Bangla - ভূতের গল্প

চতুর্দোলার কনে

Spread the love

অদ্রীশ সেনগুপ্ত


পর্ব : পূর্ণিমার রাত

পূর্ববঙ্গ থেকে ভেসে আসা লোককথার মতোই যেন গল্পটা শুরু হয়েছিল। নদীর ধার ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম—দেবীপুর। এই গ্রামে আজও অনেক পুরনো আচার চলে, আর আছে নানারকম অদ্ভুত গল্প, যেগুলো নিয়ে লোকেরা আড্ডা দেয় সন্ধেবেলা পুকুরঘাটে বা মাঠের আলপথে বসে। তবে সবচেয়ে বেশি ফিসফাস হয় যে কাহিনী নিয়ে, তা হলো চতুর্দোলার কনে

এই গ্রামে বছর পঁচিশ আগে একটা বিয়ে ভেস্তে যায়। কনে সীতারা—সাদা মুখশ্রী, টকটকে লাল শাড়ি পরা, চোখে ভয় আর লজ্জার ছায়া। হঠাৎই বিয়ের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকের মতে সে বিষ খেয়েছিল। কিছুদিন পর মৃতদেহকে গ্রামের লোকেরা মন্দিরের পাশে এনে চার বাঁশে বাঁধা চতুর্দোলা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তখন থেকেই গুজব রটে যায়—সে কনে ফেরে পূর্ণিমার রাতে।

লোকেরা বলে, মাঝরাতে গ্রামপথে বা কোনো বিয়ের বাড়ির দরজার সামনে নাকি দেখা যায় লালপাড় শাড়ি পরা এক ছায়ামূর্তি, কারো চোখে ধরা পড়ে না—কিন্তু হঠাৎ কোনো অতিথির ফোনে তোলা ছবিতে ভেসে ওঠে সাদা মুখ, ফাঁপা চোখ আর ঠোঁটে ভৌতিক হাসি।

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। গ্রামে মহালয়ার অনুষ্ঠান শেষ হয়ে পুজোর প্রস্তুতি চলছে। রাতের আকাশে রূপালি আলো ছড়াচ্ছে, আর পদ্মপুকুরের ধারে একদল কিশোর খেলছিল লুকোচুরি। তাদের মধ্যে অভি ছিল সবচেয়ে সাহসী। সে সব শুনে হেসেই উড়িয়ে দিত।

“ভূত বলে কিছু নেই, সব বাজে কথা,” সে বলল।
তখন তার বন্ধু জয় চুপচাপ ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু গতবছর তো হরিপদ কাকু বলেছিল, বৌভাতের দিন বাড়ির গেটের সামনে নাকি দাঁড়িয়ে ছিল এক অচেনা মেয়ে। তার ছবি ধরা পড়েছিল মোবাইলে। এরপরেই গেটের কাছে দুর্ঘটনায় মারা গেল কনে’র ভাই…”

অভি হেসে উঠল, “ওসব মিথ্যে কাকু বানিয়েছে।”
কিন্তু জয় বলল, “আজ পূর্ণিমা, চাইলে আমরা মন্দিরের দিকে গিয়ে দেখে আসতে পারি।”

অভি রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। চারদিকে ফাঁকা, শুধু পোকামাকড়ের ডাক আর দূরে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। তারা দু’জনেই পা বাড়াল মন্দিরের দিকে।

দেবীপুরের মন্দিরের সামনে এক বিরাট বটগাছ, তার শিকড় মাটির ওপর সাপের মতো ছড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় গাছটা যেন রূপকথার ছবির মতো, আবার ভীষণ ভয়ঙ্করও। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনল চারদিক। হঠাৎই বায়ুর সঙ্গে ভেসে এল শাঁখ বাজানোর শব্দ। অথচ মন্দিরে কোনো অনুষ্ঠান ছিল না।

জয় কেঁপে উঠল।
“তুই শুনলি?”

