নন্দিনী গঙ্গোপাধ্যায়
অধ্যায় ১
অনিক তার জীবনের অচেতন চলাচলে প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। দিনে দিনে সেই একঘেয়ে দিনগুলো যেন তার বাঁচার উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছিল। কলেজের ক্লাসগুলোতে তার আগ্রহ ছিল না, জীবনের প্রতি আর কোনো আকর্ষণ বোধ করছিল না। সকালে উঠে কলেজে যাওয়া, ক্লাসে বসে থাকা, কিছু না বলেই আবার ফিরে আসা—এভাবেই কেটে যাচ্ছিল তার প্রতিটি দিন।
ছেলেটি স্বভাবতই চুপচাপ ছিল, কিন্তু এখন তা বেশি প্রকট হচ্ছিল। তার বন্ধুরা বলত, “অনিক, তুমি খুব বদলে গেছো, কিছু বলো না, হাসছো না, তোকে কী হচ্ছে?” কিন্তু সে এসবের কোনো উত্তর দিতে পারত না। জীবনের প্রতি এক ধরনের অজ্ঞতা, অযত্ন এবং অসন্তোষ জমে উঠেছিল তার ভেতরে।
কেউ যদি তাকে প্রশ্ন করত, “তুমি কেমন আছো?”, তবে সে কেবল মুচকি হাসত, উত্তর দিত না, কিংবা খুব সাধারণভাবে বলত, “ভাল আছি।” কিন্তু আসলে তার মন কোথাও ছিল না। প্রতিটি সকাল, প্রতিটি বিকেল, প্রতিটি রাত যেন এক ধরনের শ্রান্তি ছিল। কিছুই তাকে আগ্রহী করে তুলছিল না। তার মনের মধ্যে এক ধরনের ভারী শূন্যতা ছিল, যা তাকে সর্বদা তাড়া করত।
এই ধরনের নিঃসঙ্গতার মধ্যে একদিন, অনিক ক্লাস শেষে ফিরে এসে তার ডেস্কে কিছু অদ্ভুত কিছু দেখে। সেখানে একটি লাল গোলাপ রাখা ছিল। গোলাপের পাপড়িগুলো সোনালি সূর্যের আলোতে যেন আরও রঙিন হয়ে উঠেছিল। প্রথমে সে ভাবল, এটি হয়তো কোনো বন্ধুর শখ বা মজার ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু কিছুটা অবাক হয়ে সে গোলাপটি হাতে নিল।
কেউ কিছু বলল না, এবং গোলাপের আশেপাশে কোনো চিহ্ন বা কার্ডও ছিল না। সেখানেই গোলাপটি রাখা ছিল, এবং অনিক বুঝতে পারছিল না কেন এটি সেখানে ছিল। তবে সে মনের মধ্যে কিছু একটা অনুভব করছিল—কোনো অদ্ভুত আকর্ষণ।
তবে তার এই সন্দেহও খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। হয়তো এটি কোনো ভুল বোঝাবুঝি, অথবা কোনো স্নেহপূর্ণ বন্ধুর এক ধরণের মজা ছিল। কিন্তু তার মনে যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল, তা ছিল প্রবল। সেই গোলাপের ঘ্রাণ এবং সৌন্দর্য যেন অনিককে অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল।
এরপরও সে কিছুটা অবাক হয়ে গোলাপটির দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু দ্রুত তার মন ঘুরে গেল অন্যদিকে। “এগুলো কিচ্ছু না, শুধুমাত্র একটা ফুল,” সে নিজে নিজে বলল। তবে তার ভেতরে যেন একটি খোঁচা অনুভূত হচ্ছিল। তখনই সে প্রথমবার বুঝতে পারল, তার জীবনে কিছু পরিবর্তন আসতে চলেছে।
অধ্যায় ২
পরের দিন কলেজে পৌঁছে অনিকের মনটা কেমন অস্থির লাগছিল। তার ভেতর অজানা এক অনুভূতি খেলে যাচ্ছিল। কালকের সেই লাল গোলাপটা যেন তার মনোজগতকে এলোমেলো করে দিয়ে গেছে।
কলেজের করিডোরে পা রাখতেই তার মনে পড়ল—ডেস্কের ওপর সেই গোলাপটা! সে দ্রুত ক্লাসরুমে ঢুকে নিজের ডেস্কের দিকে তাকালো। তার বুক ধকধক করছিল। প্রথমে ভেবেছিল—হয়তো কেউ মজা করে রেখেছিল, আজকে কিছু থাকবে না। কিন্তু সেখানে আবারও একটি লাল গোলাপ রাখা!
