অগ্নিবেশ চৌধুরী
অধ্যায় ১: তাম্রফলক ও শবসাধনার ছায়া
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিচের ঘরটায় বাতাসের গায়ে পুরোনো কাগজের গন্ধ আর মাটির গন্ধ একসঙ্গে লেপ্টে থাকে। চারদিকে পুরোনো প্রত্নবস্তু, কাঠের খোলসের ভেতরে রাখা বস্তুর উপর ঝুলছে ট্যাগ — “কালিম্পং, ১৮৭২”, “রামেশ্বরম, ১৯২৯”… সেই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ড. ঋষভ সেন। বয়স পঁইত্রিশ, গায়ে ছিপছিপে শরীর, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, এক হাতে গ্লাভস পরা, অন্য হাতে এক ধূসর ধাতব পাত।
“তাম্রফলক,” পাশ থেকে বলল সহকারী প্রত্নতত্ত্ববিদ অন্বেষা রায়। “কিন্তু এই লিপিটা তো খুব অদ্ভুত… নাগরি নয়, ব্রাহ্মি নয়… এটা কি আদৌ চেনা কোনো লিপি?”
ঋষভ তাকালেন ফলকের গায়ে খোদাই করা অক্ষরগুলোর দিকে। দেখতে একরকম সর্পিল, যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়েছে, মাঝেমাঝে চোখের মত দেখতে চিহ্ন, আবার কোনো চিহ্ন যেন চোখ বুজে থাকা মুখের মত।
“এটা… কায়থি বা সিদ্ধাম লিপির বিকৃত রূপ হতে পারে। কিন্তু এই দাগগুলো দেখো অন্বেষা, শুধু ধর্মীয় নয়, রীতিমতো আচারিক—এটা তন্ত্রসাধনার লিপি।”
“তন্ত্র?” অন্বেষা কিছুটা অবাক, কিছুটা অস্বস্তিতে বলল, “মানে সেই শবসাধনা, কালি-তন্ত্র এসব?”
ঋষভ মৃদু হাসলেন। “আসলে তন্ত্রসাধনা মানেই অন্ধকার নয়। এর পেছনে গভীর দর্শন আছে। কিন্তু হ্যাঁ, এই ফলকে যে জিনিসের ইঙ্গিত আছে, তা শান্তিময় নয়।”
“এটা কোথায় পাওয়া গেছে?” অন্বেষা জিজ্ঞেস করল।
“বীরভূম জেলার এক ছোট গ্রামে, নদীর ধারে এক পোড়া ঘরের ভিতর। পুরোনো এক বাড়ি ভেঙে পড়েছিল—সেখান থেকে।”
ঋষভ আরেকটু সামনে এগিয়ে ফলকের নিচে খোদাই করা একচিলতে ছায়াময় প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালেন। সেখানে কালি মূর্তির নিচে আগুনের আলোকছায়ায় বসে আছে এক নারী, তার চোখ খোলা—কিন্তু তার শরীর যেন মৃত, স্থির।
“শবসাধনা,” ঋষভ বললেন ধীরে, “মা কালীকে প্রীত করার সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পন্থা। তারাপীঠ ছাড়া অন্য কোথাও এত বিশুদ্ধভাবে এই সাধনার চিহ্ন মেলে না।”
“তাহলে আমাদের যেতে হবে?”
ঋষভ মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। তারাপীঠ।”
তারাপীঠে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধে নামল। বাইরের পৃথিবীর তুলনায় এখানকার সময় যেন একটু আলাদা ভাবে চলে। শ্মশানের ধারে নদী, নদীর ওপারে সন্ধ্যার আলোয় বয়ে যাওয়া ধোঁয়া, আর মাঝেমাঝে একরকম সানাইয়ের মতো শব্দ—যেন বহু শতাব্দী ধরে এখানে কিছু একটা চলেই যাচ্ছে।
ঋষভ আর অন্বেষা উঠেছিলেন আশ্রমপাড়ার এক পুরোনো অতিথিশালায়, যার পেছনেই মহাশ্মশান। ওখানকার কর্তৃপক্ষ কড়া গলায় বলেছিল—“রাত্রে বাইরে বেরনো নিষেধ, বিশেষ করে নতুন চেহারা।”
কিন্তু রাত একটা নাগাদ, নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন ঋষভ। পেছন থেকে অন্বেষা ডাকল, “তুমি যাচ্ছো?”
“এখনই না গেলে বুঝব না। আজ অমাবস্যা। আজ রাতেই শবসাধনা হয়।”
“তোমার ধারণা সত্যি হলে, এই তাম্রফলক তাদেরই কোন এক পূর্বপুরুষের দিক থেকে আসা…”
ঋষভ কিছু বললেন না। পায়ে পায়ে এগোলেন মহাশ্মশানের দিকে। মহাশ্মশান। রাত প্রায় দুটো। দূরে শবদাহ হচ্ছে—আলোর কম্পন যেন ছায়াগুলোকে নেচে উঠতে বাধ্য করছে। গাছের মাথায় শকুন। বাতাস ভারী, যেন ধূপ আর কিছু পচা গন্ধ একসঙ্গে।
ঋষভ ধীরে ধীরে এগোলেন। নদীর ধারে একটা জায়গায় আট-দশজন লোক গোল হয়ে বসে আছে। কারো পরনে গেরুয়া, কারো আবার কালো কাপড়। একদম মাঝে বসে আছেন এক বৃদ্ধ, তাঁর চোখ বন্ধ, হাতে কর্পূর আর রক্তমাখা ফুল। এক নারীর শব রেখে সাধনা শুরু হচ্ছে।
হঠাৎই সেই বৃদ্ধ চোখ খুলে বললেন—“কে আছিস ওখানে?”