অভি গম্ভীর হয়ে গেলেও ভয় পেল না। “হাওয়ার শব্দ, আর কিছু না।”

ঠিক তখনই তারা দেখল—মন্দিরের সিঁড়ির উপরিভাগে দাঁড়িয়ে আছে সাদা মুখের এক ছায়া। গা-ঢাকা শাড়ি, কপালে লাল টিপ, কিন্তু চোখদুটো অদ্ভুত ফাঁপা। সে দাঁড়িয়ে যেন তাদের দিকেই চেয়ে আছে।

অভির বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হলেও সে এগিয়ে গেল আরও দু’পা। তার মোবাইলটা হাতে ছিল। কাঁপা হাতে সে একটা ছবি তুলল। ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠতেই সিঁড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল—কোনো মানুষ নেই!

কিন্তু ছবিটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল—একজন কনে, চতুর্দোলায় বসে, ঠোঁটে রক্তমাখা হাসি, আর শাড়ির আঁচল ভিজে আছে জলেতে।

অভি চিৎকার করে উঠল। জয় তার হাত ধরে দৌড় দিল মাঠের দিকে। পিছনে কানে এল ভেসে আসা হাসির শব্দ—কোনো নারীর, তীক্ষ্ণ, করুণ, আর শীতল।

পর্ব : ছবির অভিশাপ

রাতটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। অভি আর জয় দৌড়ে ঘরে ফিরে এলেও বুকের ভেতর ঠকঠকানি থামছিল না। অভি তখনও মোবাইলটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। জয় একবারও তাকাতে চায়নি স্ক্রিনে, কিন্তু অভি যখন কেঁপে কেঁপে বলল,
“দেখ, ছবিটা… বদলে যাচ্ছে,” তখন জয় বাধ্য হয়ে তাকাল।

মোবাইলের আলোয় ভেসে উঠল সাদা-শাড়ি পরা এক কনে। কিন্তু এবার সে মন্দিরের সিঁড়িতে নেই। বসে আছে চতুর্দোলায়। তার চোখ যেন সরাসরি তাকিয়ে আছে ক্যামেরার ওপারে—তাদের ঘরের ভেতরে। ঠোঁটের কোণে ফাঁপা হাসি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

জয় গলা শুকিয়ে গেল।
“এটা মুছে ফেল, অভি। প্লিজ মুছে ফেল।”

অভি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল। তার মনে হচ্ছিল, ছবিটা হয়তো কোনো ক্যামেরার বিভ্রান্তি। “ভূত বলে কিছু নেই,” সে বিড়বিড় করে বলল।
কিন্তু জয় শুনতে পাচ্ছিল, ছবির ভেতরে যেন কনের চোখ আস্তে আস্তে নড়ছে।

পরদিন সকালে গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল। দু’জন কিশোর নাকি পূর্ণিমার রাতে মন্দিরে গিয়ে কনের দেখা পেয়েছে। লোকজন কৌতূহলী হয়ে অভিকে ঘিরে ধরল। সে মোবাইল দেখাতে চাইছিল না, কিন্তু চাপের মুখে ছবিটা বের করতেই সকলে চমকে উঠল।
কারণ সেই ছবিতে কনের মুখ এখন আগের চেয়েও পরিষ্কার, যেন ছবিটা প্রতিদিন জীবন্ত হয়ে উঠছে।

এক বৃদ্ধা মাটি ঠুকে বললেন,
“ওই ছবিটা যতদিন থাকবে, ততদিন তোমাদের ঘরে অশুভ ছায়া ঘোরাফেরা করবে। সীতারা শান্ত হয়নি।”

অভি হেসে উড়িয়ে দিলেও জয় আতঙ্কে কাঁপছিল।

রাত নামতেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল। অভির জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ যেন হেসে গেল। দরজার বাইরে রেখে যাওয়া কাকের পালক অজান্তেই উড়ে এসে তার বিছানার পাশে পড়ল। মোবাইলটা টেবিলে রাখলেই স্ক্রিন জ্বলে উঠত, আর ছবির ভেতরে কনে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকাত।