অনিকের চোখে বিস্ময়ের ছায়া ফুটে উঠল। কালকের মতোই আজও কোনো কার্ড নেই, কোনো চিঠি নেই—শুধু সেই টকটকে লাল গোলাপ। পাপড়িগুলো যেন রক্তে ভিজে রয়েছে। একটা অজানা শিহরণ বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে।
সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে নিল। ফুলটা তুলে নিল হাতে। পাপড়ির কোমলতা, কাঁটার তীক্ষ্ণতা—দুটোই সে অনুভব করল একসাথে। কাঁটার খোঁচায় আঙুলে সামান্য রক্ত বেরিয়ে এলো। এবার আর সেই রক্তের ব্যথা তাকে তেমন বিচলিত করল না। বরং তার ভেতরে একটা কৌতূহল, একটা অজানা টান তৈরি হলো।
“কেউ কি আমাকে লক্ষ্য করছে?”—মনে মনে ভাবল অনিক। আবার মনে হলো, হয়তো কোনো মেয়ে, হয়তো সে ভয় পাচ্ছে তার সামনে আসতে। নাহলে কে এভাবে প্রতিদিন লাল গোলাপ রেখে যাবে?
টিফিনের সময় বন্ধু রাহুল এসে পাশের চেয়ারে বসল। সে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, আবার গোলাপ পেয়েছিস? কে দিচ্ছে তোকে এসব?” রাহুলের চোখে কৌতূহল আর মজা দুটোই মিশে ছিল।
অনিক একরকম গম্ভীর গলায় বলল, “জানি না। কিন্তু এটা খুব অদ্ভুত না? প্রতিদিন একইভাবে গোলাপ রাখা হচ্ছে। কোনো চিঠি নেই, কিছু নেই।“
রাহুল হেসে উঠল, “হয়তো তোকে পছন্দ করে কোনো মেয়ে। লাজুক মেয়ে—সামনাসামনি বলতে পারছে না, তাই গোলাপ রেখে যাচ্ছে।“
অনিক ঠোঁট চেপে হাসল না। তার মনের ভেতর কেবল গোলাপের রহস্যটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার বুকের ভেতর অজানা উত্তেজনা। কিন্তু কেন যেন এই আনন্দের মধ্যে একটা অস্বস্তি মিশে যাচ্ছিল।
সন্ধ্যায় কলেজ ছুটি হলে অনিক ধীরে ধীরে করিডোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই মনে হলো, কেউ তার পেছনে পা টিপে টিপে হাঁটছে। সে তাড়াতাড়ি পেছনে তাকাল। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। কেবল ফাঁকা করিডোর, ছায়া আর নিস্তব্ধতা।
তার বুকের ধকধক বেড়ে গেল। “কেউ কি আমায় অনুসরণ করছে? নাকি আমার মনের ভুল?” — সে নিজেকে প্রশ্ন করল।
সন্ধ্যার আলো ফিকে হয়ে এলে কলেজের বাগানটা কেমন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যেই লাল গোলাপের ঝাড়গুলো কালো ছায়ার মতো ভয়ংকর লাগে। অনিকের মনে পড়ল, ছোটবেলায় অন্ধকারে সে প্রায়ই ছায়ামূর্তির মতো কারো উপস্থিতি অনুভব করত। সেই অনুভূতি যেন আবার ফিরে এলো।
সে নিজের হাতে ধরা গোলাপটা শক্ত করে ধরল। মনে হলো, এই গোলাপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই অজানা মেয়েটি। হয়তো সে-ই এই রহস্যময় গল্পের সূত্রপাত করেছে। নাকি সবই অনিকের কল্পনা?