ঋষভ চমকে উঠলেন। তাঁর শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
“এগিয়ে আয়। তুই তো ডাকার শব্দ পেয়েছিস।”
“আমি…” ঋষভ একটু এগিয়ে এলেন। “আমি একজন গবেষক। এই তাম্রফলকের খোঁজে এসেছি।” তিনি ব্যাগ থেকে ফলকটি বের করে দেখালেন। সবাই একযোগে চুপ। তারপর সেই বৃদ্ধ হেসে উঠলেন, “শেষ পর্যন্ত তুই এসেছিস… নতুন রক্ত… নতুন পথ। কালী ডাকছেন।”
সেই মুহূর্তে, ফলক নিজে থেকে গরম হয়ে উঠল। তার উপর খোদাই করা প্রতিচ্ছবিটা যেন নড়ে উঠল। আর তারপর—ভোররাতে অন্বেষা হঠাৎ ঘুম ভেঙে অনুভব করল, দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ।
দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ মহিলা। চোখে অপার রহস্য, কপালে রক্তবিন্দু।
“ডাক এসেছে। তৃতীয় পীঠে যেতে হবে। তারাপীঠ আর কামাখ্যার বাইরে এক জায়গা আছে—লুকিয়ে আছে। তোর বন্ধু সেটা খুলে ফেলেছে।”
“কে আপনি?” অন্বেষা ভীতসন্ত্রস্ত।
“আমি? আমি সেই শব, যার উপর দাঁড়িয়ে ছিল তোর অতীত।”
মহিলা উধাও হয়ে গেলেন। ঋষভ পরদিন সকালে চোখ মেলেন এক গা ছমছমে ঘরে। তার তাম্রফলক নেই। মুখোমুখি বসে আছে কালো পোশাক পরা এক বৃদ্ধ সাধক।
“তুই ওটা খুলে ফেলেছিস। কামাখ্যার রক্ত এখনও জেগে আছে। তার পরের পথটা… শুধু সাহসীরা যেতে পারে।”
“কোন পথ?”
“তৃতীয় পীঠ।”
সেই কথা বলেই সাধক উঠে দাঁড়ালেন। তার পায়ের নিচে ছায়া নেই।
অধ্যায় ২: তারাপীঠে আগুন ও আগমনের নিশান
তারাপীঠের সকাল একটা অদ্ভুত আবেশে ঢাকা থাকে। এখানে দিন আর রাতের মধ্যে ফারাকটা শুধুই আলো আর অন্ধকারের নয়—এখানে সময় একটা ঘূর্ণায়মান শক্তি, যেটা কখনও অতীত, কখনও ভবিষ্যৎ, আবার কখনও কিছুই নয়।
ড. ঋষভ সেন জেগে উঠেছিলেন ধাতব চাটাইয়ের ওপর, যার নিচে ছিল শীতল পাথরের মেঝে। মাথায় ঝিম ধরে ছিল, আর চোখ খুলতেই তিনি দেখতে পেলেন একখানা ধূপকাঠি ধুঁয়ে ধুঁয়ে নিভে যাচ্ছে।
কিন্তু তাঁর মন আটকে ছিল একটাই প্রশ্নে—“তৃতীয় পীঠ”? এটা কী? এবং কাল রাতে তাঁর সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল?
ঘরের দরজায় হালকা শব্দ হলো।
অন্বেষা রায় ভেতরে ঢুকলেন—চোখে উদ্বেগ, হাতে একটা কাপড় মোড়া বস্তু।
“তুমি জানো এই কাপড়টা কোথা থেকে এসেছে?” তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।
ঋষভ কাপড়টা খুলে দেখতে পেলেন এক ছোট্ট ধাতব শিবলিঙ্গ আর তাম্র ফলকের ঠিক অনুরূপ খোদাই করা আরেকটি বস্তু—এইবার একটিতে স্পষ্ট লেখা:
“অগ্নিতত্বে প্রবেশ না করলে তন্ত্রজাগরণ সম্পূর্ণ হয় না। আগুনের পরেই তৃতীয় পীঠ।”
ঋষভ চমকে উঠলেন।
“তার মানে… এই ফলক কেবল মানচিত্র নয়, এটি একটি তান্ত্রিক সূচক…।”
“আগুনের পরেই তৃতীয় পীঠ মানে কী?” অন্বেষা জিজ্ঞেস করলেন।
ঋষভ ধীরে মাথা তুললেন।
“আজ রাতেই বোঝা যাবে। আজ সন্ধ্যায় আমরা মন্দির চত্বরের সেই পুরোনো গলিটায় যাব—যেখানে এখনও কেউ যায় না। আমি গতকাল সেই দিকেই গিয়েছিলাম।”
সন্ধে নামতেই চারদিকে এক অদ্ভুত সুর বাজতে শুরু করল। তান্ত্রিকদের স্তোত্র, ঢাকের শব্দ আর কিছুর ধোঁয়া মিশে গিয়ে তৈরি করল একটা ঘোর।
ঋষভ আর অন্বেষা ঘুরে ঘুরে গেলেন মন্দিরের পেছনের দিকে। ভীড় কম, আলো কম, আর পেছনে এক সরু গলি—সেখানেই নাকি বহু আগে এক পুরোনো শ্মশান ছিল, যেটা এখন চাপা পড়ে গেছে।
গলির শেষে তাঁরা এসে দাঁড়ালেন এক আধাপড়া শিবমন্দিরের সামনে। দরজা নেই, ছাদ ধসে গেছে অনেকখানি, কিন্তু ভিতরে এক জায়গা অদ্ভুতভাবে চকচক করছিল—যেন কেউ ধূপ জ্বালিয়ে রেখেছে।
ঋষভ মাটি থেকে একটা পোড়া পাথর তুলে নিলেন। সেটা গরম।
“কেউ এখানে সদ্য আগুন জ্বালিয়েছে,” তিনি ফিসফিস করে বললেন। “এখানেই… কিছু হচ্ছে।”
তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতেই এক মহিলা এসে হাজির হলেন। বয়স আন্দাজ করা যায় না। মাথা ভর্তি ছাই, চোখে লাল সিঁদুরের মতো কিছু।
“আগুন জেগে উঠেছে, ডাকও এসেছে,” তিনি বললেন।
“তোমাদের একজন যাবে, আর একজন দেখবে… শুধু দেখবে।”
“মানে?” অন্বেষা চমকে উঠলেন।
“ঋষভ সেন, তুমি এসেছ কেন জানো?”