অভির বাবা-মাও অস্বস্তি টের পেলেন। মা চিৎকার করে উঠলেন,
“এটা কোনো স্বাভাবিক ছবি নয়! মুছে ফেল এটা।”

অভি মোবাইল হাতে নিয়ে চেষ্টা করল ছবিটা ডিলিট করার। কিন্তু যতবার সে ডিলিট টিপছিল, স্ক্রিন কালো হয়ে আবার সেই একই ছবি ফিরে আসছিল—আর প্রতিবার কনের চোখ একটু একটু করে কাছে চলে আসছিল।

জয় বুঝতে পারছিল ভয়টা আর কল্পনা নয়, বরং বাস্তব। সে অভিকে বোঝাতে চাইছিল, কিন্তু অভির চোখে তখন অন্য রকম এক উন্মাদনা।
“হয়তো সীতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। আমি জানব ওর আসল গল্প।”

জয় কেঁপে উঠল।
“অভি, তুই বুঝতে পারছিস না—এটা কোনো যোগাযোগ নয়, এটা অভিশাপ।”

ঠিক তখনই মোবাইলের স্পিকারে ভেসে উঠল নারীকণ্ঠ। ভাঙাচোরা ফিসফিসানি—
“আমায় ফিরিয়ে দাও… নইলে তোমাকেও নিয়ে যাব…”

দু’জন একসঙ্গে চমকে উঠল। মোবাইলটা টেবিল থেকে নিজে থেকেই মেঝেতে পড়ে গেল। আর স্ক্রিনে তখন শুধু রক্তমাখা হাতের ছাপ।

বাইরে তখন হঠাৎ হাওয়া বইতে শুরু করেছে। জানলার কাঁচ কাঁপছে। অভি মোবাইলটা আবার হাতে তুলল। জয় ভয়ে পিছিয়ে গেল। আর সেদিন রাতেই প্রথমবার অনুভব করল—অভি হয়তো আর স্বাভাবিক নেই।

পর্ব : হারিয়ে যাওয়া অভি

গ্রামের সকালের আকাশটা সেদিন অদ্ভুত ধূসর ছিল। মেঘলা সূর্য, গুমোট হাওয়া—মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। জয় হঠাৎ চমকে উঠল, কারণ অভি সারা রাত ঘরে থাকলেও সকালে কোথাও নেই। তার দরজা ভেতর থেকে খোলা, বিছানায় শুধু এলোমেলো চাদর আর টেবিলের ওপর মোবাইলটা ফেলে রাখা।

জয় প্রথমে ভেবেছিল হয়তো মাঠে গেছে খেলতে, কিন্তু সময় যত গড়াল ততই অস্বস্তি বাড়তে লাগল। চারপাশে খোঁজ নিয়েও কোনো খোঁজ মেলেনি। অবশেষে সে অভির মোবাইলটা হাতে নিল। স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই বুকের ভেতর রক্ত হিম হয়ে গেল।

ছবির ভেতরে সীতারা এখন একা নেই। তার পাশে বসে আছে অভি—সাদা মুখ, ফাঁপা চোখ, কাঁপা ঠোঁট, যেন কোনো ক্রীড়নক। ছবিটা যেন জানাচ্ছে, অভি আর বাস্তবের পৃথিবীতে নেই।

বাড়ির লোকজন কেঁদে কেটে ফেলল। গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে গেল। অনেকেই বলল—“ওই ছবিই অভিকে নিয়ে গেল। ভূতকে ফ্রেমে বাঁধতে নেই।”

অভির বাবাকে নিয়ে পঞ্চায়েত বসলো। কেউ কেউ বলল থানায় খবর দিতে, আবার কেউ বলল সোজা মন্দিরে যজ্ঞ করতে হবে। কিন্তু অভির মা কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলছিলেন,
“আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও, প্লিজ ফিরিয়ে দাও।”

জয় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। তার বুকের ভেতরে শুধু গিলতে না পারা দম আটকে ছিল। গতরাতের ঘটনার জন্য সে নিজেকে দায়ী করছিল।

