সুদীপ্ত পাল
১
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে এই মুহূর্তটি ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং অস্থিরতার মিশ্রণ। তার দীর্ঘদিনের গবেষণার অবসানপ্রাপ্তি তাকে এক নতুন অভিযানে নিয়ে আসছে—পুরুলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলের গভীরে লুকানো একটি প্রাচীন নগরীর সন্ধানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির আবর্জনায় তিনি বহু পুরনো মানচিত্র এবং বিভিন্ন ধরণের প্রাচীন খণ্ডচিত্র পরীক্ষা করেছিলেন। নিখুঁত বিশ্লেষণ এবং শতাধিক নথি পরীক্ষা করার পরও নগরীর অবস্থান আজও রহস্যময় ছিল। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীদের মুখে ছড়িয়ে থাকা কাহিনী এবং মূর্তিভঙ্গিতে উপস্থিত সতর্কবার্তাগুলি তাকে ভয় দেখাতে পারেনি; বরং প্রতিটি গল্পে লুকানো রহস্য তাকে আরও উত্তেজিত করে তুলেছিল। গ্রামের বৃদ্ধরা বলেন, “যারা সেই বনপথে প্রবেশ করেছে, তারা আর ফিরে আসেনি, কিংবা ফিরে এলে অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে।” অর্পণ জানত, প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে লুকানো আছে তার গবেষণার সাফল্যের চাবিকাঠি। তাই, প্রতিটি পদক্ষেপকে সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করে, সে তার ব্যাগে গবেষণার সরঞ্জাম, মানচিত্র, খাবার এবং জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে যাত্রা শুরু করল। পাহাড়ের ঢালু পথ এবং ঘন জঙ্গল তাকে প্রথমেই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে, প্রকৃতির এই অবলম্বন কেবল সৌন্দর্য নয়, বিপদেরও বার্তা বহন করে।
পাহাড়ি ট্রেইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে অর্পণকে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হচ্ছিল, যা শহরের হাহাকার থেকে একেবারে ভিন্ন। শীতল বাতাস, পাখির কলরব, এবং নদীর মৃদু স্রোত—সবকিছু যেন তাকে একটি অন্য জগতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে লক্ষ্য করল, প্রতিটি বাঁক এবং নদী তাকে যেন হঠাৎই ভয়ঙ্কর রহস্যের আভাস দিচ্ছে। ঘন বন থেকে হঠাৎ কোনো পশুর শব্দ, কিংবা লতা-গাছের দুলনির কম্পন, অর্পণের মনকে সতর্ক করছিল। সে থেমে থেমে চিহ্নিত করছিল স্থানটি, প্রতিটি কাঠের গাছের ছাপ, অদ্ভুতভাবে ঘুরে আসা নদী, আর পাহাড়ের গাঢ় ছায়া—সবকিছুই যেন এই হারানো নগরীর সঙ্গে সম্পর্কিত রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। মাঝেমাঝে অর্পণ নিজের ভ্রাম্যমাণ নোটবুকে সবকিছু লিখে রাখত, যাতে পরবর্তী বিশ্লেষণে তা কাজে লাগানো যায়। বনযাত্রার প্রতিটি মুহূর্তেই সে তার ইন্দ্রিয়কে সম্পূর্ণরূপে সতর্ক রাখছিল। পথ চলার সময় সে লক্ষ্য করল, পাহাড়ের গাঢ় ছায়ার মধ্যে অদ্ভুত কিছু পাথরের গঠন দেখা যাচ্ছে, যা এক ধরনের প্রাচীন নির্মাণের ইঙ্গিত বহন করছে। অর্পণ বুঝতে পারল, এটি শুধুই সাধারণ পাহাড়ি পাথর নয়; বরং প্রাচীন মানুষের ছাপ বা খণ্ডনির্মাণ হতে পারে, যা হারানো নগরীর দিকে ইঙ্গিত করছে।
কয়েক ঘণ্টার পর, অর্পণ একটি ছোট নদীর পাশে পৌঁছাল। নদীটি এতটাই অচেনা এবং শান্ত, যে তার পানি যেন আকাশের ছায়া ধারণ করেছে। নদীর ধারে বসে সে নিজের মানচিত্র আবার যাচাই করল। সে দেখতে পেল, নদীর বাঁকে একটি অদ্ভুত উঁচু স্তূপাকৃতি চূড়া, যা হয়তো নগরীর প্রাচীন দুর্গ বা মন্দিরের অংশ হতে পারে। অর্পণ বুঝতে পারল, তার যাত্রা এখানেই নতুন মোড় নেবে। ঘন বন, পাহাড়ি ঢাল এবং নদীর সংযোগস্থল—সব মিলিয়ে একটি প্রাচীন নগরীর অবস্থান নির্দেশ করছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে একটি শিহরণও অনুভূত হচ্ছিল—এক অজানা বিপদ, যা শুধু কৌতূহলপূর্ণ গবেষককেই নয়, বরং যে কেউ সাহস করে সেখানে প্রবেশ করবে, তাকে টেনে নেবে একটি রহস্যময় গল্পের গভীরে। অর্পণ গভীর নিশ্বাস নিল, তার চোখে আগ্রহ এবং মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা; সে জানত, এই যাত্রা শুধু তার গবেষণার সাফল্য নয়, বরং তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তাই, নদীর তীর ধরে আবার ট্রেইল ধরে চলতে শুরু করল, প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন রহস্যের খোঁজ, নতুন ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ এবং হারানো নগরীর সন্ধান—এটাই ছিল তার অদম্য উদ্দেশ্য।
২