রাতের বেলায় ঘরে ফিরে অনিক ব্যাগ থেকে সেই লাল গোলাপগুলো এক এক করে বের করল। টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল। প্রায় সাত-আটটি গোলাপ। প্রতিটি গোলাপের পাপড়ি যেন কিছু বলছে। যেন কোনো বার্তা আছে, যা অনিক পড়তে পারছে না।
হয়তো এই গোলাপগুলোই অনিকের জীবনে কিছু ঘটাবে। ভালো কিছু না খারাপ—সে জানে না। কিন্তু তার নিস্তেজ দিনগুলোতে এই গোলাপের রং যেন একটা রহস্যের আভা ছড়িয়ে দিল। হয়তো অনিকের গল্প এখনই শুরু হলো।
অধ্যায় ৩
রাতের অন্ধকারে ঘরের মধ্যে সেই লাল গোলাপগুলো যেন আরও অদ্ভুত লাগছিল অনিকের কাছে। একটা করে ফুল সে হাতে নিয়ে দেখল, পাপড়িগুলোর ভেতরে কী যেন লুকিয়ে আছে। প্রতিটি গোলাপের কাঁটা তার আঙুলে খোঁচা দিচ্ছিল, কিন্তু অনিক যেন সেই ব্যথায় অজানা আনন্দ খুঁজে পেয়েছিল।
সারারাত ঘুম এল না। ঘরের কোণায় রাখা গোলাপগুলোর ছায়া পড়ছিল দেয়ালে। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ায় সেই ছায়াগুলো আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অনিকের মনে হলো, এই ফুলগুলো শুধু ফুল নয়, এরা কথা বলে, এরা হাসে, এরা কাঁদে। সে বারবার ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ঘুমের আগেই অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার ঘরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে।
সকালে অনিক কলেজের পথে বেরিয়ে গেল। গতকালকের ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। কলেজের গেট দিয়ে ঢুকেই তার মন কেমন কেঁপে উঠল। কারো চোখে চোখ পড়ল না, তবু মনে হচ্ছিল, কেউ তাকিয়ে আছে। ক্লাসে ঢুকে দেখল, আজও সেই গোলাপ তার ডেস্কের ওপরে রাখা। তবে আজকের গোলাপে একটা ভিন্নতা ছিল।
সেই লাল পাপড়িগুলোর ভেতরে সাদা কাগজের ছোট্ট টুকরো। অনিকের বুক কেঁপে উঠল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা তুলল। তাতে লেখা—
“তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো, অনিক?”
অনিকের হাত কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল না, এটা কে লিখল। লেখাটা সুন্দর হাতে লেখা, নিখুঁত অক্ষর। মেয়েলি হাতের লেখা। তার মন অদ্ভুতভাবে শিহরিত হয়ে উঠল।
“বিশ্বাস করো?”—এই কথাটার মধ্যে এক ধরনের আকুতি ছিল। যেন কেউ ভয় পেয়ে বলছে, ‘আমায় ছেড়ে যেও না’।
ক্লাসে স্যারের গম্ভীর কণ্ঠে অনিকের মনোযোগ ছিন্ন হলো। তাড়াতাড়ি কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। তার মন কেবল সেই লাইনেই আটকে রইল—“তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো?”
ছুটির পর করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় অনিকের মনে হলো, কেউ তার পেছনে হাঁটছে। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ফাঁকা করিডোর। দেওয়ালের কোণায় ছায়ার মতো কিছু নড়ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। অনিক ভেবে পেল না, এটা তার মনের ভুল, নাকি সত্যি কেউ আছে।
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কাগজের টুকরোয় সেই একই লেখা দেখতে পেল—“তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো, অনিক?”