সন্ধেবেলা জয় আবার একা অভির ঘরে গেল। টেবিলে মোবাইলটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। স্ক্রিন জ্বালাতেই দেখা গেল ছবিটা নতুন রূপ নিয়েছে। এবার চতুর্দোলা ভেসে উঠেছে নদীর জলে, আর সীতারার কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে অভি। তার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।

জয় ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল, কিন্তু একইসঙ্গে তার ভেতরে তীব্র কৌতূহল জেগে উঠল। অভি যদি ছবির ভেতরে ঢুকে যায়, তবে হয়তো সীতারার মৃত্যুর রহস্যও সেখানেই লুকোনো।

সেদিন রাতে জয় অশান্তিতে ঘুমোতে পারল না। বাইরের হাওয়ায় ভেসে আসছিল মৃদু শাঁখধ্বনি। সে জানালার দিকে তাকাল—দূরে পদ্মপুকুরের ধার দিয়ে একটা চতুর্দোলা ভেসে যাচ্ছে। তার ভেতরে বসা এক কনে, আর পাশে—অভি।

জয় চমকে উঠল, চোখ কচলাল, কিন্তু কিছুই আর দেখা গেল না। শুধু কানে ভেসে এল ক্ষীণ স্বর—
“আমাকে বাঁচাও…”

পরদিন সকালে জয় সিদ্ধান্ত নিল। সে আর চুপ করে বসে থাকবে না। তাকে সীতারার মৃত্যুর সত্যিটা জানতে হবে। তাই সে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের প্রবীণদের খোঁজে, যারা হয়তো সব জানে কিন্তু মুখ খোলে না।

পর্ব : সীতারার মৃত্যু

দেবীপুর গ্রামে কথা বলে কথা মেলে না। জয় ঘুরে বেড়াচ্ছিল সকাল থেকে, কারও ঠোঁট খুলছিল না। সবাই যেন কোনো অদৃশ্য ভয়ে চেপে আছে। শেষ পর্যন্ত পুকুরঘাটে বসে থাকা বৃদ্ধা হরিমতিকে পেয়ে গেল সে। হরিমতি গ্রামের একমাত্র মানুষ, যিনি তখনও জীবিত ছিলেন যখন সীতারার বিয়ে ভেস্তে গিয়েছিল।

জয় কাছে বসতেই বৃদ্ধার চোখ ছায়ামাখা হয়ে উঠল।
“তুই সীতারার খোঁজ করছিস?”
জয় মাথা নাড়ল।
বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ওই মেয়েটার কষ্টের কথা জানলে তোকে আর শান্তি দেবে না।”

হরিমতির কণ্ঠে ধীরে ধীরে খুলে গেল এক ভয়ঙ্কর কাহিনী।

পঁচিশ বছর আগে সীতারা ছিল গ্রামের সবার প্রিয় মেয়ে। সুন্দরী, শান্ত স্বভাবের, আর গলায় দারুণ গান ছিল। তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল পাশের গ্রামে এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে। কিন্তু কথায় কথায় পাত্রপক্ষের লোভ ফুঁসে উঠতে লাগল। আরও সোনাদানা, আরও নগদ চাই।

সীতারার বাবা তখন দীনহীন মানুষ। শর্ত পূরণ করতে পারেননি। বিয়ের দিনই পাত্রপক্ষ হট্টগোল বাধিয়ে তোলে। কানাঘুষো ছিল—পাত্রর ভাই সীতারার সৌন্দর্যে মোহগ্রস্ত হয়ে তাকে পেতে চাইত। আর তাই জোর করেই বিষ খাইয়ে তাকে বধূবাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

বৃদ্ধা বললেন,
“ও মরে যায়নি সেদিন। অজ্ঞান অবস্থায় নদীর ঘাটে নিয়ে গিয়ে চার বাঁশে বেঁধে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। জলে ডুবে শেষ নিশ্বাস যায় তার। তাই তো তার আত্মা আর শান্তি পায়নি। প্রতি পূর্ণিমায় সে ফিরে আসে, যেকোনো বিয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।”

জয়ের চোখে জল চলে এল।
“তাহলে অভি… অভিও কি সেই অভিশাপে আটকে গেছে?”

