।
অথচ আমরা এখানে এতজন মিলে একটি বাড়ি তৈরি করেছি।
কে তবে উদ্বাস্তু? যে ভিটে হারায়?
না, যে হৃদয়ের বন্ধন হারায়?”
সেই রাতেই অভয়বাবু নিজের পুরোনো মানচিত্রটা খুলে দেখলেন—সেখানেও তো আছে ঢাকুরিয়া, আর আছে ধানমন্ডি।
শুধু মাঝখানে আছে একটা শূন্যতা, একটা অদৃশ্য কাঁটাতার।
তিনি মনে মনে বললেন,
“আমাদের কাজ—এই কাঁটাতার ঘিরে ভালোবাসার বাগান গড়ে তোলা।”
***
১৯৫৪ সাল। ভারতের মাটি তখন রাজনৈতিক উত্তেজনায় ঝলসে উঠছে। হায়দরাবাদ, মণিপুর, পাঞ্জাব—একেক রাজ্যে একেক রকম অস্থিরতা। উদ্বাস্তু সমস্যা যেন রাষ্ট্রের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু অনেকের চোখে সে কাঁটাকে দেখার ইচ্ছাও নেই। এই সময়, ছায়া স্কুল আর অভয় মিত্রদের ছোট গণ্ডির বাইরেও কিছু অন্ধকার শুরু হয়—যা এবার ঢাকুরিয়া পেরিয়ে কলকাতার কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে যেতে চায়।
ছায়া স্কুলের একটি ছাত্রী, নাম মালতী, একদিন আর স্কুলে ফেরেনি।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত, অভয়বাবুরা খোঁজ নিতে বেরোলেন। ট্যাংরা থেকে শুরু করে বালিগঞ্জ—শেষে এক নির্জন রাস্তায়, এক চায়ের দোকানের পেছনে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল।
সে কাঁপছিল, মুখে কথা নেই, চোখে শুধু ভয়।
রেবতী জড়িয়ে ধরেই বুঝে গিয়েছিলেন—এই শহর কেবল ঘর দেয় না, শিকারিও তৈরি করে।
পরদিন ছায়া স্কুলে এক অঘোষিত শপথ হয়। রেবতী বললেন,
“আমরা যদি কেবল পড়াই, আর পাহারা না দিই, তবে এই শহর আমাদের শিশুদের খেয়ে নেবে। এখন সময় এসেছে মেয়েদের জন্য আলাদা নিরাপত্তা গড়ার।”
ভূপাল বলল,
“এই কাঁটা শুধু শরীর ছোঁয় না, আত্মাকে রক্তাক্ত করে।
আমাদের স্কুল হবে যেন এক দুর্গ, ভিতরে ঢুকলে কেউ আঘাত পাবে না।”
এই সময় রাজনৈতিকভাবে নতুন এক চাপ আসে। রাজ্য সরকারের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছায়া স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তিনি বলেন—
“আপনাদের কাজ প্রশংসনীয়, তবে এখানে বহু অবৈধ উদ্বাস্তু আছে। রাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী, ওদের ফিরিয়ে পাঠানো উচিত।”
অভয়বাবু শান্ত গলায় বললেন,
“আপনার রাষ্ট্র কি জানে, কে ফিরবে কোথায়?
যে মেয়েটার বাবাকে নদীর পাড়ে কুপিয়ে মারা হয়েছে, তাকে কি আপনি সেই ঘরে ফেরাবেন, যেখানে এখন অন্যের রান্না চড়ে?”
সরকারি আধিকারিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু পরদিন থেকে স্কুলে আসতে থাকে একাধিক পুলিশি নজরদারি। ছাত্রদের জেরা করা হয়—“তোমার বাবা কোথায়?”, “কীভাবে এসেছিলে?”, “নাগরিকত্বের কাগজ কোথায়?”
মালতী একদিন বলল,
“আমি যদি এই দেশের না হই, তবে এতদিন থাকলাম কী করে?”
রশিদ, যিনি দিনরাত ছায়া স্কুলে কাজ করছেন, একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। শহরের বিভিন্ন থানায় খোঁজ নেওয়া হয়, কিন্তু কোনো হদিস মেলে না। দিন তিনেক পর, এক অনামী হাসপাতালে তার সন্ধান মেলে—মাথায় আঘাত, মুখে রক্ত জমাট।
হরিদাস ছুটে গিয়ে তাকে দেখে বলে,
“কারা করল এটা?”