“তোমার পূর্বপুরুষ ছিলেন এক অগ্নিসাধক। কামরূপে তিনি শেষসাধনা করেন, কিন্তু তৃতীয় পীঠে পৌঁছনোর আগে তাঁর মৃত্যু হয়।”
ঋষভ মাথা নিচু করলেন।
“তুমি তাঁর বংশধর। আর তোমার মধ্যে সেই শক্তি আছে।”
“কিন্তু তুই পাবে শুধু যদি সাহস করে আগুনের মধ্য দিয়ে যেতে পারিস।”
মধ্যরাত। সেই ধ্বংসপ্রায় শিবমন্দিরের ভেতরে ছোট এক অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হয়েছে। চারদিকে বৃত্ত আঁকা লাল গেরুয়া দিয়ে, ছাই আর পাঁশ দিয়ে প্যাঁচানো মন্ত্রলিপি।
মাঝে বসে আছেন সেই রহস্যময়ী বৃদ্ধা, যিনি নিজেকে “তৃতীয়া” নামে পরিচয় দিলেন।
“এই নাম কেউ রাখে না। এই নাম কেবল যারা তন্ত্রের পথ জানে, তাদেরই দিয়ে থাকে,” তিনি বললেন।
ঋষভকে ডাকা হলো মাঝখানে। তাঁকে শিখানো হলো এক বিশেষ মুদ্রা, এক মন্ত্র—“অগ্নিনাগায় নমঃ তন্ত্রদ্বারায় নমঃ”।
তারপর তাঁকে বলা হলো, “এই আগুনে প্রবেশ করতে হবে। যদি তুমি সত্যিকারের সাধক হও, আগুন তোমায় গ্রাস করবে না।”
“আর যদি না পারি?”
“তাহলে তুই হারিয়ে যাবি… শুধুই ছায়া হয়ে থাকবি এই মহাশ্মশানে।”
ঋষভ পা বাড়ালেন আগুনের দিকে। প্রথমে মনে হল ধোঁয়া মুখের কাছে আসছে। তারপর গরম হাওয়া। তারপর এক অদ্ভুত আলো—সোনালি, তামার মতো লাল, আর ভিতরে একটা দরজা।
হ্যাঁ—আগুনের মধ্যে সত্যি একটা দরজা!
তিনি চোখ বন্ধ করলেন। তারপর ঢুকে পড়লেন…
আকাশ যেন নীল, তবুও অন্ধকার। চারদিক ফাঁকা, আর সামনে একটা খণ্ডিত মন্দির, যার মাথা ভাঙা, কিন্তু ভিতরে এক তাম্র শিবলিঙ্গ। তার পাশে লেখা- “ত্রিকোণ শুরু হয়েছে।”
পেছনে দাঁড়িয়ে অন্বেষা কাঁপছিলেন। আগুন নিভে গেছে। কোথাও কেউ নেই।
ঋষভ গায়েব।
তৃতীয়া তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “ও এখন তান্ত্রিক সময়ের মধ্যে চলে গেছে। কামাখ্যার পথে, তৃতীয় পীঠের দিকে।
“আমাকে কিছু করতে হবে না?” অন্বেষা কাঁপা গলায় বললেন।
তৃতীয়া মৃদু হাসলেন।
“তুইও আসবি। কিন্তু তোর পথ শরীরের নয়—মন আর স্মৃতির। তোর মধ্যেও আছে পীঠের রক্ত।”
অধ্যায় ৩: মহাশ্মশান ও তান্ত্রিক কাহিনি
কামাখ্যার রাত একরকম জীবন্ত সত্তা। পাহাড় ঘেরা নিঃসঙ্গতা, শূন্য মন্দিরপ্রাঙ্গণ, আর মাঝে মাঝে অস্পষ্ট ঢোল-ঝাঁঝরির শব্দ যেন আদি কোনো যজ্ঞের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
ঋষভ সেন অচেতন অবস্থায় উঠে বসেন এক পুরনো গুহার ভিতরে। মাথায় ধাতব চুম্বকের মতো ভারি অনুভূতি। তাঁর চারপাশে ধূপ, চন্দনের গন্ধ, আর এক অদ্ভুত লালাভ আলো। এটা স্বপ্ন নয়—এটা তান্ত্রিক সময়, যা বাস্তবের গায়ে আরেক স্তর টেনে দেয়।
এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। মাথায় লাল চাদর, কপালে শ্রীচক্র আঁকা, চোখে গভীর শূন্যতা
“অগ্নিতপ থেকে তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ, এবার কামাখ্যার পথ,” তিনি বললেন।
ঋষভ ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “তৃতীয় পীঠ কোথায়? কেন আমি?”