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য দিনটি শুরু হয়েছিল কলকাতার এক পুরোনো গ্রন্থাগারে প্রবেশের সঙ্গে। গরম দুপুরের রোদ বাইরে ঝলমল করছিল, কিন্তু গ্রন্থাগারের ভেতরের অন্ধকার ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত শান্তি তাকে গ্রাস করল। এই গ্রন্থাগারটি শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর পাশে হলেও একেবারেই ভিন্ন, যেন সময় এখানে থেমে গেছে। বইয়ের ধুলো এবং পুরনো কাগজের গন্ধ অর্পণের মনকে আকৃষ্ট করল। সে খুঁজতে খুঁজতে এক গোপন চিত্রশালা বা “আর্কাইভ রুম”-এ পৌঁছল, যেখানে প্রাচীন নথি, মানচিত্র, এবং খণ্ডচিত্র সংরক্ষিত ছিল। তার চোখে এক মানচিত্র পড়ল, যা তার জীবনের দিক পরিবর্তন করার মতো ছিল। মানচিত্রটি ছিল হাতে আঁকা, বর্ণময় প্রতীক এবং অদ্ভুত রেখাচিত্রে পূর্ণ। প্রথম দেখাতেই অর্পণ বুঝতে পারল, এটি শুধু একটি ভূগোলিক মানচিত্র নয়; এর প্রতিটি রেখা, প্রতিটি চিহ্ন গভীর অর্থ বহন করছে। মানচিত্রের কিছু স্থানে অদ্ভুত প্রতীক নকশা করা ছিল—এক রকমের বৃত্তাকার চিহ্ন, অর্ধচন্দ্রাকার চিহ্ন, এবং অজানা চিহ্নমালার সংমিশ্রণ। অর্পণ বুঝতে পারল, এটি কোনো সাধারণ নগরীর পরিকল্পনা নয়; বরং এটি একটি তন্ত্রচর্চার সাথে সম্পর্কিত রহস্যপূর্ণ নির্দেশ।
মানচিত্রের প্রতি অর্পণের দৃষ্টি যখন স্থির হলো, তখন তার মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা এবং ভয়ের অনুভূতি জেগে উঠল। প্রতিটি প্রতীক যেন তার সঙ্গে কথা বলছে, তাকে আহ্বান করছে এই হারানো নগরীর গভীরে প্রবেশ করার জন্য। সে ধীরে ধীরে প্রতিটি চিহ্নের মানে বিশ্লেষণ করল, তার গবেষণার জ্ঞান এবং অতীতের প্রাচীন লেখা সম্পর্কে ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে। মনে মনে সে ভেবেছিল, এই নগরী কখনো সাধারণ মানুষের জন্য ছিল না; এটি এমন কিছু মানুষের আবাসস্থল, যারা প্রাচীন তন্ত্র এবং রহস্যময় শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। প্রতিটি প্রতীক, প্রতিটি লাইন, এমনকি মানচিত্রের প্রান্তে থাকা ছোট ছোট চিহ্নও তার মনে রহস্যের নতুন স্তর যোগ করল। অর্পণের হাত অস্থির হয়ে ওঠে; একটি অদ্ভুত তৃষ্ণা তাকে আরও গভীরে যাওয়ার জন্য উসকে দিচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে ভয় তাকে সতর্ক করছিল। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সে বুঝতে পারল, কোনো গবেষক কখনো এমন রহস্যের সামনে আবির্ভূত হলে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে না।
রাত গভীর হতে হতে অর্পণ মানচিত্র নিয়ে নিজের ল্যাবরেটরিতে ফিরে আসে। চিরকালীন মোমবাতির আলোর নিচে মানচিত্রকে সে আবার পর্যবেক্ষণ করে, প্রতিটি রেখা এবং প্রতীককে বিশ্লেষণ করতে করতে। সে লক্ষ্য করল, মানচিত্রের কেন্দ্রে একটি বড় অজানা চিহ্ন আছে, যা সম্ভবত নগরীর মূল কেন্দ্র নির্দেশ করছে। এই কেন্দ্রে প্রবেশ করলে যা ঘটতে পারে, তা অর্পণ কল্পনাও করতে পারছিল না। তন্ত্রচর্চার সংকেত এবং প্রাচীন প্রতীকগুলোর মিলনে একটি অদ্ভুত রহস্য ফুটে উঠছিল, যা নগরীর অতীতকে আজকের দিনের সঙ্গে সংযুক্ত করছে। অর্পণ গভীর নিশ্বাস নিল, অনুভব করল ভয় এবং উত্তেজনা একত্রিত হয়ে তার শরীরের প্রতিটি কোণে প্রবাহিত হচ্ছে। সে জানত, এই মানচিত্র শুধু প্রাচীন নগরীর অবস্থান নির্দেশ করছে না, বরং এটি একটি বিপজ্জনক যাত্রার দরজা খুলে দিচ্ছে, যেখানে কেবল জ্ঞানই নয়, সাহসও পরীক্ষা হবে। সেই রাতের নিরবতা এবং মানচিত্রের প্রতীক তার মনে চিরকাল অদ্ভুত এক রহস্যের অনুভূতি রেখে যায়, যা তাকে আরও গভীরে খুঁজে বের করার জন্য উসকানি দিচ্ছিল।
৩
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাত্রা ঘন জঙ্গলের দিকে যখন এগিয়ে গেল, তখন দুপুরের আলো হটেই অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে গেল। গাছের লতা-গাছের ছায়ায় পাহাড়ি পথটি যেন এক রহস্যময় স্বপ্নের মতো হয়ে উঠল। সে প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকল, কারণ স্থানীয় গ্রামবাসীরা বহুবার সতর্ক করেছিল যে এই জঙ্গল বিপজ্জনক। তবে অর্পণের কৌতূহল তাকে থামাতে পারল না। দিনের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে রাতে রূপান্তরিত হলো। সন্ধ্যার পর, জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে অদ্ভুত সঙ্গীতের মতো শব্দের উদ্ভব হলো—পাখি, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, আর হয়তো বনজঙ্গলের অন্য রহস্যময় প্রাণীর অদ্ভুত আওয়াজ। অর্পণ তার মানচিত্র ও ল্যাম্প নিয়ে পথ চলতে চলতে অনুভব করল, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তার হৃৎপিন্ড দ্রুত বেজে উঠল, তবে মন তার সাহসকে বলছিল, “এটাই তোমার গবেষণার পথ।” তার চারপাশের পরিবেশে এক ধরনের চাপ এবং রহস্যময়তা অনুভূত হচ্ছিল, যা শহরের জীবনের একেবারেই বিপরীত।