রশিদ ধীরে বলল,
“একটা কথা বলেছিলাম—এই শহরে ওপার বাংলার মুসলমান মানেই সন্দেহ।
তাতেই ওরা বলেছিল, দেশপ্রেম শেখাবে আমাকে।”
এই ঘটনায় ছায়া স্কুলের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অভয়বাবুরা থামান, বোঝান—“এখনো আমাদের কাজ অসমাপ্ত, যুদ্ধ লড়তে গেলে অস্ত্র নয়, সাহস লাগবে বেশি।”
মঞ্জরী একটি পোস্টার লেখে—
“যে দেশে নিজের পরিচয় বলতে গেলে ভয় পেতে হয়, সেই দেশ এখনও স্বাধীন নয়।”
ছাত্ররা সেই পোস্টার হাতে নিয়ে দাঁড়ায় ঢাকুরিয়ার মোড়ে।
পথচারীরা দেখে, থেমে যায় কেউ কেউ, কেউ আবার বলে—“ওরা উদ্বাস্তু, এদের এত সাহস কেন?”
কেউ জানে না, সাহস আর স্মৃতি একসঙ্গে জন্মায়।
এদিকে, অভয়বাবুর বিরুদ্ধে সরকার একটি মামলা রুজু করে—“অবৈধ শরণার্থী লুকানোর ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতা ছড়ানোর অভিযোগে।”
একদিন ভোরে, পুলিশ আসে তাকে ধরতে।
অভয়বাবু শান্তভাবে দরজা খোলেন।
সরস্বতীদেবী চিৎকার করেন—“ও লোক তো শুধু পড়ায়, দেশ গড়তে চায়, তবু কেন?”
পুলিশের কেউ চোখ নামিয়ে রাখে।
অভয়বাবু শুধু বলেন,
“আমি ভয় পাই না। আমি ছিন্নমূল, তাই জানি—ভূমি না থাকলে মেরুদণ্ডটা সোজা রাখতে হয়।”
ছাত্ররা, প্রতিবেশীরা, এমনকি কিছু সরকারি কর্মচারীও একত্রিত হয়ে থানা ঘেরাও করে। গণস্বাক্ষর সংগ্রহ হয়। সাংবাদিকেরা ঘটনাটি তুলে ধরে। অবশেষে চাপে পড়ে অভয়বাবুকে জামিনে ছেড়ে দেয়।
ছাড়ার পর অভয়বাবু ছায়া স্কুলে ফিরে এসে বললেন—
“এই কাঁটার পথেই যদি হাঁটতে হয়, তবে আমরা হাঁটব।
কারণ আমাদের হাঁটার অর্থই হলো—ভবিষ্যতের পথ গড়ে দেওয়া।”
রেবতী, রশিদ, মঞ্জরী, ভূপাল—সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তাদের চোখে জল, মুখে জেদ।
ভূপাল বলল,
“এই যুদ্ধ যেন না শেষ হয় শুধু আমাদের হাতে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন একদিন নিজের দেশকে নিজের নামে ডাকতে পারে, চিৎকার করে বলতে পারে—‘এই দেশ আমার।’”
পর্বের শেষে মঞ্জরী নিজের ডায়েরিতে লেখে—
“আজ বুঝলাম, আমরা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
আমাদের পেছনে অতীত, সামনে অনিশ্চয়তা।
কিন্তু যতক্ষণ হাত ধরাধরি করে আছি, আমরা পড়ব না।
কারণ আমরা শুধু মানুষ নই, আমরা প্রত্যাখ্যানের উত্তর।”
***
১৯৫৫ সাল। ছায়া স্কুল এখন অনেকের কাছে শুধু এক বিদ্যালয় নয়—এক আদর্শ, এক লড়াইয়ের প্রতীক। শহরের বিভিন্ন সংবাদপত্রে মাঝে মাঝে এর নাম উঠে আসে: “উদ্বাস্তু শিশুদের জন্য গড়ে ওঠা আশ্চর্য প্রতিষ্ঠান”, “অভয় মিত্রের নেতৃত্বে এক বিকল্প বিদ্যালয়চর্চা”।
কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত—তারা জানে, এই প্রতিষ্ঠান চোখ রাঙিয়ে উঠতে পারে রাষ্ট্রের অসহায়তার দিকে। আর সেই চোখই তাদের অস্বস্তির কারণ।
একদিন বিকেলে, হঠাৎ এক সরকারি প্রতিনিধি আসেন অভয়বাবুর কাছে।
দপ্তরের নাম: উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ও উন্নয়ন মন্ত্রক।
তার কথা:
“আমরা চাই ছায়া স্কুলকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিতে। কিছু অনুদান, কিছু নিয়ম, কিছু বদল। আপনি সম্মতি দিলে, এই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি সাহায্য দিয়ে বড়ো করব।”
অভয়বাবু কিছুক্ষণ চুপ থাকেন, তারপর জিজ্ঞেস করেন,
“তবে কি শিশুরা এখন ফর্মে ‘উদ্বাস্তু’ নামে চিহ্নিত হবে? ওরা কি আবার রাষ্ট্রের ফাইলে বন্দী হবে?”