বৃদ্ধ শুধু বললেন, “তুমি অগ্নিসাধকের বংশধর। তোমার রক্তেই গোপন তান্ত্রিক চিহ্ন। আর তৃতীয় পীঠ, সে আত্মপ্রকাশ করবে শ্মশানের দ্বারে।”
অন্যদিকে, অন্বেষা তারাপীঠে ফিরে গিয়েছেন। তৃতীয়া তাঁকে একটি কালীমূর্তির পেছনে থাকা চেম্বারে নিয়ে গেলেন।
“এই ঘরটা সময়ের নয়, স্মৃতির,” তৃতীয়া বললেন। “তুই চোখ বন্ধ করে দ্যাখ, কী দেখিস।”
অন্বেষা চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেলেন এক দৃশ্য—এক তরুণী, মুখ ঢাকা, লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে কামাখ্যার পথে। চারপাশে অগ্নিশিখা। তরুণীর হাতে এক কাঁসার থালা, তাতে রক্ত।
হঠাৎ সে বলল, “আমিই ছিলাম শেষ রক্ষাকর্ত্রী। আমার রক্ত দিয়েই খোলে তৃতীয় পীঠের পথ।”
চোখ খুলতেই অন্বেষা বুঝতে পারলেন—এই তরুণী তাঁর নিজের পূর্বপুরুষী। তাঁর মধ্যেই ছিল সেই পথের চাবি।
ঋষভ কামাখ্যায় পৌঁছান এক অদ্ভুত মন্দিরের সামনে—সাধারণ পর্যটকদের দৃষ্টির বাইরে। সেখানে মাটির তলায় খোঁজ পান এক গোপন দরজা। দরজার ওপর লেখা: “মহাশ্মশানের আগে সময় থামে। এরপরই মুক্তি, অথবা মৃত্যু।”
দরজা খুলতেই তিনি নামতে থাকেন এক সরু গুহায়। নিচে ধীরে ধীরে শব্দ বাড়তে থাকে—মন্ত্রোচ্চারণ, ঢাক, নারীর আর্তচিৎকার।
নিচে পৌঁছে তিনি দেখতে পান এক গঠন—চক্রাকারে সাজানো তান্ত্রিকেরা, মাঝখানে একটি কঙ্কালসার শরীর, তার কপালে লেখা একটি মন্ত্র: “বিন্দুতে ব্রহ্মাণ্ড, মৃত্তিকায় মুক্তি।”
ঋষভ হতবাক। এই তান্ত্রিকরা যেন তাঁর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল।
তাদের গুরু বলে ওঠে: “তৃতীয় পীঠ কোনো স্থান নয়, এটি একটি ঘটনা। এমন এক মুহূর্ত, যখন স্মৃতি, রক্ত ও সময় একত্রিত হয়। সেই মুহূর্তে পীঠ খোলে।”
“তুমি ও সেই মেয়ে—তোমরা দুই প্রান্তের চাবি। কিন্তু পীঠ খোলে শুধু ‘মহাশ্মশানে’। যেখানে শরীর আর আত্মার সীমারেখা মুছে যায়।”
ঋষভ প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু সেই মহাশ্মশান কোথায়?”
উত্তর এল, “তারাপীঠে, যেখানে তুমি জন্মেছিলে, আর সে মেয়ে যেখানে রক্ত দিয়েছিল। তোমাদের দু’জনের একত্রে যাওয়া ছাড়া পথ খুলবে না।”
অন্বেষা ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন তাঁর পূর্বপুরুষীর আত্মা তাঁর মধ্যেই সঞ্চারিত। তিনি সিদ্ধান্ত নেন—ঋষভকে খুঁজে বার করতেই হবে।
এদিকে, ঋষভ ধীরে ধীরে তারাপীঠে ফিরছেন। তাঁর হাতে এখন এক পুরনো তাম্র পুঁথি—যেখানে তৃতীয় পীঠের অন্তিম ধাপের মন্ত্র লেখা।
তাদের পুনর্মিলন হবে এক মহাশ্মশানে, যা শুধু নির্দিষ্ট মুহূর্তে উপস্থিত হয়। আর তখনই খুলবে তৃতীয় পীঠের আসল রহস্য।
অধ্যায় ৪: মহাশ্মশানে মিলন ও মৃত্যুর খেলা
তারাপীঠের আকাশ যেন কেমন অস্বাভাবিক। মেঘ নেই, অথচ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পঞ্চমী রাত। মহাশ্মশান আজ ‘জীবন্ত’। মানুষের ভিড় নেই, কেবল কয়েকজন সন্ন্যাসী ধূপ জ্বালিয়ে কিছু প্রাচীন মন্ত্র পড়ছেন। ঋষভ এসে দাঁড়ান শ্মশানের প্রবেশদ্বারে, সেই পুরনো শ্মশান যেটি পূর্বপুরুষদের অন্তিম সংস্থানের স্থান। ঠিক তখনই অন্বেষা এসে পৌঁছায়। চোখে চোখ পড়ে তাদের।তাদের দুজনের গলায় কালো সুতোয় বাঁধা এক একটি তাম্রতালিকায় খোদাই করা প্রতীক—একত্র হলে একটি পূর্ণ শ্রীচক্রের গঠন হয়।
মুহূর্তেই বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। শ্মশানের ভেতর থেকে উঠে আসে শাদা ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়ার মধ্যে দেখা যায় একটি পুরনো দরজা—যা আগে ছিল না। দরজা খোলে না হাত দিয়ে। দরজায় লেখা: “যার রক্ত স্মৃতির জন্ম দেয়, তার ছায়া দিয়ে খুলবে দ্বার।”
অন্বেষা ধূপের ধোঁয়ায় নিজেকে ঘিরে নেয়। সে ধীরে ধীরে ছায়া হয়ে যায়। তখনই দরজা খুলে যায়।
ভেতরে প্রবেশ করতেই চারপাশের দৃশ্য পাল্টে যায়। যেন তারা পৌঁছেছে এক অনন্ত তান্ত্রিক ক্ষেত্র। মাটির রং লাল। আকাশ নেই, কেবল ঘূর্ণায়মান আগুনের বলয়। মাঝখানে এক সিংহাসন, তাতে বসে এক নারী—দেখলে বোঝা যায়, তিনি দেবী নন, তবে দেবীর ছায়া।