রাতের গভীরে অর্পণ একটি ছোট খোলা জায়গায় পৌঁছাল। চাঁদের মৃদু আলো পাতার ফাঁক দিয়ে পড়ছিল, আর হাওয়ার সঙ্গে লতাগাছের ছায়া নাচছিল। হঠাৎ, দূরে কিছু অচেনা শব্দের উদ্ভব হলো। এটি ছিল কোনো প্রাণীর আওয়াজের মতো, কিন্তু একই সঙ্গে যেন মানুষের মন্ত্রচর্চার সুরও শুনা যাচ্ছিল। অর্পণ প্রথমে ভেবে নিয়েছিল এটি তার কল্পনার খেলা, কিন্তু শব্দ ক্রমশ ঘনিয়ে আসল এবং স্পষ্ট হলো যে, এটি কোনো সাধারণ বনজীবীর ধ্বনি নয়। তার শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। মনে হলো, অদৃশ্য কোনো শক্তি তার চারপাশে অবস্থান করছে। সে চেষ্টা করল গভীর নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে, কিন্তু অদ্ভুত শব্দগুলি যেন তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল। প্রতিটি ধ্বনি তার নিদ্রা এবং মনোবলকে নাড়া দিচ্ছিল। অর্পণ বুঝতে পারল, এই বন শুধু জৈবিক প্রাণীর আবাস নয়; এখানে এমন শক্তি বিদ্যমান যা প্রাচীনকাল থেকে লুকানো, এবং মানুষ এই এলাকায় প্রবেশ করলে তা অনুভব করতে পারে।
রাত্রি যত গভীর হচ্ছিল, অর্পণের অনুভূত ভয়ও তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে তার তম্বুর, মানচিত্র এবং জরুরি সরঞ্জাম নিয়ে একটি নিরাপদ স্থান খুঁজতে শুরু করল, যেখানে সে রাত কাটাতে পারে। চারপাশের অন্ধকারে ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেছিল, গাছের পাতা ভয়ঙ্কর মুখের মতো দুলছিল, এবং দূরের মন্ত্রধ্বনি আরও জোরালো হচ্ছে। অর্পণ নিজেকে আশ্বাস দিতে বলল, “তুমি একজন গবেষক, ভয়কে পাশ কাটিয়ে সত্যের সন্ধান করো।” কিন্তু সে জানত, এই রাতটি তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি হতে চলেছে। সে বসে, মাটি ছুঁয়ে এবং হালকা দোয়া করতে করতে, সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। বন তার চারপাশে নিঃশব্দে কথা বলছিল, প্রতিটি পাখি, প্রতিটি হাওয়া, প্রতিটি শাখা যেন তাকে একটি গুপ্ত বার্তা পাঠাচ্ছিল। সেই রাত, ঘন অন্ধকার, অদ্ভুত মন্ত্রধ্বনি, এবং অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি—সব মিলিয়ে অর্পণের মনে এক অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর উত্তেজনা তৈরি করল। সে বুঝতে পারল, এই যাত্রা শুধু একটি নগরীর খোঁজ নয়; এটি এক রহস্যময়, প্রাচীন এবং বিপজ্জনক জগতের দরজা খুলে দিচ্ছে, যেখানে মানবজ্ঞান ও সাহসের পরীক্ষা চলবে।
৪
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ি ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলছিল। ঘন জঙ্গলের অন্ধকার আর রাতের নিস্তব্ধতা তাকে তর্কাতীতভাবে সতর্ক করছিল, কিন্তু তার গবেষণার আগ্রহ আরও তীব্র হয়ে উঠছিল। হঠাৎ, মাটির ঢালু পথে একটি প্রাচীন স্তূপ তার দৃষ্টিতে পড়ল। স্তূপটি এতটাই পুরনো ছিল যে, এর পাথরের ছায়ায় সময়ের চিহ্ন এবং ছিঁড়ে যাওয়া খোদাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল স্তূপের উপর খোদাই করা অজানা প্রতীকগুলি—এক ধরনের জটিল রেখাচিত্র, যা পূর্ববর্তী মানচিত্রের প্রতীকগুলির সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। অর্পণ কাছে গিয়ে সেই খোদাই পরীক্ষা করল। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি চিহ্ন যেন কোনো প্রাচীন তন্ত্রচর্চার শক্তি বহন করছে। সে বুঝতে পারল, এই স্তূপ নগরীর কেন্দ্রীয় অংশের দিকে একটি নির্দেশ, যা প্রাচীন প্রার্থনা এবং মন্ত্রচর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত। তার মন কৌতূহল এবং ভয়ের মিশ্রণে দোলা খাচ্ছিল। সে লক্ষ্য করল, স্তূপের চারপাশে মাটি ও ঘাসের অদ্ভুত বিন্যাস রয়েছে, যা কোনো পরিকল্পিত আয়োজনের ইঙ্গিত দিচ্ছিল—এক ধরনের প্রাচীন রক্ষা ব্যবস্থা, যাতে কেউ সহজে নগরীর কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারে।
ঠিক সেই সময়, অর্পণ হঠাৎ একটি অদ্ভুত ছায়া লক্ষ্য করল। ছায়াটি ধীরে ধীরে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসল। প্রথমে মনে হল এটি কেবল বাতাসে দুলছে পাতা বা কোনো প্রাণীর ছায়া, কিন্তু যত কাছাকাছি এল, তা তার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেল। ছায়াটি মানুষের আকৃতির, তবে তার ভঙ্গি এবং উপস্থিতি অদ্ভুত—মানবসদৃশ হলেও, যেন অমরত্বের ছাপ রয়েছে। ছায়ার চোখ নেই, কিন্তু তার দৃষ্টিতে একটি অদ্ভুত তেজ এবং জ্ঞান ফুটে উঠছে। অর্পণের হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এটি কোনো সাধারণ প্রহরী নয়। নগরীর এই স্থানটি এমন শক্তি ধারণ করছে, যা শুধুমাত্র প্রাচীন তন্ত্রচর্চার ফল। ছায়াটি অর্পণের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, কিন্তু কোনো শব্দ ছিল না। প্রতিটি পদক্ষেপে অর্পণ অনুভব করছিল, যেন এই ছায়া তার মন এবং আত্মার গভীরে প্রবেশ করছে। সে স্থির হয়ে দাঁড়াল, তার মানচিত্র এবং ল্যাম্প হাতে ধরে, নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করল, তবে ভয়ের ছায়া তাকে পুরোপুরি কেবল রাখছিল।