প্রতিনিধি একটু কাঁচুমাচু গলায় বলে,
“কাগজপত্র তো লাগেই, মিত্রবাবু।”
রেবতী বললেন,
“আমরা কাগজ বানাই না, মানুষ গড়ি।”
এই প্রস্তাব ঘিরে ছায়া স্কুলে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
মঞ্জরী বলল,
“সরকারি সাহায্য দরকার, কিন্তু শর্ত দিলে সেটা দান হয়ে যায়।
আর দান গিলে ফেলে আত্মমর্যাদা।”
ভূপাল বলল,
“আমরা যদি নিজেই প্রণয়নের নিয়ম বানাতে পারি, তবে সরকারকে দরজার ভেতরে ডাকা যায়। কিন্তু যদি তারা আমাদের মুখে লাগাম দিতে চায়, তবে দরজা বন্ধই ভালো।”
অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়—“সরকারি প্রস্তাব গ্রহণ নয়, সহযোগিতার ভিত্তিতে আলাপ।”
অভয়বাবু নিজে মন্ত্রকে চিঠি লেখেন:
“আমরা রাষ্ট্রকে শত্রু করি না, তবে রাষ্ট্র যদি আমাদের অস্তিত্ব নির্ধারণের চেষ্টা করে, তবে আমরা তাকে প্রশ্ন করতেই থাকব।”
এরমধ্যেই কলকাতায় ঘটে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা—মেয়ো রোডে এক বিশাল সভা: “বিচার চাই উদ্বাস্তুদের সম্মানের, ভিক্ষা নয়”।
অভয় মিত্র, রশিদ, রেবতী, ভূপাল, এমনকি ছাত্ররাও অংশ নেয়।
সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে অভয়বাবু বলেন:
“একটা সময় ছিল, আমরা নদীর কিনারে ছিলাম, এখন রেললাইনের পাশে।
তখন আমাদের উঠোন ছিল, এখন শুধু দাগ টানা খাঁচা।
তবু আমরা বেঁচে আছি—এটাই প্রমাণ, আমরা মাটি ছেড়ে পালাই না।”
সেই সভার শেষে একটি ঘোষণা হয়—উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা বোর্ড গঠনের দাবি জানানো হবে সংসদে।
মঞ্জরী পরে লিখে ফেলে এক চিঠি, পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয়:
“আমরা বারবার শুনেছি—তোমরা আমাদের ‘বহিরাগত’।
অথচ আমাদের ঘাম দিয়ে এই শহরের ইট গাঁথা,
আমাদের কান্না দিয়ে এই রাষ্ট্রের শপথ গড়া।
তবে আমরা কোথাকার লোক?”