বৃদ্ধা মাথা নিচু করলেন।
“যে-ই কনের ছবি তোলে, সে কনের দলে যোগ দেয়। সীতারা তার দুঃখের সাক্ষী খুঁজছে, সঙ্গী খুঁজছে।”

জয় কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“কোনো উপায় নেই তাকে শান্ত করার?”

বৃদ্ধা গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে বললেন,
“শান্তি নয়, সে প্রতিশোধ চায়। আর প্রতিশোধ না মেটা পর্যন্ত তার চতুর্দোলা ভেসে যাবে নদীর জলে।”

সেদিন রাতে জয় ঘুমোতে পারল না। বারবার মনে পড়ছিল সীতারার মুখ, তার শাড়ি ভিজে যাওয়া আঁচল, আর অভির ফাঁপা চোখ। বাইরে নদীর দিকে তাকিয়ে সে দেখল—চাঁদের আলোয় জল কেমন ভয়ঙ্কর ঝিকমিক করছে।

আর হাওয়ার ভেতরে ভেসে এল মেয়েলি গলা—
“আমায় ন্যায় দাও… না হলে আমি তোমাকেও নিয়ে যাব…”

জয়ের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল।

পর্ব : বিয়ের বাড়ির অশনিসংকেত

দেবীপুর গ্রামে হঠাৎ আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। বছর ঘুরতেই ঘোষপাড়ার নীলমণি ঘোষের মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো। পূর্ণিমার ঠিক দু’দিন পরেই বিয়ের তারিখ। সারা গ্রামে সাজসজ্জার ধুম পড়ে গেল। কিন্তু আনন্দের মাঝেই জয় অনুভব করছিল বুকের ভেতরে জমে থাকা এক অদৃশ্য ভয়।

হরিমতি দিদার কথা তার কানে বাজছিল বারবার—“যে বিয়ের বাড়ি হবে, সেই বাড়ির গেটেই দাঁড়াবে সীতারা।”

জয় চেষ্টাই করছিল সতর্ক করতে, কিন্তু কেউ শোনেনি।
“ভূতের ভয় দেখাচ্ছিস নাকি? মেয়ে বিয়ে দিচ্ছি, ভয়-টর পেতেই হবে?”—নীলমণি ঘোষ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

বিয়ের আগের দিন রাতে গ্রামে মহড়া চলছিল। আলো ঝলমলে আলপনা, শাঁখধ্বনি, গানের আওয়াজ। জয় ভিড়ের মধ্যেও বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছিল। মোবাইল হাতে একবার ছবি তুলতেই বুক কেঁপে উঠল। কারণ স্ক্রিনে সে দেখল—গেটের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা মুখ, লাল শাড়ি পরা এক কনে।

সে চোখে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ছবিতে স্পষ্ট। জয় আর কাউকে দেখাতে সাহস পেল না। মোবাইল অফ করে ফেলল কাঁপা হাতে।

বিয়ের দিন ভোর থেকে অদ্ভুত সব লক্ষণ দেখা দিল। বরের গাড়ি আসার আগে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। ফুলের মালা ছিঁড়ে গেল, আলো নিভে গেল বারবার। সকলে বলছিল “আবহাওয়ার খেলা”—কিন্তু জয় জানত এটা অন্য কিছু।

বরযাত্রী যখন গ্রামে ঢুকল, ঠিক তখনই পূর্ণিমার চাঁদ উঠল আকাশে। আর বিদ্যুৎ একেবারে চলে গেল। গ্রাম অন্ধকারে ডুবে গেল মুহূর্তে।

চিৎকার উঠল গেটের দিক থেকে।
“কে ওখানে? কে দাঁড়িয়ে আছে?”