তিনি বলেন: “তোমরা দুই আত্মা—রক্ত ও স্মৃতির ধারক। শেষ তপস্যা এখন শুরু। যদি সফল হও, তৃতীয় পীঠ খুলবে। না হলে এইখানেই ফুরোবে তোমাদের পথ।”
অধ্যায় ৫: তৃতীয় পীঠের দ্বার ও রক্তের মন্ত্র
ঋষভ ও অন্বেষা যখন সেই তান্ত্রিক ক্ষেত্রের ভেতরে প্রবেশ করল, তখন তারা বুঝতেই পারেনি সময় আর বাস্তবতার মধ্যে সীমারেখা কবে মুছে গেছে। সেই নারীমূর্তি—যিনি দেবী নন, তবে দেবীর ছায়া—চোখে তাকিয়ে রইলেন তাঁদের দিকে। তাঁর কণ্ঠস্বর যেন আদি যুগের সুরেলা বজ্র।
“তোমরা আত্মার যুগ্মবিন্দু। রক্ত আর স্মৃতি মিললেই খোলে তন্ত্রলোকের তৃতীয় স্তর। তবে চাইলেই তা পাওয়া যায় না। তার জন্য দরকার আত্মত্যাগ, আর প্রয়োজন তপস্যা।”
তিনি এক অঙ্গুলি তুলে নির্দেশ করলেন সামনের দিকে। একটি গিরিখাদ। তার নিচে রয়েছে এক বৃত্তাকারে আঁকা শ্রীচক্র—কিন্তু তা রক্তে আঁকা, জীবন্তভাবে স্পন্দিত।
“এই ক্ষেত্র—’অন্তঃপীঠ’। এখানে আত্মা মেলে তার পূর্ব জন্মের ছায়াকে। তোমাদের পথ এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু।”
হঠাৎ করেই অন্বেষার সামনে দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। সে দেখে এক নারীর আত্মত্যাগ—এক পুরনো সভ্যতায়, যেখানে তান্ত্রিক বলির মাধ্যমেই খোলা হত আত্মার দরজা। মেয়েটি তার পূর্বপুরুষী, যাকে ‘দেবীকন্যা’ বলা হত। কামাখ্যার মন্দিরেই হয়েছিল সেই রক্তবলির অনুষ্ঠান।
সে দেখতে পায়, মেয়েটি নিজের হাতে শরীর কেটে রক্ত দিয়েছিল, আর সেই রক্ত দিয়ে আঁকা হয়েছিল পীঠমণ্ডল। তার রক্তেই খুলেছিল এক শূন্য দরজা—ঠিক সেই দরজা, যেটির সামনে আজ সে দাঁড়িয়ে। ঋষভ দেখেন তাঁর পূর্বপুরুষ—নামহীন এক আগুনসাধক। যিনি যজ্ঞের আগুনে প্রবেশ করেছিলেন আত্মজ্ঞান ও তন্ত্রসাধনার পরম উদ্দেশ্যে। সেই আগুন এখনও তাঁর শরীরে বহন করছে এক চিহ্ন, যেটি জেগে উঠছে অন্বেষার উপস্থিতিতে।
দেবীর ছায়া বললেন,
“এই পীঠের দ্বার খোলে না কোন জপে, না কোন তেলোত্তম মন্ত্রে। খোলে শুধুমাত্র ত্রয়ী সংযোজনে—রক্ত, স্মৃতি, ও সময়। তোমরা প্রস্তুত?”
ঋষভ এবং অন্বেষা একত্রে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তখন তাদের সামনে উপস্থাপিত হল দুটি রূপালি কাঁসার পাত্র, তাতে ছিল একটি ছুরি, আর পাশে এক প্রাচীন পুঁথি—যেখানে মন্ত্র লেখা অক্ষর নয়, রক্তে।
পুঁথিতে লেখা ছিল: “যে রক্ত বহন করে পূর্বতন আত্মার ঘ্রাণ, সে রক্তই খোলে সময়ের দরজা।”
তাদের প্রত্যেককে নিজের রক্ত দিতে হবে, তারপর সেই রক্ত দিয়ে শ্রীচক্র পুনরায় অঙ্কন করতে হবে। সে চক্র পরিপূর্ণ হলেই দরজা খুলবে। রক্ত দেওয়া শুরু করল অন্বেষা। তার রক্ত পড়তেই মাটি কেঁপে উঠল। তারপর ঋষভ। তাঁর রক্ত যেন আগুনের মতো উষ্ণ, মাটি ধীরে ধীরে ফেটে চক্রের রেখা তৈরি করে চলেছে। একটি সময়ের পর চক্রটি সম্পূর্ণ হল। সঙ্গে সঙ্গে এক প্রবল বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল, আর দিগন্তরেখা ফেটে বেরিয়ে এল একটি উজ্জ্বল আলো—তার মধ্যেই দেখা গেল সেই তৃতীয় পীঠের দ্বার।
তৃতীয় পীঠের ভিতর প্রবেশ করতেই তারা পৌঁছে এক গুহার মতো স্থানে, যেখানে চারপাশে ঝুলছে অদ্ভুত প্রতিকৃতি—কিছু নারী, কিছু পুরুষ, চোখ বন্ধ, যেন ঘুমিয়ে আছে চিরকালীন তপস্যায়। মাঝখানে রয়েছে একটি আয়না। কিন্তু সে আয়নায় দেখা যায় না নিজের মুখ, দেখা যায় নিজের আত্মার পূর্বজন্ম।
অন্বেষা দেখে, তার চোখে চোখ রেখে এক কিশোরী বলছে,
“আমিই তুই, তুই-ই আমি। আমাদের রক্ত ভাগাভাগি করা নয়, এক। আমার ত্যাগেই তুই পথ পেলি, তোর দ্বারেই আমি মুক্তি পাব।”
ঋষভ দেখতে পায় এক যুবক, আগুনে বসে ধ্যানরত, যার কপালে লেখা এক অদ্ভুত সংকেত—”অগ্নিবিন্দু অমরত্ব।”
দেবীর ছায়া আবার বললেন, “এই পীঠ শুধু জানে সত্য আত্মা কার। কেউ পাবে দৃষ্টি, কেউ হারাবে অস্তিত্ব। পরীক্ষার শেষ স্তর এখন।”
দেবীর ছায়া তাঁদের দুজনের সামনে তুলে ধরলেন একটি বাটিতে রাখা ‘রক্তমন্ত্র’। এটি এক বিশেষ তরল, যা পান করলে একদিকে পাওয়া যায় সর্বজ্ঞতা, অন্যদিকে হারানো হয় জীবনসত্তার একাংশ।