ছায়া স্কুলে তখন এক নতুন প্রজন্ম উঠে আসছে—যারা শরণার্থী পরিচয়ে বড়ো হয়নি, কিন্তু শেকড়ের গল্প শুনে বেড়ে উঠেছে।
একদিন এক ছাত্র বলল,
“আমার দাদু বলতেন—আমরা এসেছিলাম ভেসে।
আমি বলি—আমরা গড়েছি বসে, দাঁড়িয়ে, লড়ে।”
এই নতুন প্রজন্মের হাত ধরে ছায়া স্কুলে শুরু হয় ‘উদ্বাস্তু ইতিহাস সংগ্রহ প্রকল্প’।
ছাত্ররা শহরের বিভিন্ন কলোনিতে গিয়ে গল্প সংগ্রহ করে—কে কোথা থেকে এসেছে, কেমন করে পেরিয়েছে সীমান্ত, কাকে হারিয়েছে, কোথায় আবার শুরু করেছে।
একদিন কুসুম এসে অভয়বাবুকে বলল,
“আমি একটা নাটক লিখেছি—নাম ‘রাষ্ট্রের ছায়া’।
তাতে আছে এক ছায়া, যে প্রতিদিন আকার বদলায়, কিন্তু রোদ পড়লেই আবার গায়েব হয়ে যায়।”
অভয়বাবু হেসে বললেন,
“তোমরা এই গল্পগুলো লেখো, রেখে দাও।
এইটাই হবে আমাদের দেশের বিকল্প সংবিধান—যেখানে মানুষের মুখটাই হবে আইন।”
রাতের শেষে, একদিন, অভয়বাবু ছাদে বসে আকাশ দেখছিলেন।
চোখে ছিল প্রশান্তি, পাশে ছিল সরস্বতী।
তিনি বললেন,
“এই দেশটা একদিন বদলাবে।
শুধু ভোট নয়, কণ্ঠস্বর পাবে মানুষ।
শুধু প্রার্থনা নয়, প্রতিজ্ঞা পাবে রাষ্ট্র।”
সরস্বতী বললেন,
“তুমি কী চাও?”
অভয়বাবু বললেন,
“আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর কেউ যেন ছায়া স্কুলের দেয়ালে লিখে—
‘এইখানে এক শিক্ষক ছিলেন, যিনি রাষ্ট্রের ছায়ায় মানুষ খুঁজেছিলেন।’”
***
১৯৫৬ সাল। ছায়া স্কুল গড়ে ওঠার এক দশক পূর্ণ হয়েছে। সাদা রঙের পুরনো দোতলা বাড়িটা এখন চেনা মুখের আশ্রয়, অজানা ভবিষ্যতের বীজতলা। স্কুলের নাম শহরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নীতিতে বারবার উঠে আসে এই স্কুলের উদাহরণ।
কিন্তু অভয় মিত্র জানতেন—গল্প তখনই শেষ হয় না, যখন রাষ্ট্র চায়; গল্প শেষ হয়, যখন মানুষ নিজের উত্তর পেয়ে যায়।
গ্রীষ্মের এক দিন। রেবতী সবাইকে খবর দিলেন,
“অভয়বাবু আর স্কুলে আসতে পারবেন না। ডাক্তার বলেছে, শরীর আর সঙ্গ দেবে না।”
ছাত্রছাত্রীরা স্তব্ধ। মঞ্জরী বলল,
“যিনি আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছেন, তিনি নিজে বিছানায়… এটা তো ঠিক মানা যায় না।”
এক সন্ধ্যায়, ছায়া স্কুলের সবাই একসাথে যায় অভয়বাবুর কাছে। তিনি বিছানায় শুয়ে, চোখ মেলে চুপচাপ শুনছেন সবার কথা।
ভূপাল এগিয়ে গিয়ে বলে,
“স্কুলে এখন একশোর বেশি ছেলে-মেয়ে। কুসুম নিজেই এখন শিক্ষক। হরিদাস প্রতিদিন নাটকের চর্চা করাচ্ছে। আপনি তো ছিলেন, আছেন… থাকবেন।”
অভয়বাবু হেসে বলেন,
“আমি তো শুধু রাস্তা দেখিয়েছিলাম। হাঁটতে শিখেছ তোমরা। এখন তো পালা তোমাদেরই।”
শেষদিনগুলিতে অভয়বাবু একটি চিঠি লেখেন ছায়া স্কুলের ছাত্রদের উদ্দেশে। চিঠিটি পরবর্তীতে স্কুলের মূল ভবনের প্রবেশপথে ফলকে খোদাই করে রাখা হয়।
“প্রিয় আমার ছেলেমেয়েরা,
তোমরা উদ্বাস্তু নও। তোমরা জাতির কারিগর।
যাদের ভিটেমাটি ছিল না, তারাই ঘর গড়তে জানে।