আলোর ঝলক ফিরে আসতেই দেখা গেল গেটের বাইরে কারও দেখা নেই। কিন্তু ভেতরে যারা ছিল তারা বলল—হঠাৎ করেই এক কনে দাঁড়িয়েছিল লাল শাড়ি পরে, হাত তুলে তাদের দিকে তাকিয়ে।

জয়ের বুক হুহু করে উঠল। সে বুঝল, সীতারা ফিরে এসেছে।

আর তখনই ঘটে গেল অশনি সংকেত। গেটের পাশেই রাখা আতশবাজির বাক্স হঠাৎ আগুন ধরে বিস্ফোরিত হলো। চিৎকারে গ্রাম কেঁপে উঠল। কয়েকজন আহত হলো।
সবাই যখন দৌড়াদৌড়ি করছে, জয় স্পষ্ট শুনল কানের কাছে নারীকণ্ঠের ফিসফিস—
“এটা শুরু মাত্র…”

রাত্রি বাড়তে থাকল, বিয়ের আচার এগোতে থাকল, কিন্তু গেটের বাইরে অন্ধকারে কেউ যেন অবিরত নজর রাখছিল। আর জয় অনুভব করছিল, এই রাত শান্তিতে শেষ হবে না।

পর্ব : মৃতের ডাকে

বিয়ের বাড়ি তখনো বিশৃঙ্খলায় ভরা। আতশবাজির আগুনে যাদের সামান্য পুড়েছে, তারা গোঙাচ্ছে, আর যাদের কিছু হয়নি তারা আতঙ্কে ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও আচার চলছিল—কারণ গ্রাম্য মানুষদের বিশ্বাস, বিয়ে থামানো মানেই অশুভ।

জয় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, আলো-অন্ধকারের আড়ালে যেন কারও ছায়া লুকিয়ে আছে। পূর্ণিমার আলোয় মাঝে মাঝে ঝিকমিক করছে লাল শাড়ির আভা।

বরযাত্রীদের মধ্যে তখনো কেউ কেউ গান গাইছিল, কেউ হাসছিল। কিন্তু হঠাৎই হৈচৈ শুরু হলো। একজন লোক হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল কেউ অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু একটু পরেই দেখা গেল, তার শরীরে কোনো নড়াচড়া নেই।

বরযাত্রীদের মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে উঠল—
“এ লোক তো… বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে! কীভাবে এল এখানে?”

চমকে উঠল সকলে। নামটা যখন প্রকাশ হলো, জয় কেঁপে উঠল। লোকটার নাম ছিল নীলু। পাঁচ বছর আগে বরযাত্রীদের সঙ্গে যাওয়া পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল সে। অথচ আজ আবার সে এসেছে, বরযাত্রী সেজে!

লোকেরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। কেউ কেউ কাঁপা গলায় বলল—
“এটা সীতারার ডাকে এসেছে।”

জয় দেখল, মৃত নীলুর ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি, আর তার চোখ স্থির তাকিয়ে আছে বিয়ের কনের দিকে। তারপর আচমকা যেন অদৃশ্য হাত টেনে নিয়ে গেল তাকে অন্ধকারের ভেতর। মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেল নীলু।

সবার চোখ কপালে। কেউ কেউ কেঁদে ফেলল, কেউ দৌড়ে পালাতে চাইলো।

ঠিক তখনই জয় নিজের কানে শুনতে পেল ফিসফিসানি—
“একজন নয়… আরও আসবে… প্রতিটি মৃত বরযাত্রী আসবে আমার ডাকে।”

জয়ের মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, সীতারা শুধু প্রতিশোধ চাইছে না, সে মৃতদের ফের ডাকছে। বরযাত্রীদের শোভাযাত্রা আর জীবিতদের ভিড়ে এখন থেকে ঘুরে বেড়াবে মৃত আত্মারাও।

রাত্রি তখন গভীর হচ্ছিল। হঠাৎ গ্রামের কুলঘাটের দিক থেকে শাঁখ বাজল। কিন্তু সেটা কারও হাতের বাজানো নয়, যেন জলের নিচ থেকে আসছে। সেই সঙ্গে উঠল এক নারীকণ্ঠের অট্টহাসি—তীক্ষ্ণ, শীতল, আর ভেদ করা কান্নার মতো।