এই লেখাগুলো যেন তার চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সে আর স্রেফ কাকতালীয় ঘটনা মনে করতে পারল না। তার মনে হলো, কেউ তার জীবনে ঢুকে পড়ছে, অদৃশ্য কোনো ছায়া। তার নিস্তেজ দিনগুলোতে এই অদ্ভুত ছায়া যেন ভয় আর ভালোবাসা একসাথে নিয়ে আসছে।
রাতের বেলায় অনিক আবার সেই লাল গোলাপগুলোর দিকে তাকাল। মনে হলো, প্রতিটি গোলাপের পাপড়ির আড়ালে সেই ছায়া লুকিয়ে আছে। তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ। এই ছায়া কি সত্যি কোনো মেয়ে? নাকি অনিকের মনের সৃষ্টি?
হয়তো সময়ই সেই উত্তর দেবে।
অধ্যায় ৪
পরের দিন কলেজে আসার আগেই অনিকের মন ভরে গেল অজানা শঙ্কায়। কাল রাতে অদ্ভুত ছায়ার ভাবনাগুলো ঘুমোতে দেয়নি। বারবার মনে হচ্ছিল, সেই লাল গোলাপের আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা সে বুঝতে পারছে না।
কলেজে পৌঁছেই ক্লাসরুমের দিকে ছুটল। আজকে কি আবার সেই গোলাপ থাকবে? তার বুক ধকধক করছিল। ক্লাসরুমে ঢুকেই নিজের ডেস্কের দিকে তাকালো। আজও সেই লাল গোলাপ, কিন্তু আজ পাপড়িগুলো আরও উজ্জ্বল, যেন আগের দিনের তুলনায় লাল রংটা আরও বেশি গাঢ়। তার পাশে রাখা কাগজের টুকরোতে লেখা—
“আমি খুব কাছেই আছি, অনিক।”
অনিকের হাত কাঁপতে লাগল। খুব কাছেই? কে খুব কাছে? সে আতঙ্কে চারপাশে তাকাল। বন্ধুরা সবে এসে বসছে। কেউ তো তাকে লক্ষ্য করছে না। তবু মনে হলো, কোনো চোখ যেন তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে অদৃশ্যভাবে।
রাহুল হেসে বলল, “কিরে, তোর প্রেমিকা মনে হচ্ছে এবার সত্যি দেখা দিতে চলেছে!”
অনিক কৃত্রিম হাসি দিল। কিন্তু তার ভেতরে এক অজানা স্রোত বইতে লাগল। কে এই মেয়ে? কোথায় আছে সে? আর কী চায় সে অনিকের কাছ থেকে?
ক্লাসের পর অনিক সোজা কলেজের বাগানের দিকে গেল। সেখানে লাল গোলাপের ঝাড়গুলোয় বসন্তের শেষ রঙ। গাছের নিচে ছায়া ঘন হয়ে আছে। হঠাৎ করেই ঝোপের ভেতর থেকে মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
“অনিক, তুমি কি আমাকে খুঁজছো?”
অনিক চমকে উঠল। চারপাশে তাকাল—কেউ নেই। আবার সেই কণ্ঠস্বর—“অনিক, তুমি কি আমাকে খুঁজছো?”
সে ভয়ে পেছিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু পা যেন মাটিতে আটকে গেল। কণ্ঠস্বর এবার আরও কাছে মনে হলো। হঠাৎ করেই ঝোপের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো এক মেয়ের অবয়ব। মাথায় খোলা চুল, সাদা কামিজ, পায়ের নীচে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। চোখে অদ্ভুত এক গভীরতা, যেন হাজার বছরের রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে।
মেয়েটি মৃদু হাসল, “আমি জানতাম তুমি আসবে, অনিক।”
অনিকের কণ্ঠ শুকিয়ে এলো, “তুমি কে? তুমি কি—তুমি সেই মেয়ে, যে এই লাল গোলাপগুলো রেখে যাচ্ছো?”