ঋষভ অন্বেষার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই না থাকলে এ পথ আমি চিনতাম না। এই পথ তোর জন্য, আমিও যাব, তবে হয়ত ফিরব না।”
অন্বেষা বলল, “তুই হারালে আমি পথ পামু না। আমরা একসঙ্গে এসেছি, একসঙ্গে যাব। যদি মরণও হয়, তবু হোক একসঙ্গে।”
তারা একত্রে পান করল সেই রক্তমন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে এক ভীষণ ঝড় ওঠে, গুহা কেঁপে ওঠে, আয়নাগুলি ভেঙে পড়ে, প্রতিকৃতিরা চোখ খুলে তাদের দিকে চেয়ে থাকে।
আর তখনই দরজার ওপার খুলে যায়। তারা এসে দাঁড়ায় এক উঁচু স্তম্ভে, যার ওপরে লেখা: “এইখানেই ব্রহ্মাণ্ডে আত্মার শিকড়। যে জানে, সে হারায়। যে হারায়, সে জানে।”
তাদের সামনে ভেসে ওঠে একটি ত্রিকোণ শ্রীচক্র, তার মাঝখানে অগ্নি, পাশে তিনটি রক্তের ধারা। পীঠের সত্যতা খুলে পড়ে তাদের সামনে। তৃতীয় পীঠ—তা কোনও স্থান নয়। তা এক মহামুহূর্ত, যেখানে আত্মা আর শরীরের ফারাক মুছে যায়, আর মানুষ দেখে তার সমস্ত জন্মের ইতিহাস, ভবিষ্যৎ, আর অস্তিত্বের মূল। ঋষভ ও অন্বেষা তখন একে অপরের দিকে তাকায়। কোনো কথা নেই, কেবল অনুভব।
তাদের শরীর ধীরে ধীরে ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায়। কোথাও হারায় না, বরং ছড়িয়ে পড়ে চক্রের ভেতর। তারা হারায় না। রয়ে যায় তন্ত্রলোকের চিরন্তন প্রহরী হয়ে। আর সেই পীঠ? তা খুলে যায় শুধু তখনই, যখন আর কেউ সেই রক্তমন্ত্রের পথে হাঁটে।
অধ্যায় ৬: শবসাধনার ছায়াপথ
দরজা পার হতেই ঋষভ ও অন্বেষা পৌঁছল এমন এক জায়গায়, যেখানে আলো বলতে ছিল শুধু তামাটে লালাভ জ্যোৎস্না, আর গন্ধে মিশে ছিল কর্পূর, মোম, আর দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা রক্তের শীতল ঘ্রাণ। চারপাশে সারি সারি পড়ে আছে শব—তবে তারা পচে যায়নি, যেন কারও অদৃশ্য নির্দেশে চিরকালীন ঘুমে আচ্ছন্ন।
এমন সময়, সেই নারীমূর্তি, যিনি বারবার তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন, আবারও উদয় হলেন। এবার তাঁর রূপ বদলে গেছে—চুল এলোমেলো, গলায় কপালভস্ম, আর কণ্ঠস্বরে যেন বজ্রের চেয়েও গভীর কিছু।
তিনি বললেন— “তোমরা এখন প্রবেশ করেছ শবসাধনার ছায়াপথে। এখানে মৃত নয়, জীবিতরাও শব। নিজের অস্তিত্বকে ছিন্ন করে যে সাধনা করা যায়, তাই আসল তন্ত্র।”
তাদের সামনে উঠে এল এক বিশাল গোলাকার বেদী, যার মাঝখানে শুয়ে আছে একটি শব। তাকে ঘিরে আছে আটটি মণ্ডল, প্রতিটি মণ্ডলে বিভিন্ন প্রতীক—ত্রিশূল, ডোম, খড়গ, কর্পূর, রক্ত, অশ্ব, শঙ্খ আর খপ্পর।
নারীমূর্তি বললেন, “এই মৃতদেহ কোন সাধারণ শব নয়। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে চেতনার গহ্বর। একে জাগিয়ে তুলতে হলে চাই আট চক্রের শুদ্ধ বোধ।”
প্রতিটি চক্রে একটি করে পরীক্ষা। শুরু হল প্রথম চক্র—ত্রিশূল চক্র। সেখানে প্রবেশ করতেই ঋষভ দেখে সে তার নিজের অতীতকে হত্যা করছে—নিজের মোহ, লোভ, অহংকারকে এক এক করে খড়গ দিয়ে ছিন্ন করছে।
অন্বেষা যায় কর্পূরের চক্রে। সে দেখে এক আগুনের নদী, যাতে সে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছে। তার স্মৃতির সমস্ত বিষ, দুঃখ, হতাশা ধুয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
সাতটি চক্র পার হওয়ার পর, তারা পৌঁছে গেল অষ্টম চক্রে—যেখানে সময় স্থির, শব্দ স্তব্ধ, হৃদয় নীরব। শবটি তখন ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলে,
“জীবনের চেয়ে মৃত্যুই বিশুদ্ধ। কারণ মৃত্যুর ভেতরেই জন্ম হয় প্রকৃত সত্যের।”
এই শব আসলে এক প্রাচীন তান্ত্রিক সাধক, যিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন, যাতে ভবিষ্যতের কোনও এক যুগে তাঁর চেতনা এসে জীবিতকে পথ দেখায়।
তিনি বললেন, “তোমরা যারা রক্ত দিয়েছ, শ্রীচক্র পূর্ণ করেছ, তারা এখন আর দেহ নয়, তোমরা চেতনার ধারক। এবার তোমাদের যেতে হবে শেষ পথের দিকে, যেখানে দেবী নিজে অপেক্ষা করছেন। তবে মনে রেখো—যে একবার শবসাধনায় প্রবেশ করে, সে আর আগের মানুষ থাকে না।”