তোমরা কাঁটার পথে হেঁটে এসেছো,
এখন অন্যদের জন্য ফুল ফোটাও।
স্কুল যদি একদিন না থাকে, তবু তোমরা থাকো—
নিজের ভাষায়, নিজের সাহসে, নিজের কণ্ঠে।
কারণ এই দেশ তোমাদেরও ঠিক ততটাই,
যতটা তারা যারা কোনওদিন দেশভাগ বোঝেনি।
ভালো থেকো।
—অভয় মিত্র”
চিঠি পড়ে অনেকেই কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু সেদিন স্কুলে কোনো হাহাকার ছিল না—ছিলো এক ধরনের দৃঢ়তা, যেন শোক নয়, উত্তরাধিকার হাতে নেবার প্রস্তুতি।
অভয় মিত্র মারা যান ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে। তার অন্ত্যেষ্টিতে যারা এসেছিল, তারা কেউ আত্মীয় নয়, তবুও সবাই আপন।
মালতী বলেছিল,
“তিনি আমাদের বাবার মতো ছিলেন—যিনি জন্ম দেন না, কিন্তু বাঁচতে শেখান।”
সরকারের পক্ষ থেকে কেউ না এলেও, কলকাতার নামী পত্রিকায় পরদিন একটি পেছনের পাতায় ছোট্ট খবর বেরোয়:
“এক শিক্ষক, এক প্রতিরোধ, এক স্কুল—বিদায় অভয় মিত্র।”
তার মৃত্যুর পর, স্কুলের নেতৃত্ব নেয় রেবতী, ভূপাল, মঞ্জরী, রশিদ ও হরিদাস।
তারা সিদ্ধান্ত নেয়—স্কুলের নাম বদলাবে না। কিন্তু আরও তিনটি নতুন শাখা গড়ে তোলা হবে উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে।
আর একটি বড় সিদ্ধান্ত—স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্ম সনদ, পরিচয়পত্র ও নাগরিক নথির কাজে সাহায্য করবে তারা নিজেরাই।
মঞ্জরী বলে,
“আমরা আর পরিচয় চাই না, আমরা পরিচয় গড়ে তুলব।
রাষ্ট্র আমাদের চিনুক না চিনুক, আমরা নিজেদের চিনে ফেলেছি।”
একদিন কুসুম নিজের হাতে লেখা নতুন নাটক মঞ্চস্থ করে—নাম ‘প্রথম স্বপ্ন’।
গল্প এক ছোট্ট মেয়ের, যে নিজের ভাঙা বাড়ির ইট দিয়ে নতুন ঘর তৈরি করে।
নাটকের শেষ সংলাপ—
“আমার ঘর নেই বলে আমি ঘর বানালাম।
তোমার ঘর আছে, তাই তুমি গেট দাও।
আমার গেট নেই, তবু আমার জানালা খোলা।”
নাটকের পর দর্শকদের কোলাহল নয়, নিঃশব্দ সম্মান। একজন প্রবীণ অধ্যাপক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
“এই স্কুলের ছেলেমেয়েরা ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের ইঞ্জিন। ওদের দিকে তাকাও, দেখবে একটি জাতির পুনর্জন্ম।”
সেই বছর শীতের শুরুতে, ছায়া স্কুলের সামনের দেওয়ালে নতুন এক লাইন আঁকা হয়:
“আমরা ছিন্নমূল নই—আমরা শিকড় খোঁজার নাবিক।”
এই লেখাটার নিচে ছাত্ররা নিজের নাম স্বাক্ষর করতে শুরু করে—একটা পরিণত প্রজন্ম, যারা এখন নিজের স্বরে কথা বলে।
গল্পের একদম শেষে, মঞ্জরী একদিন নিজের ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—
“তখন আমরা জানতাম না, আমরা ইতিহাসের অংশ।
জানতাম না, স্মৃতিরা এত ভারী হতে পারে।
তবু ভালোবাসা আর জেদের ভেতর দিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম এক ঠিকানায়।
সেই ঠিকানার নাম—নিজের মুখে নিজের নাম বলা।
সেই নাম, কেউ আর আমাদের কেড়ে নিতে পারবে না।”
শেষ