অর্পণ যখন ছায়ার উপস্থিতি অনুভব করছিল, তখন সে বুঝতে পারল, নগরীর প্রাচীন তন্ত্রচর্চা শুধু পৌরাণিক কাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তব জগতেও এর প্রভাব রয়েছে। এই ছায়া, যা যেন মানবসদৃশ এবং অমর, তার সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে নগরীর প্রাচীন শক্তি প্রকাশ করছিল। প্রতিটি মুহূর্তে অর্পণের মধ্যে ভয়, বিস্ময় এবং গবেষণার উত্তেজনা মিলিত হয়ে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা তৈরি করছিল। সে নিজের শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে সতর্ক রাখছিল, প্রতিটি শব্দ এবং ছায়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। স্তূপের প্রতীক, জঙ্গলের অন্ধকার, এবং অদ্ভুত ছায়া মিলিত হয়ে তাকে একটি নতুন উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল—নগরীটি কেবল প্রাচীন মানুষদের আবাস নয়, এটি একটি জীবন্ত প্রভাবশালী শক্তির কেন্দ্র। অর্পণ বুঝতে পারল, এই শক্তি তাকে পরীক্ষা করছে, তাকে নগরীর রহস্যের এক গভীরতম স্তরে প্রবেশ করতে বলছে। সেই রাত, স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে, অর্পণ নিজেকে প্রস্তুত করল, জানিয়ে যে তার যাত্রা শুধু ভূগোলগত নয়, বরং মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং রহস্যময় অভিজ্ঞতারও হবে।
৫
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ি জঙ্গলের গভীর অন্ধকার অতিক্রম করে অবশেষে সেই মুহূর্তে পৌঁছাল যার জন্য সে বহু দিন অপেক্ষা করেছে—প্রাচীন, হারানো নগরীর প্রবেশদ্বার। বাইরে থেকে নগরীটি যেন এক নিস্তব্ধ কল্পনার মতো, ভেঙে পড়া প্রাচীন মন্দির, কাদামাটি এবং ঘাসে ঢেকে থাকা ধ্বংসাবশেষের ভিড়ে গঠিত। প্রবেশদ্বারের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি মূর্তির চোখ যেন জীবন্ত—যেন তারা অদৃশ্য চোখে অর্পণের উপস্থিতি পরীক্ষা করছে। এই মূর্তিগুলো প্রাচীন দেবদেবীর এবং অচেনা রাক্ষসাকারী চরিত্রের মিশ্রণ, যা অদ্ভুতভাবে মানবমনের ভয় এবং কৌতূহলকে একসাথে উসকে দেয়। অর্পণ তার মানচিত্র হাতে ধরে চিহ্নিত করে, বুঝতে চেষ্টা করল কোন পথ তাকে নগরীর ভিতরে প্রবেশের নিরাপদ এবং প্রাচীন সূত্রানুসারে সঠিক পথে নিয়ে যাবে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার শরীরের মধ্যে ভয় এবং উত্তেজনা একসাথে প্রবাহিত হচ্ছিল। চারপাশের অন্ধকার এবং ঘন বন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এই নগরী শুধুমাত্র ভূগোলগত সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্রাচীন শক্তি এবং রহস্যের এক কেন্দ্রীয় বিন্দু।
অর্পণ ধীরে ধীরে প্রবেশদ্বারের ভিতরে ঢুকল। তার পা মাটির ভাঙা কংক্রিট এবং ঘাসে ঠেকল, প্রতিটি শব্দ যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চিরন্তন নিস্তব্ধতায়। নগরীর ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে লক্ষ্য করল, চারপাশে একটি বিশাল চত্বর, যেখানে বাতাসে অদ্ভুত ঘ্রাণ এবং অজানা শব্দ ভেসে আসে। ঘ্রাণটি এক ধরনের পুরোনো ধুলোর, ধোঁয়ার এবং অদ্ভুত গাছের সুগন্ধের মিশ্রণ, যা অর্পণের মনকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয়ের মধ্যে ফেলে। চত্বরের চারপাশে আরও ভেঙে পড়া মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এবং অচেনা মূর্তি স্থানান্তরিত হয়ে স্থিতি নেয়, যেন এই স্থাপনাগুলো তার চারপাশের সময় এবং বাস্তবতার ধারণাকে বদলে দিচ্ছে। অর্পণ অনুভব করল, প্রতিটি মূর্তির চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে নগরীর প্রবেশদ্বার এবং ভিতরের শক্তির উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে। প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ, প্রতিটি চিহ্ন, এবং প্রতিটি ছায়া তাকে একটি অদ্ভুত সংকেত দিচ্ছিল যে, এখানে প্রবেশ করা সহজ নয়—এটি প্রাচীন তন্ত্রচর্চার কেন্দ্র, যেখানে সময়, স্থান এবং শক্তি একসাথে মিলিত।
চত্বরে প্রবেশের পর, অর্পণ তার মানচিত্র এবং ল্যাম্পের আলো দিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হঠাৎ, সে লক্ষ্য করল চত্বরের মাঝখানে একটি অদ্ভুত পাথরের প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা সম্ভবত প্রাচীন প্রার্থনা বা সভার জন্য ব্যবহৃত হত। প্ল্যাটফর্মের চারপাশে মূর্তি এবং অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা আছে, যা বাতাসে ভেসে আসা অজানা শব্দের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। প্রতিটি শব্দ যেন অর্পণের মন এবং শরীরের মধ্যে প্রবেশ করছে, তাকে সতর্ক করছে, বা হয়তো পরীক্ষা করছে। সে বুঝতে পারল, এই নগরী কেবল অজানা ধ্বংসাবশেষ নয়; এটি জীবন্ত এক অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দৃষ্টি এবং প্রতিটি শ্বাস তার উপর প্রাচীন শক্তির প্রভাব ফেলছে। অর্পণ গভীর নিশ্বাস নিল এবং ধীরে ধীরে সেই চত্বরের মধ্যে এগোতে শুরু করল, জানিয়ে যে তার যাত্রা শুধু হারানো নগরীর খোঁজ নয়, বরং প্রাচীন তন্ত্রচর্চা, অদ্ভুত শক্তি এবং মানববোধের এক নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি। এই রাত, চত্বরের অদ্ভুত ঘ্রাণ এবং অজানা শব্দের মধ্যে, অর্পণ তার জীবনের সবচেয়ে গভীর রহস্যের প্রান্তে পৌঁছেছে—যেখানে ইতিহাস, ভূগোল এবং অতিপ্রাকৃত একসাথে মিলিত হয়ে তাকে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে যাচ্ছে।
৬
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় নগরীর চত্বরের মধ্য দিয়ে এগোতে চলল, তার ধীরে ধীরে ঘ্রাণময় বাতাস, অজানা শব্দ এবং ছায়ার ছোঁয়ায় মনোযোগ স্থির হয়ে গেল। চত্বরের শেষ প্রান্তে সে হঠাৎ লক্ষ্য করল একটি প্রাচীন, ভেঙে পড়া গম্বুজাকৃতির ভবন, যা অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অদ্ভুত নকশা, খোদাই করা প্রতীক এবং মূর্তিগুলি ভবনের দিকে তাকাতে দেখাচ্ছিল, যেন এটি নগরীর সবচেয়ে গোপন ও শক্তিশালী কেন্দ্র। অর্পণ বুঝতে পারল, এখানেই লুকানো আছে নগরীর সমস্ত রহস্য। ধীরে ধীরে সে ভিতরে প্রবেশ করল। ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে দেখতে পেল, একটি বিশাল গ্রন্থাগার, যেখানে প্রাচীন খাতার পৃষ্ঠাগুলোতে এমন মন্ত্র ও লেখা আছে, যা কখনো সাধারণ মানুষের জন্য প্রকাশ করা হয়নি। বাতাস ভারী এবং স্থির, বইয়ের ধুলো আর মোমবাতির নরম আলো একটি রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করছিল। অর্পণ তার হাতের ল্যাম্প দিয়ে প্রতিটি তাক পরীক্ষা করল, প্রতিটি খাতা খুলে দেখল, এবং ধীরে ধীরে সেই নিষিদ্ধ মন্ত্রগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করল।
প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি লেখা অর্পণের মনে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করছিল। সে বুঝতে পারল, এই শক্তি সাধারণভাবে মানুষ ব্যবহার করতে পারে না; এটি শুধুমাত্র অধ্যবসায়ী, অভিজ্ঞ এবং প্রাচীন তন্ত্রচর্চায় দক্ষ ব্যক্তিদের জন্য তৈরি। খাতাগুলোতে লেখা প্রায় প্রতিটি নির্দেশনা, প্রতিটি প্রতীক, এবং প্রতিটি শব্দ তার মনকে পরীক্ষা করছিল। অর্পণ গভীরভাবে পড়তে পড়তে অনুভব করল, যে প্রতিটি মন্ত্র কেবল শক্তি প্রদর্শন নয়, বরং এটি একটি ধৈর্য, মনোযোগ এবং আধ্যাত্মিক সতর্কতার পরীক্ষা। ধীরে ধীরে সে বোঝার চেষ্টা করল, এই নগরীতে প্রবেশ করা এবং এই গ্রন্থাগারটি পড়া মানেই হলো ইতিহাস এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ। সে অনিন্দ্যশীল মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি পৃষ্ঠা পরীক্ষা করছিল, প্রতিটি শব্দের মানে খুঁজছিল, এবং প্রতিটি প্রতীককে তার মানচিত্র ও আগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিল।
হঠাৎ অর্পণ অনুভব করল যে কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে। প্রথমে সে ভাবল এটি কেবল তার মানসিক উত্তেজনার ফল, কিন্তু চোখের কোণে ধূসর ছায়া দ্রুত ঘুরে যাওয়ায় তার ধারণা বদলে গেল। ছায়া ছিল অদ্ভুতভাবে মানবসদৃশ, তবে তার উপস্থিতি যেন কোনো সাধারণ প্রাণীর নয়। অর্পণ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার দৃষ্টি বারবার সেই অদৃশ্য ব্যক্তির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছিল। মনে হলো, নগরীর প্রতিটি শক্তি এবং প্রতিটি মন্ত্র তার উপস্থিতি অনুভব করছে, এবং কেউ বা কিছু তাকে পরীক্ষা করছে। তার শরীরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয়ের মিশ্রণ প্রবাহিত হলো, যা তাকে সতর্ক করছিল। অর্পণ ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করল, গ্রন্থাগারের প্রতিটি কোণ পরীক্ষা করল এবং ছায়ার উৎস খুঁজতে চেষ্টা করল। সে বুঝতে পারল, এই গ্রন্থাগার কেবল একটি স্থান নয়; এটি নগরীর হারানো শক্তির হৃদয়, যেখানে অধ্যবসায়, জ্ঞান এবং সাহস একত্রিত হয়ে মানুষের সক্ষমতা পরীক্ষা করে। এই মুহূর্তে, অর্পণ উপলব্ধি করল, তার যাত্রা এখন শুধু গবেষণা নয়—এটি একটি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পরীক্ষা, যেখানে তাকে তার সব ধৈর্য, জ্ঞান এবং সাহস প্রদর্শন করতে হবে, কারণ নগরীর প্রতিটি কোণ, প্রতিটি মন্ত্র এবং অদৃশ্য ছায়া তার প্রতি অখণ্ড নজর রাখছে।
৭
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রন্থাগারের অন্ধকার কোণে বসে নিষিদ্ধ মন্ত্রের পাঠ শুরু করল। ধীরে ধীরে সে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করল, প্রতিটি লিপি ও প্রতীক অনুসরণ করে তার মনকে পুরোপুরি স্থির রাখার চেষ্টা করল। প্রথম কিছু মুহূর্তে সবকিছু শান্ত মনে হচ্ছিল, শুধু কেবল ধুলো আর মোমবাতির আলোর নরম ঝলক তার চারপাশে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করল। গ্রন্থাগারের প্রতিটি মূর্তির চোখ যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল; তাদের পাথরের ভঙ্গি, নাক এবং ঠোঁটের রেখা অল্প অল্প নড়তে লাগল। বাতাস হঠাৎ ঘন হয়ে ওঠল, আর প্রতিটি শ্বাসে অর্পণ অনুভব করল অদ্ভুত কম্পন। ধুলোয়ের কণাগুলো বাতাসে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু আলোয় ছায়ার নাচ শুরু করল। অর্পণ বুঝতে পারল, যে শক্তি সে সংস্পর্শে এসেছে, তা তার কল্পনার বাইরে—একটি বাস্তব, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি।
প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হয়ে উঠল। মূর্তিগুলি যেন কেবল চোখ খোলেনি, বরং তাদের পাথরের শরীরও অদ্ভুতভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাতাসে হালকা কেঁপে ওঠার শব্দ—যা প্রথমে সে বাদ দিয়েছিল, তা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠল। প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে অর্পণ অনুভব করল যে, এই শক্তি তার চারপাশে ঘিরে ধরে, তাকে পরীক্ষা করছে। ধূসর ছায়া স্থানান্তরিত হতে লাগল, আর প্রতিটি প্রতীক যেন আলো দিয়ে কথা বলছে। অর্পণের দৃষ্টি তার হাতে থাকা খাতার প্রতিটি প্রতীক এবং শব্দে স্থির থাকল। সে বুঝতে পারল, এই নগরীর শক্তি কেবল প্রাচীন মানুষ বা অভিজ্ঞ তান্ত্রিকদের জন্য সীমিত নয়; বরং এটি একটি জীবন্ত, সচেতন শক্তি, যা নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অর্পণের হৃদয়ে ভয় জন্ম নিল, কিন্তু গবেষক মন তাকে হুঁশিয়ার করল যে, এখানেই তার সত্যের সন্ধান লুকানো।
অর্পণ যতক্ষণ মন্ত্রের পাঠ চালিয়ে গেল, ভয় আরও তীব্র হয়ে উঠল। বাতাসের কেঁপে ওঠা, মূর্তির অদ্ভুত নড়াচড়া, এবং অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি এক অদ্ভুত মিল তৈরি করল। সে বুঝতে পারল, এই নগরী কেবল অমরত্বের ছায়া বা ইতিহাসের অংশ নয়; এটি একটি অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কেন্দ্রীয় কেন্দ্র, যা নিজেই বাঁচতে এবং পরীক্ষা নিতে সক্ষম। অর্পণ আতঙ্কিত হলেও থামল না; তার ভিতরে এক ধরণের কৌতূহল এবং দমবন্ধ করা উত্তেজনা প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রতিটি উচ্চারিত শব্দের সঙ্গে তার শরীর কেঁপে উঠছিল, কিন্তু তার মন বলছিল, “এটাই সত্যের পথে তুমি প্রবেশ করেছ।” অর্পণ নিজের সমস্ত সাহস ও মনোযোগ একত্রিত করে মন্ত্রের পাঠ চালিয়ে গেল। চারপাশের অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া—মূর্তিগুলোর জীবন, বাতাসের কেঁপে ওঠা, অদৃশ্য শক্তির অনুভূতি—সব মিলিয়ে তাকে এই নগরীর রহস্য এবং শক্তির প্রকৃত গভীরে নিয়ে গেল, যেখানে শুধু জ্ঞান নয়, বরং সাহস এবং আত্মার দৃঢ়তা পরীক্ষা হচ্ছিল।
৮
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রন্থাগারের গভীরে যখন এগোচ্ছিল, তখন হঠাৎ এক অদৃশ্য শক্তি তার পথকে বাধা দিতে শুরু করল। প্রথমে সে বুঝতে পারল না, বাতাস কি হঠাৎ ঘন হয়ে এসেছে, নাকি কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তার চারপাশে ঘেরা। মৃদু কম্পন তার পায়ের তলা দিয়ে উঠে আসছিল, আর প্রতিটি ধুলোর কণার সঙ্গে বাতাস যেন কথা বলছিল। হঠাৎ, অর্পণ লক্ষ্য করল, অন্ধকারের কোণে অদ্ভুত ছায়ামূর্তি আবির্ভূত হয়েছে। প্রথমে সে কেবল ছায়ার খেলা মনে করল, কিন্তু ধীরে ধীরে এগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল—মানবসদৃশ, অমরত্বের ছাপ যুক্ত, চোখের অভিব্যক্তি ভয়ঙ্কর, যেন তারা তার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ছায়াগুলি ক্রমশ ঘন হয়ে এক ঘন অদ্ভুত ধোঁয়ার মতো হয়ে উঠল, যা অর্পণের মনকে আতঙ্কিত করছিল। সে বুঝতে পারল, এটি নগরীর সেই প্রাচীন শক্তি, যা কেবল তান্ত্রিকদের জন্য নয়; বরং যারা সাহস করে এখানে প্রবেশ করে, তাদেরকে পরীক্ষা করে এবং প্রায়শই পথচ্যুত করে।
প্রতিটি পদক্ষেপে অর্পণ আরও ভয়ানক দৃশ্যের মুখোমুখি হল। ঘরের দেওয়াল এবং মেঝেতে অচেনা তন্ত্রচর্চার প্রতীক উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন একটি অদ্ভুত আলো তাদের মাধ্যমে বাতাসে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিটি চিহ্ন যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, এবং অর্পণের মনকে পরীক্ষা করছে। সে বুঝতে পারল, যারা এই নগরীতে প্রবেশ করেছে, তারা কখনো বের হতে পারেনি—তাদের গল্প শুধু কল্পনা নয়, বাস্তবের অন্ধকারে ভেসে আসা সতর্কতা। অর্পণের হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে গেল, ঘাম ঝরে পড়তে শুরু করল। সে বারবার তার মানচিত্র দেখে পথ খুঁজতে চাইল, কিন্তু প্রতিটি চিহ্ন যেন তার মনকে বিভ্রান্ত করছে। চারপাশের অদ্ভুত শব্দ, হাওয়ার সঙ্গে মিলিত ধ্বনির কম্পন, এবং ছায়াগুলোর অদ্ভুত নড়াচড়া—সব মিলিয়ে অর্পণের জন্য এক ধরনের অতিপ্রাকৃত হুমকির অনুভূতি তৈরি করল।
ভয়, আতঙ্ক এবং উত্তেজনার মধ্য দিয়ে অর্পণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করল। সে জানত, শুধুমাত্র সাহস এবং সতর্ক মনোযোগের মাধ্যমে এই নগরী থেকে বের হওয়া সম্ভব। প্রতিটি অদ্ভুত প্রতীক, প্রতিটি ছায়ামূর্তি এবং অদৃশ্য শক্তি তার জন্য এক পরীক্ষা। সে ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে এগোতে লাগল, নিজের শরীর এবং মনকে প্রস্তুত করে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে যেন কোনো অজানা বিপদে পড়তে না হয়। তার দৃষ্টি প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি প্রতীক পর্যবেক্ষণ করছিল। অর্পণ উপলব্ধি করল, নগরীর শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এবং এই একমাত্র নিরাপদ পথ হলো তার মনকে স্থির রেখে, অতিপ্রাকৃত হুমকির মধ্য দিয়ে ধৈর্য ও জ্ঞান নিয়ে এগিয়ে চলা। প্রতিটি মুহূর্তে সে জানছিল, এই যাত্রা শুধু হারানো নগরীর রহস্য উন্মোচন নয়, বরং তার জীবন এবং আত্মার ওপর এক বড় পরীক্ষা, যেখানে তাকে কেবল সাহস, বুদ্ধি এবং স্থিরতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
৯
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় ধীরে ধীরে নগরীর ভেতরের প্রাচীন স্থাপনাগুলি পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। প্রতিটি ভেঙে পড়া মন্দির, প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ, এবং প্রতিটি মূর্তির খোদাই তাকে এক সময়ের ইতিহাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তার চোখে ধুলো আর ছায়ার খেলায় ধরা পড়ল বিভিন্ন প্রতীক, যেগুলো নগরীর প্রাচীন তান্ত্রিক সমাজের শক্তি ও বিশ্বাসের পরিচায়ক। মানচিত্র এবং খাতার সাহায্যে অর্পণ বুঝতে পারল, এই নগরী এক সময় বিশাল তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের কেন্দ্র ছিল, যেখানে মানুষের আত্মা, প্রাকৃতিক শক্তি, এবং অতিপ্রাকৃত শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য গভীর চর্চা হত। প্রতিটি স্থাপনার নকশা, প্রতিটি মূর্তির অবস্থান, এমনকি বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত ঘ্রাণও—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ধারাবাহিকতা তৈরি করছিল, যা প্রাচীন তন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ও সীমারেখা তুলে ধরছিল। অর্পণ বুঝতে পারল, এই নগরী শুধুমাত্র স্থাপত্য বা ভৌগোলিক রূপে নয়, বরং এক জীবন্ত শক্তির কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।
অর্পণের অনুসন্ধান যত গভীর হচ্ছিল, তত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, তান্ত্রিকরা এখানে মানুষের আত্মা এবং অদ্ভুত শক্তি নিয়ন্ত্রণ করত। প্রতিটি চিহ্ন, প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি অদ্ভুত প্রতীক তার সামনে এক এক করে খুলে যাচ্ছিল। অর্পণ বুঝতে পারল, যে শক্তি আজও নগরীতে বিরাজমান, তা কেবল অতীতের গল্প নয়—এটি এখনো সক্রিয় এবং সচেতন। চারপাশের বাতাসে অদ্ভুত কেঁপে ওঠার অনুভূতি, ছায়ামূর্তির অদ্ভুত দৃষ্টিপাত, এবং হঠাৎ ভেসে আসা অজানা শব্দ সব মিলিয়ে তাকে স্মরণ করাচ্ছিল যে, নগরীর শক্তি তার উপস্থিতি উপলব্ধি করছে। সে লক্ষ্য করল, শুধু জ্ঞান বা কৌতূহলই এখানে যথেষ্ট নয়; স্থির মন, গভীর ধৈর্য, এবং শান্ত আত্মার প্রয়োজন। নগরীর ইতিহাস বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ তৈরি হলো—ভয়, বিস্ময়, এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক উত্তেজনা, যা তাকে সতর্ক করছিল এবং একই সঙ্গে এগিয়ে চলার জন্য প্রলুব্ধ করছিল।
অর্পণ অবশেষে উপলব্ধি করল, এই নগরীতে বেঁচে থাকার একমাত্র পথ হলো কেবল তর্ক, জ্ঞান এবং স্থিরতার মাধ্যমে। আতঙ্কিত হলেও সে জানল, কোনো ত্বরিত পদক্ষেপ বা অজ্ঞান আচরণ তাকে বিপদে ফেলতে পারে। সে ধীরে ধীরে প্রতিটি প্রতীক, প্রতিটি মন্ত্র এবং প্রতিটি স্থাপনার অর্থ বিশ্লেষণ করল, এবং নিজেকে প্রস্তুত করল নগরীর শক্তির সঙ্গে মেলানোর জন্য। অর্পণ বুঝতে পারল, এই শহর কেবল অতীতের ইতিহাস নয়, বরং এক জীবন্ত পরীক্ষা, যেখানে সাহস, বুদ্ধি এবং মননশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিঃশ্বাস, এবং প্রতিটি পর্যবেক্ষণ তাকে নগরীর রহস্যের আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল। এই অভিজ্ঞতা তাকে জানিয়ে দিল যে, নগরী কেবল প্রাচীন তন্ত্রের কেন্দ্রই নয়, বরং জীবন্ত শক্তি এবং প্রজ্ঞার এক অদ্ভুত সমাহার, যেখানে শুধুমাত্র সচেতন মন এবং জ্ঞানী বুদ্ধি দিয়ে একজনই বেঁচে থাকতে পারে।
১০
অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ রাত এবং দিনের অভিজ্ঞতার পর অবশেষে নগরীর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসল। পাহাড়ি ট্রেইল, ঘন বন, এবং অজানা নদীর পেরিয়ে সে যখন গ্রামের সীমানায় পৌঁছাল, তখন তার শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন ছিল গভীরভাবে প্রভাবিত। নগরীর প্রতিটি মুহূর্ত—প্রবেশদ্বারের ভাঙা মূর্তি, চত্বরের অদ্ভুত ঘ্রাণ, গ্রন্থাগারের নিষিদ্ধ মন্ত্র, এবং ছায়ামূর্তির উপস্থিতি—সবই তার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রইল। সে বুঝতে পারল, এই নগরী কেবল হারানো স্থাপনা নয়; এটি একটি জীবন্ত শক্তির কেন্দ্র, যা মানুষের কৌতূহল, সাহস এবং জ্ঞানের সীমা পরীক্ষা করে। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিঃশ্বাস, এবং প্রতিটি পর্যবেক্ষণ তাকে শিক্ষা দিল যে, কিছু জ্ঞান শুধু পর্যবেক্ষণ এবং আধ্যাত্মিক সতর্কতার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য, প্রকাশের জন্য নয়। নগরীর অদ্ভুত শক্তি, অতিপ্রাকৃত ছায়া এবং প্রাচীন তন্ত্রচর্চার প্রভাব তার মনের গভীরে এক চিরস্থায়ী ছাপ ফেলল, যা তাকে জানিয়ে দিল, সত্য এবং শক্তি কখনোই সহজলভ্য নয়।
গ্রামে ফিরে এসে অর্পণ তার অভিজ্ঞতা গ্রামবাসীদের সাথে শেয়ার করল, বিশেষ করে সেই সতর্কতা নিয়ে যে কেউ এই নগরীতে প্রবেশ না করে। সে বোঝাতে চেষ্টা করল, এই স্থানের রহস্য শুধুমাত্র গবেষকের কৌতূহল নয়, বরং বিপদও বহন করে। গ্রামের বৃদ্ধরা, যারা একসময় নগরীর নাম শুনে ভয় পেত, এবার তার কথা শুনে আরও সতর্ক হল। অর্পণ জানত, এই নগরী শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, বরং এটি এখনও জীবন্ত এবং সচেতন। যদি কেউ অজ্ঞান বা অনভিজ্ঞভাবে প্রবেশ করে, তাদের ওপর নগরীর শক্তি প্রচন্ড প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিল যে, তার অভিজ্ঞতার প্রতিটি শিক্ষা গ্রামবাসীদের জন্য সতর্কতার বার্তা হয়ে থাকবে, কিন্তু কোনো মন্ত্র বা শক্তির ব্যবহার কখনোই প্রকাশ পাবে না। তার উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র জ্ঞান এবং সতর্কতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, যাতে কেউ অযাচিত বিপদে না পড়ে।
অর্পণ সমস্ত অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে লিখে রাখল, প্রতিটি পর্যবেক্ষণ, প্রতিটি প্রতীক, প্রতিটি শব্দ—সবকিছু যেন একটি নিখুঁত রেকর্ড হয়ে থাকে। তবে সে কখনোই কোনো মন্ত্রের সরাসরি ব্যবহার বা প্রকাশ করল না। সে বুঝতে পারল, প্রকৃত গবেষণার সেরা ফলাফল হলো শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং সেই তথ্যের সঙ্গে সতর্কতা এবং নৈতিকতার ভারসাম্য বজায় রাখা। নগরীর অভিজ্ঞতা তাকে শিক্ষা দিল যে, সত্য, শক্তি এবং জ্ঞান—এই তিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই সবচেয়ে মূল্যবান। পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে, অর্পণ অনুভব করল যে, তার জীবনে এই অভিজ্ঞতা চিরকাল ছাপ ফেলবে। নগরীর অদ্ভুত শক্তি, অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি এবং প্রাচীন তন্ত্রচর্চার শিক্ষা শুধু তার গবেষণার অংশ নয়, বরং তার মনোভাব, সতর্কতা এবং জ্ঞানের সঙ্গে চলার দিকনির্দেশক হয়ে উঠল। এই অভিজ্ঞতা তাকে জানিয়ে দিল, কখনো কোনো রহস্যের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ তাকে বিপদে ফেলে দিতে পারে; কেবলমাত্র ধৈর্য, জ্ঞান এবং সতর্কতার সমন্বয়েই মানুষ সত্যিকারভাবে বেঁচে থাকতে পারে।
শেষ