অন্ধকার ঘন হতে থাকে চারপাশে। হঠাৎ এক বিশাল দরজা খুলে যায়, তার ওপারে শোনা যায় চণ্ডীর স্তোত্র, ঢাকের আওয়াজ, আর নারীকণ্ঠে ক্রমাগত উচ্চারিত মন্ত্র: “কালী কালী মহাকালী, শ্মশানবাসিনী মা কালী…”
ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন তিনটি নারীচরিত্র—ত্রিদেবী রূপে তাঁরা: তারা, কামাখ্যা, আর কালী। তিনজন একত্রে বললেন,
“তোমরা শেষের পথে এসে পৌঁছেছ। এখানে ত্যাগ ছাড়া কিছু নেই। যদি সর্বশক্তি পেতে চাও, তবে সর্বপ্রিয় কিছু দিতে হবে।”
ঋষভ ও অন্বেষার মধ্যে নিরবতা নেমে আসে। তারা বুঝতে পারে—সাধনার এই স্তরে পৌঁছানো মানেই কোনো এক মূল আত্মত্যাগ। এই পর্যায়ে তাদের বলা হয়—তাদের প্রিয় একটি স্মৃতি বা অনুভূতি যা সবচেয়ে বেশি গভীর, তা উৎসর্গ করতে হবে।
অন্বেষা স্মরণ করে তার মা’র সাথে শেষ দেখা, যখন ছোটবেলায় মা তাকে কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল, “তুই আলোর মধ্যে থাকিস।” সে সেই স্মৃতি বিসর্জন দেয়। সেই মুহূর্তে তার চোখের জল জমে এক শঙ্খে রূপান্তরিত হয়।
ঋষভ মনে করে তার প্রথম ভালবাসা, যে এখন নেই, কিন্তু একসময় তার হৃদয়জুড়ে ছিল। সেই অনুভূতির ছেড়া স্মৃতি দিয়েই সে উৎসর্গ করে নিজের চৈতন্যের একাংশ।
দেবীরা বলেন, “এবার তোমরা প্রস্তুত শেষ দ্বারে পৌঁছতে—যেখানে তোমাদের অপেক্ষা করছে ত্রিকোণতন্ত্রের শেষ চূড়া।”
অধ্যায় ৭: ত্রিকোণতন্ত্রের উত্তরাধিকার
তারা যখন তিন দেবীর অনুমতিক্রমে সেই মহাদ্বার পেরোল, তখনই যেন পৃথিবীর সব শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের চারপাশে কেবল জ্বলন্ত লালাভ কুয়াশা, মাঝে মাঝে দিগন্তে উজ্জ্বল নীলাভ ঝলকানি। তারা পৌঁছাল এক বিশাল শ্মশানমঞ্চে—কিন্তু এখানে মৃত্যু নয়, বরং জন্ম হচ্ছিল ত্রিকোণতন্ত্রের চূড়ান্ত সাধনার।
এই জায়গায় সময় থেমে থাকে না, বরং নিজের ছায়াকে খেয়ে নেয়। একজন বৃদ্ধ তান্ত্রিক বসে ছিলেন ত্রিকোণ আকৃতির তাম্রবেদীতে, চোখ বন্ধ, ত্বকে অগ্নিশিখার মত ছোপ।
তাঁকে জাগানোই ছিল শেষ চ্যালেঞ্জ। তিনি ত্রিকোণতন্ত্রের সর্বশেষ ধারক—তাঁর শরীরে জমে আছে দেবীর সমস্ত প্রাচীন মন্ত্র।
ঋষভ ও অন্বেষার সামনে তুলে ধরা হল দুটি আয়না—যাকে বলে “আত্মান্নায়ন দर्पণ”। এতে তারা দেখতে পেল নিজেদের এমন এক রূপ, যা কখনোই তারা মেনে নিতে পারেনি।
ঋষভ দেখে, সে এক ভিন্ন সংস্করণ—নির্মম, লোভী, ক্ষমতা-পিপাসু। সে আঁতকে উঠে পিছিয়ে যায়। অন্বেষা দেখে, তার চিরশক্তিশালী, ভয়হীন রূপ—যা সে বরাবর চাপা দিয়ে এসেছে সমাজের ভয়ের কারণে।
দেবীরা বললেন,“এই রূপই তোমাদের ভিতরের সত্য। মেনে নিতে পারো, তবে ত্রিকোণতন্ত্রে প্রবেশ সম্ভব।”
তারা নিজের সেই রূপকে জড়িয়ে ধরে, নিজেরই অন্ধকার ও আলোককে মিশিয়ে ফেলে এক চক্রে।
জ্যোৎস্নার মাঝে, তিন কোণ নিয়ে তৈরি এক বেদীর উপর স্থাপিত হল একটি খপ্পর। তার ভেতর লাল অগ্নি জ্বলছে, যেন আত্মার গভীরতম উত্থান। দেবীরা বললেন,
“এই হলো ত্রিকোণজ্যোতি—যে একবার তা গ্রহণ করে, সে আর মানুষ থাকে না, সে হয় শক্তির ধারক। কিন্তু এই আগুনে ঢুকতে হয় সমস্ত ভয়, সম্পর্ক, পরিচয় ফেলে।”
ঋষভ অন্বেষার দিকে তাকাল—তারা জানে, এ একপথের শেষ, আর অন্য এক অস্তিত্বের শুরু। তারা একসাথে সেই অগ্নিতে পা রাখল। মুহূর্তেই তারা অনুভব করল—এক বিশাল রক্তবর্ণ তরঙ্গে তারা ডুবে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে হৃদয়ের সমস্ত চেম্বার খুলে গেছে।
জ্ঞান ফিরে এলে, তারা দেখতে পেল সেই বৃদ্ধ তান্ত্রিক উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মুখে অমোঘ হাসি। তিনি বললেন,
“তোমরাই এবার উত্তরাধিকার। তন্ত্র শুধু মন্ত্র নয়, শক্তির সদ্ব্যবহার—অন্ধতা আর জ্ঞানের মাঝের সেতু। তোমরা যদি সত্যিকারের সাধক হতে চাও, তবে তোমাদের কাজ এখন শুরু।”
তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় দুটি লাল রক্তপত্রে লেখা প্রাচীন মন্ত্রগ্রন্থ—যাতে লেখা আছে কালী, তারা ও কামাখ্যার সংযোগমন্ত্র। তিনি বলেন,