মেয়েটি চোখ মুছে বলল, “তুমি কি আমায় বিশ্বাস করবে, অনিক? আমি এখানে আছি, তবু তোমার সামনে নেই। আমি—”
কথা শেষ করার আগেই হাওয়ার ঝাপটায় পাপড়িগুলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মেয়েটি হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেল। কেবল সেই লাল গোলাপের গন্ধটা ভাসতে থাকল বাতাসে।
অনিক হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়েটি কি সত্যিই এখানে ছিল? নাকি কেবল তার মনের কল্পনা?
বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ছটফট করছিল। এই রহস্যের জালে সে জড়িয়ে যাচ্ছে। তার নিস্তেজ দিনগুলোতে এই লাল গোলাপই যেন নতুন কোনো রঙের আভাস নিয়ে এলো। আর সেই রঙের নাম—অজানা প্রেম।
অধ্যায় ৫
পরের কয়েকদিন অনিকের দিনরাত্রি কেটে যাচ্ছিল সেই মেয়েটির অদৃশ্য উপস্থিতির মাঝে। কলেজে গেলে প্রতিদিন তার ডেস্কের ওপর থাকত সেই লাল গোলাপ। কখনো কাগজের ছোট্ট টুকরো, কখনোবা শুধু গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে থাকত। অনিকের মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো অজানা গল্পের নায়ক হয়ে গেছে, যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ে নতুন রহস্যের বাঁক।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করে অনিকের মনে হলো, কেউ তার পিছু নিচ্ছে। রাস্তার পাশের গাছের ছায়ার ফাঁক দিয়ে যেন কেউ তাকিয়ে আছে। বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল সে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। তবু সেই অদৃশ্য চোখের স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠছিল।
রাতে খাওয়ার টেবিলে মা বারবার অনিককে জিজ্ঞেস করছিল, “কিরে, মন খারাপ নাকি?” অনিক কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলেছিল, “না তো, সব ঠিক আছে।” কিন্তু তার ভেতরে ঠিকঠাক কিছুই ছিল না। প্রতিটি নিশ্বাসে লুকিয়ে ছিল অজানা ভয় আর রোমাঞ্চ।
রাত গভীর হলে সে ল্যাম্পের আলোয় বসে সেই কাগজের টুকরোগুলো একে একে খুলে পড়তে লাগল। প্রতিটি কাগজে বারবার লেখা—“তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো, অনিক?”
কোনো কাগজে আবার লেখা—“আমি তোমার খুব কাছেই আছি, অনিক। তুমি কি আমাকে খুঁজছো?”
অনিকের মনে হতে লাগল, এই মেয়েটি কেবল গোলাপের মধ্যে নয়, বরং তার ঘরের অন্ধকার কোণেও লুকিয়ে আছে। তার নিঃশ্বাসে, তার স্বপ্নে, এমনকি তার ঘুমের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে।
একদিন দুপুরে কলেজের লাইব্রেরিতে বসে অনিক বই পড়ছিল। হঠাৎ করে পেছনের শেলফের ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ দেখতে পেল। চমকে গিয়ে তাকাতেই মেয়েটি আবার মিলিয়ে গেল। অনিক উঠে দৌড়ে গেল শেলফের আড়ালে, কিন্তু কাউকে পেল না।
পাশের টেবিলে বসা লাইব্রেরিয়ান অনিককে দেখে বলল, “কিরে, এমন অস্থির কেন?”
অনিক ম্লান হেসে বলল, “কিছু না, হয়তো চোখের ভুল।”
কিন্তু তার বুকের ভেতর ঠিকই অনুভব করল—এটা চোখের ভুল নয়। কেউ তাকে খুঁজছে, বা হয়তো সে-ই কাউকে খুঁজছে।
পরদিন সকালে কলেজের মাঠে বসে অনিক ভাবছিল, যদি মেয়েটি সত্যিই কোনো বাস্তব মেয়ে হয়, তাহলে সে কেন সামনে এসে কথা বলছে না? কেন এই রহস্য, এই লুকোচুরি?
হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে সেই মেয়েটির হাসির শব্দ ভেসে এল। অনিকের গা শিউরে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে গাছটার আড়ালে তাকাল, কিন্তু কেউ নেই। কেবল বাতাসে লাল গোলাপের গন্ধ ভাসছে।
তখনি পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট খাম নজরে এলো। কাঁপা হাতে সেটা তুলল। খাম খোলার পর ভেতরে লেখা—
“আমি চাই, তুমি আমার সত্যিকারের পরিচয় জানো। কাল দুপুর তিনটায় কলেজের পেছনের বাগানে এসো। —তোমার অদৃশ্য মেয়ে।”
অনিকের বুক ধুকধুক করতে লাগল। এতদিনের ধোঁয়াশার জাল যেন কেটে যাওয়ার সুযোগ এল। এইবার সে সত্যিই মুখোমুখি হবে সেই মেয়ের সঙ্গে।
কিন্তু তার ভেতরের আরেকটা কণ্ঠস্বর বলল, “তুমি কি প্রস্তুত, অনিক? এই প্রহেলিকার মায়াজালে পা রাখার জন্য?”
অনিক জানত না, কাল কী অপেক্ষা করছে তার জন্য—ভালোবাসা, না ভয়াবহ কোনো অন্ধকার!
অধ্যায় ৬
কলেজ শেষ হওয়ার পর অনিকের মন উথাল-পাথাল করছিল। বারবার মনে পড়ছিল সেই খামের লেখা—“কাল দুপুর তিনটায় কলেজের পেছনের বাগানে এসো।” এতদিনে যেন এই রহস্যময় ছায়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কা আর কৌতূহল একসাথে খেলা করছিল।
ঘড়ির কাঁটা যখন দুইটে পঁয়তাল্লিশ বাজাল, অনিক ধীরে ধীরে কলেজের পেছনের বাগানের দিকে হাঁটতে লাগল। গাছপালার ফাঁকে সূর্যের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। পাখির ডাকও যেন থমকে গেছে। সেই বাগানটায় পা রাখতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। বাতাসে লাল গোলাপের গন্ধ ভাসছে, আর অদ্ভুতভাবে চারপাশের নীরবতা ঘন হয়ে উঠেছে।
একটা গোলাপের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে চারপাশে তাকাল। কোনো সাড়া নেই। তবু তার মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কোনো চোখ তাকে দেখছে। হঠাৎ ঝোপের ফাঁক দিয়ে মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেল। সেই হাসিটা কানে লেগে হিমেল স্রোতের মতো বয়ে গেল অনিকের সারা শরীরে।
“অনিক, তুমি এসেছো?”
অনিক চমকে পেছন ফিরে তাকাল। গাছের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো সেই মেয়েটি। মাথায় খোলা চুল, চোখে একরাশ অনির্বচনীয় দুঃখ। সে সাদা কামিজ পরেছে, পায়ের নিচে লাল গোলাপের পাপড়ি বিছানো।
মেয়েটি ধীরে ধীরে অনিকের দিকে এগিয়ে এলো। “অনিক, এতদিন ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুমি আমাকে দেখতে পাবে কিনা, জানতাম না। কিন্তু আজ তুমি এসেছো, তাই আমি খুব খুশি।”
অনিক কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কে? কেন এই গোলাপগুলো রেখে যাচ্ছো?”
মেয়েটি হাসল। তার চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল অদ্ভুত জলরেখা। “আমি…আমি তোমার স্মৃতির মেয়ে, অনিক। তোমার মনেই আমার বাস। সেই প্রথম দিন থেকে যখন তুমি এই গোলাপ বাগানে দাঁড়িয়ে একটা লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে ছিলে। আমি তখনই জন্ম নিয়েছিলাম—তোমার একাকীত্বে, তোমার কল্পনায়, তোমার ভালোবাসার ইচ্ছেতে।”
অনিক হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। “তুমি…তুমি কি কেবল আমার কল্পনা?”