জয় বুক চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হলো, পুরো গ্রামটা আস্তে আস্তে সীতারার মৃত্যুর ফাঁদে ঢুকে যাচ্ছে। আর অভি, যে প্রথম ছবি তুলেছিল, সে এখন এই খেলার অন্যতম শিকার।

পর্ব : মন্দিরে রক্তস্নান

রাত্রি যতই গভীর হচ্ছিল, দেবীপুর গ্রামের চারপাশ যেন অচেনা হয়ে উঠছিল। দূরের বাঁশঝাড়ে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল, বাতাসে কেমন এক ধাতব গন্ধ, আর আকাশে ভাসছিল পূর্ণিমার রূপালি আলো। বিয়ের বাড়ির হট্টগোল থেকে সরে এসে জয় একা হেঁটে চলল মন্দিরের দিকে।

তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত টান অনুভব করছিল—যেন কেউ ডাকছে। হরিমতি দিদার সতর্কবাণী তার কানে বাজছিল—“শান্তি নয়, সে প্রতিশোধ চায়।” তবু জয় ভাবছিল, হয়তো প্রার্থনা করলে, হয়তো সত্য স্বীকার করলে আত্মা শান্তি পাবে।

মন্দিরটা ফাঁকা ছিল। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই জয় বুঝল কিছু অস্বাভাবিক। মাটিতে কেমন ভিজে ভিজে লাল দাগ পড়েছে। প্রথমে ভেবেছিল সিঁদুর, কিন্তু একটু কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো—ওগুলো রক্ত। পুরনো, শুকনো রক্তের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

হঠাৎ কানে এলো অনেকগুলো মেয়ের কান্নার শব্দ, যেন চারদিক থেকে ভেসে আসছে। জয় ভয়ে জমে গেল। মন্দিরের মাঝখানে রাখা পাথরের দেবীমূর্তির চোখের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে পিছিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু দরজা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে।

অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে উঠল সীতারার রূপ। এবার আর অর্ধেক ছায়া নয়—পুরো রক্তমাখা কনে। লাল শাড়ি ভিজে গেছে গাঢ় রক্তে, মুখে অদ্ভুত হাহাকার মেশানো হাসি।

“আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল… বেঁচে থেকেও মরতে হয়েছিল আমাকে। এখন কেউ বাঁচবে না। প্রতিটি বিয়ের বাড়ি হবে রক্তের বাড়ি।”

জয় কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তুমি চাইছো প্রতিশোধ… কিন্তু কাকে শাস্তি দেবে? যারা তোমায় মেরেছিল তারা তো নেই।”

কনের চোখ লালচে হয়ে উঠল।
“তাদের রক্ত আমি নিয়েছি। এবার তাদের বংশ, তাদের গ্রাম—সবকিছুকে আমি অভিশাপ দেব।”

ঠিক তখনই মন্দিরের ভেতর চিৎকার ভেসে এল। জয় দেখল, মাটিতে রক্ত জমে উঠছে আর তার ভেতর থেকে উঠছে হাত, অসংখ্য হাত, যারা বিয়ের রাতে হারিয়ে যাওয়া আত্মারা। তারা সবাই সীতারার চারপাশে দাঁড়িয়ে, তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে।

জয়ের বুক ঠকঠক করছে। সে মোবাইলটা বের করে ছবি তুলল—আর মুহূর্তেই স্ক্রিনে দেখা গেল রক্তস্নাত চতুর্দোলা, যেখানে বসে আছে সীতারা আর তার চারপাশে শত শত অশরীরী।

মন্দিরের ভেতর ভীষণ কোলাহল শুরু হলো। দরজা হঠাৎ খুলে গেল প্রবল ঝড়ে। জয় দৌড়ে বাইরে বেরোল, কিন্তু তখনও তার কানে বাজছিল এক ভৌতিক অট্টহাসি—যেন সারা গ্রামকে ভেসে দিল শীতল স্রোতে।