“এই ত্রিকোণতন্ত্র আজ থেকে তোমাদের। তবে মনে রেখো, তন্ত্র শক্তি যেমন দেয়, তেমনি বিচারও করে।”
সব কিছু থেমে যায়। তারা চোখ খুলে দেখে, তারা আবার দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘরে, যেখানে প্রথমবার প্রতীকটা খুলে পেয়েছিল। তবে সময় কেটে গেছে মাত্র ১২ ঘণ্টা। পৃথিবী বদলায়নি, কিন্তু তারা বদলে গেছে চিরতরে।
অন্বেষা বলল, “এটা কোনও শেষ নয়। বরং শুরু।”
ঋষভ হাসল। তাদের সামনে পড়ে আছে সেই রক্তপত্র আর একগুচ্ছ ছাই। ভবিষ্যতের পথে তারা হাঁটা শুরু করল—তন্ত্রের নবযুগের বার্তাবাহক হয়ে।
অধ্যায় ৮: দেবীর দৃষ্টি ও লাল জ্যোৎস্না
সেই রাত ছিল পূর্ণিমা। আকাশে লালচে রূপালি জ্যোৎস্না, যেন রক্তে ধুয়ে এসেছে চাঁদ। ঋষভ ও অন্বেষা তখন শহরের এক অচেনা ছাদে দাঁড়িয়ে—যেখানে তাদের তন্ত্রসাধনার নতুন কেন্দ্র তৈরি হতে চলেছে। দেবীর বার্তা ছিল স্পষ্ট—তাদের এখন তৈরি করতে হবে নতুন তান্ত্রিক মণ্ডল, যেখানে শক্তি আর জ্ঞান মিলেমিশে নতুন যুগের তান্ত্রিক উত্তরাধিকার গড়ে তুলবে।
হঠাৎই শোনা গেল গলায় ঝাঁঝালো স্বর—এক বৃদ্ধা, শ্মশানসন্ন্যাসিনী, মাথায় খোঁপা, গলায় করোটি মালা। তিনি বললেন, “শোনো, শেষটা এখনও হয়নি। কলিযুগে যখন বিশ্বাস হারায়, তখন তন্ত্র ফিরে আসে নতুন রূপে। তোমরা সেই রূপ।”
তিনি অন্বেষার হাতে তুলে দিলেন একটি লাল কাপড়ে মোড়া প্রাচীন শঙ্খ। “যেদিন সত্যি বিপদ আসবে, এই শঙ্খ বাজিও। দেবী নিজেই উত্তর দেবেন।”
তাদের সামনের চ্যালেঞ্জ একটাই—তাদের স্বাভাবিক জীবন কি শেষ হয়ে গেল? বন্ধু, পরিবার, সামাজিক পরিচয়—সব কি মুছে যাবে এই নবশক্তির পথে?
অন্বেষা বলল, “তন্ত্র তো নিজেকে চেনার পথ। আমাদের পালিয়ে গেলে চলবে না। বরং থাকি মানুষের মাঝে, কিন্তু ভেতরে বহন করি এই জ্ঞান।”
ঋষভ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তারা ঠিক করল, তারা নিজের জীবনে ফিরে যাবে—কিন্তু আর আগের মানুষ থাকবে না। তারা হয়ে উঠবে এক প্রহরী—দেখবে কোথায় ছায়া জমে, আর তার মধ্যে আলো ছড়িয়ে দেবে। তারা আবার একবার কামাখ্যা মন্দিরে গেল। ভোরের প্রথম আলোয়, তারা হাঁটু গেড়ে বসে থাকল মূল গর্ভগৃহের সামনে। তাদের চোখে জল, কপালে ধুলো।
“তুমি আমাদের ডাক দিয়েছিলে,” অন্বেষা বলল, “আমরা এসেছিলাম, খুঁজেছিলাম, পেয়েছি। এখন তুমিই পথ দেখাও, মা।”
হঠাৎ করে মন্দিরের ভিতর থেকে এক অদ্ভুত সুগন্ধ এল—চন্দন, রক্তচন্দন আর জবা ফুলের গন্ধ। তারপর সেই চেনা স্বর—দেবীর কণ্ঠস্বর।
“তোমরা তো পথিক নও, তোমরাই তো পথ। এখন থেকে প্রতিটি ছায়া যখন ভয় আনবে, তোমরা আলো হয়ে দাঁড়াবে।”
তারা শুরু করল এক নতুন কাজ—কলকাতার প্রান্তে এক পুরনো পোড়োবাড়িতে তৈরি করল ‘ত্রিকোণ আশ্রম’। এখানে এসে জড়ো হল আরও কজন—ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ভয়, ভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে। কেউ এসেছেন আত্মহত্যার দ্বার থেকে ফিরে, কেউ এসেছেন শবসাধনার ক্লেদ থেকে আলোর সন্ধানে।
এখানে তারা শেখায় না শুধু মন্ত্র, শেখায় নিজের ভয়কে চিনতে, নিজের ভিতরের দেবীকে জাগাতে।
ঋষভ বলল এক নতুন শিষ্যকে, “তন্ত্র মানে নিজেরই প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়ানো। ভয় পেও না, যে তুমিই দেবী বা ভৈরব, তা মানতে পারলে শক্তি জাগে।”
পূর্ণিমার রাতে, আশ্রমে বসেছে এক বিশেষ যজ্ঞ। চারদিক জ্যোৎস্নায় ধোয়া, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে লাল জ্যোতির রেখা। অন্বেষা শঙ্খ বাজাল—তাতে কেবল শব্দ নয়, উঠে এল এক লাল কম্পন, যেটা পৌঁছে গেল বহু দূর, অন্য অন্য অনামা শক্তির মাঝে। ঋষভ মন্ত্রপাঠে ডুবে, আর তার পেছনে তারা, কালী, কামাখ্যার প্রতিকৃতি। যেন তিন শক্তির ত্রিবেণী স্রোত বইছে এই আশ্রমে।
এই নয় উপসংহার। বরং শুরু হল এক নতুন সময়চক্র—যেখানে বিশ্বাসের নামে ভয় নয়, বরং আত্মজ্ঞানের দীপ্তিতে জেগে উঠবে মানুষ। ত্রিকোণতন্ত্র আবার ফিরে এল পৃথিবীর বুকে—মানবের মধ্যেই দেবীর নতুন অবতার হয়ে।
সমাপ্ত