মেয়েটি মাথা নাড়ল। “না, আমি কল্পনা নই। আমি তোমার মনের সেই অংশ, যে ভালোবাসা পেতে চায়, যাকে তুমি খুঁজতে চাও। এই লাল গোলাপগুলো আমাদের দুইজনের ভালোবাসার প্রতীক।”
অনিকের চোখে পানি চলে এলো। “তাহলে কি তুমি বাস্তবে নেই?”
মেয়েটি এগিয়ে এসে তার হাতে একটা লাল গোলাপ তুলে দিল। “আমি আছি, অনিক। ঠিক এই গোলাপের মতোই—বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে। যখন তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে, তখনই আমি সত্যি হয়ে উঠব। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?”
অনিকের হাত কাঁপছিল। সে সেই লাল গোলাপের পাপড়ি ছুঁয়ে দেখল। তার মনে হলো, সেই পাপড়ি থেকে মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে—“ভালোবাসা মানে বিশ্বাস, অনিক।”
অনিক মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।”
সেই মুহূর্তে বাতাসে লাল গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মেয়েটি হেসে উঠল, আর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে হতে বলে গেল, “আমি আছি, অনিক, সবসময় আছি—তোমার মনেই।”
অনিক ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। বুঝতে পারল, এই মেয়েটি আসলে তার মনেরই প্রতিচ্ছবি, তার অবচেতন ভালোবাসা, তার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। সেই বাগানে দাঁড়িয়ে সে প্রতিজ্ঞা করল—এই মেয়েকে, এই লাল গোলাপকে সে কখনো ভুলবে না।
কেননা, ভালোবাসা আসলে সত্য আর কল্পনার মাঝখানের এক প্রহেলিকা।
অধ্যায় ৭
অনিকের জীবন ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে উঠল। প্রতিদিনের ক্লাস, বন্ধুরা, মা—সবই আগের মতোই ছিল। তবু তার মনের ভেতর অদ্ভুত এক পরিবর্তন অনুভব করছিল। সেই বাগানের দিনটার পর থেকে আর কোনো লাল গোলাপ তার ডেস্কে রাখা হচ্ছিল না। কিন্তু সে জানত, মেয়েটি এখন তার মনের ভেতরেই বাস করছে।
রাতের বেলা ল্যাম্পের নিচে বসে পড়াশোনার ফাঁকে অনিক অনুভব করত, যেন কারো শীতল স্পর্শ কাঁধের কাছে এসে থমকে যাচ্ছে। জানলার বাইরে চাঁদের আলোয় গাছের ছায়ায় কেমন এক মায়াজাল তৈরি করছিল। হঠাৎ করেই বাতাসে লাল গোলাপের সুবাস ভেসে আসত। অনিক বুঝে যেত, মেয়েটি তার খুব কাছেই আছে—অদৃশ্য হয়ে, তবু অনুভবে ভর করে।
একদিন কলেজের করিডরে হেঁটে যাওয়ার সময় রাহুল এসে কাঁধে হাত রাখল। “কিরে, তুই এত চুপচাপ হয়ে গেছিস কেন?”
অনিক হাসল। “কিছু না, ভাবছিলাম…আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে, সবই কি সত্যি, নাকি কল্পনা?”
রাহুল হেসে বলল, “কল্পনা আবার কেমন? বাস্তব না হলে দেখছিস কীভাবে?”
অনিক ধীরে বলল, “সবই দেখা যায় না, রাহুল। কিছু অনুভব করতে হয়, ঠিক যেমন লাল গোলাপের সুবাস—দেখা যায় না, কিন্তু বোঝা যায়।”
রাহুল অবাক হয়ে বলল, “তোর এই কাব্যিক কথাবার্তা শুরু হলো কবে থেকে?”
অনিক উত্তর না দিয়ে হেঁটে চলে গেল। তার ভেতর থেকে মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—“ভালোবাসা আসলে শব্দ নয়, অনুভূতি। ভালোবাসা মানে বিশ্বাস।”
রাতের বেলা ঘুমের মাঝে স্বপ্নে সেই মেয়েটিকে দেখল অনিক। মেয়েটি বসে আছে লাল গোলাপের বাগানে, হাসছে, হাতের মুঠোয় পাপড়ি ভরা। অনিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি এখনো আছি, অনিক। তুমি কি আমাকে মনে রাখবে?”
অনিকের বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি তোমাকে ভুলতে পারব না।”
ঘুম ভেঙে গেল। অনিকের চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভোরের আলো। পাখিরা ডাকছে। তার মন বলল—আজও সেই মেয়েটি তার সঙ্গে আছে, নিঃশব্দ ভালোবাসার ছায়া হয়ে।
সেই মুহূর্তে অনিক বুঝে গেল—ভালোবাসা মানে কেবল কারো হাত ধরা নয়, কারো মন ছুঁয়ে যাওয়া। আর সেই মেয়েটি—সে অনিকের জীবনের অংশ হয়ে গেছে, এমনভাবে যে হয়তো সবার চোখে ধরা দেবে না, কিন্তু অনিকের মনে সে চিরকাল রয়ে যাবে।
অধ্যায় ৮
শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই কলেজ ক্যাম্পাসের চারপাশে বিদায়ী আবহ বয়ে গেল। বন্ধুদের হাসি, কোলাহল, আর সেই চিরচেনা ডেস্কগুলো—সবকিছুর মাঝেই অনিকের মনের মধ্যে কেবল সেই মেয়েটির কথা ভাসছিল।
পরীক্ষার পরের দিন বিকেলে কলেজের বাগানে একা বসে ছিল অনিক। গ্রীষ্মের আলো কিছুটা নরম হয়ে গিয়েছে। গাছের ছায়ায় বসে বারবার ভাবছিল—এই মেয়েটি কি কেবল তার কল্পনা, নাকি সত্যিই কোনো এক আশ্চর্য জগতে তার অস্তিত্ব আছে?
হঠাৎ হাওয়ার মাঝে লাল গোলাপের সুবাস ভেসে এলো। অনিক জানত, এ সুবাস কোনো ফুলের দোকান থেকে আসেনি। এ সুবাস তার মনেরই গভীর থেকে উঠে এসেছে।
অনিকের চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই মেয়েটির মুখ। সাদা কামিজ, খোলা চুল আর মায়াবী চোখের সেই হাসি। মনে হলো, মেয়েটি যেন তাকে ডাকছে। সে আস্তে করে বলল, “তুমি কি আবার আসবে?”
তখনই হাওয়ার মধ্যে মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “আমি তো আছি, অনিক। তোমার মনের প্রতিটি কোণে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে। ভালোবাসা মানেই চিরকালীন উপস্থিতি। যখন তুমি লাল গোলাপের সুবাস পাবে, তখনই বুঝে নিও, আমি তোমার আশেপাশেই আছি।”
অনিকের চোখ ভিজে গেল। সে জানত, এই মেয়েটি আসলে তার মনেরই প্রতিফলন। একাকীত্ব আর ভালোবাসার অমোঘ সংমিশ্রণ। তবু সেই অনুভূতি যে বাস্তব, তা যেন আর অস্বীকার করা যায় না।
মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিক হাসল। মনে মনে বলল, “তুমি কখনো হারাবে না, লাল গোলাপ। তুমি আমার অমর ভালোবাসার প্রতীক হয়ে থাকো।”
বাতাসে আবার ভেসে এলো লাল গোলাপের সুবাস, আর অনিক বুঝে গেল—ভালোবাসা কখনো মরে না। তা কেবল রূপ বদলে মনের ভেতর গেঁথে থাকে, অনির্বচনীয় হয়ে।
সমাপ্ত