সে বুঝল, এবার গ্রাম আর রক্ষা পাবে না।

পর্ব : শেষ চতুর্দোলা

গ্রাম তখন ভয়ে কাঁপছে। মন্দির থেকে জয় দৌড়ে বেরোনোর পর খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে—সীতারা নাকি ফিরে এসেছে পূর্ণ রূপে, আর মন্দির ভরে গেছে রক্তের স্রোতে।

গ্রামপঞ্চায়েত, পুরোহিত, সবাই মিলে শেষ সিদ্ধান্ত নিল—এই অভিশাপ থামাতে হবে আজ রাতেই। মন্দিরের প্রাঙ্গণে বড় যজ্ঞের আয়োজন হলো। ধূপ, আগুন, শাঁখ, মন্ত্র—সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত আতঙ্ক আর আশার পরিবেশ তৈরি হলো।

জয় যজ্ঞস্থলে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে তখনও ভাসছিল মন্দিরের সেই রক্তস্নান, আর অভির মুখ। সে জানত—যদি এই রাতে কিছু না করা যায়, তবে আর কেউ বাঁচবে না।

মধ্যরাতে হঠাৎ চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শাঁখধ্বনি থেমে গেল, আগুন নিভে এল। সবাই একসঙ্গে ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখল—গভীর নদীর জলে ভেসে উঠেছে একটা চতুর্দোলা।

চাঁদের আলোয় ভেসে উঠল সীতারা। রক্তমাখা লাল শাড়ি, ফাঁপা চোখ, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। আর তার কোলের পাশে বসে আছে অভি—মৃত নাকি জীবিত বোঝা যায় না।

গ্রামের লোকজন শিউরে উঠল। পুরোহিত মন্ত্র পড়তে লাগলেন, আগুন জ্বালাতে লাগলেন। কিন্তু নদীর ঘাট থেকে ভেসে এল এক অট্টহাসি—যেন কানে ছুরি চালাল।

জয় হঠাৎ অনুভব করল, তাকে কিছু করতে হবে। সে নদীর দিকে দৌড় দিল, আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল,
“সীতারা! তুই প্রতিশোধ চাইছিস, আমি জানি! কিন্তু এরা দোষী নয়, এরা নির্দোষ মানুষ। তুই যদি ন্যায় চাই, তবে আমায় নিয়ে যা—গ্রামকে ছেড়ে দে।”

চতুর্দোলার ভেতরে সীতারা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে তার চোখ ঘুরল জয়ের দিকে। অভির নিস্তেজ দেহকে আঁকড়ে সে মৃদু হাসল।

নদীর জল হঠাৎ তোলপাড় হতে লাগল। ঘূর্ণির মতো টেনে নিতে লাগল চতুর্দোলা। গ্রামবাসীরা ভয়ে পিছু হটল। জয় দাঁড়িয়ে রইল নদীর ধারে, বুক কাঁপছে, কিন্তু চোখ সরাল না।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সীতারার ঠোঁট কেঁপে উঠল—
“ন্যায় আমি পেয়েছি…”

চতুর্দোলা ধীরে ধীরে নদীর গভীরে ডুবে গেল। ঝড় থেমে গেল। হাওয়া শান্ত হলো। গ্রাম আবার নিস্তব্ধ।

সকালবেলা গ্রামবাসীরা দেখল, নদীতে আর কোনো চিহ্ন নেই। মন্দিরে রক্তের দাগও মিলিয়ে গেছে। মানুষজন বলল, অভিশাপ কেটে গেছে।

কিন্তু জয় জানত—অভি আর ফিরবে না। তার মোবাইলের ছবিগুলো মুছে গেছে, ফাঁকা স্ক্রিন। তবুও মাঝেমধ্যে পূর্ণিমার রাতে সে অনুভব করত, নদীর দিক থেকে ভেসে আসছে শাঁখের শব্দ আর মৃদু কণ্ঠ—
“এখনও আমি আছি…”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-10-03-at-12.50.03-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *