পর্ব-১:
রূপা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। শহরের কোলাহল, ট্র্যাফিকের শব্দ, লম্বা লাইন—সব কিছুর মাঝেই যেন আজকের দিনটা অন্যরকম। শিহাব পাশের সিটে বসে ড্রাইভারের সিট সামলে বলল, “আর মাত্র মিনিট দশেক, ওখানেই পৌঁছে যাবো।”
রূপা হেসে তাকালো ওর দিকে। কতদিনের স্বপ্ন—নিজের ফ্ল্যাট! দু’জনেই হন্যে হয়ে খুঁজেছে—সস্তা, কিন্তু সুবিধাজনক, আর অবশ্যই একটু আধুনিক—যেখানে ওরা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে থাকবে।
বিয়ের দুই বছর পর অবশেষে এই ঠিকানা—শুধু তাদের দু’জনের জন্য। গাড়ি পার্কিংয়ে থামিয়ে শিহাব বেরিয়ে দাঁড়ালো। “এই যে, চল।”
রূপা ব্যাগ নিয়ে নামলো। চারপাশে নতুন ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর সারি—সবুজ রঙের, প্যাস্টেল শেডের রঙ করা দালানগুলো। চোখে শান্তি লাগে। দারোয়ান এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, “স্যার, ম্যাডাম—ওয়েলকাম! সব ব্যবস্থা করে রাখা আছে।”
শিহাব ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। রূপার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। নতুন ফ্ল্যাটে পা রাখার আনন্দের সঙ্গে মিশে রইলো অজানা এক শিহরণ—একটা শূন্য, নিঃশব্দ শ্বাস যেন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। লিফট ওপেন হতেই শিহাব ব্যাগ হাতে করে এগিয়ে গেল। রূপা ধীরে ধীরে পা ফেলল। পাঁচ তলা, করিডরটা বেশ লম্বা। সাদা টাইলস, মাঝেমধ্যেই গাঢ় ছায়া, যেন সঠিক আলো জ্বলে না সবখানে।
“দেখছো করিডরটা?” শিহাব বলল। “একটু লম্বা হলেও বেশ সুন্দর না?”
“হ্যাঁ…”—রূপা আস্তে বলল। তবু বুকের ভেতর অজানা অস্বস্তি। করিডরের শেষ মাথায় একটা বাদামী দরজা—হাতলের ওপর ধুলোর আস্তরণ। কাঁচে তালা মারা। যেন কেউ বহুদিন ধরেই ওটা খোলেনি।
“ওটা কী ঘর?” রূপা জিজ্ঞেস করল।
শিহাব হাসল। “ওটা স্টোর রুম। ওখানে মালপত্র রাখব। ভেতরে কিছুই নেই। তবে দরজাটা বন্ধ রাখাই ভালো।”
“কেন?”
“আসলে আগের মালিক… মানে… যাকগে, তেমন কিছু না।” শিহাব এড়িয়ে গেল। “চল, ফ্ল্যাটটা আগে দেখো।”
রূপা কিছুটা অবাক হলেও কিছু বললো না।
ফ্ল্যাটের ভেতরটা বেশ বড়। দুই বেডরুম, বড় লিভিং রুম, বেলকনি। দেয়ালে হালকা পেস্টেল রঙ, জানালা থেকে আলো এসে পড়ছে। মেঝেতে সাদা মার্বেল—একেবারে ঝকঝকে। রান্নাঘরেও মডুলার সেটআপ—সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া।
রূপা বলল, “দারুণ হয়েছে! মনে হচ্ছে—আসলে আমাদের নতুন জীবন এখান থেকেই শুরু হবে।”
শিহাব ওর কাঁধে হাত রাখল। “তুমি যত্ন নিলে বাড়িটাও প্রাণ পাবে।”
রূপা হেসে বসল। কিন্তু মনের ভেতর থেকে সেই করিডরের অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাসের অনুভূতিটা যাচ্ছিল না।
বিকেলে ডেকোরেটর এসে পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে গেল, শেলফ সাজিয়ে দিলো। শিহাব বাজার থেকে কিছু জরুরি জিনিস নিয়ে এল। ফ্রিজে জল, কিছু ফল, আর রুটি-সবজি। প্রথম রাত—যেটা শুরু হবে নতুন ঠিকানার গল্প।
রাত সাড়ে দশটা। শিহাব টিভি খুলে খবর দেখতে লাগলো। রূপা রান্নাঘরে কাপ-গ্লাসগুলো ঠিকঠাক করে রাখছিল। হঠাৎ করিডরের দিক থেকে একটা খটাস শব্দ।
সে তাকালো—দরজাটা নড়ছে।
“শিহাব!”—রূপা ডাকল।
শিহাব আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। “কী হয়েছে?”
“দরজাটা… নড়ছে কেন?”
শিহাব হাসল। “হাওয়া… জানালা খোলা আছে তো।”
কিন্তু রূপা জানে—জানালা সব বন্ধ। বাইরে হাওয়া নেই। সে বলল, “তবু… ভেতর থেকে যেন…”
“আরে, এগুলো ভূতের গল্পের মত কথা। তুমি এসব ভাববে না, বুঝলে?”
রূপা একটু থমকালো। তারপর ঘর গোছানোর কাজ শেষ করে ওর বেডরুমে ঢুকল। শিহাব পাশের ঘরে টিভি দেখছিল।
রাত বাড়তেই করিডরের অন্ধকারটা ঘনালো। ফ্ল্যাটের বাকি আলো থাকলেও করিডরের বাতিটা নিভে গেল হঠাৎ। রূপা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল—দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত আলো যেন বেরোচ্ছে।
কৌতূহল সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। দরজায় হাত রাখতেই বুক ধক করে উঠলো। শীতলতা ছড়িয়ে পড়লো হাতের তালুতে।
“কে… কে ওখানে?”—রূপা ফিসফিস করে বললো। কোনো উত্তর নেই।
দরজার গায়ে কপাল ঠেকিয়ে শুনল—দীর্ঘশ্বাসের মতো এক শব্দ।
“আ…আ…মা…কে…বাঁচাও…”
রূপা তাড়াতাড়ি পেছিয়ে এল। চোখ কপালে তুলে দেখল—দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ছুটে বেরোচ্ছে।
শিহাব এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি দরজা খুলতে গিয়েছিলে?”
রূপা কাঁপা গলায় বলল, “না… না… আমি খুলি নি। ভেতর থেকে আওয়াজ আসছিল… কেউ সাহায্য চাইছে।”
শিহাব বিরক্ত হয়ে বলল, “ভুতের গল্প বাদ দাও তো। কাল দুপুরে দেখব। এখন ঘুমোতে চলো।”
রূপা কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেল। শিহাবের চোখে-কানে যেন সেই ভয় ঢুকছে না। অথচ ওর বুকের ভেতর হু হু করে শীতল বাতাস বইছে। ঘড়িতে রাত তিনটে। চারদিক নিস্তব্ধ। রূপার চোখে ঘুম নেই। করিডর থেকে যেন নিঃশ্বাসের শব্দ—কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এক ছায়া—কেবল মুখটা অস্পষ্ট, চোখদুটো লাল।
“তুমি…আমাকে…ডেকেছিলে…?”
রূপার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না। পাথরের মতো বসে রইল বিছানায়। শিহাব পাশের বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে। ছায়াটা ধীরে ধীরে দরজার ভেতর মিশে গেল। আবার নিস্তব্ধতা। রূপা জানে—এত সহজে এই দুঃস্বপ্নের করিডর তাকে ছেড়ে যাবে না।
পর্ব-২:
রাত তখন সবে শেষরাতের দিকে গড়াচ্ছে। রূপার চোখে ঘুম নেই। করিডরের শেষ মাথায় সেই দরজাটা যেন ওকে ডাকছে, ফিসফিস করে বলছে, “আমাকে ছেড়ে যেও না…”
হাতে কাপে ধরা কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। পাথরের মতো বসে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে রূপা। শিহাব পাশের ঘরে, অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এভাবে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন—এই ফ্ল্যাটের করিডরটা যেন ওদের দু’জনের সম্পর্কের মাঝখানেও দাঁড়িয়ে গেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত আলো, আর ফিসফিসানি।পরদিন সকালে শিহাব তাড়াহুড়ো করে অফিসে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল, “দরজাটা নিয়ে ভাবনা বাদ দাও, প্লিজ। ওই ঘরটা বন্ধই থাকবে, ঠিক আছে?”
রূপা ধরা গলায় বলল, “কিন্তু তুমি বলেছিলে, ওই ঘরে আগের মালিক…?”
শিহাব বিরক্ত হয়ে হাত তুলল, “রূপা, প্লিজ! এই বাড়িতে একদম ভালোভাবে থাকতে চাইছি। এসব বাজে গল্প শুনে মনের ভেতর কেবল আতঙ্ক ঢুকবে। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। বুঝলে?”
শিহাব চলে যাওয়ার পর রূপা একা হয়ে পড়ল। ফ্ল্যাটের নিস্তব্ধতা যেন শীতল, মৃত। খোলা জানালা দিয়ে রোদের আলো এসে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু করিডরটা আলো পেরিয়ে গিয়েও অন্ধকারে ঢাকা।
কৌতূহল আর আতঙ্ক মিশিয়ে ও দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার হাতলে হাত রাখতেই বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল করিডরের একপাশে রাখা পুরনো বাক্সের ওপর। মনে পড়ল, এগুলো ফ্ল্যাট কেনার পর থেকেই পড়ে আছে। শিহাব বলেছিল, “ওগুলো পুরনো ভাড়াটিয়ার জিনিস। পরে দেখব।”
রূপা ধীরে ধীরে বাক্সের ঢাকনাটা খুলল। ধুলোর স্তর তুলে একগুচ্ছ কাগজপত্র। কিছু ভাড়াটিয়া চুক্তিপত্র, কিছু বিদ্যুতের বিল, আবার কিছু চিঠিপত্র—অদ্ভুত অক্ষরে লেখা, রংচঙে কাগজে হাতে আঁকা রঙিন রেখা। একটা চিঠি খুলতেই রূপার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
“প্রিয় রাহুল,
তুমি কি জানো, এই ফ্ল্যাটের করিডরটা কখনো নিস্তব্ধ নয়? কেউ আছে, যে আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না। ওর ফিসফিসানি শুনতে পাই—‘আমাকে বের করো, আমাকে বাঁচাও…’। আমি জানি ও এখনো এখানেই আছে, ও মরেনি…”
চিঠিটা অসমাপ্ত। নিচে কাঁপা হাতে লেখা—
“ও আমাকে নেবে…ও আমাকে ছাড়বে না…”
রূপার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ও পেছনে তাকিয়ে দেখল দরজাটা এবার অদ্ভুতভাবে দুলছে।
হাত কাঁপতে কাঁপতে রূপা শিহাবকে ফোন করল।
“শিহাব… ওই দরজার ঘরটা—ওখানে কিছু হয়েছে… আমি কাগজগুলো দেখলাম… আগের ভাড়াটিয়া… ও…”
শিহাব বিরক্ত গলায় বলল, “রূপা! আমি এখন মিটিংয়ে আছি। এসব নিয়ে আবার ফোন দিও না প্লিজ।”
রূপা ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি আমাকে সব কিছু বলছ না?”
শিহাব ফোন কেটে দিল। বিকেলের দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। রূপা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে রইল। করিডরের বাতিটা নিভে যাওয়ায় সেই দরজাটা আরও অন্ধকারে ডুবে গেছে।
হাওয়ার মতো শীতল একটা কাঁপুনি এসে গিয়ে ওর ঘাড়ে ছুঁল। কাঁপা গলায় রূপা বলল, “কে… কে ওখানে?”
দরজার ফাঁক দিয়ে ভেসে এলো ফিসফিসানি।
“আমি… এখানেই… আছি…”
রূপা দৌড়ে গিয়ে দরজার হাতল চেপে ধরল।
“কে তুমি? কেন এখানে?”
কোনো উত্তর নেই। শুধু ফাঁক দিয়ে একজোড়া লালচে চোখ যেন অন্ধকারে ভাসছে। রূপা চোখ বন্ধ করে ফেলল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কাঁপতে কাঁপতে পেছিয়ে গেল। রাত আটটা নাগাদ শিহাব ফিরল। রূপাকে দেখে চমকে উঠল।
“তুমি এভাবে কাঁপছো কেন? কী হয়েছে?”
রূপা জড়িয়ে ধরে বলল, “ওই দরজার ঘরটা… ওই ছায়াটা… ও আমাকে ডাকছে শিহাব… ওই ঘরটা ভালো নয়… আমাদের এখানে থাকা উচিৎ নয়…”
শিহাব এবার ধৈর্য হারাল।
“রূপা, এসব ভয় তোমার মনের ভুল। ওই ফ্ল্যাটের আগের ভাড়াটিয়া মানসিক রোগী ছিল—তাই সাইকিয়াট্রিক সমস্যায় ভুগে শেষমেশ আত্মহত্যা করেছে। সেজন্য ওখানে মালপত্র রেখে স্টোর বানিয়েছি। আমি চাই তুমি এসব নিয়ে ভাবা বন্ধ করো।”
রূপা ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি নিজ চোখে দেখেছ, ও মরেছে? নাকি কোনো গল্প?”
শিহাব এবার আর কথা বলল না। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তুমি কাল থেকে মায়ের বাড়ি যাও। আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকব। এই ব্যাপারটা ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে দেখব। তুমি প্লিজ ঠিক হও।”
রূপা মাথা নাড়ল। কিন্তু ও জানে—ওখানে সত্যি কিছু আছে। শুধু গল্প নয়। রাত গভীর হলে রূপা আবার করিডরের দিকে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এল।
“আমাকে… ছেড়ে যেয়ো না…”
রূপা সাহস করে বলল, “তুমি কে? তুমি কী চাও?”
অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা হাত—রক্তজমাট নখওয়ালা—দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল।
“আমাকে বাঁচাও… আমাকে বের করো… আমি… আমি… মরে গেছি… আমি বাঁচতে চাই…”
রূপা চিৎকার করে পেছিয়ে গেল। শিহাব দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল।
“তুমি কী করছো! ওখানে যেয়ো না!”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও আমাকে ডাকছে শিহাব! ও বাঁচতে চাইছে!”
শিহাব জোরে দরজায় হাত রেখে বলল, “এই দরজার পেছনে কোনো মানুষ নেই। এটা সব তোমার কল্পনা।”
কিন্তু দরজার ভেতর থেকে সেই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল—
“আমি এখানেই আছি… আমাকে ছেড়ে যেয়ো না…”
রাতের পর রাত রূপা শুনতে পাচ্ছে সেই ডাক। ওর স্বপ্নে আসে সেই ছায়া—লালচে চোখ, কুয়াশার মতো দেহ, রক্তজমাট নখ। ওকে ইঙ্গিত দেয়, “দরজা খুলে দাও… আমাকে বের হতে দাও…”
রূপা জানে, শিহাব সবটা জানে। ওর চেহারায় আতঙ্ক, এড়িয়ে যাওয়া কথাবার্তা—সবটাই ধরা পড়ছে। কিন্তু শিহাব ওকে কিছু বলছে না।
রূপার বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন:
“আমাদের ফ্ল্যাটের করিডরে কে বন্দি?”
পর্ব-৩:
রাত তখন গভীর। করিডরের অন্ধকারে ভেজা বাতাসের মতো শীতলতা ছেয়ে আছে। রূপা বারবার সেই দরজার দিকে তাকাচ্ছে। বারান্দা থেকে হালকা আলো এসে পড়েছে করিডরের মেঝেতে, তবু দরজার ফাঁকটুকু অন্ধকারেই রয়ে গেছে। রাতের পর রাত, রূপার ঘুম ভেঙে যায় সেই ফিসফিসানি শুনে—
“আমাকে… বের করে দাও… আমাকে বাঁচাও…”
কিন্তু শিহাব? ও যেন দিনে দিনে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। অফিসের কাজের চাপ, ফোন কেটে দেওয়া, কিংবা কথার মাঝেই হঠাৎ রেগে যাওয়া—সবকিছুতে শিহাবকে আগের মতো আর আপন মনে হয় না।
একদিন দুপুরে রূপা ঠিক করল—যে করেই হোক সত্যি জানতেই হবে। শিহাব অফিসে, বাড়ি ফাঁকা। করিডরের পাশে রাখা বাক্সগুলো খুলে খুঁজতে লাগল। পুরনো ফাইল, বিদ্যুতের বিল, বীমার কাগজপত্রের ফাঁকে পেয়ে গেল একটা হলুদ খাম। ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা—“ডেথ সার্টিফিকেট ও পুলিশ রিপোর্ট”।
রূপার বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো। ধীরে ধীরে খাম খুলে দেখল— একটা নোট— “মৃত্যু: আত্মহত্যা, করিডরের স্টোররুমে গলায় ফাঁস”
আরো লেখা—
“পুলিশ রিপোর্ট: সন্দেহজনক আত্মহত্যা, পরিবার দাবি করছে মানসিক অস্থিরতা। প্রতিবেশীরা অদ্ভুত শব্দ ও কান্না শুনেছে রাতের বেলায়।”
রূপা পড়ে শিউরে উঠল। মানসিক অস্থিরতা? প্রতিবেশীরা কান্না শুনেছে? তাহলে কি সত্যিই কিছু অস্বাভাবিক ঘটেছিল? সন্ধ্যায় বেল বাজল। রূপা দরজা খুলতেই চমকে উঠল। দরজার ওপাশে এক মধ্যবয়সী নারী—চোখে গভীর কালি, মলিন শাড়ি।
“আমি বীণা, পাশের ফ্ল্যাটে থাকি,” ম্লান হেসে বলল।
“আপনাদের ওখানে সব ঠিক আছে তো? রাতের বেলা কেমন একটা শব্দ পাই… কেমন কান্নার মতো…”
রূপা ভয়ে গলা কাঁপিয়ে বলল, “হ্যাঁ, মানে… একটু অস্বস্তি হয় মাঝে মাঝে…”
বীণা নিচু গলায় বলল, “আগের ভাড়াটিয়ার আত্মহত্যার পর থেকে ওখানে কিছু ঠিক নেই। অনেকেই বলছে, তার আত্মা ওখানেই রয়ে গেছে। ওই করিডরের ঘরটা… ওখানেই ঝুলেছিল ও…”
রূপা যেন শ্বাস বন্ধ করে ফেলল।
“ঝুলেছিল?”
বীণা মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ। আমরা সবাই জানতাম ওর মানসিক সমস্যা ছিল, কিন্তু ওর মৃত্যুর পরেও রাতে মাঝেমাঝে কাঁদার শব্দ শোনা যেত। আমি একবার দরজার ফাঁক দিয়ে লালচে আলো দেখেছিলাম… তারপর থেকে ওই করিডরের দিকে যাই না।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “শিহাব এসব কিছুই আমাকে বলেনি…”
রাতে শিহাব ফিরল। রূপা ওর সামনে সেই ফাইলের কাগজগুলো ছুঁড়ে দিল।
“তুমি আমাকে সত্যি কিছুই বলোনি, তাই না? এই ফ্ল্যাটের করিডরে একজন মারা গিয়েছিল! আর তুমি বললে মানসিক সমস্যা? প্রতিবেশীরা কান্নার শব্দ শুনেছে, জানো?”
শিহাব মুখ শক্ত করে বসে রইল। চোখ নামিয়ে বলল,
“আমি জানতাম না তুমি এসব ফাইল খুঁজবে…”
রূপা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি আমাকে অন্ধকারে রেখেছিলে! আর ওই দরজার ফাঁক দিয়ে কে যেন আমাকে ডাকছে—আমাকে বের করে দাও, আমাকে বাঁচাও! এটা কি কেবল মানসিক ব্যাপার?”
শিহাব চোখ তুলে তাকাল, এবার গলায় কাঁপুনি,
“রূপা… ওই ভাড়াটিয়ার নাম ছিল রাহুল। ওর মৃত্যুর পর একরাত আমি এখানে একা ছিলাম—হঠাৎ করে দরজার ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত আলো আর কাঁদার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। ওর আত্মা হয়তো এখানেই আটকে আছে। তাই… আমি চেয়েছিলাম তুমি এসব না জানো…”
রূপা দম নিয়ে বলল, “তুমি জানো, আমরা এখন একটা ফাঁদে আছি? ওই দরজার পেছনে কিছু আছে। ও আমাদের সাহায্য চাইছে—আর তুমি সেটাকে এড়িয়ে যাচ্ছ!”
শিহাব কপালে হাত দিয়ে বলল, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, রূপা। ভয় পেয়েছিলাম তুমি যদি জানো, তুমিও ফাঁদে পড়ে যাবে… তোমাকেও টেনে নিয়ে যাবে…”
রাতের বেলা আবার বিদ্যুৎ চলে গেল। পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকার। করিডরের ঘর থেকে অদ্ভুত আলো বেরিয়ে আসছে। শিহাব আর রূপা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে সেই ফিসফিসানি— “আমাকে… বাঁচাও… আমি মরে গেছি, আমি বেরোতে চাই…”
রূপা শিহাবের হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
“তুমি কি সত্যিই সাহায্য চাও? তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
দরজার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ করেই ভেসে উঠল অর্ধেক ছায়া—রক্তমাখা মুখ, চোখ লালচে, গলায় দড়ির দাগ।
“আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে… এটা আত্মহত্যা নয়… আমাকে ওরা মেরেছে…”
রূপার কণ্ঠ আটকে গেল, “কাকে বলছ তুমি?”
ছায়ার কণ্ঠ আরো করুণ— “আমার মৃত্যুর পেছনে ও আছে… ওই… ওই…”
আরেকটা হাত বেরিয়ে এল দরজার ফাঁক থেকে—একেবারে রক্তজমাট। রূপা পেছিয়ে যেতে যেতেই শুনল— “তোমরা দু’জনও ওর ফাঁদে পড়ছো… সাবধান…”
হঠাৎ দরজার ফাঁক ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। শিহাব তড়িৎ গতিতে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
“রূপা, আর ওখানে যেয়ো না!”
রূপা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। শিহাবকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে কেঁদে ফেলল।
“শিহাব… তুমি জানো, ও কাকে বলছে? কে ওর মৃত্যুর পেছনে আছে?”
শিহাব চুপ করে রইল। ওর চোখ অদ্ভুত ভয়ে ঢেকে গেছে।
“রূপা, এখন না। কাল সকালে সব বলব। আজ রাতে ওখানে যেয়ো না।”
রূপা ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি ওর মৃত্যুর পেছনের সত্যিটা জানো?”
শিহাব কাঁপা গলায় বলল, “আমি… আমি…”
কথাটা শেষ করার আগেই বিদ্যুতের আলোটা জ্বলে উঠল। কিন্তু তখনই রূপা দেখল—শিহাবের চোখের কোণায় লালচে ছায়া, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত অন্ধকার হাসি।
রূপার বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে গেল।
“তাহলে কি… ও বলেছিল ঠিক…?”
পর্ব-৪:
রূপা সারা রাত ঘুমোতে পারল না। করিডরের দরজাটা যেন অন্ধকারের মধ্যে থেকে ওকে ডাকছিল—একটা শীতল হাত, একটা ফিসফিসানি। বারবার মনে পড়ছিল সেই ছায়ার রক্তমাখা মুখ, সেই করুণ আর্তি—“আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে… এটা আত্মহত্যা নয়…”
শিহাবের চোখের কোণায় লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত অন্ধকারের হাসিটা রূপার বুকের মধ্যে শীতল আতঙ্কের ঢেউ তুলছিল।
সকালে শিহাব বিছানায় নেই। রান্নাঘরেও নেই। রূপা চারদিকে খুঁজে বেড়াল। ফোন করল—অফিস বন্ধ, ফোন সুইচড অফ। রূপার বুক ধকধক করতে লাগল।
হঠাৎ করিডরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ম্লান আলো। রূপা থমকে গেল। দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
—“আমাকে বাঁচাও…”
—“ওরা আমাকে খুন করেছে…”
—“আমাকে ধরে রেখেছে…”
শিহাবের অফিসের কাগজগুলো খুঁজতে খুঁজতে রূপা হঠাৎ খুঁজে পেল এক চিঠি।
লেখা আছে: “ডিল সম্পূর্ণ। ও যেন মুখ না খুলতে পারে, তাই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট ও করিডরের ঘর—সব গুছিয়ে দিয়েছি।”
রূপার বুকের ভেতর যেন বরফ পড়ল।
—“ডিল”?
—“ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে”?
—“ফ্ল্যাট ও করিডরের ঘর”?
কিছুটা ভেঙে পড়া হাতে রূপা সেই চিঠিটা শক্ত করে ধরল।
দুপুরবেলা বীণা এসে দাঁড়াল দরজায়। রূপা ভেতরে ডেকে নিল।
“দিদি, আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে হবে।”
রূপা সেই চিঠিটা দেখাল। বীণা পড়ে থতমত খেল।
“এটা শিহাবের হাতের লেখা… ও কি আসলে…?”
রূপার চোখ ছলছল করল।
“আমার মনে হচ্ছে রাহুলের মৃত্যুর পেছনে শিহাবের হাত থাকতে পারে। ওকে হয়তো কেউ দিয়েছিল—অন্য কিছু লেনদেনের জন্য… আর রাহুল হয়তো সেটা জেনে গিয়েছিল…”
বীণা কাঁপা গলায় বলল, “দিদি, ও ঘরটা পবিত্র নয়। ওই ঘরের ভেতর শুধু আত্মা নয়, পাপের ছায়া আটকে আছে। সেই ছায়া এখন আপনার স্বামীর ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।”
রাতে বৃষ্টি নামল। বাতাসে ভিজে থাকা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর বিদ্যুতের ঝিলিক। করিডরের দরজা আবার খুলে গেল। রূপা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে কুয়াশার মতো ধোঁয়া আর গন্ধ। হঠাৎ করে দেওয়ালে ভেসে উঠল এক ছবি—রাহুলের রক্তমাখা মুখ।
—“আমাকে বাঁচাও… শিহাব ওদের লোক…”
—“শিহাব ওদের সঙ্গে মিলে গেছে…”
—“আমার মৃত্যু… শিহাব…”
রূপা গলা শুকিয়ে বলল, “কিন্তু শিহাব আমার স্বামী…”
ছায়াটা ফিসফিস করে বলল, “তোমার স্বামী আর সেই শিহাব নেই… ও এখন আমার খুনি, পাপের হাতিয়ার… ওর মধ্যে ওদের ছায়া ঢুকে গেছে…”
হঠাৎ পেছন থেকে দরজায় শব্দ হল—ঠকঠক ঠক।
“রূপা…”
শিহাবের গলা, কিন্তু তাতে কেমন যেন এক অদ্ভুত কর্কশতা।
“তুমি এখানে কী করছ?”
রূপা ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল। শিহাবের চোখ দুটো লালচে, চামড়া ফ্যাকাশে, ঠোঁটের কোণায় রক্তের ছোপ।
“তুমি কি…?” রূপা জড়ানো গলায় বলল।
শিহাব হেসে উঠল—একটা অস্বাভাবিক, পিশাচের হাসি।
“আমি? আমি সেই দালান—যেখানে সব পাপ আটকে আছে। আমি সেই দরজা—যেখানে সব অভিশাপ লুকিয়ে আছে। রাহুল খুব বেশি জানত… তাই ওকে সরিয়ে দিতে হয়েছিল।”
রূপা পেছাতে লাগল।
“তুমি শিহাব নও… তুমি কেউ… অন্য কেউ…”
শিহাবের চোখ জ্বলতে লাগল।
“আমি সেই অন্ধকার—যে কিনা অন্ধকার দরজার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন তুমি আমার—তুমিও আমার পাপের অংশ।”
রূপা এক লাফে দরজার ছিটকিনি টেনে ধরে দরজা লাগিয়ে দিল। ভিতর থেকে শিহাবের থাবা মেরে দরজা ধাক্কাতে লাগল।
“দরজা খোল! রূপা! দরজা খোল!”
রূপা কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল, “যতক্ষণ না তোমার আসল রূপ ফিরছে, আমি দরজা খুলব না!”
বাইরে শিহাবের হাসি—ভয়াল হাসি।
“আমি শিহাব—তোমার স্বামী—দরজা খোলো!”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে দরজার ওপাশে বসে পড়ল।
“তুমি শিহাব হতে পারো না। শিহাব আমাকে ভালোবাসত, ও কখনো কাউকে মারতে পারত না। ও এভাবে আমার দিকে আসতে পারত না…”
শিহাব থেমে গেল। তারপর ধীরে ধীরে করুণ স্বরে বলল,
“রূপা… আমাকে ক্ষমা করো… আমি ওদের পাপ থেকে মুক্তি পেতে চাই… আমায় সাহায্য করো…”
রূপা চোখ মুছল।
“কীভাবে সাহায্য করব? বলো…”
শিহাবের গলা ভাঙা ভাঙা।
“ও ঘরের ভেতর ওর রক্তের দাগ… সেখানে আমার রক্ত মিশেছে… ওই দাগ মুছে ফেলতে হবে… ওর আত্মা তখনই শান্তি পাবে… আমাকে ছেড়ে যাবে…”
রূপা দরজা খুলল। শিহাব ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো ক্লান্ত।
“তুমি কি…?”
শিহাব ফিসফিস করে বলল, “আমি শিহাব—কিন্তু ওদের অভিশাপ আমার শরীরে ঢুকেছে। ওই দাগ মুছে দাও, আমায় ওদের হাত থেকে বাঁচাও…”
রূপা করিডরের ঘরে ঢুকল। মেঝেতে লালচে রক্তের দাগ। হাত দিয়ে সেই দাগ মুছে ফেলতে লাগল। অদ্ভুতভাবে সেই দাগ মুছতে মুছতে মেঝে যেন শীতল হয়ে গেল। ঘরটা ধীরে ধীরে হাওয়া হয়ে গেল। শিহাবের শরীর থেকে অদ্ভুত ছায়া বেরিয়ে আসতে লাগল। সেই ছায়া দেওয়াল বেয়ে উঠে গেল—দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল।
শিহাব ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। রূপা ছুটে ওর কাছে গেল।
“তুমি এখন কেমন?”
শিহাব ম্লান হেসে বলল,
“তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ রূপা… আমি ওদের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছি…”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে ওকে জড়িয়ে ধরল।
“তুমি ফিরে এসেছ… তুমি সত্যিই ফিরে এসেছ…”
হঠাৎ করিডরের দরজাটা আবার ধীরে ধীরে খুলে গেল।
মেঝেতে সেই রক্তের দাগ—আবার ভেসে উঠল।
শিহাব আতঙ্কিত গলায় বলল, “ওরা আবার ফিরে এসেছে…”
রূপা ফিসফিস করে বলল, “দু’জনেই মিলে লড়াই করব। আমরা একসঙ্গে ওদের পাপের শিকল ভাঙব…”
কিন্তু তখনই শিহাবের চোখের কোণায় সেই লালচে ছায়া—
এক মুহূর্তে ওর মুখে পিশাচের হাসি।
“তুমি ভেবেছিলে ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে?”
রূপার বুকের ভেতর শীতল বাতাস বয়ে গেল। করিডরের অন্ধকারে সেই ছায়া আবার ডাকতে লাগল—
“এখন তোমার পালা, রূপা… ফাঁদ থেকে আর কেউ বেরোতে পারে না…”
পর্ব-৫:
রূপা সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে শিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই মানুষটার চোখের কোণে লালচে আঁচ, ঠোঁটের কোণে একটা অদ্ভুত বাঁকা হাসি। যেন এই মানুষটা তার চেনা শিহাব নয়, বরং করিডরের অন্ধকারের পাপের প্রতীক।
শিহাব ফিসফিস করে বলল, “তুমি আমাকে ছাড়তে পারো না, রূপা। আমি আর সেই শিহাব নই, আমি পাপের কণ্ঠস্বর। রাহুল… রাহুলও বুঝতে পেরেছিল।”
রূপার বুক ধড়াস করে উঠল।
—“তুমি রাহুলকে খুন করেছ?”
শিহাবের ঠোঁটের কোণে সেই বাঁকা হাসি—
—“আমি না। পাপের ঘরটাই করেছে। আমি শুধু হাতিয়ার। ওই ঘর… ওই করিডর… সেখানেই লুকিয়ে আছে সব রহস্য।”
রূপা আরেকবার করিডরের দরজার দিকে তাকাল। দরজার ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস বেরোচ্ছে, কুয়াশার মতো ধোঁয়া পাকিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত গন্ধ—পঁচা রক্ত আর পচা মাংসের গন্ধ।
রূপা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি বলেছিলে, পাপের ঘর… ওটা আসলে কী?”
শিহাব ফিসফিস করে বলল, “এই ফ্ল্যাটটা যখন বানানো হচ্ছিল, তখন এক শ্রমিক—তার নাম ছিল রাহুল—কিছু ভয়ানক সত্য জেনে ফেলেছিল। সেই সময়ে এই ফ্ল্যাটের নির্মাণের আড়ালে মাদক পাচার, টাকা লেনদেন আর খুন—সবই চলছিল। রাহুল সেই ডিলের সাক্ষী হয়ে গিয়েছিল।”
রূপা চমকে উঠল।
—“তুমি…!”
শিহাব কাঁদতে কাঁদতে বলল,
—“আমি তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই করিডরের ঘর… ওখানে রাহুলকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাকে মেরে ওখানেই পুঁতে রাখা হয়েছে। ওই পাপের দাগ এখনো মুছে যায়নি।”
রূপা আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, “তাহলে তুমি তো পাপের অংশীদার!”
শিহাব মাথা নাড়ল, “আমি পাপের শিকল ছিঁড়তে চাই। ও ঘরটার অভিশাপ আমাকে ছাড়ছে না। আমাকে মুক্তি দাও, রূপা।”
রূপা বুক শক্ত করে দাঁড়াল।
—“মুক্তি চাইলে ওই ঘরটার সত্যি তোমাকেই খুলতে হবে। যা লুকিয়ে আছে, তা সবাইকে জানাতে হবে।”
শিহাব ভয় পেয়ে বলল, “না! ওই ঘর খুললে… ওরা ছেড়ে দেবে না…”
রূপা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমার “আমি লড়ব। আমি তোমাকে বাঁচাব।”
শিহাব চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল।
—“ওরা আমার রক্ত চায়, রূপা। ওরা আমাকে খুন করাবে। তুমি পারবে না আমাকে রক্ষা করতে।”
রূপা হাত ধরে ওকে টেনে নিল।
—“আমি পারব, যদি তুমি সত্যিটা বলতে পার।”
রূপা ধীরে ধীরে করিডরের সেই অন্ধকার ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কাঠের দরজা যেন মাটির সঙ্গে লেগে গেছে, ওটার গায়ে আঁচড়ের দাগ। রূপা বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে ছিটকিনি খুলল।
ভেতরে গিয়ে শিউরে উঠল— মেঝের ঠিক মাঝখানে রক্তের দাগ, রাহুলের ছিন্নবিচ্ছিন্ন জামা, দেওয়ালে অদ্ভুত প্রতীক—যেন শয়তানের হাসি। একটা ছায়া দেওয়ালের কোণ থেকে ফিসফিস করে বলল, “রূপা, তুমিও পাপের শরিক হয়ে গেলে। ওকে বাঁচাতে চাইছ, তাই তো? তুমি জানো না, এই ঘর পাপের শিকল। রাহুলের আত্মা মুক্তি পায়নি, শিহাবও পাবে না।”
রূপা গলা শক্ত করে বলল, “আমি শিহাবকে বাঁচাব, আর রাহুলকেও মুক্তি দেব।”
ছায়াটা হেসে উঠল। “তাহলে দেখাই তোমার শক্তি।”
হঠাৎ ঘরের ভেতর ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছায়া-ছায়া মানুষ বেরিয়ে এল। তাদের চোখ আগুনের মতো জ্বলছে, আর ওরা ফিসফিস করে বলছে— “আমরা পাপের পাহারাদার। রাহুলের রক্তে আমাদের শিকল বাঁধা হয়েছে। তুমি ওর রক্ত মুছতে পারবে না। শিহাবকেও ছাড়ব না।”
রূপা দম নিল।
—“আমাকে তোমাদের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না।”
ও পাশ থেকে শিহাব কাতরস্বরে ডাকল, “রূপা! ওরা আমাকে পাবে! আমাকে বাঁচাও…”
রূপা মাটিতে বসে হাত দিয়ে সেই রক্তমাখা দাগ মুছতে লাগল। কিন্তু দাগ মুছে যাচ্ছে না। উল্টে হাতের তালুতে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে, জ্বালা করছে।
শিহাবের আর্তনাদ—
“ওরা আমার রক্ত নিয়ে খেলছে, রূপা! আমাকে বাঁচাও…”
রূপা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হ্যাঁ… আমি পারব…”
হঠাৎ বুকের ভেতর কেমন শক্তি অনুভব করল রূপা। মনে হল যেন রাহুলের আত্মা ওর হাত শক্ত করে ধরছে। রাহুলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল— “রূপা, ওদের সত্যি ফাঁস করো। ওরা শুধু শিহাব নয়, এই ফ্ল্যাটের প্রত্যেককেই খেয়ে নেবে।”
রূপা হঠাৎ সাহসের আগুনে জ্বলে উঠল।
দরজার ওপাশে দাঁড়ানো ছায়াদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠল— “তোমাদের পাপ আজ এখানেই শেষ হবে!”
এক হাত দিয়ে সেই রক্তমাখা দাগে হাত রাখল। দাগ যেন গলতে লাগল। ছায়াগুলো চিৎকার করে উঠল— “না! না! এটা হতে পারে না…”
রাহুলের ছিন্নবিচ্ছিন্ন জামা হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। মেঝের রক্ত মুছে গেল। শিহাবের গলা ফিসফিস করে উঠল— “রূপা… আমি মুক্ত…”
শিহাব ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রূপা কাঁপা হাতে ওকে জড়িয়ে ধরল।
—“তুমি আমার শিহাব… তুমি পাপের শিকল ভেঙে মুক্তি পেলে…”
শিহাব চোখ মেলল। মুখে শান্তির ছায়া।
—“রূপা, তুমি বীর, তুমি আমার মুক্তি…”
করিডরের ঘর হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। রক্তের দাগের বদলে পবিত্র সাদা আলো। রাহুলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল— “ধন্যবাদ, রূপা। তুমি আমাকে মুক্তি দিলে…”
রূপা এক ফোঁটা অশ্রু ফেলল। “তোমার আত্মা শান্তি পাক, রাহুল।”
সকালের আলো ফুটল। রূপা আর শিহাব হাত ধরে করিডর পেরিয়ে বারান্দায় এল। পাখির ডাক, নীল আকাশ, সাদা মেঘের ফুরফুরে বাতাস। রূপা শিহাবের হাত শক্ত করে ধরে বলল— “তুমি আর আমি—পাপের শিকল ভেঙে নতুন জীবন শুরু করব।”
শিহাব ম্লান হেসে বলল— “তোমার সাহস না থাকলে আমি পাপের করিডরেই হারিয়ে যেতাম।”
দুজনের চোখের কোণে অদ্ভুত শান্তি, এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু করিডরের ফাঁকে হাওয়ার দোলায় অদৃশ্য ফিসফিসানি যেন বলে গেল— “পাপের ছায়া সহজে ছাড়ে না…”
পর্ব-৬:
সকালবেলা রূপা বারান্দায় বসে গরম চায়ের কাপ হাতে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। কাকের ডাক, হালকা বাতাস, এক চিলতে রোদ—সবকিছু যেন স্বাভাবিক। কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির।
শিহাব পাশে এসে চুপচাপ বসে রইল। মুখের কোণে ক্লান্তি, চোখের কোলে গভীর ঘুমের অভাবের ছাপ। রূপা জানে—গত রাতে পাপের করিডরের ঘর থেকে ওরা ফিরেছে বটে, কিন্তু করিডরের ছায়া ওদের ছেড়ে যায়নি।
শিহাব ফিসফিস করে বলল— “রূপা, কাল রাতের পর মনে হচ্ছে সব কিছু যেন বদলে গেছে। তুমি কি কিছু অনুভব করছ?”
রূপা চা রেখে শিহাবের চোখের দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ। করিডরের সেই ঘরটা চোখের সামনে নেই, কিন্তু ওর ছায়া এখনো এখানে রয়ে গেছে।”
শিহাব শিউরে উঠল।
“কাল রাতে যখন তুমি রক্ত মুছছিলে, আমি অনুভব করছিলাম—ওরা আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। রাহুলের আত্মা মুক্তি পেলেও ওদের আসল শক্তিটা এখনো ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে আছে।”
রূপা শিহাবের কাঁধে হাত রাখল।
“তাহলে আমরা এখন কী করব?”
শিহাব চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“আমি ভেবেছিলাম—সব শেষ। কিন্তু মনে হচ্ছে আসলে সবকিছু শুরু হয়েছে।”
হঠাৎ রান্নাঘরের দিক থেকে একটা শব্দ হল— টন… টন… টন…
রূপা চমকে উঠল।
“শিহাব! আবার সেই শব্দ!”
দুজনেই আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ওপাশ থেকে শীতল বাতাস এসে ঠাণ্ডা লাগছে। রূপা দরজার হাতলটা ছুঁতেই ফিসফিসানির শব্দ কানে এল— “তোমরা আমাদের ছাড়তে পারো না…”
শিহাব কাঁপা গলায় বলল— “এই ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেয়ালে পাপের ছায়া লেগে আছে। ওই ঘরটা বন্ধ করলেও দেওয়াল আর মেঝে থেকে ওরা ফিসফিস করে ডাকছে…”
রূপা ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দরজা খুলল। ভেতরে আলো নিভে গেছে, দেয়ালে লালচে দাগ। ছায়ার মতো কুয়াশা পাকিয়ে উঠছে। শিহাব তাড়াতাড়ি পেছনে সরে এল।
“না, রূপা, ওরা আমাদের ছাড়বে না। ওরা আমাদের পাপের শেকড়ে টেনে নিয়ে যাবে।”
রূপা সাহস সঞ্চয় করে কুয়াশার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল।
“শিহাব, আমি ভয় পাই না। ওদের সত্যিটা জানতেই হবে।”
কুয়াশার ভেতর দেওয়ালে অদ্ভুত আঁকিবুকি দেখা গেল— ত্রিভুজের মধ্যে চোখ, তার চারপাশে আগুনের শিখার মতো প্রতীক।
রূপার কানে ভেসে এল এক নারীর কান্না, এক শিশুর বিলাপ, আর একজনের হাহাকার— “আমাদের রক্ত দিয়ে এই ঘর তৈরি হয়েছে… আমাদের আত্মা মুক্তি চায়…”
রূপা হঠাৎ বুঝতে পারল—এই ফ্ল্যাটের নিচে লুকিয়ে থাকা পাপের শিকড় বহু পুরনো। শিহাব যেটুকু বলেছিল, তার চেয়ে অনেক বড় ষড়যন্ত্র।
রূপা শিহাবকে ডাকল— “শিহাব, ওরা শুধু তোমার নয়, এই পুরো ফ্ল্যাটের সব বাসিন্দার পাপ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
শিহাব এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল— “আমি জানতাম না, রূপা। আমি ভেবেছিলাম শুধু রাহুল… কিন্তু ওরা আমাকে ব্যবহার করেছে। আমাকে দিয়ে অন্যদের রক্তে হাত লাগিয়েছে। আমি পাপের পুতুল।”
রূপা শিহাবের হাত ধরে বলল— “তুমি পুতুল না, তুমি মানুষ। তুমি চাইলে এই পাপের খেলায় ছেদ টানতে পারো।”
শিহাব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল— “কিন্তু কীভাবে?”
রূপা দৃঢ় কণ্ঠে বলল— “তুমি যেদিন ওই করিডরের ঘর খোলে, ওদের শক্তি তোমার শরীরে ঢুকে পড়েছিল। এখন ওদের শেষ করার উপায় একটাই—তোমাকে ওই প্রতীক মুছে ফেলতে হবে, যেটা ওদের শক্তির উৎস।”
শিহাব কাঁপতে কাঁপতে বলল— “রূপা, ওটা করলে আমাকে মেরে ফেলতে হবে… কারণ ওরা আমাকে ছেড়ে যাবে না।”
রূপার গলা বুজে এল। চোখ ছলছল করে উঠল।
“আমি তোমাকে মরতে দেব না, শিহাব। আমরা একসঙ্গে লড়ব।”
হঠাৎ রান্নাঘরের মেঝে কেঁপে উঠল। দেওয়াল ভেঙে অদ্ভুত ফাটল তৈরি হল। সেখান থেকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এলো, সেই ধোঁয়ার ভেতর মুখ—চোখ লাল, জিভ বেরিয়ে আছে, লম্বা দাঁত।
“তোমরা আমাদের শেষ করতে পারো না! এই ফ্ল্যাটটা আমাদের রক্তে বানানো! তোমরা সবাই আমাদের খাদ্য!”
শিহাব হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। রূপা ওকে টেনে ধরতে গিয়ে নিজেই পড়ে গেল। শিহাব কাঁদতে কাঁদতে বলল— “আমাকে ছেড়ে দাও, রূপা! আমাকে ওরা নেবে! তুমি পালাও…”
রূপা হাত শক্ত করে শিহাবের বুকের ওপর রেখে বলল— “না! তুমি আমার স্বামী। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না!”
সেই কালো মুখগুলো হাহাকার করে উঠল— “তোমরা আমাদের শিকার! রক্ত চাই! আত্মা চাই!”
রূপা বুকের ভেতর সাহসের আগুন জ্বেলে চিৎকার করে উঠল— “তোমাদের শিকল ছিঁড়ব! শিহাবকে বাঁচাব! তোমাদের পাপের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেব!”
ওই প্রতীকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে ভেতর থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে এল।
শিহাব কাতরস্বরে ডাকল— “রূপা! তুমি পুড়ে যাবে! থেমে যাও!”
রূপা ফুঁসে উঠল— “যতই পোড়াও, আমি পাপের শিকল ছিঁড়ব!”
প্রতীকের চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কালো মুখগুলো চিৎকার করে মিলিয়ে যেতে লাগল— “না! না! আমাদের ক্ষমা করো… আমাদের রক্ত… আমাদের…”
একসময় সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আগুন নিভে গেল। দেওয়াল আগের মতো দাঁড়িয়ে, শুধু প্রতীকটা অদৃশ্য। রান্নাঘর আবার আলোকিত।
রূপা শিহাবকে জড়িয়ে ধরল।
“দেখলে, শিহাব? ওরা শেষ।”
শিহাব ধীরে ধীরে চোখ খুলল।
“তুমি সত্যিই অদম্য, রূপা। তুমি আমাকে পাপের করিডর থেকে টেনে বের করে আনলে।”
রূপা হাসল।
“তুমি আর আমি—দুজনেই জিতেছি।”
কিন্তু রান্নাঘরের কোণের দেওয়ালে একটা হালকা ফাটল দেখা যাচ্ছে। সেই ফাটলের ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস বইছে, আর ভেতর থেকে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে— “পাপের করিডর এখনো বাকি…”
পর্ব-৭:
রূপা রান্নাঘরের দেওয়ালের ফাটলটার দিকে স্থিরদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল। ফিসফিসানির আওয়াজ ক্রমেই জোরালো হচ্ছিল। শিহাব পাশে এসে দাঁড়িয়ে একবার হাত ধরে ফেলল— “রূপা, আমরা কী করব এবার? এই ফ্ল্যাটটা আমাদের জন্য অভিশাপ।”
রূপা গম্ভীর গলায় বলল— “শিহাব, করিডরটাকে পুরোপুরি শেষ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের উৎস আছে, ততক্ষণ আমাদের পিছু ছাড়বে না।”
শিহাব কাঁপা গলায় বলল— “কিন্তু উৎসটা কোথায়? আমরা প্রতীকটা তো মুছে ফেলেছি…”
রূপা চোখ বুজে মনে মনে করিডরের শেষ রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল— সেই করিডর, সেই অন্ধকার ঘর, দেয়ালের রক্তের ছোপ, রাহুলের ভয়ঙ্কর ছায়া।
তখনই মনে পড়ল—ঘরের মেঝেতে যে শিকল বাঁধা ছিল, সেটাই ছিল ওদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু!
“শিহাব! ওই অন্ধকার ঘরে একটা লোহার শিকল ছিল—যেটা মেঝেতে গেঁথে রাখা। ওটাই পাপের শেকড়। ওটাকে ছিঁড়ে ফেলতে হবে!”
শিহাব হোঁচট খেয়ে বলল— “ওটা খুললে ওরা আছড়ে পড়বে আমাদের ওপর! আমাদের খেয়ে ফেলবে!”
রূপা দৃঢ় গলায় বলল— “তবুও চেষ্টা করতে হবে। ওদের আর ক’দিন আমাদের ভয় দেখাবে?”
দুজনেই সাবধানে অন্ধকার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বাতি নিভে আছে, বাতাসে পচা রক্তের গন্ধ। শিহাবের গলা শুকিয়ে গেছে। ঘরের মেঝেতে সেই লোহার শিকল, যেটা দেখে রূপার গা শিউরে উঠল। শিকলের চারপাশে আবারও অদ্ভুত প্রতীক—ত্রিভুজের চোখ, রক্তবিন্দুর মতো আঁকিবুকি।
হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে কালো ছায়া পাক খেয়ে উঠল— “আমরা চিরকাল এখানে থাকব… কেউ আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না… রক্ত… রক্ত…!”
শিহাব এক লাফে পেছনে সরে এল। রূপা শিকলের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎই শিকল যেন জীবন্ত হয়ে রূপার পায়ে লেপ্টে গেল।
“তুমি আমাদের দাসী! তুমি আমাদের পাপ বহন করবে!”
রূপা হাতড়াতে হাতড়াতে শিকল ধরে টান দিল। কালো ছায়া ওর শরীরে ঢোকার চেষ্টা করল। শিহাব ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করল— “রূপা! ছেড়ে দাও! ওরা তোমাকে শেষ করে দেবে!”
রূপা সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে উঠল— “শিহাব! আমাকে সাহায্য কর! একসাথে টান!”
শিহাব ভয়কে উপেক্ষা করে দৌড়ে এল, রূপার হাত ধরে শিকলটা টানতে লাগল। হঠাৎ ঘরের দেয়াল কেঁপে উঠল, সিলিং থেকে ধুলো পড়তে লাগল। শিকলটায় আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটে বেরোতে লাগল।
“না! আমাদের দাসী যাবে না! আমাদের দাসী যাবে না!”
“না! রক্ত! রক্ত!”
দেওয়ালের প্রতীকগুলো জ্বলন্ত আগুনের বন্যায় গলে যেতে লাগল। শিকল ছিঁড়ে গেল—এক বিকট চিৎকার আর তীক্ষ্ণ আলো ঘরটাকে ঢেকে ফেলল। সব আলো নিভে যাওয়ার পর রূপা আর শিহাব জড়িয়ে মেঝেতে পড়ে রইল। নিস্তব্ধতা। শুধু কাচ ভাঙার শব্দ। ধীরে ধীরে চোখ মেলে রূপা দেখল—ঘরটা ফাঁকা। কালো ছায়া নেই। রক্ত নেই। শিকলও নেই।
শিহাব কাঁদতে কাঁদতে বলল— “রূপা… শেষ? ওরা গেছে?”
রূপা ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল— “হ্যাঁ, শিহাব। আমরা ওদের বন্দিদশা ভেঙে দিয়ে ওদের মুক্তি দিয়েছি। ওরা আর আমাদের পিছু নেবে না।”
শিহাব ফুঁপিয়ে উঠল— “আমরা বাঁচলাম… সত্যিই বাঁচলাম…”
ভোরের আলো জানালা দিয়ে ঢুকছে। বাইরে পাখির ডাক। সেই ফ্ল্যাট, যেটা এতদিনে অন্ধকার করিডর হয়ে ছিল, এখন যেন নতুন করে শ্বাস নিচ্ছে।
রূপা শিহাবকে আলতো করে বলল— “দেখো, শিহাব, আলো ফুটেছে। এই আলোই আমাদের নতুন জীবন।”
শিহাব হাসল— “হ্যাঁ, রূপা। আমরা নতুন করে শুরু করব।”
দুজনের চোখে একসাথে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ দেওয়ালের ফাটল বুঁজে গেল। করিডর নিস্তব্ধ। রক্তমাখা প্রতীকের বদলে সাদা দেওয়াল। সবকিছু শেষ। রূপা পেছনে ফিরে তাকাল— “বিদায়, করিডর। বিদায়, অন্ধকার।”
শিহাব ওর হাত ধরে বেরিয়ে এল। আর কোনো ছায়া নেই। আর কোনো ফিসফিসানি নেই। রোদ উঠেছে। একটা নতুন জীবন ওদের ডাকছে—পাপের করিডর থেকে মুক্তি পেয়ে।
শেষ